রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
346

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

সকলের অস্থিরতায় সন্ধ্যে গড়িয়েছে খুবই অদ্ভুত ভাবে৷ মসজিদে মাগরিবের আজান পড়েছে। হসপিটালের করিডরে ক্রমাগত পায়চারি করছেন মোর্শেদ শিকদার। ছেলের চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে উনার। মেহরাব শিকদারকে কলে পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো নেটওয়ার্ক নেই। এদিকে ছেলের এমন অবস্থা মেনে নিতে পারছেন না মাধুরী। ফিরোজা সামলাচ্ছেন উনাকে। পূর্ণতা আর পুষ্পিতাকে তৃপ্তির কাছে রেখে এসেছেন উনারা। মেয়ে দুটো হসপিটালে আসার জন্য খুব কান্না করছিল। কিন্তু হসপিটালে এত ভীড় না বাড়ানোই ভালো। এরই মাঝে কেবিন থেকে বের হয়ে এলো অর্পণ। ওকে দেখা মাত্রই মোর্শেদ শিকদার জিজ্ঞেস করলেন‚

“প্রলয় কেমন আছে?”

কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই অর্পণ বলল‚ “ভয়ের কোনো কারণ নেই জেঠু। ক্ষ’তগুলো কিছুটা গভীর ছিল আর কপালে চারটে সেলাই লেগেছে। ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে৷ ভাই সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”

“ওকে কী বাড়িতে নিয়ে যাবি নাকি হসপিটালেই থাকবে?”

“বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া যাবে৷”

দুজনের কথার মাঝখানেই ফোড়ন কা’টলেন মাধুরী। ব্যাকুল চিত্তে অর্পণের হাত আঁকড়ে জিজ্ঞেস করলেন‚

“আমার ছেলেটা কেমন আছে? সুস্থ হয়ে যাবে তো?”

কিছুটা আশ্বাস দিয়ে অর্পণ বলল‚ “তুমি চিন্তা কোরো না জেঠিমা। ভাই খুব শীগ্রই সুস্থ হয়ে যাবে।”

গ্রামে সন্ধ্যা হতে রাত নেমে আসে। রাস্তাঘাটেও মানুষের আনাগোনা কমে যায়৷ উঠোনের তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বালিয়েছেন গৌরী৷ সম্পর্কে তিনি তনুজার ননদ হন। আর এই রাজবংশী পরিবারের মাথা। তনুজা উনার ননদের ভিটেয় উঠেছেন৷ অসময়ে মেয়েটার বায়না পূরণ করছে এখানে থাকতে হচ্ছে। না জানি কখন কোন কথা বলে ওঠেন তিনি৷ মৃত্তিকা উনার চোখের বালি। এই নিয়ে খুবই চিন্তায় আছেন তনুজা। এদিকে শাঁখ বাজানো হয়ে এলে গৌরী বললেন‚

“আমার একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ বৌদিভাই। ও মেয়েকে এদিকে সেদিক টই টই করতে বারণ করে দেবে৷ আমার বাড়িতে কোনো অনাচার আমি সইতে পারব না। এই তোমাকে আমি বলে দিলুম।”

“আহা ঠাকুরঝি এভাবে বোলো না৷”

“তোমাদের আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না বাপু।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তনুজা৷ মৃত্তিকা পছন্দ করেন না গৌরী। প্রথম থেকেই মেয়েটা তিনি হেলাফেলাই করে গেলেন। আবছা আঁধারিয়ায় দোতলা বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলেন মৃত্তিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে মৃত্তিকা সেখান থেকে চলে গেল৷ তনুজা উনার ননদের দিকে তাকিয়ে বললেন‚

“আমি ঘরে যাচ্ছি।”

গৌরী কিছু বললেন না। শঙ্খটা হাতে করে নিয়ে মন্দিরে চলে গেলেন। কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় প্রথম ঘরটায় প্রবেশ করলেন তনুজা। ঘুমন্ত সুদর্শিনীর মাথার কাছটায় বসে রয়েছে মৃত্তিকা৷ দরজা খানিকটা চাপিয়ে তনুজা সেখানেই গেলেন। নিজে থেকেই বললেন‚

“পিসিমণির কথায় কিছু মনে করিস না মা। তুই তো জানিসই সে কেমন?”

“আমি কিছু মনে করিনি মামনি।”

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মাথার কাছটায় বসেই সুদর্শিনীকে ডাকতে শুরু করল মৃত্তিকা৷ তনুজা বিছানার অপর প্রান্তে বসেছেন৷ কয়েকবার ডাকার পরও যখন সুদর্শিনী উঠল না তখন মৃত্তিকা বলল‚

“অ্যাই দিদিভাই— তুই এত ঘুমকাতুরে কবে হলি? আগে তো এমন ছিলি না?”

তনুজা বললেন‚ “এ সময় খুব ঘুম পায় এটাই স্বাভাবিক।”

সুদর্শিনী উঠে বসল৷ বিকেলে হালকা কিছু খেয়েই জম্পেশ ঘুম দিয়েছিল৷ জার্নি করে প্রচণ্ড অলসতা তাকে কাবু করছিল৷ এখন বেশ ফ্রেশ লাগছে। সে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল‚

“চাইলে তুইও আমার সঙ্গে ঘুমতে পারিস। আমি একটুও মাইন্ড করব না।”

“বয়েই গেছে আমার। আমি মোটেও তোর মতো ঘুম কাতুরে নই।”

“মাসিমণি! তোমার কী মনে হয় না— আমাদের মৃত্তিকাকে বিয়ে দেওয়া উচিত?”

“কীসের মধ্যে কী বলছিস দিদিভাই?”

তনুজা বললেন‚ “ও ভুল কী বলেছে? তুই একটু ওকে বোঝা মা। আমি তো কতই বলি— আমার কথা শুনলে তো!”

“আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি৷ এখানে এইসব অযৌক্তিক কথাবার্তা না বললেই নয়?”

“আমার তো বয়স হয়েছে! আমার কিছু হয়ে গেলে তুই তো একা হয়ে যাবি মা।”

তনুজার কথায় খারাপ লাগা শুরু হলো। একমাত্র তার জন্য এত দুশ্চিন্তা করেন তিনি। কথা কাটানোর জন্য মৃত্তিকা বলল‚

“মামনি তুমি আবার ওইসব কথা বলা শুরু করেছ?”

প্রলয়কে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে৷ বাড়িতে আসার পরপরই মাধুরী ব্যস্ত হয়ে পরলেন ছেলের সেবা শুশ্রূষা করায়। রান্নাঘরে ঢুকেছেন অনেকটা সময় হলো৷ প্রলয়ের জন্য স্যুপ বানাবেন। পূর্ণতা পুষ্পিতার পড়াশোনা আজ লাটে উঠেছে৷ দুটোতে মিলে ভাইয়ের হাত ধরে দুদিকে বসে রয়েছে৷ তৃপ্তিকে যে প্রলয় একদমই পছন্দ করছে না তা সে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে৷ তাইতো একবার প্রলয়ের সামনে পর্যন্ত যায়নি সে৷ যথাসম্ভব আড়ালে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একা একা থাকতেও ভালো লাগছে না৷ সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত। তৃপ্তি একবার রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিল৷ মাধুরী সবজি কাটছেন৷ ভেতরে প্রবেশ করল সে৷ সেই সঙ্গে মাধুরীকে জিজ্ঞেস করল‚

“আন্টি আমি সাহায্য করি?”

“আমার কাজ প্রায় হয়ে গিয়েছে।”

তবুও দাঁড়িয়ে রইল তৃপ্তি৷ কোনো কথা নেই দুজনের মাঝে। মাধুরী নিজের মতো করে রান্না করছেন। নীরবতা কা’টিয়ে তৃপ্তি জিজ্ঞেস করল‚

“আন্টি আমি কাল সকালে চলে যেতে চাই।”

ঘাড় বাকিয়ে তৃপ্তির দিকে তাকালেন মাধুরী। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন‚

“কী বলছ এসব?”

“আপনি যা চাইছেন সেটা আমি করতে পারব না।”

“কেন?”

“মানুষের মন থেকে স্মৃতি মুছে ফেলা কী এতই সহজ? আমি আপনার ছেলের সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি তাতে বেশ ভালোই বুঝতে পারছি— উনি উনার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন।”

“সেই ভালোবাসাই তোমাকে মুছে দিতে হবে।”

“সেটা আমি করতে পারব না আন্টি।”

“তোমাকে পারতেই হবে৷ এখন ঘরে যাও৷ আমার অনেক কাজ পড়ে আছে৷ ছেলেটা এখন অসুস্থ।”

রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল তৃপ্তি। মাধুরী ছেলের জন্য স্যুপ রান্নায় মনোনিবেশ করলেন। এই সুযোগে ফিরোজা এসে রাতের রান্নার প্রস্তুতি নিলেন।

সকালে…..

❝কিছু স্বপ্ন কিছু মেঘলা কিছু বইটই ধূলো লাগা
কিছু ইচ্ছে সাড়া দিচ্ছে এই বসন্ত রাত জাগা
মম চিত্তে পাশ ফিরতে আজ পলাশ ফুলের কাব্য
নীতে নৃত্যে ফুল ছিড়তে শুধু তোমার কথা ভাবব
আজ হাওয়া বেপরোয়া দিল সন্ধ্যে পাখির ঝাঁক
এই দিকে লাল বেল ফুল হৃদ মাঝারে থাক
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল…লাগল
নীল দিগন্তে বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল… বসন্তে
নীল দিগন্তে!❞

[রবীন্দ্র সঙ্গীত]

নাচ শেষ হতেই করতালি দিতে শুরু করল সকলে৷ এখানে সকলে বলতে গৌরী রাজবংশীকে বাদ দিয়ে— তনুজা‚ সুদর্শিনী‚ অর্জুন‚ রিখিয়া আর অহনা৷ সকালেই অহনা বায়না ধরেছিল নাচ দেখবে৷ এমনিতে সবাই জানে মৃত্তিকা বেশ ভালো নাচ করে। একটা রিয়েলিটি শো’তে প্রথম স্থান পেয়েছিল সে৷ অহনার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও তালে তাল মিলিয়েছে। সকলের ইচ্ছে পূরণ করতেই রবীন্দ্র সঙ্গীতে নাচ করল মৃত্তিকা। ওকে এভাবে নাচতে দেখে মুখ ঝামটা দিলেন গৌরী। নাচটা যে ভালো লেগেছে সেটা তিনি মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে তিনি ঠিকই বুঝলেন৷ সকলের আনন্দে পানি ঢেলে গৌরী চেঁচিয়ে বললেন‚

“বলি শুধু নাচ দেখলেই কী পেট ভরবে লো?”

একটু থেমে গৌরী আবারও বললেন‚ “কী গো বউমা— তুমিও দেখছি এদের তালেই তাল মেলাচ্ছ!”

রিখিয়া চট করে উঠে দাঁড়াল। মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে বলল‚ “যাচ্ছি মা।”

দ্রুত পায়ে প্রস্থান নিল রিখিয়া৷ শাশুড়ীকে সে ভীষণ ভয় পায়। কিছুটা ভীতু প্রকৃতির সে৷ মনঃক্ষুণ্ন হলো সকলের৷ মায়ের প্রতি চরম বিরক্তি প্রকাশ করল অহনা। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ উচ্চারিত হলো। সবাই উঠোন ত্যাগ করল।

দুপুরে…

মাত্রই প্রলয়ের খবরটা পেলেন মেহরাব শিকদার। খবরটা পাওয়া মাত্রই ঢাকার উদ্দেশ্যে ছুটলেন তিনি৷ যে কাজে এসেছিলেন সেটা অন্তত ভাইপোর জীবনের থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ রাসেল গাড়ি ড্রাইভ করছেন আর মেহরাব শিকদার ফোন বের করে অর্পণের নাম্বারে বারবার ডায়াল করছেন। ছেলেটার ফোনে কিছুতেই কল লাগছে না৷ চলন্ত গাড়ির জানালা ভেদ করে বাহিরের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করতেই হকচকিয়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। গলা শুকিয়ে এলো উনার। হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল। কম্পিত স্বরে আওড়ালেন “ভূ..ভূমি!” দ্রুত জানালার কাঁচ নামিয়ে বাহিরের দিকে তাকালেন। কই কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না? তবে কী সবই উনার মনের ভুল?

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here