#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সময়টা দুপুর হলেও রোদের তপ্ততা অতটাও ঝাঁজালো নয়। হলদে আলোয় গায়ের রং ঝলমল করছে৷ লম্বা চুলগুলো বিনুনি গাঁথা। হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠছে। বেগুনি রঙা শাড়ির আঁচলটা কাঁধ জুড়ে জড়িয়ে নেওয়া। অহনাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে মৃত্তিকা৷ অহনা-ই জোর করে নিয়ে এসেছে তাকে৷ এই মেয়ের ঘরে বসার দুদণ্ড স্বস্তি নেই। সারাক্ষণ ঘোরাঘুরি আর সখীদের সঙ্গে খেলায় মজে থাকা। কিছুটা ডানপিটে স্বভাবেরও। এ মেয়েকেই গৌরী চোখে হারান। দুই ছেলের মাঝে এই একটি মাত্র মেয়ে উনার। ছোটো ছেলে এখন শহরে রয়েছে৷ হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। স্বামী গত হয়েছে অনেকগুলো বছর অতিবাহিত হয়েছে। মেয়ে‚ ছেলে আর বউমাকে নিয়েই উনার সংসার।
মৃত্তিকার হাতে কয়েকটা গাঁদা ফুল দিয়েছে অহনা। কমলা‚ হলুদ রঙের ফুলগুলো থেকে সুবাস ছড়াচ্ছে। দুজনের একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে৷ অহনা একবার পেছনে উঁকি দিয়ে মৃত্তিকা বিনুনি দেখে মিটিমিটি হাসল। এরপর লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল‚
“দিদি তুমি খুব সুন্দর।”
দাঁড়িয়ে পড়ল মৃত্তিকা৷ তাকে অনুসরণ করে অহনাও থেমে গেল৷ গাল এলিয়ে হেসে মৃত্তিকা বলল‚ “মোটেও আমি সুন্দর নই— বরং তোর দেখার চোখ সুন্দর।”
“সুন্দরীরা কখনো স্বীকার করে না যে‚ সে সুন্দর।”
“হয়েছে পাঁকা পাঁকা কথা বলতে হবে না৷”
“এক মিনিট।”
“আবার কী হলো?”
“আরেকটা প্রশংসা করতে ভুলে গেছি। তোমার লম্বা চুলগুলোও খুব সুন্দর। কী দাও গো চুলে?”
এই মেয়ের কাণ্ড দেখে কপাল চাপড়াল মৃত্তিকা৷ হাসি পাচ্ছে ভীষণ। অহনার গাল টিপে বলল‚
“সপ্তাহে দুদিন শ্যাম্পু করি আর মামনি সেই ধোয়া চুলে তেল দিয়ে দেয়।”
একটু থেকে মৃত্তিকা আবারও বলল‚ “হয়েছে প্রশ্ন করা?”
হাঁটতে হাঁটতেই একটা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। বাড়ির সামনের দিকটায় বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ। ঘরবাড়িও খুব একটা নেই। মাঠে ছোটো বাচ্চারা গোল্লাছুট খেলছে৷ মৃত্তিকা ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। ছোট্টো উঠোন বিশিষ্ট বাড়িটা শূন্য ব্যাকুলতায় উৎকণ্ঠিত। অবহেলায় পড়ে থাকা বাড়িটার দেয়াল খসে খসে পড়ছে। উপরের টিনগুলো মরিচা ধরে গিয়েছে৷ একপ্রকার পরিত্যক্তই বলা যায়।
“হ্যাঁ রে অহনা এই বাড়িটা কাদের? পরিত্যক্ত ভুতের বাড়িটা দেখে— গা ছমছমে করছে।”
“আমিও জানি না গো দিদি।”
“ভরদুপুরে এখানে থাকার দরকার নেই। তেনারা যদি কোনো ক্ষতি করে।”
হয়েছে কাজ। অহনা এমনিতেও যা ডরুক। আজ মনে হয় না সে এদিকসেদিক ছোটাছুটি করবে বলে৷ অহনা ভীতু গলায় জিজ্ঞেস করল‚
“তুমি আমাকে ভয় কেন দেখাচ্ছ দিদি?”
“আমি কোথায় ভয় দেখালাম? বাড়িটা দেখে তোর কী মনে হচ্ছে না— এখানে প্রেতাত্মা থাকতে পারে বলে?”
“দয়া করে থাম দিদি৷ আমার ভীষণ ভয় করছে। দৌঁড়ে পালানোর মতো জোর আমার পায়ে নেই৷”
অহনার কথায় শব্দ করে হেসে উঠল মৃত্তিকা৷ সে তো মজা করছিল৷ কিন্তু মেয়েটা দেখছি সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছে।
“পাগলি মেয়ে— এসব প্রেতাত্মা বলতে কিছু হয় না৷ চল বাড়ি ফিরে যাব৷”
“তুমি আমাকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বলছ তাই-না?”
মাথা দুই দিকে ঝাকিয়ে মৃত্তিকা বলল‚ “উঁহু! সত্যি বলছি।”
“পুষ্করিণী পাড়ে যাবে দিদি?”
“এখন সোজা বাড়িতে যাব। বুঝতেই তো পারছিস একটু এদিকসেদিক হলে উনি আমার উপর কীভাবে রেগে যান।”
“তুমি মায়ের কথা বলছ?”
“আর কার কথা বলব?”
“মায়ের কথায় তুমি কিছু মনে কোরো না দিদি। মা একটু রাগী তবে মনটা অনেক ভালো। আমি জানি না উনি তোমাকে এত অপছন্দ কেন করে!”
“এত ভাবতে হবে না। চল বাড়ি যাই। ওহ হ্যাঁ— পুষ্করিণী পাড়ে বিকেলে যাব৷”
“আচ্ছা।”
❑
মাত্রই ভরপেট খাইয়ে গিয়েছেন মাধুরী। ছেলেকে নিয়ে তিনি ভীষণই উদ্বিগ্ন। এই তো নিজের হাতে সাড়া দুপুর রান্না করলেন। এরপর নিজের হাতে ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হলে তিনি। জম্পেশ খেয়ে এখন দুচোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসছে প্রলয়ের৷ চোখে ছোটো হয়ে এসেছে। তবুও জানালা ভেদ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল সে৷ দৈবাৎ সমীরণে ঝুলে থাকা পর্দাগুলো উড়ছে৷ এবার চোখ বন্ধ করে রইল সে। দরজা খোলার প্রতিধ্বনি হতেই চোখ মেলে তাকাল। নিভৃতে ঢেকে রাখা গ্লাসটা বিছানার পাশের টেবিলের উপর রাখল তৃপ্তি। তাকে দেখা মাত্রই ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রলয় সোজা হয়ে বসল। ত্রস্ত কণ্ঠস্বরে বলল‚
“আপনি আবারও আমার ঘরে এসেছেন? যান বের হয়ে যান আমার ঘর থেকে।”
“প্লিজ আপনি উত্তেজিত হবেন না৷”
তবুও শান্ত হলো না প্রলয়। কিছু বলতে নেবে তার আগেই তৃপ্তি আবারও বলল‚ “আপনি আমাকে যতটা খারাপ ভাবছেন ততটা খারাপ আমি নই।”
চুপ করে রইল প্রলয়। মায়ের প্রতি সুপ্ত রাগ এই মেয়েটার উপর চড়াও হয়েছে৷ তৃপ্তি বলল‚
“আমি জানি আপনি কেন আমার সাথে এরকম ব্যবহার করছেন।”
অবাক চোখে তাকাল প্রলয়। তৃপ্তি ক্ষীণ হেসে বলল‚
“আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হবেন না আপনি। আমি কারো জায়গা দখল করতে আসিনি৷”
“তাহলে আপনার উদ্দেশ্য কী?”
অকপটেই তৃপ্তি জবাব দিল‚ “বন্ধুত্ব।”
বুঝতে পারল না প্রলয়। তৃপ্তিকে শুধাল‚ “মানে?”
“মানে এই যে‚ আমি এখানে এডমিশন টেস্টের জন্য এসেছি। তবে আপনি যেহেতু চান না তাই কালই এখান থেকে চলে যাব৷”
কিছু বলল না প্রলয়। মুখ ফিরিয়ে জানালার বাহিরটা অবলোকন করল। তার নীরবতা আঁধার নেমে এলো তৃপ্তির মুখপানে। সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। প্রলয়ের ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বালিশের কাছ থেকে ফোনটা বের করে কাউকে কল করল। কল রিসিভ হতেই প্রলয় বলল‚
“যেই কাজটা দিয়েছিলাম সেটা হয়েছে?”
অপরপ্রান্তে কী কথা হলো তা শোনা গেল না৷ “…….”
“সবগুলোকে আমার চাই অ্যাট এনি কস্ট।”
“…….”
মুঠোফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলল প্রলয়। রাগে শরীর কাঁপছে ক্রমাগত। রাগের মাঝেও কঠিন স্বরে প্রলয় বলল‚
“রাজনীতি করতে গিয়ে একটা জিনিস ভুলে গিয়েছিস ইট ছুড়লে পাটকেলের আঘা’ত তো পেতে হবে। নাজিম চৌধুরী এবার যে পাল্টা আঘা’ত আমিও ছুড়ব! প্রলয় নিজের খেলা দেখাবে এবার। সামলাতে পারবি তো?”
ঠোঁট উঁচু করে কয়েকবার ‘চ’ উচ্চারিত হলো৷ প্রলয় হাসল অস্বাভাবিক ভাবে৷ টেবিলের উপরে রাখা জুসটা ঢকঢক করে খেয়ে নিল৷ টেস্টটা বেশ অন্যরকম। ভালোই লেগেছে খেতে।
বিকেলে…
দিবসান্তের দীপ্তিমান নীলাম্বর। প্রকাণ্ড সূর্যটার আবছায়া পুষ্করিণীর নিটল জলে দৃশ্যমান। শানবাঁধানো ঘাট‚ নিরিবিলি পরিবেশে হাঁটু ভেঙে বসে রয়েছে মৃত্তিকা আর অহনা। এখানে বসে থাকতে বেশ ভালোই লাগছে। পুষ্করিণীর অপরপ্রান্তে বড়ো একটা তেঁতুল গাছে৷ কাঁচা পাঁকা তেঁতুল ঝুলে রয়েছে৷ তেঁতুল দেখেই জিভে জল এলো অহনার। কিন্তু যখন থেকে শুনেছে তেঁতুল গাছে শাঁকচুন্নি থাকে; সেদিন থেকেই তেঁতুল তার অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। অহনাকে লোভ লাগানোর জন্য মৃত্তিকা বলল‚
“তেঁতুল খাবি অনা?”
মাথা দু দিকে ঝাকিয়ে বলল‚ “খাব না৷”
আলতো করে হাসল মৃত্তিকা। হিম শীতল বাতাস বইছে সেখানে। মৃত্তিকা বলল‚ “এখানে এসে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।”
“আমি প্রায়শই পুষ্করিণী পাড়ে এসে বসে থাকি।”
“তুই না এত ভীতু— এখানে আসতে তোর ভয় করে না?”
“অভ্যেস হয়ে গেছে৷ এখানে এলে আমার ভয় করে না।”
“দুপুরে তো খুব ভয় পাচ্ছিলিস?”
আজ তার ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গিয়েছে৷ মেকি হাসল অহনা। তবে হাসিটা ছিল মিষ্টি। মেয়েটার হাসি সুন্দর। মনে মনে একটা ডাকনাম দিল মৃত্তিকা। ‘সুহাসিনী’ বেশ মানাবে নামটা। আনমনে জলে পা নাচাচ্ছে৷ এক দু ফোটা জল ছিটে আসছে বৈকি। অহনার দেখাদেখি মৃত্তিকাও ডুবে থাকা সিঁড়িতে পা ভেজালো। শীতল জলে শরীর শিরশির করে উঠল।
সবে বাড়ি ফিরেছেন মেহরাব শিকদার। বাড়িতে ফিরেই প্রথমে প্রলয়ের ঘরে গেলেন। প্রলয় তখন গভীর ঘুমে আচ্ছাদিত। ছেলেটাকে সহিসালামতে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। পুরোটা রাস্তায় চিন্তা করে করেই ফিরেছেন তিনি। ছোটো থেকে প্রলয় উনার খুব আদরের। মেহরাব শিকদার ভাইপোর কাছে এগিয়ে গেলেন। ঘুম ভেঙে গেল প্রলয়ের৷ আধবোজা চোখ পিটপিট করল৷ কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে চোখ মেলে তাকাল। মেহরাব শিকদার জিজ্ঞেস করলেন‚
“ঠিক আছিস তুই?”
প্রলয় তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল‚ “এক বছর আগেও ভালো ছিলাম না— এখনো ভালো নেই আমি।”
“কী হয়েছে তোর? আর এক্সিডেন্টই বা কী করে হলো?”
“আমি ভালো নেই চাচ্চু। কেন করলে এমনটা? আমার সুন্দর জীবনটা যে বিভীষিকাময় হয়ে গেছে।”
কথাটা বলতে গিয়েও কণ্ঠনালি কাঁপছে৷ মেহরাব শিকদার স্পষ্ট বুঝলেন ভাইপোর কষ্টটা। কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তিনি। বিনাবাক্য ব্যয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। খোলা দুয়ারে তাকিয়ে প্রলয় বলল‚
“জানতাম কোনো উত্তর দিতে পারবে না তুমি৷ বাকিরাও কোনো উত্তর দিতে পারবে না। যেখানে আমার নিজের মা-ই আমাকে বিষাদের নীল সাগরে ছুড়ে ফেলেছেন— সেখানে তোমাদের দোষ তো কোনো দোষই না।”
চলবে?…..