স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ২১

0
652

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২১
‘ আহানা আমার প্রেমিকা।এই কথা অফিসে কে ছড়িয়েছে?’ প্রচণ্ড রাগের সাথে চিৎকার করে কথাগুলো বলল জায়ান।অফিসে যেটুকু সময় ছিলো আরাবীর কারনে শান্ত থেকেছে জায়ান।কিন্তু অফিস থেকে ফিরা মাত্রই মনের মাঝে দমিয়ে রাখা রাগটা যেন এখন জোয়ালামুখীর মতো টগবগিয়ে উঠেছে।এদিকে অকস্মাৎ জায়ানের এহেন গর্জনে বাড়ির প্রতিটি মানুষ যেন চমকে উঠেছে।জায়ানের দিকে তাকাতেই পরক্ষণে ওর শক্ত চোয়াল আর লাল হয়ে যাওয়া চোখজোড়া দেখেই ভয়ে কুকড়ে উঠে।আরাবীর সাথে দেখা হওয়ার পর জায়ান অনেকটাই শান্ত হয়ে গিয়েছিলো।রাগ দেখাতো না সচরাচর।কিন্তু আজ আবার জায়ানকে এতো ভয়ংকরভাবে রাগতে দেখে সবাই যেন অস্থির হয়ে উঠেছে।জায়ান আবারও গর্জে উঠল,
‘ সাহস থাকলে আমার সামনে এসে দাঁড়াও।আমার নামে এইসব মিথ্যে প্রচারণা করার সাহস কিভাবে পেলো সে?’

নিহান সাহেব কিছুই বলছেন না।চুপচাপ সব দেখছে।তার বেশ ভালোই লাগছে।কাজটা যে সুহানা করেছে তা তিনি বেশ ভালোভাবেই জানেন।তাই তো চুপ করে আছেন।দেখা যাক এখন ওই মহিলা কি করে।
এদিকে জায়ানের একেকটা বাক্যে সুহানার আত্মা লাফাচ্ছে।এই মিথ্যে কথাটা সে নিজেই রটিয়েছে।কিন্তু জায়ান যে অফিস থেকে এসব শুনে বাড়িতে এসে তাণ্ডব করবে সেটা বুঝতে পারেনি।কিন্তু এখন কিছু করার নেই।জায়ানকে শান্ত করতে হবে।কারন জায়ান যদি নিজ উদ্যোগে এইটার তদন্ত করে তবে সেটা ওর জন্যে ভালো হবে না।সুহানা শুকনো ঢোক গিললেন।পর পর নিজেকে পালটে নিলেন মুহূর্তেই।মুখে অসহায়ত্বের ছাপ আনলেন মিথ্যে মিথ্যে।তিনি ডাইনিং টেবিলের কাছেই ছিলেন।কোনোরকম সবার অগোচরে একট গ্লাস থেকে আঙুলে করে একটু পানি চোখে দিলেন।তারপর দ্রুত কদমে চলে আসলেন জায়ানের কাছে।ন্যাকা কান্না করতে করতে তিনি বললেন,
‘ আসলে জায়ান বাবা আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো আহানার সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার।তাই আমি এই কথাটা হয়তো কোনোদিন ভুলে অফিসের লোকেদের সামনে বলে ফেলেছিলাম।আর তারা সেটাই ধরে নিয়েছে।কিন্তু বিশ্বাস করো বাবা সেটা অনেক আগের ঘটনা।তুমি তো এখন নিজেই নিজের জীবনসঙ্গিনী বেছে নিয়েছ।তাই আমি আহানা আর তোমার বিয়ের ভাবনা বাদ দিয়ে দিয়েছি।আমি তো মা বলো।মা হয়ে কি ছেলের জন্যে এটুকু ভাবা আমার অপরাধ?’

জায়ান চুপ করে নিলো।চোখ বন্ধ করে নিজের রাগটুকু নিয়ন্ত্রণ করে নিলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুহানাকে একপাশ হতে জড়িয়ে ধরল।অপর হাতে তার চোখের পানিগুলো মুছে দিলো।কণ্ঠস্বর নরম করে বলল,
‘ নাহ কোনো অপরাধ না মম।আসলে এসব কথা শুনে আজ আরাবী একটু আপসেট হয়ে পরেছিলো।তাই আমি রেগে গিয়েছিলাম।আ`ম সরি মম।’

সুহানা সাখাওয়াত ন্যাকামো কণ্ঠে বলল,
‘ সরি কেন বলছ তুমি। সরি তো আমার বলা উচিত।আমার কারনে আরাবী মা মন খারাপ করেছে।তুমি বললে আমি ওকেও সরি বলব। ‘

জায়ান সুহানাকে সোফায় বসালো। উনাকে একগ্লাস পানি দিলো জায়ান।তারপর বলল,
‘ তুমি আমার মা।এভাবে নিজেকে ছোটো কেন করছ?মায়েদের সন্তানদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে,চাওয়া পাওয়া থাকে।তুমি তাই করেছ।এতে সরি বলার কিছু হয়নি।নাও ডোন্ট ক্রায়। ওকে?’

সুহানা সাখাওয়াত এইবার হাসলেন।জায়ান উনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ প্রিটি লেইডিদের হাসলেই সুন্দর লাগে।’

জায়ান এইবার উঠে দাঁড়ালো।এখন রুমে যাবে সে।
ও বলল,
‘ আমি রুমে যাচ্ছি।খাবারটুকু রুমেই খাবো।’
‘ আচ্ছা বাবা তুমি যাও।আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

জায়ান নিজের রুমে চলে গেলো।আস্তে আস্তে সবাই নিজেদের কাজে চলে গেলো।এদিকে নিহান এসে দাঁড়ালো সুহানা সাখাওয়াতের সামনে।ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
‘ আর কতো নিচে নামবে তুমি?বিন্দু পরিমান লজ্জাবোধ হয় না তোমার?আমার ছেলেটা তোমায় কতো ভালোবাসে।বিশ্বাস করে।’

সুহানা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলেন,
‘ এসব কি বলছ?জায়ান আর নূরকে কি আমি ভালোবাসি না?ওরা কি তোমার একার সন্তান?আমার সন্তান না তারা?ছোটো থেকে ওদের আমি পেলেপুষে মানুষ করেছি।এটুকু চাওয়া কি খুব অন্যায় ছিলো নিহান?আমি কি এটুকুর প্রাপ্য নাহ?এটা কি তুমি অস্বীকার করতে পারবে?ওদের কখনই সতীনের সন্তান মনে করিনি।নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছি।’

এই পর্যায়ে থেমে গেলেন নিহান সাহেব।বার বার ঠিক এখানে এসেই তিনি থমকে যান।কারন এটা সত্যি যে সুহানা জায়ান আর নূরকে ছোটো থেকে পেলেপুষে এতো বড়ো করেছে।মায়ের কমতি অনুভব করতে দেয়নি।নিহান সাহেব শান্ত চোখে সুহানা সাখাওয়াতকে একপলক দেখে নিয়ে চলে গেলো।।এদিকে নিহান সাহেব তো আর জানেন না।সুহানা কখনই জায়ান আর নূরকে মন থেকে ভালোবাসেনি।সবটা লোক দেখানো ছিলো আর নিজ স্বার্থে।
সুহানা সাখাওয়াত শয়তানি হাসি হাসলেন।নিজ মনে মনে বলেন,
‘ আহ নিহান।নিজেকে যতোই চালাক ভাবোনা কেন তুমি।তুমি সেই বোকাই রয়ে গেলে।তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি আমার জানা আছে।তুমি কি ভেবেছ নিহান?জায়ান আর নূরকে আমি এমনি এমনি মায়ের মতো যত্ন করেছি।আর এতো বড়ো করেছি?আহা,একদম ভুল ধারণা তোমার।সুহানা নিজ স্বার্থ ছাড়া কোনো কিছু করে না বুঝেছ।কিন্তু এখন শুধু একটাই সমস্যা।এই আরাবীকে জায়ানের জীবন থেকে সরাতে হবে।জায়ানের বউ তো আহানাই হবে।আমাকে প্লান সাজাতে হবে।কঠিন প্লান করতে হবে।আমার ওর সাথে যোগাযোগ করতেই হবে।’

এদিকে দ্বিতীয় তলা থেকে সুহানা সাখাওয়াতকে দেখে তাচ্ছিল্য হাসল নূর।বেদনাময় হাসি দিয়ে বলে উঠে,
‘ যতোই এই অভিনয় করোনা কেন মিসেস সুহানা সাখাওয়াত। তুমি আমাদের মা কখনই হতে পারবে না।শুধু পাকাপোক্ত কোনো প্রমান পাচ্ছি না আমি।নাহলে তোমার এই আসল রূপ আমি সবাইকে দেখিয়ে দিতাম।তোমার এই রূপের পিছনে কতোটা কুৎসিত রূপ লুকিয়ে আছে।আমি কঠোর চেষ্টা করছি।শুধু একটা প্রমাণ পাই।তাহলে আমি আর চুপ থাকব না।আর একবার জায়ান ভাই আর আরাবী ভাবির বিয়েটা হয়ে যাক।এরপর আমি জায়ান ভাইকে সব বলে দিব।আমরা দু ভাই বোন মিলে তোমাকে শাস্তি দিবো।আমাদের সাথে এসব মিথ্যে অভিনয় করার জন্যে।আমাকে ফাহিমের থেকে এইভাবে দূরে রাখার জন্যে।অনেক হয়েছে।অনেক সহ্য করেছি।ভেবেছি তুমি অন্য মায়েদের মতোই আমাকে শাষণ করো।কিন্তু সেদিন তোমার শামিম আংকেলের সাথে কথাগুলো না শুনলে তো আমি জানতেই পারতাম না।তুমি ঠিক কি কারনে আমাদের এতো আদর যত্ন করতে সৎমা হয়েও।বাট এখন আমি সব জানি। তাই আর চুপ থাকব না।’

নূর চলে গেলো।কিন্তু বোকা নূর তো জানে না।শুধু এটুকু পাপই সুহানা সাখাওয়াত করেনি।তিনি আরও গভীর জলের মাছ।তা মেয়েটা আদৌ কোনোদিন জানতে পারবে?রহস্য আর রহস্য চারদিকে।এই রহস্যের সন্ধান জায়ান অথবা নূর কি কোনোদিন জানতে পারবে?
——
‘ ভাই আসব?’ নূর জায়ানের দরজায় নক করল।মাত্রই গোসল নিয়ে বেড়িয়েছে জায়ান।নূরের ডাকে দ্রুত টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিলো।তারপর গিয়ে দরজা খুলে দিলো।নূরের হাতে খাবারের ট্রে। জায়ানকে দেখে নূর হাসল।জায়ান চুল মুছতে মুছতে বলে,
‘ তুই কষ্ট করতে গেলি কেন?সার্ভেন্টসকে দিয়ে পাঠালেই তো হতো।’

ট্রেতে টি-টেবিলে রাখল নূর।তারপর জায়ানের বিছানায় বসতে বসতে বলে,
‘ কেন আমি আসলে কি কোনো সমস্যা হবে?’
‘ নাহ, সেটা না তবে তুই তো নিজের স্টাডি নিয়ে ব্যস্ত।সেদিন তোর ভাবিকে দেখতে গেলাম।সেদিন নাকি তোর কোচিং-এ এক্সাম ছিলো।যেতে পারলি না তুই।তাই বললাম আরকি।’

নূর মলিন হাসি দিলো।তা খেয়াল করল জায়ান।বোনের পাশে নিঃশব্দে বসে পরল।নূরের মাথায় আদুরে স্পর্শ করে বলল,
‘ কি হয়েছে?এই মলিন হাসি দেওয়ার মানেটা কি?আহাদের সাথে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে?’

নূর জায়ানের বুকে মাথা রাখল।জায়ানও একহাতে বোককে আগলে নিলো। বোনটা তার ভীষণ আদরের।হয়তো অন্য সব ভাইয়েদের মতো জায়ান নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে পারে না।আবার ব্যস্ততার কারনে নূরকে সময় দিতে পারে না।কিন্তু নূরকে ভীষণ ভালোবাসে জায়ান।নূর একবার যা চায়।তা ওর বলার সাথে সাথে এনে দেয় জায়ান। যাতে ওর বোনের মন খারাপ না হয়।কিন্তু আজ বোনের মুখে মলিনতা দেখে জায়ানের বুকটা কেমন বিষাদতায় ছেঁয়ে গেলো।তাহলে কি ও ভাইয়ের দায়িত্বটুক ঠিকঠাক পালন করতে পারছে না?
জায়ান ধীর আওয়াজে বলে,
‘ কি হয়েছে?ভাইকে বলবি না?কিছু কি লাগবে তোর?আমাকে একবার বল তুই।দেখবি সাথে সাথে তা তোর হাতের কাছে এসে যাবে।’

নূর মনে মনে বলল,
‘ আমার যে একজনকেই চাই ভাইয়া।ইহকালেও তাকে চাই,পরকালেও তাকে চাই।তাকে কি এনে দিতে পারবে তুমি ভাইয়া?আমি যে তাকে খুব করে চাই।কিন্তু এই চাওয়া কি কোনোদিন পূর্ণতা পাবে।’

এদিকে নূরের নিরবতা দেখে জায়ান বুঝল নূরের মন খারাপ।হয়তো আহাদের সাথে কিছু হয়েছে।নাহলে অতিরিক্ত পড়াশোনা করে মেয়েটা অস্থির হয়ে গিয়েছে।নূরের মন ভালো করার জন্যে জায়ান বলল,
‘ তোর ভাবির সাথে দেখা করবি?’

চমকে উঠল নূর।সাথে খুশিও হলো।ঝট করে মাথা তুলে তাকালো।উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে,
‘ সত্যি?কবে দেখা করাবে?’

জায়ান মনে শান্তি পেলো।যাক মেয়েটা তবে হাসল।জায়ান উঠে দাঁড়ালো এইবার।খাবার ট্রেটা নিয়ে আবার বসে পরল নূরের পাশে।তারপর বলল,
‘ কাল রেডি থাকিস।ডিনারে নিয়ে যাবো তোদের।’
‘ আচ্ছা।’

জায়ান ভাত মাখিয়ে নিয়েছে ততোক্ষণে।মাখানো শেষে এক লোকমা নূরের দিকে তুলে ধরল।বলল,
‘ আমি জানি তুই খাসনি।তাই এখন চুপ চাপ হা কর।’

নূর হাসল।তারপর খুশি মনে ভাইয়ের হাত থেকে খাবার খেতে লাগল। এদিকে জায়ানও খাচ্ছে সাথে নূরকেও খাওয়াচ্ছে।দরজার আঁড়াল থেকে এই দৃশ্যটুক দেখে সরে আসলেন নিহান সাহেব।চোখের কোণে জলটুক মুছে নিজের রুমে চলে গেলেন।আলমারি খুলে উনার মৃ’ত স্ত্রীর একটা শাড়ি বের করে বুকে জড়িয়ে নিলেন।ধীর আওয়াজে বলেন,
‘ তুমি দেখতে পাচ্ছ সাথি?আমাদের ছেলে মেয়ে দুটো একদম তোমার মতো হয়েছে।ভাই বোনের মধ্যে কতো মিল।তুমিও তো এরকম ছিলো।সবাইকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে।ছেলে মেয়ে দুটোকে এইবার তাদের সঠিক জীবনসঙ্গীদের সাথে জুড়ে দিতে পারলেই হলো।এরপর আমার ছুটি।বসে বসে শুধু প্রহর গুনব তোমার কাছে যাওয়ার।’

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here