শিশির_ভেজা_শিউলি #পর্ব_৮ #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
397

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৮
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

বৃষ্টিস্নাত রজনী। ধরনীর বুকে তান্ডব চালাচ্ছে প্রকৃতি। চৈত্রের শেষ। দিবাকর তার রাগের আগুনে ধরনীকে দগ্ধ করতে ব্যস্ত ছিল এই কয়েক দিন। কিন্তু তাতে বুঝি প্রকৃতির সায় ছিল না। সন্ধ্যা থেকেই তুমুল বৃষ্টি ও ঠান্ডা অনিল ধরনীতে প্রশান্তি বয়ে দিচ্ছে। বিশাল এক আভিজাত্য পূর্ণ ড্রয়িং রুমের সোফায় কাচুমাচু হয়ে বসে আছে সূরা। পাশেই বেস্ট ফ্রেন্ড দিয়া বসে। তারা দুজনে এখন সুখনীড়ের ড্রয়িং রুমে অবস্থান করছে। দশ মিনিট হবে এখানে এসেছে তারা। পার্টি শুরু হতে এখনো ঢের বাকি। দিয়া তাকে জোর করে এতো তাড়াতাড়ি নিয়ে এসেছে। সূরা যখন বলল এতো তাড়াতাড়ি যেয়ে কি হবে তখন তার একটাই কথা শ্বশুড় বাড়ীর সবার সাথে আগে থেকে পরিচয় হওয়া প্রয়োজন। অস্বস্তি হচ্ছে তার। দিয়ার জোড়াজুড়িতে মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে সে। দিয়াও পড়েছে কালো রঙের। কিন্তু তার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া ইমোশনাল ব্লাকমেইল করতে এই মেয়ে ওস্তাদ। তখন থেকে এসে কাউকে দেখতে পায়নি সে। শুধু কাজের একটা মেয়ে দরজা খুলে তাদের বসিয়ে রেখে ভেতরে গেছে। অনেক বড় ডুপ্লেক্স বাড়ি। ড্রয়িং রুম বেশ বড়। মাঝবরাবর দোতলা যাওয়ার সিঁড়ি। আসবাবপত্রের সবকিছুতে আভিজাত্যের ছোঁয়া। খুব নিখুঁতভাবে সাজানো সবকিছু। এসব দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো সূরা। এতো বড় বাড়ীর ছেলে নাকি তার মতো এক শ্যামকন্যাকে ভালোবাসে। হাস্যকর ঠেকলো তার কাছে। কেউ আসার শব্দ পেয়ে সামনে তাকালো দুজনে। অতি সুন্দরী দুই মধ্যবয়সী রমনী হাসি মুখে এগিয়ে আসছে তাদের কাছে। দেখে যে কেউ বলবে দুই বোন হয়তো তারা। হাতে শরবত সহ কিছু নাস্তা। দুজনে দাঁড়িয়ে সম্মুখে উপস্থিত আগন্তুকের উদ্দেশ্যে সালাম দিল। মুনতাহা সিকদার ও তার বোন মলি চৌধুরী হাসি মুখে সালাম নিয়ে তাদের বসতে বলে সম্মুখে টি টেবিলে ট্রে রেখে তাদের সামনের সোফায় বসে। মলি চৌধুরী একগাল হেসে দিয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন

“দিয়া মা আমার পাশে এসে বস তো দেখি।তোকে খুব মিষ্টি লাগছে আজ। আমার গর্দভ ছেলে এই প্রথম কোনো ভালো কাজ করেছে। আয় মা আমার পাশে বস। আর ও বুঝি সূরা?”

সূরার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। দিয়া নম্র স্বরে বলল “জী আন্টি।”

মলি চৌধুরী বলে ” খুব মিষ্টি মেয়ে তুমি সূরা। সিহাব বলেছিল তোমার কথা। শাড়িতে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে মা।”

সূরা মাথা নিচু করেই ক্ষীন স্বরে বলল “ধন্যবাদ আন্টি।”

মলি চৌধুরী দিয়া কে আবার পাশে বসার কথা বলে। দিয়া মিষ্টি হেসে মলি চৌধুরীর পাশে গিয়ে বসতেই মলি চৌধুরী দিয়া কে জড়িয়ে ধরলেন। গদগদ হয়ে মুনতাহা সিকদারের উদ্দেশ্যে বলেন

“দেখ আপা আমার ছেলের হবু বউটা কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে। আমি বেশি দেরি করবোনা আপা। ওদের দ্রুত বিয়ে দিতে পারলে আমার শান্তি।”

দিয়া মুচকি হাসলো। শাশুড়ি কে তার বেশ মনে ধরেছে। বাবা মা হারা মেয়ে বুঝি এবার কপাল গুনে বাবা মা পাবে। ছলছল চোখে মলি চৌধুরীর দিকে দৃষ্টিপাত করতেই তিনি হয়তো বুঝলেন দিয়ার মনের অবস্থা। অতি স্নেহে জড়িয়ে ধরলেন দিয়া কে। মায়ের পরশে অশ্রু বুঝি কপোল ছুঁয়ে গেল। এতোক্ষণ সূরা দিয়া ও মলি চৌধুরীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ মুনতাহা সিকদারের দিকে চোখ পড়তেই চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। সূরা দ্রুত চোখ ফিরিয়ে মেঝেতে দৃষ্টিপাত করল। অস্বস্তি হচ্ছে তার। এতক্ষণ যে মুনতাহা সিকদার তাকে দেখছিল আর বুঝতে বাকি নেই সূরার। তিনি যে মিসবাহর মা চেহারা দেখেই বুঝেছে সে। মা ছেলের মুখে অনেক মিল। দুজনের চাহনিই এক। মারাত্মক চাহনি। মুনতাহা সিকদার বুঝলেন হয়তো সূরার অস্বস্তির কারণ। মুচকি হাসলেন তিনি। মেয়েটা উজ্জ্বল শ্যামলা। যেকোনো ফর্সা মেয়ে কে হার মানিয়ে দিবে তার স্নিগ্ধ এই মুখোস্রি। মায়াবী মুখোস্রিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার চোখ। কি স্নিগ্ধ মুখোস্রি।নাহ্ ছেলে তার মন মতো মেয়েকে ভালবেসেছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি সূরার পাশে বসলেন। গালে হাত রেখে হেসে বলে

“সূরা মা তুমি কি এখানে আনইজি ফিল করছো? দেখো মা আমি সব জানি। এমনকি বাসার প্রত্যেকটা মানুষকে আমার পাগল ছেলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলেছে সূরা নামের মেয়েটি কে সে ভালবাসে। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের কাছে তোমার মতামত সবার আগে। তুমি আমার ছেলেকে পছন্দ করোনা এতে কোনো সমস্যা নেই। আমরাও কিছু মনে করছি না কেউ। তুমি এটা ভাববে না আমরা মিসবাহর পরিবার। এটা ভাববে আমরা সবাই তোমার আপনজন। আমি তোমার আর এক মা। আমি কি পারিনা তোমার আর এক মা হতে?”

সূরা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল এতক্ষণ। মানুষটা কতো সহজে তাকে আপন করে নিল। তার সব সংকোচ লহমায় দুর করে দিল। সূরা তার গালে হাত রাখা মুনতাহা সিকদারের হাতের উপরে আলতো করে হাত রেখে আল্লাদি সুরে বলল

“মা হতে পারেন যদি মেয়ে মনে করে তুই সম্বোধন করেন।”

“ঠিক আছে তাহলে তুইও আমাকে মামনি আর তুমি সম্বোধন করবি। কি খুব বেশি কিছু চাইলাম?”

সূরার কি হলো কে জানে। হঠাৎ মুনতাহা সিকদারকে জড়িয়ে ধরে বলল “উহু খুব বেশি চাওনি মামনি। তুমি কি জানো তুমি খুব ভালো। কিন্তু তোমার ছেলেটা আস্ত বজ্জাত। আমায় জ্বালাতন করে।”

মুহুর্তেই মনে হলো কি বলে ফেলেছে সে।মুনতাহা সিকদার কে ছেড়ে নড়েচড়ে বসল সূরা। আচ্ছা মতো নিজেকে বকে দিল।সবাই কেমন থমথমে মুখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভয় পেল সে। শুকনো গলা বার কয়েক ঢক গিলে ভেজানোর প্রয়াস করেও ব্যর্থ হলো। মুখটা নামিয়ে নিয়ে চিবুকে থুতনি ঠেকালো। লহমায় হাসির শব্দে মাথা তুলতেই দেখলো সবাই হাসছে। সবাইকে হাসতে দেখে সেও ফিক করে হেসে উঠলো। মুহুর্তেই হাসির পসরা বসল বুঝি সুখনীড়ের ড্রয়িং রুমে। উপরে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা একজনের মুখেও হাসি দেখা দিলো। প্রশান্তিময় হাসি।

★★★★★★

রাত্রির প্রথম প্রহর। নিচে মেহমান আসতে শুরু করেছে। উপরের সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখছে দিয়া, সূরা আর মেহের। মেয়েটি ভারি মিষ্টি। খুব মিশুক প্রকৃতির। কতো সহজেই মিশে গেল ওদের সাথে। একপর্যায়ে দিয়াকে সিহাব ডেকে নিলে মেহেরও একটু আসছি বলেই দৌড় দিল। সূরা বুঝল না ব্যাপারটা। এখন সে একা একাই ঘুরে ঘুরে দেখছে। দেখছে ভুল হবে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে খুঁজছে। এসেছে সেই কখন এখনো সেই অসভ্য পুরুষের দেখা পায়নি সূরা। একটা ঘরের সামনে এসে দাড়িয়ে যায় সে। গলা উঁচু করে উঁকি দেয়। কাউকে না দেখতে পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। রুম টা বেশ বড়। রুমের প্রত্যেকটা আসবাবপত্র থেকে শুরু করে দেয়ালের রং সবকিছুতেই শুভ্রতার ছোঁয়া। মিষ্টি শিউলি ফুলের ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করতেই উৎস খুঁজতে বেলকনির দিকে গেল সে। ঈষৎ দুই ওষ্ঠধর ফাক হলো নিজের অজান্তেই। বেলকনিটা সূরা যে রুমে থাকে তার চেয়েও বড়। ছোট ছোট টবে হরেক রকমের ফুল গাছ। শিউলি ফুল গাছের সংখ্যা বেশি এখানে। সূরার পছন্দের ফুল হলো শিউলি।কি মিষ্টি ঘ্রান। নিচে পড়ে থাকা শিউলি কুড়িয়ে নিল সে। অজান্তেই হেসে উঠলো। বারান্দা থেকে রুমে আসতেই চমকে গেল সূরা। এখন এই মানুষটাকে এই অবস্থায় সে আশা করেনি। ফুল গুলো হাত থেকে পড়ে অবহেলিত হয়ে নিচে ঠাঁই পেল। সামনে মিসবাহ দাঁড়িয়ে। পরনে তার ট্রাউজার শুধু। শুভ্র উন্মুক্ত বুকে গুটিকয়েক লোম লেপ্টে আছে। আকর্ষণীয় লাগছে মিসবাহকে সূরার নিকট‌। লজ্জা লাগছে সূরার। দ্রুত চোখ সরিয়ে এদিকে ওদিকে তাকালো মেয়েটি। কয়েক কদম এগিয়ে এলো মিসবাহ। সূরার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ফুল গুলো কুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। লজ্জাবতী রমনীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিল সে। মেরুন শাড়িতে অপ্সরা লাগছে তার সুরজান কে। চোখে কাজল, পাতলা গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। কেশগুলো নিত্যদিনের ন্যায় হিজাবে আবৃত। মনে মনে বিরবিরালো মিসবাহ “আমার অপ্সরা সুরজান।” ঘোরলাগা কন্ঠে বলল

“শিউলি ফুল গুলো তোমার খোঁপায় ঠাঁই পেল না সুরজান। এভাবে ফেলে দিলে? তোমার লম্বা কেশে আমাদের হৃদয়ের সন্ধিক্ষণে আমি নিজ হাতে এই শিউলি জড়িয়ে দিব। তুমি মুগ্ধ হয়ে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ নিবে আর আমি আমার সুরজানের।”

“সুরজান”এই একটা শব্দই সূরাকে এলোমেলো করে দিতে যথেষ্ট ছিল। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো কপোলদ্বয়। এই লোকের থেকে সে দূরে থাকতে চায় কিন্তু প্রকৃতি বুঝি অন্যকিছু চায়‌। লোকটা নির্লজ্জ, ভয়ংকর নির্লজ্জ। এখনো কেমন উদোম শরীরে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ছিঃ ছিঃ! সূরা মাথা নিচু করে ক্ষীন স্বরে বলে

“আপনার কি লজ্জা নেই? একটা মেয়ের সামনে এভাবে উদোম শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন।”

“লজ্জা নারীর ভূষণ তুমি কি জানো না সুরজান? পুরুষদের লজ্জা পেতে নেই। আমি লজ্জা পেলে বংশবৃদ্ধি হবে কিভাবে? আমি আবার সচেতন প্রেমিক পুরুষ।”

বাঁকা হেসে বলে উঠলো মিসবাহ। লজ্জার “ল” ও নেই তার মাঝে। বরং সূরা লজ্জায় আরো নেতিয়ে পড়ল। মিসবাহ টান টান হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে নয়তো অনেক আগেই সে চলে যেতো। এখন না পারছে এখানে থাকতে আর না পারছে মিসবাহকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে। পা যেনো সুপার গ্লু দিয়ে কেউ আটকে দিয়েছে। সূরার লজ্জা রাঙ্গা মুখোস্রী দেখে বক্ষপিঞ্জরে চিনচিনে সুখময় ব্যথা হচ্ছে মিসবাহর। মেয়েটাকে আজ নতুন বউ বউ লাগছে। মিসবাহর বউজান। খাটের উপরে রাখা শার্টটা পরে নিল মিসবাহ। একটু কেশে মনোযোগ আকর্ষণ করল সূরার। স্বার্থকও হলো। সূরা তার দিকে তাকাতেই মুখোমুখি খুব নিকটে এসে দাঁড়ালো সে। সূরার বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। মিসবাহ ঘোরলাগা কন্ঠে বলল

“মেয়ে তুমি সর্বনাশিনী। এ তোমার কোন রুপ সুরজান? আমাকে আর কতো মারবে?মরা মানুষ কে বুঝি বার বার মারা যাই?তোমার প্রেমে বারবার, শতবার মরি আমি। তবুও তোমার নিষ্ঠুর মনে এই পাগল প্রেমিক পুরুষের ঠায় মিলেনা।”

সূরা মিসবাহর চোখে চোখ রেখে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ছিল। সে জানে এই পাগল, নির্লজ্জ, ভয়ংকর সুদর্শন পুরুষ তাকে পাগলের মত ভালবাসে। কিন্তু তার যে উপায় নেই। সে পারবেনা প্রিয় এই পুরুষটাকে ঠকাতে। নাহ্! সূরার পক্ষে আর সম্ভব হলো না এখানে দাড়িয়ে থাকার। দুর্বল লাগছে ভীষন। চোখ ছলছল করে উঠল মুহুর্তেই। বেহায়া অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই সে দ্রুত গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মিসবাহ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তার প্রেয়সীর যাওয়া। ওই অশ্রুসিক্ত নয়ন, বিষাদময় মুখোস্রি সবকিছুই দৃষ্টিগোচর হয়েছে মিসবাহর। সূরার যাওয়ার দিকে চেয়ে বুকের চিনচিনে ব্যথা বুঝি বাড়লো। অসহনীয় যন্ত্রণা। আবেগপ্রবণ কন্ঠে বলল

“তুমি দুর আকাশের চন্দ্র সুরজান। সে চন্দ্রের জ্যোৎস্না সারা অঙ্গে মাখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায়না।”

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here