শিশির_ভেজা_শিউলি #পর্ব_২৩ #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
391

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_২৩
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

প্রকৃতি আজ বড্ড অশান্ত। ধরনীর বুকে তান্ডব চালাচ্ছে। ঝুমঝুম বৃষ্টিতে ভরিয়ে তুলছে মাঠ-ঘাট। নদীনালা পানিতে টুইটম্বুর। সিকদার বাড়ির বসার ঘরে সূরাকে ঘিরে বসে আছে সবাই। সূরার একপাশে মোজাম্মেল সিকদার অন্যপাশে মাহমুদ সিকদার বসে। বাড়ির প্রত্যেকের মুখে চিন্তার ছাপ। পা ফুলে উঠেছে সূরার। চোখে মুখে ব্যথার ছাপ স্পষ্ট। মিসবাহ সূরার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে সূরার পা নিজের হাঁটুর উপরে নিল। হকচকিয়ে গেল সূরা। সবার সামনে লজ্জা পেল। কিন্তু মিসবাহর মুখে লজ্জার “ল” ও নেই। সূরা মনে মনে বিরবিরালো “নির্লজ্জ”‌। মিসবাহ সুতির কাপড়ে বরফ টুকরো নিয়ে সূরার পায়ের ফোলা অংশে ধরতেই সূরা অস্ফুটস্বরে “আহ্” বলে ওঠে। মিসবাহ মাথা উঁচু করে তাকালো ব্যথায় কাতর প্রেয়সির মুখোস্রির দিকে। এই মেয়ের ব্যথাতুর মুখোস্রি যে তার বুকে চিনচিনে ব্যথা দিচ্ছে এই মেয়ে কি জানে? মিসবাহ দৃষ্টি সরিয়ে যত্নসহকারে বরফের সেঁক দেয়। মিসবাহ নরম স্বরে বলে

“আমার মনে হয় না বেশি ফ্র্যাকচার হয়েছে। তবুও কাল একবার হসপিটাল নিয়ে যাবো। তবে কিছুদিন বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই।”

মাহমুদ সিকদার সূরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন “আম্মু বেশি ব্যথা করছে?”

“না বড়আব্বু। একটু রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”

সবাই সূরার দিকে তাকায়। মাহমুদ সিকদার হয়তো ভাবেন নি সূরা বড়আব্বু বলে ডাকবে। আগে আঙ্কেল বলে ডেকেছে। প্রশান্তি অনুভব করেন তিনি। সোফায় বসা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে তুললেন মুখে। মাহমুদ সিকদার কে খুশি হতে দেখে সবার মুখেই হাসি ফুটে উঠে। মিসবাহ সূরার পায়ে ব্রেস লাগিয়ে দেয়। সাধারণত ব্রেস বা ত্রুেপ পায়ের যন্ত্রনা উপশমের কাজ করে। মিসবাহ সূরার পা উঁচু করে টি টেবিলে রাখে। সূরার হাতের ছিলে যাওয়া অংশে মলম লাগিয়ে সোফায় বসে। সূরা চোখ পিটপিট করে তাকায়। কনুইয়ের কাছে যে ছিলে গেছিলো পায়ের যন্ত্রনায় খেয়াল করেনি সে। এই লোকের সব দিকে খেয়াল থাকে। মোজাম্মেল সিকদারের কথায় সূরা নড়েচড়ে ওঠে। মোজাম্মেল সিকদার বলে

“এক সপ্তাহ পর আমার বন্ধুর নাতনির বিয়ে। আমি কোথায় ভাবলাম বড়গিন্নির সাথে নাচবো। কিন্তু সে গুড়ে বালি। বড়গিন্নি তুমি তো দেখছি পা ভেঙ্গে পড়ে আছো। এখন দেখছি ছোট গিন্নির সাথেই নাচা লাগবে আমাকে।”

মেহের চোখ ছোট ছোট করে বলে “আমার বয়েই গেছে তোমার সাথে নাচতে। যেই দেখলে বড়গিন্নি নাচার অবস্থায় নেই ওমনি ছোটগিন্নির কথা মনে পড়লো তোমার। লুচু জমিদার।”

সূরা শব্দ করে হেসে ওঠে মেহেরের কথায়। সবাই মুচকি হাসে। সূরা কৌতুক স্বরে বলে

“আহা ছোটগিন্নি রাগ করছো কেন? একদিনের জন্য না হয় আমার সুদর্শন বরের সাথে নাচলে।”

মেহের ঠোঁট উল্টে বলে “সূরা আপু তুমিও।”

সবাই শব্দ করে হেসে উঠে। মিসবাহ দেখে তার হাস্যজ্জ্বল সুরজান কে। মিজানুর সিকদার মিসবাহর উদ্দেশ্যে বলে

“মিসবাহ আব্বা! বেশি চট পায়নি তো মেয়েটা। বেশি চোট পেলে আজকেই হসপিটালে নিয়ে যাবো মেয়েটাকে।”

মিসবাহ বলে “বেশি সমস্যা হয়নি চাচ্চু। একটু বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। এখন তোমার এই উড়নচণ্ডী মেয়েকে বলো, যেনো বেশি লাফালাফি না করে বিশ্রাম নেয়।”

মিজানুর সিকদার সূরার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন

“আম্মাজান শুনলেন তো। বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবেন আপনি। আজ থেকে পা ভালো না হওয়া পর্যন্ত রুমে থাকবেন কেমন।”

“ঠিক আছে আব্বাজান। আমার পুষিও আমার সাথে থাকবে।”

সিহাব কৌতুহলী কন্ঠে বলে “তোর সাথে তো দিয়া থাকে। দিয়ার নাম পুষি হলো কবে থেকে?”

জিহাদ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে “আগে তো জানতাম এর নাম শুটকি মাছ আজ আবার জানলাম পুষি। কালে কালে আর কতো কি যে দেখবো! ভাই সিহাব এখনো সময় আছে, তুই ভেবে নে এই পুষিকে বিয়ে করবি কিনা।”

দিয়া কটমট করে তাকালো দুইজনের দিকে। একজনের মুখে রাজ্যের মায়া। কিন্তু দিয়ার এখন মায়া হচ্ছে না। আরেক জনের মুখে শয়তানি হাসি দেখে গা জ্বলে ওঠে দিয়ার ‌। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে

“তোদের দুজনকে আমি পরে দেখে নিব‌। আঙ্কেলের বাচ্চা সিহাব রে তুই আমাকে কি রিজেক্ট করবি আমি তোকে রিজেক্ট করলাম। করতাম না তোকে বিয়ে। যা ভাগ!”

সিহাব ইনোসেন্ট ফেস করে বলে “আমি কি করলাম জান?”

দিয়া চোখ পাকিয়ে তাকায়। শব্দ করে হেসে উঠে সকলে। সবাইকে হাসতে দেখে লজ্জা পায় দিয়া। সূরা হাসি চেপে বলে

“পুষি মানে আমার বিড়াল ছানা বুঝলি।”

“এখন এসব ছানা পোনা রাখা যাবেনা কাছে। ওদের শরীরের জীবাণু থেকে ইনফেকশন হবে তোমার হাতের ক্ষত জায়গায়।”

সূরা ভেংচি কাটে। পুষিকে সে রাখবে মানে রাখবেই। সূরা ঠোঁট উল্টে তাকায় মোজাম্মেল সিকদারের দিকে। মোজাম্মেল সিকদারের বুকে মাথা রাখে। মিসবাহ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।সে নিশ্চিত এই মেয়ে আবার আল্লাদিপনার ভোল ধরবে। আর হলোও তাই। সূরা আল্লাদি স্বরে বলে

“ও দাদাজান! আপনি বলুন না একা একা রুমে কতোক্ষন থাকা যায়? আমার পুষিকে চাই। আমার ওতো ছোট বাচ্চাটা আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা।”

জিহাদ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে “বিদ্যার রানী তুই শেষ মেষ বিড়াল ছানার মা হয়ে গেলি। ছ্যাঃ ছ্যাঃ! অত্যাধনিক যুগে এসব কি হচ্ছে! মানবতা আজ কোথায়!”

সূরা ভ্রু কুঁচকে তাকায় জিহাদের দিকে। সে কখন বলল পুষির মা সে। সূরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে

“আর একটা কথা বললে আমি যে দীঘিতে পড়ে ছিলাম সেই দিঘীতেই তোকে চুবিয়ে আসবো।”

জিহাদ দাঁত কেলিয়ে বলে “আগে নিজে তো উঠে দাঁড়া।”

মিসবাহ গম্ভীর গলায় বলল “বাচ্চাদের মতো ফাইট করা বাদ দাও দুজনে। আর আমি যা বলেছি তাই ফাইনাল। তোমার বাচ্চাকে আপাতত তোমার কাছে রাখার পারমিশন দিচ্ছি না আমি। আমার মনে হয় না তোমার বাচ্চার মা ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে।”

সূরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে সবার দিকে তাকায়‌। এটা কোনো কথা হলো। এই বদ অসভ্য লোকটাও তাকে টিজ করছে। পুষিকে আমার বাচ্চা বলেছে বলে কি তারা পুষির মা বানিয়ে দিবে তাকে। মিসবাহর কথা শুনে ছোটরা শব্দ করে হাসে।সূরা ঠোঁট উল্টে মোজাম্মেল সিকদারের দিকে তাকায়।মোজাম্মেল সিকদার মিসবাহ্ কে কিছু বলবে তার আগেই মিসবাহ গম্ভীর স্বরে বলে

“একদম ওর হয়ে কিছু বলবে না বড় জমিদার সাহেব। তুমি জানো বেশি কথা আমার পছন্দ না।”

মোজাম্মেল সিকদার বলেন “আহা ছোট জমিদার সাহেব রাগ করো না। বাচ্চা মেয়ে বিড়াল ছানা রাখতে চাইছে রাখুক না। আর সূরার পায়ের ব্যথা কমলে আমরা সবাই বিয়ে বাড়ি যাবো।

মীরা ক্ষীন স্বরে বলে “দাদু ওর বিয়ে বাড়ি যাওয়া কি ঠিক হবে? আর ভাইয়া তো ওকে রেস্ট নিতে বলল। তোমরা বিয়ে বাড়ি যেও আমি থাকবো ওর সাথে।”

মোজাম্মেল সিকদার কিছু বলার আগেই মিসবাহ ভরাট কন্ঠে বলে ওঠে “সবাই বিয়ে বাড়ি যাবো বড় জমিদার সাহেব। সুরও যাবে। আমার মনে হয় এক সপ্তাহর মধ্যে ব্যথা কমে যাবে তাই সমস্যা হওয়ার কথা না।”

সবাই মিসবাহর দিকে তাকায়। এতো সহজে সূরাকে বিয়ে বাড়িতে যেতে দিবে কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি। এই লোকের মতিগতি বোঝেনা সূরা। মিসবাহ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন তার। সূরাকে লোকসমাগমের মাঝে রাখা উচিত। এতে সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারবে না। ডিপ্রেশনের প্রধান কারণ একাকিত্ব। মিসবাহ সূরাকে এই যন্ত্রনা থেকে বের করে আনতে চাই । তার জন্যেই পায়ে ব্যথা থাকা সত্ত্বেও সূরা বিয়ে এটেন্ড করুক সে চাই‌। তার সুরজান শুধু ভালো থাকুন।

★★★★★★

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে হিমশীতল কক্ষের আনাচে কানাচে। ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে এগারো ছুঁই ছুঁই। ঘর জুড়ে পিনপতন নীরবতা। নুহাশ পাশ ফিরে তাকালো প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। মেয়েটা আজ একটা কথাও বলেনি তার সাথে। তার কি উচিত হয়েছে সবার সামনে নিজের সহধর্মিনী কে অপমান করা। উহু! একদম উচিৎ হয়নি। স্বামী স্ত্রীর মন-মালিন্য কখনো বাইরে প্রকাশ করতে নেই। আর না একে অপরকে কারো সামনে ছোট করা উচিৎ। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক পবিত্র। এই সম্পর্কে যখন তৃতীয় ব্যক্তি প্রবেশ করে তখন সেই সম্পর্ক তিক্ততায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। নুহাশ পেছন থেকে মীরার কোমড় জড়িয়ে ধরে। গলায় মুখ গুজে ফিসফিসিয়ে বলে

“রাগ করেছো মীরাবতী?”

মীরা ক্ষীন স্বরে বলে “রাগ করবো কেন? যার কেউ নেই তার কি রাগ করা মানায়?”

নুহাশের বুক ধক করে উঠল। সে কি এই মেয়েটাকে বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলল? নুহাশ মীরাকে সোজা করে শুয়ে দেয়। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ললাটে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে

“কে বলেছে আমার মীরাবতীর কেউ নেই? আমি আছি আমৃত্যু তার পাশে। আমার পরিবার কি তার পরিবার না?”

“তুমি কিভাবে বলতে পারলে সূরা তোমার বোন। সে কি আমার কেউ না নুহাশ?”

“আই এম সরি জান। মাথা ঠিক ছিল না আমার।”

মীরা ফুঁপিয়ে উঠলো। নুহাশ হকচকিয়ে যায়‌। দুহাতের আজলায় মীরার মুখোস্রী আগলে নিয়ে মুখোস্রীতে অসংখ্য ঠোঁট ছোঁয়ায়। বলে

“প্লীজ কেঁদোনা মীরাবতী। তোমার কান্নায় আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরন হয়। তুমি কি চেনো না আমাকে?”

মীরা পূর্নদৃষ্টি দেয় নুহাশের দিকে। এই মানুষটার জন্য আজ তার সব আছে‌। ভরা সংসার তার। মা বাবা মারা যাওয়ার পরে নিঃস্ব মীরাকে আগলে নেই এই মানুষটা। মীরা চোখে হেসে জড়িয়ে ধরে নুহাশকে। স্বামীর বুকে শান্তি খুঁজে নেয় সে। মনের সরল স্বীকারোক্তি দেয়

“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি নুহাশ।”

নুহাশ মুচকি হেসে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে মীরাকে। বলে

“আমিও যে আমার মীরাবতী কে খুব ভালোবাসি।”

মীরা মুচকি হাসে। কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে “আমাদের সুর কি সুখের মুখ কখনো দেখবেনা? মেয়েটার যন্ত্রনা, কষ্ট যে আমার আর সহ্য হয়না।”

নুহাশ ক্ষীন স্বরে বলে “পুতুলের সুখ তার আশেপাশেই আছে মীরা। কিন্তু আমার বোনটা নিজের সুখ থেকে পালাতে চাইছে।”

“তুমি কি ভাইয়ার কথা বলছো?”

“হুঁ। ভাইয়া পুতুলকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার বোনটা অনুভূতিকে ভয় পাচ্ছে।”

“ভয় পাওয়া কি স্বাভাবিক না?”

“জানিনা। আমি শুধু জানি আমার পুতুলটা সুখে থাকুক। আর তার সুখের নাম মাকহুল সিকদার মিসবাহ।”

মীরা কিছু বলে না। সে শুধু চাই মেয়েটা সুখে থাক। একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে তার কপোল বেয়ে। নুহাশ মীরার চোখের অশ্রু আলতো করে মুছে দেয়। ফিসফিসিয়ে বলে

“আমি যে এতো কষ্ট করে আমার বউয়ের রাগ ভাঙালাম তার জন্য আমারও তো কিছু পাপ্য নাকি।”

মীরা মাথা উঁচু করে তাকালো নুহাশের দিকে। স্বামীর মনোভাব বুঝতে একটুও সময় ব্যয় হয় না রমনীর। নুহাশ মিটিমিটি হেসে ভ্রু নাচায়‌। মীরা লজ্জায় মুখ লুকায় নুহাশের বুকে। নুহাশ শব্দ করে হাসে। এই মেয়েটাকে সে বড্ড ভালোবাসে। নুহাশের কাছে অনুভূতির অপর নাম তার মীরাবতী।

#চলছে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here