শূন্যতায়_অস্তিত্ব ( পর্বঃ ১১) লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

0
143

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব ( পর্বঃ ১১)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

তিয়াসকে নিয়ে আমার মধ্যে যে খারাপ ভাবনা ছিল, সে তার সীমান্তও অতক্রম করে ফেলেছে। অনেক বেশি অপরাধী সে!

আমি নুজহাতের কথার প্রতিত্তোরে বললাম,
___নুজহাত তুই এসব কোথা থেকে জেনেছিস? তোর আর সা’দের মধ্যে তিয়াস কেন আসবে? এতে ওর কি ফায়দা?

নুজহাত গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
___ জানিনা আমি! কিন্তু তিয়াসের জন্যই সব হয়েছে। সা’দ তিয়াসের সাথেই চলাফেরা করে। তো তার চরিত্র তো ওর মতোই বানাবে নাকি?

আমি থেমে বললাম,
___ নুজহাত কান্না করিস না। আমি এর সত্যতা যাচাই করে নিবো যে করেই হোক। তারপর তিয়াস আর সা’দকে আমি অবশ্যই সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। শুন তুই ঘরে বসে থাকবিনা। চাকরি খুঁজে নে, মেয়েদের জন্য অসংখ্য কর্মসংস্থান আছে। নইলে গার্মেন্টসে যাবি, তবুও আত্মনির্ভরশীল হবি। বুঝেছিস আমার কথা?

নুজহাত বললো,
___ অবশ্যই হতে হবে। নিজের জন্য না হোক আমার সন্তানের জন্য আমাকে পারতে হবে।

আমি ফোনটা রেখে জোরে জোরে দুইটা নিঃশ্বাস ফেললাম।

রাত এগারোটার দিকে ফোন দিলাম দীপ্তিকে। প্রথমেই কুশল বিনিময় তারপর বললাম নাম্বার কোথায় পেলাম। রায়ানের সাথে আমার পরিচয় আছে শুনে সে প্রথমে একটু অবাক হলো। তারপর আমি তিয়াসের ব্যপারে কোনো কথা তোলার আগেই সে ক্ষমা চাইতে লাগলো, অনুনয় করে বলতে লাগলো,
___হঠাৎ তুমিও হারিয়ে গেলে, আর আমিও চলে আসলাম। তাই ক্ষমা চাওয়াটা হয়ে উঠেনি। সত্যি বলতে আমরা দুজনেই একই মানুষের প্রতারণার স্বীকার। তাই জানিনা তোমার কাছে আমি কীভাবে ক্ষমা চাইবো? কিন্তু ক্ষমা চাওয়াটা অনিবার্য মনে করি কারণ তিয়াস আমার নাম দিয়ে তোমার সাথে প্রতারণা করেছিল। সে বলেছিলো সে আমার জন্য এসব করেছে। কিন্তু সত্যি এটাই আমি এই সম্পর্কে কিচ্ছু জানতাম না।

আমি ধিরে ধিরে বললাম,
___ তার মানে তিয়াস পরবর্তীতে সত্যি তোমাকে ঠকিয়েছে?

___হ্যাঁ লিয়া। সে ভীষণ নিখুঁতভাবে মানুষকে ঠকায়। প্রথমে এতটা বিশ্বস্ত হয়ে উঠে যতটা কেউ পরিবারকেও করে না। তারপর সে সুযোগ বুঝে ঠকায়। তিয়াসের বাবার চাকরির ট্রান্সপারেন্ট যখন চট্রগ্রামে, তখন সে এইটে এসে আমাদের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। তখন থেকেই সে আমার সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলে। সে এসে আমাকে সবসময়ই ক্লাসে প্রথম স্থানে দেখেছে। তবে সেও ভালো ছাত্র বটে। তারপর আমাদের বন্ধুত্বটা কলেজেও ছিল। তবে তিয়াস ক্লাসে অনিয়মিত ছিল, যার জন্য সেটা তেমন কারোরই চোখে পড়েনি। সেটা ছাড়াও কথাবার্তা কম বলতাম, মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়টা ভীষণই কম জানোই তো। তবে কলেজের প্রথম দিকে একদিন আমি ওর সাথে তোমার ব্যপারে বলেছিলাম, তখন ক্লাসে তুমি সবার নজরে ছিলে। এরপর তোমার হঠাৎ পরিবর্তন, ক্লাসেও আসোনা, আর পরিক্ষাতেও কোনো কম্পিটেশন রাখো না। আমি খুশিই ছিলাম, কারণ আমার প্রথম স্থানটার মধ্যে আর কাউকে আসার সম্ভাবনা দেখছিলামনা। এরপর এভাবেই চলে গেলো সেই বছর। চেয়েছিলাম পরিক্ষার পরে একসাথে তিয়াস আর আমি মন বিনিময় করবো,অনূভুতি প্রকাশ করবো। কিন্তু নির্বাচনী পরিক্ষার আগেই সেটা করে ফেলার প্লানিং করে। আরে হ্যাঁ তোমার সামনেই তো করেছিলো।
এরপর আমাকে ইম্প্রেশন করার যাবতীয় কার্যকলাপ করতে থাকে। তাকে ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলি, কিন্তু এরপরেই আমার একটা কাছের বন্ধুর থেকে জানতে পারি তিয়াস লিয়ার সাথে মানে তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছে। সেটার বিষয়ে তিয়াসকে জিজ্ঞাসা করতে যাওয়ার পরে সে বললো, তোমাকে নাকি এতোদিনে ভালোবেসে ফেলেছে। তোমার শূন্যতা ওর পুরো অস্তিত্ব ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।

দীপ্তির এই কথা পর্যন্ত থামিয়ে দিয়ে বললাম,
___ তোমাকে সে এই কথা বলেছে? এদিকে তুমি জানো সে নুজহাতের সাথে কি করেছে? সা’দ আর নুজহাতকে নিজের হাতে মিলিয়ে দিয়ে এখন সে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ টানিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে আমাকে বলেছে তোমাকে ভালোবাসে, আর তোমাকে বলেছে আমাকে ভালোবাসে। তাকে নিয়ে আসলে কিছু বলার ভাষা নেই, পুরো চরিত্রহীন একটা!

___ আমারও তাই মনে লিয়া। আমি বিদেশে এসেও ওর এমন অনেক কুকর্মের কথা শুনেছি। সে মেধাবীদের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। তারপর পরিক্ষার আগে আগে এমন একটা কান্ড করে যে তারা সারা বছর যেই ফলাফল আশা করে, তার কাছেও যেতে পারে না! আমি জানিনা এসবের রহস্য কি? কিংবা কেন করে!?

___ আমিও জানিনা। আচ্ছা শুনো আরেকদিন কথা হবে। ভালো থাকবে কেমন? আজকে নুজহাতের কথা শুনে ভীষণ খারাপ লাগছে!

___ আচ্ছা ঠিকাছে, তুমিও ভালো থাকবে লিয়া।

লাইনটা কেটে দিলাম। তবে আমার ভাবনার ঘোর এখনো কাটছেনা। সত্যিই সে এমন কেন করে?
ওর মা বাবা তো খুব ভালো। সে ভালো ভালো ভাব নিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করে কেন?বছর বছর একটা মানুষের সাথে মেলামেশা করে, এরপর তার বিশ্বাস জুগিয়ে তারপরই কেন এমন প্রতারণা করে?
যদি মেয়েদের প্রতি ওর বেশিই ইন্টারেস্ট থাকে, সে চাইলে সে ধরনের মেয়েদের সাথেই টাইম পাস কর‍তে পারে! কিন্তু ভালো ভালো মেয়েদের পেছনে কেন ছুটে?

সত্যিই ওর এই কাজের উপরে আমার মতো মানুষ চিন্তা করলে মাথা একদম বরবাদ হয়ে যাবে। তার চেয়ে কৌশলে ওর নিজের মুখ থেকেই শুনে নিতে হবে আসল সত্যিটা কি!



সপ্তাহখানেক পরে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িতে গিয়ে দুইদিন থাকবো। এসব চিন্তায় চিন্তায় আমার দিনক্ষণ সব এলোমেলো। এতদিন আমার সাথে হয়ে যাওয়া এতকিছুর জন্য তিয়াসের বিষয়ে সিরিয়াস ছিলাম না, কিন্তু সে নুজহাতের সাথে কেন এমন করলো? নুজহাত তো এখন চাইলেই সহজে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারবেনা। তারপর একটা বাচ্চার মা!
এদিকে তিয়াসকেও আশেপাশে দেখিনা আর এসব সত্য জানার কোনো রাস্তাও পাইনা।

পরেরদিন বাড়িতে যাবো মা’কে জানিয়ে দিয়েছি। মা ভীষণ খুশি, আমার জন্য কি কি রান্না করবে সেগুলো আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। আমি বিন্নি ভাতের সঙ্গে বোয়াল মাছের ভাজা পছন্দ করি বলে মা প্রতিবার গেলেই সেটা একবার হলেও রান্না করে খাওয়াবে। আর বাবা সারা গ্রামের জেলেদের বলে রাখে বোয়াল মাছ পেলেই যেন বাবাকে খবর দেয়!
বাবাও বারবার ফোন দিয়ে বলছে স্টেশন পৌঁছেই যেন জানাই।
বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবতেই মনটা ফুরফুরা লাগছিলো।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, মাগরিবের নামাজের পরে বসে ভাবছিলাম কি রান্না করা যায়?
যদি এখন নতুন কোনো তরকারি রান্না করি তাহলে সেটা থেকে যাবে। কেননা কাল সকালের ট্রেনেই চলে যাবো। আর তাছাড়া এখন বাসায় ডিমও নেই।
প্রথম ভাবলাম পাশের রুমের আন্টি থেকে চেয়ে আনবো, কিন্তু পরে ভাবলাম . নাহ নিচে গিয়ে কিনে নিয়ে আসি।
যেই ভাবা সেই কাজ। চুলগুলো ঠিক করে, মাথায় ছোট করে ওড়না টেনে দরজা খোললাম।
দরজা খোলার সাথে সাথে দরজার সামনে একটা কাগজ পড়লো, আমি সেটাকে হাতে নিলাম।
চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের বিস্তার এখানের হাতের লেখায়, আমি প্রথমে অবাক হয়ে লেখাগুলো দেখছিলাম। তারপরেই খেয়াল করে লেখাগুলো পড়তে লাগলাম, লেখা আছে..

“”ক্লান্তি আর কিছুটা গ্লানিবোধে দরজার কপাট খুলে বিস্মিত চোখে এই টুকরোটা উঠিয়ে নিবে! কেন নিবে কীভাবে নিবে অথবা কি ভেবে নিবে জানিনা। তবে এখানে কি আছে সেটা দেখার আগে আস্তে আস্তে মাথার উপরের ওড়না ঠিক থাকলেও আবার ঠিক করে নিবে, এটা তোমার মতো ভদ্র মেয়েদের একটা চিরস্থায়ী চিত্র! বিকাল, সন্ধ্যা, রাত কিংবা সকাল, কখন এই চিরকুটে তোমার স্পর্শ পড়বে সেটা বলতে পারবোনা, তবে বলবো যখনি পাবে চলে আসবে উত্তরে লেকের পাড়, আমি অপেক্ষমান! “”

আমি কিছুক্ষণ কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর কি ভেবে মিটমিট করে হাসলাম। দরজার উপরে লক করে আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম লেকের পাড়ের দিকে। খুব বেশি দূরে নয়, বাসার বারান্দা থেকে এর একটা কর্ণার দেখা যায়।
ডিম কেনার কথা এই মূহুর্তে আর মনে নেই।

ধির পায়ে এগুচ্ছি। ভেতরে ভিন্ন একটা কম্পন। ঠিক ষোলো থেকে আঠারো বছর একটা মেয়ের জীবনে প্রথম যে অনূভুতি জাগ্রত হয়!
বারবার মাথায় ওড়নাটা টেনে ঠিক করছি। জানিনা কাগজের লেখাটার জন্যই কিনা ওড়নার দিকে এতো মনোযোগ!

লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাশে কিছুই দেখলাম না। পশ্চিমেও না, তারপর উত্তরেও কিছু দেখলাম না।
দক্ষিণে তাকাতে যাবো তখনি চমকে উঠলাম। একদম আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের পাঞ্জাবী পরা একটা মানুষ। চোখে চিকন ফ্রেমের একটা চশমা, বাম হাতের বদলে ডান হাতে পাঞ্জাবীর সাথে মিল রেখে কালো একটা ঘড়ি!
তার হাতে আমার জন্য একটা একটা খোলা ডায়েরি যেখানে আমার জন্য লেখা আছে একটা কবিতা!

আমি আবারও সেই লেখার মাঝে ডুবে গেলাম, লেখা আছে…

‘ উষ্ণতার বৈচিত্র্য টের পাইনি, তবে স্বচ্ছতার আগুনে পুড়ে ছাই হই রোজ!
বলতে পারো তোমার মাঝে কি আছে?
ফাল্গুনের মোহনায় কবিতা না সাজায়েও, তোমাকে ভেবে সহস্ররূপে আঁকিবুঁকি টানি!
কীভাবে টানতে পারো এতো কাছে?

বিস্তৃত আকাশের বুকেও এতো বিশালতা নেই,যতটা আছে তোমার ওই আঁখে,
নেশার এতো তীব্রতা কেন রাখো সেথায়?
রংধনুর সাত রঙেও এতো চোখ ঝলসে উঠে না, যতটা তোমার হাসিতে ঝলসায়!
আমাকে একটু জায়গা দিবে তোমার দুনিয়ায়?””

আমি অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইলাম। চোখ কেন ভিজে উঠছিলো বুঝতে পারছিলাম না। তবে সেটা লুকানোর চেষ্টা করে মৃদু হেসে বললাম,
___ খুব ভালোবাসেন?

চলবে…..

একদিনে দুই পর্ব পাওয়ার খুশিটা ফটাফট জানিয়ে দেন গ্রুপে👉 Tajrin’s world

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here