#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্ব_০২
সকালবেলার নাস্তা করার জন্যে আরাবী,ফাহিম,জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগম একসাথে বসেছেন।জিহাদ সাহেবের খাওয়া শেষ হতেই আরাবী তার মেডিসিনগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘ মেডিসিনগুলো খেয়ে নেও আব্বু!’
‘ মাত্র তো খাবার খেয়ে উঠলাম আম্মা।একটু পরে খাই।’
আরাবী শাষণ করার মতো করে বলে,
‘ তুমি সবসময় এমন করো আব্বু।এতো বাহানা করো কেন?চুপচাপ খেয়ে নেও।কোনো কথা শুনবো না আমি।’
জিহাদ সাহেব মুখ লটকিয়ে মেডিসিনগুলো খেয়ে নিলেন।তবে তা শুধু অভিনয়।তিনি প্রতিদিনই এমন করেন।আর আরাবী তাকে একটু শাষণ করে।যেটা তার ভীষণ ভালো লাগে।মনে হয় এইতো তার মা তাকে দুষ্টুমি করার জন্যে বকা দিচ্ছে।
ফাহিমের খাওয়া শেষ।এখন সে বেরোবে।আজ কোচিংয়ে টেস্ট নিবে কিছু শিক্ষার্থীদের।তাই এতো তারাহুরো করছে।খাওয়া শেষে হাত মুছতে মুছতে ফাহিম আরাবীকে ডেকে উঠল,
‘ আরু?’
আরাবী পানি পান করছিলো।ভাইয়ের ডাকে গ্লাসটা টেবিলে রেখে জবাব দিলো,
‘ হ্যা ভাইয়া।’
‘ আমি গতকাল নয়নের সাথে কথা বলেছি। ও আমাকে কয়েকটা কোম্পানি সাজেস্ট করেছে।তবে সবথেকে ভালো নাকি সাখাওয়াত ইন্ডাস্ট্রি। সেখানে ওর এক কাজিন জব করে।কাজের দিক দিয়ে একটু স্ট্রিক্ট।তবে কোম্পানির মালিক নাকি মেয়েদের সম্মানের দিক দিয়ে বিশেষ খেয়াল রাখেন। তোকে ওখানে ট্রায় করতে বলছে ও বেশি জোড় দিয়ে।যদি চাকরিটা হয়ে যায় ওখানে।নয়ন বলেছে ওর কাজিনকে বলে দিবে।তোর খেয়াল রাখার জন্যে।কি বলিস তুই?’
আরাবী মৃদ্যু হেসে বলে,
‘ আমি সবগুলোতেই ট্রায় করব। দেখি কোনটায় চাকরিটা পাই।যদি সাখাওয়াত ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরিটা হয়ে যায় তবে তো কোনো কথাই নেই।’
‘ যাক! তাহলে সিভি রেডি রাখিস।আগামীকালই আমরা কোম্পানিগুলোতে চাকরির এপ্লাই করতে যাবো।’
‘ আচ্ছা।’
বোনের সাথে আরেকটু টুকটাক কথা বলে কাজের জন্যে বেড়িয়ে গেলো ফাহিম।তবে মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ওর।কোচিং-এ যা পায় তা দিয়ে আর হচ্ছে না ওদের।নিজের ছোটো বোনটা কষ্ট করে কাজ করবে।এটা ভাবলেই কষ্ট লাগবে।তবে ওটা ওর স্বপ্ন।তাই তার পূরণ তো অবশ্যই হতে হবে।ও নিজেও চাইছে ভালো একটা জব করার।ইন্টারভিউ ও দিয়েছে।তবে চাকরি হয়নি।হয়নি মানে অনেক টাকা ঘুষ চায় কোম্পানিগুলো।তাই ফাহিম সিদ্ধান্ত নিয়েছে এইবার কোনো কলেজের শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিবে।ওর বন্ধু নয়নের সাথে কথা বলেছে ও।দুটো কলেজ আছে যেখানে ও চাকরি পেতে পারে।এইবার বাকিটা উপরওয়ালার হাতে। দেখা যাক কি হয়।
নানান চিন্তা করতে করতে ফাহিম কোচিং সেন্টারে এসে পৌছালো।ক্লাস শুরু হওয়ার এখনও পনেরো মিনিট বাকি।ভাবল একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। তাই ফাহিম অফিস রুমে চলে গেলো।নাহ,আর কেউ আসেনি।
—
তারাহুরো করে কোচিং-এ এসে পৌছালো নূর।পুরো নাম মেহজা নূর সাখাওয়াত।এইবার অনার্স প্রথম বর্ষে পরে সে।
আজ তার টেস্ট আছে। তাই তো তারাহুরো করছে।তবে এর থেকেও বড় কারন হলো তার একজনকে দেখতে হবে।সেই মানুষটাকে চোখের দেখা একবার না দেখলে যে ওর পুরো দিনটাই বিষাদ লাগে।যেই ভাবা সেই কাজ।নূর দ্রুত অফিসরুমের দিকে চলে গেলো।গিয়ে দেখল অফিস রুমের লাইট জ্বালানো।তার মানে লোকটা এখানেই আছে।নূর ধীরে ধীরে দরজার আড়াল হতে উঁকি মারল।তাকাতেই যেন ওর চোখে একরাশ মুগ্ধতা এসে ভড় করল।লোকটা এতো সুন্দর কেন?এইযে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখের উপর হাত রেখে আছে।কি সুন্দরই না লাগছে তাকে।গ্রে রঙের টি-শার্ট আর কালো ডেনিম প্যান্টে লোকটাকে মারাত্মক সুদর্শন লাগছে।
এইযে একটু পর পর ঢোক গিলার সময় অ্যাডামস অ্যাপলটা নড়ে উঠে। নূরের খুব করে মন চায় ওখানে একটা চুমু এঁকে দিতে।নিজের ভাবনাতে নিজেই লজ্জা পেলো নূর।নাহ, এখানে আর এক মিনিট দাঁড়ালে পাগল হয়ে যাবে ও।তাই দ্রুত অফিস রুম থেকে চলে আসল।ওদের জন্যে বরাদ্ধকৃত রুমটাতে গিয়ে।একটা বেঞ্চে বসে পরল।জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো নূর।কি করবে ও?কি করলে এই বেহায়া মনটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে?আর কতোকাল এই দহনে জ্বলে’পুড়ে ছাড়’খাড় হবে।কাউকে ভালোবাসা কি পাপ? হ্যা,পাপই তো।তার জন্যে ভালোবাসা পাপ।ওর যে কাউকে ভালোবাসার অধিকার নেই।তবুও কিভাবে যে এই লোকটাকে নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলল জানে না নূর।যখন ওদের নয়ন স্যার এসে লোকটাকে পরিচয় করাতে নিয়ে এসেছিলো।তখন এক দেখাতেই প্রেমে পরে গিয়েছিলো লোকটার।জানতে পেরেছিলো লোকটার নাম ফাহিম মৃধা।সেই থেকেই এই নামটা ওর মন আর মস্তিষ্কে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছে যে।তা মুছে ফেলার সাহস ওর নেই।কিন্তু এটা যে হবার নয়।
সে যে চাইলেও ফাহিমকে পাবে না।তার যে হাত পা আগে থেকেই বাঁধা। কথাগুলো যতোবার ভাবে নূরের কান্না পায়।ভীষণ রকম কান্না পায়।রুমে থাকলে একা একা কাঁদেও অনেক।এইযে এখনও চোখ ভড়ে আসতে চাইছে নূরের।তারপরেও নিজেকে সামলে নিলো।কিন্তু হায়! যেভাবে চোখের অশ্রুগুলোকে সামলালো।সেভাবে যদি এই মনটাকে আর অনুভূতিগুলোকে সামলাতে পারতো।
ক্লাসে সব স্টুডেন্টরা এসে পরেছে।নূর ঠিকঠাক হয়ে বসল।একটু পরেই ফাহিম আসল।হাতে তার প্রশ্ন।টেস্ট নিবে যে।নূর আঁড়চোখে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।পুরো ক্লাসে আর একবারও তাকালো না।কারন তাকালেই যে সর্বনাশ।
_____
দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেলো।মোট চারটা কোম্পানি সিলেক্ট করেছিলো ফাহিম।সেখানের তিনটাতে ইন্টারভিউ দিয়েছে আরাবী।আর আজ শেষ একটাতে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে আরাবী।এমনিতে গত ইন্টারভিউগুলোতে ফাহিমই নিয়ে গিয়েছিলো ওকে।কিন্তু আজ আর আসতে পারেনি।ফাহিমেরও নাকি কি জানি জরুরি কাজ পরে গিয়েছে।তাই আরাবীকে আজ একাই বের হতে হলো।কিন্তু এইযে রাস্তার জ্যাম এ যেন ছাড়ার নামই নিচ্ছে না।ফাহিমের কথা মতো দেঢ় ঘন্টা আগে বের হয়েছে আরাবী।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে।আরও আগে বের হতে হতো।যেই জ্যাম লেগেছে।আরাবী বিরক্ত হয়ে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালো।হেটে গেলেও আগানো যাবে।কিন্তু এভাবে এক জায়গায় বসে থাকলে কিছুই হবে না।ওদিকে ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে।আরাবী রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিলো।তারপর হাটা ধরল নিজের গন্তব্যের দিকে।গুগল ম্যাপে আরেকবার লোকেশনটা চ্যাক করে নিলো।নাহ,ঠিক পথেই যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হাটার পর জ্যাম ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলো আরাবী।যাক অবশেষে নিস্তার পেলো এই জ্যাম থেকে।এখন আবার একটা রিকশা বা সিএনজি ভাড়া করা লাগবে।কিন্তু না একটা রিকশা বা সিএনজিও খালি নেই।না পেয়ে আবারও হাটতে লাগল ও।
( এই গল্পের লেখিকা সাদিয়া জাহান উম্মি)
—
‘ ড্যাম ইট!আই হ্যেভ টু গো টু দ্যা অফিস আর্জেন্টলি। আর এই গাড়িটাকে এখনই নষ্ট হতে হলো।’ বিরক্ত হয়ে বলল জায়ান।পুরো নাম সাফওয়ান জায়ান সাখাওয়াত।সাখাওয়াত ইন্ডাস্ট্রির মালিক নিহান সাখাওয়াতের ছেলে।
এদিকে জায়ানের কথা শুনে ওর ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি থেকে বের হতে হতে বলে,
‘ জায়ান বাবা।তুমি চিন্তা কইরো না।বেশি কিছু হয় নাই।আমি এখনই ঠিক করে নিচ্ছি একটু অপেক্ষা করো।’
‘ ঠিক আছে।জলদি করুন চাচা। ‘
ড্রাইভার চাচা বেড়িয়ে যেতেই। জায়ান ফোন বের করে ওর বাবাকে বিষয়টা জানিয়ে দিলো।যে আসতে একটু দেরিও হতে পারে।তারা যেন ওর অপেক্ষা না করে।তারপর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।কিন্তু নাহ,এভাবে আর টিকা যাচ্ছে না।এসির বাতাসেও কেমন যেন হাশফাশ লাগছে জায়ানের।তাই গাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো।আজ বেশি একটা রোদের তাপ নেই।হালকা মেঘলা মেঘলা।ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশ। হয়তো বৃষ্টি হতে পারে।রাস্তার ওপরপ্রান্তে একটা শিশুপার্ক দেখতে পেলো।অসংখ্য বাচ্চারা খেলাধুলা করছে ওখানে।করবেই তো। আজ যে শনিবার।তাদের স্কুল বন্ধ।জায়ান ভাবল,গাড়িটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত ওই পার্কটাতে গিয়ে একটা গাছের ছায়ার নিচে বসা যাক।যেই ভাবা সেই কাজ।জায়ান ওপরপাশে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো।হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেলো। সেই সাথে মনে হলো ওর চোখে কোনো ময়লা গিয়েছে। জায়ান সাথে সাথে চোখে হাত দিয়ে দিল।তাকাতে পারছে না জায়ান।দ্রুত পকেট হতে রুমাল বের করল ও।হালকাভাবে চোখটা রুমাল দিয়ে আলতোভাবে পরিষ্কার করে নিলো।হ্যা,এখন ঠিক আছে।রাস্তায় ভালোভাবে তাকালো।দেখছে কোনো গাড়ি স্পীডে আসছে কি না।এভাবে তাকাতে নিয়ে হঠাৎ জায়ানের একটা জায়গায় চোখ আটকে গেলো।সাথে মনে হলো ওর হৃৎপিণ্ডটাও কেমন জোড়ে জোড়ে বিট করছে।জায়ান বুকের বা-পাশটায় হাত রাখল।কি অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে বুকের বা-পাশটায়।আশ্চর্য! চোখের পলকটাও তো ফেলতে পারছে না।এমন কেন হচ্ছে?আগে তো এমন হয়নি।আশেপাশে শতশত মেয়েদের দেখে ও।কিন্তু কোনো মেয়েকে দেখে তো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়নি।এই মেয়েটাকে তো এই প্রথমবার দেখল।তাহলে এইসব অনুভূতির মানে কি? নিজের এইসব অদ্ভূত কান্ডে নিজের উপরেই বিরক্ত হলো জায়ান।টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে আনলো চোখজোড়া।কিন্তু বেহায়া চোখজোড়া ওই শুভ্র জামা পরিহিত মেয়েটার দিকেই চলে যাচ্ছে।জায়ান সরে যেতে চাইলো।হঠাৎ খেয়াল করল কিছু একটা।রাস্তার ওপরপাশে হলো সেই শিশুপার্ক। আর তার পাশ দিয়েই হেটে যাচ্ছে মেয়েটা।শিশুপার্ক আর সাধারণ মানুষ চলাফেরা করার জন্যে যেই রাস্তা এর মধ্যে লোহার বেড়িবাঁধ দেওয়া।ঠিক সেই বেড়িবাঁধের সাথেই ঘেষেই একটা পেয়ারা গাছ।কিছু বাচ্চা সেই পেয়েরা গাছে ইটের টুকরো দিয়ে ঢিল ছুরছে।
আর মেয়েটা আরেকটু গেলেই তো ওই ইটের টুকরোগুলো মেয়েটার গায়ে এসে লাগতে পারে।জায়ানের মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল।ডেকে উঠল জোড়ে,
‘ এই মেয়ে?আর সামনে এগিয়ে যেও না।’
কিন্তু গাড়ির আওয়াজে কিছুই কানে শোনা যাচ্ছে না।জায়ান চরমরকম বিরক্ত হলো। মেয়েটাও কি কানা নাকি?চোখে দেখে না?একটু সুযোগ পেতেই জায়ান দ্রুত রাস্তার ওপারে দৌড় লাগালো।তারপর কোনো কিছু না ভেবেই হেঁচকা টানে মেয়েটাকে সরিয়ে দিলো। যার ফলে ওই ছুড়ে মারা ইটের টুকরোগুলোর একটা এসে লাগল জায়ানের কপালের ঠিক বা-পাশে।সাথে সাথে ব্যথায় নাক মুখ কুচকে নিলো জায়ান।আর ব্যথাযুক্ত স্থানটা হাত দিয়ে চেপে ধরল।
_______
ফাহিম ফোন দিয়েছিলো আরাবীকে।বোনের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার জন্যে।কিন্তু ফোনে কি যেন একটা সমস্যা হলো।ফোনটা বন্ধ হয়ে গেলো।এরপর কিছুতেই আর চালু হচ্ছে না।বার বার চেষ্টা করছে আরাবী।আর সাথে রাস্তায় এগিয়েও যাচ্ছে।নাহলে যে দেরি হয়ে যাবে।এদিকে একটা রিকশা বা সিএনজিও পাচ্ছে না।কি এক মুসিবতে এসে পরল সে।সে এদিকে মোবাইল নিয়ে দুশ্চিন্তায় মগ্ন। হঠাৎ মনে হলো কে যেন সজোড়ে তার হাত ধরে টান দিলো।ভয় পেয়ে আরাবী মৃদ্যু চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে নিলো।পর পর ব্যাপারটা কি হলো বুঝার জন্যে চোখ খুলতেই।অবাকের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো আরাবী।একটা লোক তার পাশে দাঁড়ানো।আর লোকটা হাত দিয়ে তার কপাল ধরে রেখেছে। সেই হাতের তেলোর নিচ দিয়েই লাল রঙের তরল মানে র’ক্ত গড়িয়ে পরছে।আর লোকটার চোখে মুখে স্পষ্ট বেদনার ছাপ।তবে কি লোকটা ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই আঘাত পেলো?কেন করল লোকটা এমন?কেন ওকে রক্ষা করল?
#চলবে_____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানবেন।আপনাদের সুন্দর সুন্দর মন্তব্যের আশায়।অন্তত একটা রিয়েক্ট দিয়ে যাবেন।তাহলে আমি লিখার উৎসাহ পাবো।