#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৭
সবার মধ্যিমনি আরাবী।মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে মিলি বেগমের পাশে।রুমে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে করতেই লজ্জায় চুপসে আছে মেয়েটা।কিভাবে পারলো ও ওইভাবে জায়ানের বুকে মাথা রাখতে?ইশ,এখন যেন লজ্জায় ম’রে যাচ্ছে মেয়েটা। এদিকে সবাই কথাবার্তা বলছে।ফাহিম আরাবীর কাছে এসে আস্তে করে ডেকে উঠল,
‘ আরু?একটু এদিকে আয়।’
আরাবী মাথা দুলিয়ে ভাইয়ের সাথে চলল।ফাহিমের সাথে ফাহিমের রুমে আসল আরাবী।ফাহিম দরজাটা আলতো করে লাগিয়ে দিয়ে।আরাবীর দিকে ফিরল।আরাবী মাথায় হাত রেখে কোমল সুরে বলে,
‘ এইবার তোর সিদ্ধান্তটা কি আরু?আমাকে জানা।তুই যা বলবি তাই হবে।’
আরাবী চুপ করে রইলো।ভীষণ লজ্জা করছে ওর।এভাবে বড়ো ভাইকে কিভাবে বলবে যে এই বিয়েতে ওর কোনো আপত্তি নেই।ও যেমন ঠিক তেমনভাবেই ওকে ভালোবাসে এমন মানুষটাকে ও পেয়ে গিয়েছে। ঠিক যেমন ওর মা বলেছে।আরাবী চুপ থাকতে দেখে ফাহিম বলল,
‘ তোর কি এই বিয়েতে মত নেই?তাহলে আমি ওদের মানা করে আসি।’
আরাবী এমন একটা কথা ভড়কে গেলো।চট করে বলে ফেলল,
‘ নাহ ভাইয়া,আমি কখন বললাম আমার মত নেই?’
ফাহিম মুঁচকি হাসল।বলল,
‘ তবে কি আমি হ্যা ধরে নিবো?’
আরাবী লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো।ফাহিম হেসে ফেলল।আরাবী মুখ ফুলিয়ে নিলো।বলল,
‘ উফ! ভাইয়া ভালো লাগছে না কিন্তু।হাসছ কেন?’
ফাহিম বহু কষ্টে হাসি থামালো।বোনের গালে আদুরে স্পর্শ করে বলে,
‘ তুই পৃথিবীর সবথেকে সুখী ব্যক্তি হবি ইনশাআল্লাহ!’
আরাবী আলতো হাসল।ফাহিম আরাবীর হাত ধরে বলে,
‘ চল।এখন তাদের জানিয়ে দেই আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
আরাবী ফাহিমের সাথে বেড়িয়ে এলো।ফাহিম সেখানে গিয়ে ওর বাবাকে সাথে চোখের ইশারায় জানালো আরাবীর কোনো আপত্তি নেই।জিহাদ সাহেব মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বললেন।তারপর নিহান সাহেবকে বললেন,
‘ ভাই সাহেব আমাদের কোনো আপত্তি নেই সম্বন্ধে।’
নিহান সাহেব বড়ো একটা হাসি দিলেন।যাক তার ছেলে ওর মনের মানুষটাকে অবশেষে পাচ্ছে।তিনি বলেন,
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভাই সাহেব।তাহলে এইবার দুজনের বাগদানটা এখনই করিয়ে রাখা যাক?’
জিহাদ সাহেব বাগদানের কথায় একটু নড়েচড়ে বসলেন।তাকালেন স্ত্রী আর সন্তানদের দিকে।লিপি বেগম আর ফাহিম ইশারায় জানালো কোনো সমস্যা নেই এতে।লিপি বেগম দ্রুত নিজেদের রুমে গিয়ে আলমারি থেকে স্বর্ণের আংটিটা বের করলেন।টুকাটুকি অনেকখানি গহনা আরাবীর জন্যে বানিয়ে রেখেছেন লিপি আর জিহাদ সাহেব।মেয়ের বিয়ের সময় যেন কোনো রকম কমতি না হয়।আরাবীর বিয়ের জন্যে টাকাও ব্যাংকে রাখা আছে।সেখানে কোনোপ্রকার হাত দেননা তারা।আজ অবশেষে এসব ব্যবহার করার সময় এসেছে।
_____
আরাবী আর জায়ানকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে।জায়ানের পাশে বসায় আরাবীর বুক কাঁপছে।অন্যরকম অনুভূতিতে হৃদয় দুলে উঠছে। এদিকে জায়ান হাত বাড়িয়ে দিলো আরাবীর দিকে।আরাবী কাঁপা কাঁপা দেহে হাতটা এগিয়ে দিলো।জায়ান খুব যত্নে সেই হাতটা আঁকড়ে ধরল।তারপর আরাবী অনামিকা আঙুলে আংটিটা পরিয়ে দিলো।তারপর নিজেই ওর হাতটা বাড়িয়ে দিলো আরাবীর দিকে। আরাবী আলতো স্পর্শে জায়ানকেও আংটিটা পড়িয়ে দিলো।সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।জায়ানের মুখটা হাসি হাসি হয়ে উঠল মুহূর্তেই।ধীর আওয়াজে সে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ আমাদের এক হওয়ার প্রথম ধাপ সম্পন্ন হলো আরাবী।’
আরাবী মুচঁকি হাসল।জায়ান আরাবীর হাতটা মুঠোয় আঁকড়ে ধরে আছে ছাড়ার কোনো নাম নেই।এদিকে আরাবী শক্ত হয়ে বসে আছে।করছে কি লোকটা?হাত ছাড়ছে না কেন ওর?এভাবে এতোগুলো মানুষের সামনে ওর হাত ধরে আছে।আরাবী থেমে থেমে বলে,
‘ শুনছেন?হাতটা ছাড়ুন নাহ।’
জায়ান আরেকটু চেপে বসল আরাবীর দিকে।আরাবীর যেন নিঃশ্বাস আটকে গেলো।এই লোকের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।নাহলে এমন করছে কেন?জায়ান আলতো স্বরে বলে,
‘ ছাড়তে ইচ্ছে করছে না সুইটহার্ট।’
‘ কিসব বলছেন?’
‘ কি বললাম?’
‘ কিছু না।’
আরাবী এই পর্যায়ে হাত মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিলো।না চাইতেও জায়ানের হাতটা ছেড়ে দিতে হলো।নাহলে এই মেয়ে দেখা যাবে হাতটা ভেঙে ফেলবে।আরাবী যেন এতোক্ষণে শান্তি পেলো।
এদিকে সবাই আলোচনা করছে আরাবীদের বিয়ের ডেট কবে দেওয়া যায়।জায়ান ফটাফট মোবাইলে মেসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করল,
‘ আগামী মাসের এক তারিখে বিয়ের ডেট ফিক্স করো।’
তারপর মেসেজটা সেন্ড করে দিলো নিহান সাহেবের কাছে।কথা বলার মাঝে মোবাইল ফোন ভাইব্রেট হওয়ায় তা অন করে দেখল জায়ান মেসেজ করেছে।মেসেজটা পড়েই নিহান সাহেব কতোক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো।নিশ্চিত এই ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।নাহলে আগামী মাস আসতে আর মাত্র ছয় দিন বাকি।এই ছয় দিনে কি করবে তারা?সবার আড়ালে চোখ রাঙালেন নিহান সাহেব ছেলেকে।জায়ান ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে বসে আছেন।নিহান সাহেব ছেলের এই মুডকে ওতো পাত্তা দিলেন না। তিনি বললেন,
‘ আমরা আগামী মাসের পনেরো তারিখে জায়ান আর আরাবী মায়ের বিয়েটা সম্পন্ন করতে চাইছি।আপনারা কি বলেন ভাই সাহেব? আপনাদের কোনো আপত্তি আছে?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভাই সাহেব আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
‘ আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে আমরা প্রিপারেশন শুরু করে দেই?কি বলেন?’
‘ হ্যা হ্যা।’
লিপি বেগম দ্রুত রসগোল্লা এনে সবাইকে মিষ্টিমুখ করালেন।
এদিকে জায়ান দাঁতে দাঁত চিপে বসে আছে।ওর বাবা ওর মেজাজটাই খারাপ করে দিয়েছে।আগামী মাসের পনেরো তারিখ।এতোদিন সে অপেক্ষা করবে কিভাবে?নিজের পাশে বসা আরাবীকে দেখে জায়ান বিরবির করল,
‘ এই এতো কিউট মেয়েটাকে নাকি নিজের করে পাওয়ার জন্যে আরও বিশদিন আমায় অপেক্ষা করতে হবে।আহ,একে তো এখনই বুকের মাঝে লুকিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
জায়ান আবারও ওর বাবাকে মেসেজ করল,
‘ হোয়াট হ্যেভ ইয়্যু ডান বাবা?হোয়াট ডিড আই টেল ইয়্যু?এন্ড হোয়াট ডিড ইয়্যু ডু?’
নিহান সাহেব মেসেজটা পরে আর কোনো জবাবই দিলেন না। জায়ানকে দেখেও না দেখার ভাণ ধরে বসে থাকলেন তিনি।জায়ান বাবার এই ব্যবহারে শক্ত মুখে বসে রইলো।
কথাবার্তা শেষে এইবার খাওয়া দাওয়ার পালা চলল।জায়ানদের জন্যে হরেকরকম রান্না করছেন লিপি বেগম।খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সবাই অল্প সময়ের জন্যে বিশ্রাম নিতে বসলেন।এইতো এখনই চলে যাবেন তারা।তাই জায়ান আর আরাবীকে একান্তে আরেকটু সময় কাটানোর জন্যে আরাবীর রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তাদের।
—-
আরাবী বিছানার এককোণে চুপচাপ বসে আছে আরাবী।শাড়ির আঁচল হাতের মাঝে নিয়ে প্যাঁচিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।
জায়ানও কিছু বলছে না।শুধু চুপচাপ বসে আরাবীকে দেখছে।জায়ানের এইভাবে তাকিয়ে থাকা সহ্য হচ্ছে আরাবীর।সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা নিজেই বলে উঠল,
‘ এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
‘ একটা চুমু খাবো তোমায়।কিন্তু কোথায় খাবো ভেবে পাচ্ছি না।কপালে?গালে? নাকি ঠোটে?’
জায়ানের এমন কথায় সর্বাঙ্গ শিরশির করে উঠল।শিহরণ বয়ে গেলো দেহ জুড়ে।হতভম্ব চোখে তাকালো মেয়েটা।জায়ান দুষ্টু হেসে বলল,
‘ কি? ডিসাইড করো তো কোথায় আমার প্রথম চুমুটা দিবো?ওহ সরি প্রথম না এটা আমার দ্বিতীয় চুমু। ‘
চমকে উঠল আরাবী।দ্বিতীয় চুমু মানে?লোকটা কি আগেও কাউকে চুমু খেয়েছে?হ্যা,এটাই হবে?নাহলে দ্বিতীয় চুমু কেন বলবে লোকটা?আরাবীর বুক ভাড় হয়ে আসল খারাপ লাগায়।মুখটা একটুখানি করে বসে রইলো।
জায়ান বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পারল।ও উঠে গিয়ে আরাবীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।আরাবী বাহু দুটি আঁকড়ে ধরে ওর মুখোমুখি দাঁড় করালো।আরাবী মাথা নিচু করে আছে।জায়ান আরাবী চিবুক স্পর্শ করে আরাবীর মুখটা উঁচু করল।ঘাড় কাত করে তাকায়া জায়ান।আরাবী ঠোঁটজোড়ার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে বলে,
‘ মন খারাপ কেন?’
আরাবী ভড়কে যায়।জায়ানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘ কোথায়? ‘
‘ এইযে আমি যখন বললাম এটা আমার প্রথম চুমু না।এটা শুনেই তোমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছে।’
‘ এমন কিছু না।’
‘ তো কেমন কিছু?’
আরাবী চুপ করে রইলো।জায়ান মুচঁকি হেসে আরাবী কাছে এগিয়ে এলো।আরাবীর হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে মুঠোবন্ধি করল।তারপর তা ওর ঠোঁটের কাছে এনে।প্রথমবার আরাবীর সজ্ঞানে আরাবীর হাতের উল্টোপিঠে গভীরভাবে ঠোঁটের আবেশ দিলো জায়ান।জংকার দিয়ে কেঁপে উঠল আরাবীর শরীর।হৃদস্পন্দন বেরে গেলো দ্রুতগতিতে।হৃদপিণ্ডটা এতো জোড়ে লাফাচ্ছে। যেন এখনই তা বুক চিরে বেড়িয়ে আসবে।থরথর করে কাঁপছে শরীর।জায়ান চুমু খেয়ে সরে আসল।এইবার মুখটা আরাবীর কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,
‘ আমার একটাই ব্যক্তিগত কাঠগোলাপ ফুল আছে।যাকে আমার হৃদয়ে আধিপত্য করার অনুমতি দিয়েছি আমি।যাকে ভালোবেসেছি আমি।যাকে প্রথমবার ভালোবাসাময় স্পর্শও করেছি আমি।তুমি তো জানো না মেয়ে আমি তোমায় ঠিক কতোটা ভালোবাসি।একটা কথা বলি শুনে রাখো।তুমি আমার, শুধুমাত্র আমার।’
একটু থামে জায়ান।তাকায় আরাবীর দিকে। মেয়েটা চোখ খিচে বন্ধ করে আছে। জায়ান আরাবীর চোখে মুখে হালকা ফু দিলো।আরাবীর চোখের পাপড়িগুলো কেঁপে উঠল।দুহাতে খামছে ধরল শাড়ি।এমন করছে কেন লোকটা?ও যে লোকটার এহেন কান্ডে দম আ’টকে মারা যাবে।তা কি লোকটা বুঝে না?’
জায়ান আরাবীর হাতটা ধরে উচু করল।আরাবী টের পাচ্ছে জায়ান ওর হাতের কব্জিতে কিছু একটা পরাচ্ছে।খুব কোমল কিছুর স্পর্শ অনুভব করছে আরাবী।তবুও চোখ খুলল না।এদিকে জায়ান নিজের কাজ শেষ করে আরাবীর হাত ছেড়ে দিলো।তারপর কোমল কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ তুমি কাঠগোলাপ হয়ে ফুটো রোজ আমার আঙ্গিনায় , আমি শিশির হয়ে জন্মাবো তোমার কল্পনায়..!’
কথাটা একেবারে হৃদয়ের গভীরে গিয়ে লাগল আরাবীর।এতোটা আবেগময় কথা কেউ কিভাবে বলতে পারে? আরাবী পিট পিট করে সামনে তাকালো।তাকাতেই আর জায়ানকে দেখতে পেলো না।বুঝল, লোকটা চলে গিয়েছে।আরাবী নিজের হাতের দিকে তাকালো।দেখল,ওর হাতের কব্জিতে একটা কাঠগোলাপ ফুলের তৈরি মালা। তবে কি লোকটা ওর হাতে এটাই পরাচ্ছিলো। কাঠগোলাপ ফুলগুলো আলতো হাতে স্পর্শ করল আরাবী।সাথে সাথে ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি ফুটে উঠল মেয়েটার।
#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।