#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_১৪
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
সময় বহমান নদীর স্রোতের মতো। কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না।সে বয়ে চলে আপন গতিতে।সূরার এক্সিডেন্টের আজ পাঁচদিন।এই পাঁচ দিন সূরা হসপিটালেই ছিল। মিজানুর সিকদার আর নুহাশ সূরার পাশে থেকে ওকে আগলে রেখেছে এই কয়দিন। পঞ্চপাণ্ডবের চারজন এসে সঙ্গ দিয়ে গেছে। সামনে মাসে ইয়ার ফাইনাল এক্সাম। চাইলেও তো সময় করে ওরা আসতে পারবেনা বেশি। মাহমুদ সিকদার, মুনতাহা সিকদার এমনকি মেহেরও এসেছিল দেখতে।যখন থেকে জেনেছে সূরা ওর বোন তখন থেকে শত শত কথার ঝুড়ি নিয়ে বসেছিল।এই কয়দিন কখনো নিজেকে একা মনে হয়নি সূরার।এই কয়দিন মিসবাহ কে একবারো দেখেনি সূরা। কিন্তু মিসবাহ লোকচক্ষুর আড়ালে ঠিকি নজরে রেখেছে তার শ্যামকন্যাকে।আজ হসপিটাল থেকে রিলিজ দিচ্ছে সূরাকে। কিন্তু আফসোস এই কয়দিন চোখের সামনে সবাই ঘুর ঘুর করলেও আজ ওকে নিতে এখনো কেউ আসেনি। নুহাশকে শখানেক ফোন দিলেও ওইপাশের ফোনের মালিকটার ফোন রিসিভ করার কোনো নাম গন্ধ নেই। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল সূরার।পায়ে ব্যাথা আছে নয়লে একাই চলে যেত সে।জেদ চেপে গেল মাথায়। কাউকে আসতে হবেনা তাকে নিতে। একাই যাবে সূরা।জেদ করে বেড থেকে নিচে নামলো সে।কয়েক ধাপ দিতেই পায়ের ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো সূরা।বসে পড়ল নিচে। শরীরের ব্যথা, মনের মধ্যে সবার প্রতি অভিমানে চোখ ছলছল করে উঠল সূরার। তখনি নিজের হাত কারো হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ আবিষ্কার করল সে।মানুষটি খুব যত্নে আগলে নিয়েছে তাকে। নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছে চিরচেনা পুরুষালী সেই সুবাস।এই ঘ্রাণে নেশাতুর কিছু কি আছে? নিজেকে মাতাল মনে হয় কেন তার?মুখ তুলে তাকালো সূরা।মানুষটাকে এতো অগোছালো কেন লাগছে? চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কোনো ভুল করেছে কি সে? ভেবে পেল না সূরা। মিসবাহ আলতো করে সূরাকে ফ্লোর থেকে উঠিয়ে বেডে বসালো। মিসবাহ এবার সূরার দিকে পূর্ণদৃষ্টি দিল।মেয়েটা এই কয়দিনে শুকিয়ে গেছে। মায়াবী মুখোস্রি দেখে যে কারো রাগ এক নিমিষেই হারিয়ে যাবে।মিসবাহর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলোনা।চাইলেও এই মেয়ের ওপরে রাগ দেখাতে পারছে না সে।জেদের বশে একা একা কোন সাহসে কেবিন থেকে বের হতে গিয়েছিল এই মেয়ে। বেশি আল্লাদে মাথায় উঠে গেছে।এখন জেদ করে পায়ে ব্যথা পেল। কষ্ট তো সেই পাচ্ছে।নাহ্ এই মেয়ের ব্যথাতুর মুখোস্রি তাকেও তো কষ্ট দিচ্ছে। শান্ত স্বরে বলল
“পায়ে কি বেশি ব্যথা করছে? বেড থেকে নিচে নামতে গেলে কেন? এতো অধৈর্য্য কেন তুমি? হাঁটতে তো পারবে না আমি কি…
“নাহ্ না। কোলে নিতে হবে না। আমি হেঁটেই যেতে পারব।”
মিসবাহ কে বলতে না দিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো সূরা। পায়ে ফ্র্যাকচার হওয়ায় এক মাসের ফুল বেড রেস্টে থাকতে হবে তাকে। কিন্তু এই মেয়ে বলে সে নাকি হেঁটে যেতে পারবে। যে মেয়ে নিজের খেয়াল রাখতে পারেনা সে মেয়ে ডাক্তার হবে কিভাবে। মিসবাহ ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো কিছুক্ষণ। পরক্ষনে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোনে। বাঁকা হেসে বলল
“আমি তো হুইলচেয়ার আনার কথা বলছিলাম। তুমি তো আমার কোলে ওঠার কথা ভেবে নিলে।আমার জানার চেয়েও বেশি এ্যাডভান্স তুমি সুরজান।তবে কোলে ওঠার আইডিয়া কিন্তু খারাপ না।আমি রাজি। তুমি রাজি থাকলে এখনি এসো, একটু আদর করে কোলে নিই।”
সূরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে তো সত্যি ভেবেছিল মিসবাহ ওকে কোলে নিতে চাইছে।তাই বলে ফেলেছে কিছু না ভেবে।সে কি জানতো এই লোক এখন লজ্জায় ফেলবে তাকে।নাহ্ লজ্জা পাবেনা সে।নয়তো এই লোক আরো বেশি পেয়ে বসবে। লজ্জারও বলি হারি তোদের কেন আমার কাছেই আসা লাগবে এখন।যা এখন পরে আসিস।পরে আসলে বিরিয়ানি খাওয়াবো পেট পুরে।এখন যা।নাহ্ এই লজ্জা খুঁজে খুঁজে সূরার কাছেই আসলো। বিরিয়ানি কে উপেক্ষা করে সূরার দুই কপোল রক্তিমায় রাঙিয়ে দিল।এতো কাছে থেকে সূরাকে লজ্জা পেতে দেখে মিসবাহ মুগ্ধ চোখে দেখছে তার সুরজানকে।কি মিষ্টি লাগছে। আচ্ছা এখন কি একটু ওই লজ্জায় লাল হওয়া কপোলদ্বয়ে তার ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া দেওয়া যায় না। খুব বেশি কি অপরাধ হবে? পাপ হবে কি? প্রেয়সীকে ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া দেওয়ার অপরাধে তার কি কঠিন কোনো শাস্তি হবে। হলে হবে। একটু অনাধীকার চর্চা করলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে? নাহ্ সে চাইনা তার সুরজান তাকে ঘৃনার চোখে দেখুক।ভালো না বাসলেও চলবে কিন্তু ঘৃনা সে নিতে পারবে না। জোরে জোরে শ্বাস ফেলল সে। নিজেকে স্বাভাবিক করে কন্ঠে খাদ নামিয়ে বলে উঠলো
“এভাবে লজ্জা পেয়ো না সুরজান।এই শক্ত, কঠোর লৌহ মানব টাও যে তোমার ওই লজ্জা রাঙ্গা মুখোস্রি দেখে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। তুমি তো দেখছি ধান্দাবাজ মেয়ে। আমার ফুলের মতো চরিত্রে কলঙ্ক দিতে চাইছো।দেখ মেয়ে কলঙ্ক লাগলে কিন্তু সামান্য চুমু খেয়ে কলঙ্কিত হবো না।আরো অনেক কিছু করে তুমি নামক কলঙ্কে কলঙ্কিত হবো।”
যে একটু লজ্জা আড়ালে রেখেছিল।মিসবাহর কথা শুনে লজ্জায় আরো নুয়ে পড়লো সূরা। মনে মনে শতাধিক গালি দিল বজ্জাত লোকটাকে। মিসবাহ সূরাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে মুচকি হাসলো ।এই লজ্জা রাঙ্গা মুখোস্রি দেখে সূরাকে মিসবাহর কাছে এখন নতুন বউ মনে হচ্ছে। মিসবাহ মনে মনে আওরালো “আমার বউজান”। সূরা মাথা নিচু করেই আমতা আমতা করে বলল
“আজ কি হসপিটালেই থাকবো? ভাইজান আসলো না কেন নিতে? আর এখন আমরা কোথায় যাবো স্যার?”
“তোমার ভাইজানের অনেক কাজ আছে। তাই আমি আসলাম।আর কোথায় যাবো গেলেই জানতে পারবে।”
সূরা নাক ফুলালো। ঠোঁট উল্টে নালিশ করে বলল “আমার চেয়ে ভাইজানের কাছে কাজ বড়ো হলো?কেউ আসলো না আজ? শয়তানের নানা নানীও আসলো না? ”
মিসবাহ হাসলো সূরাকে নাক ফুলাতে দেখে।মেয়েটা অভিমানী।বড্ড বেশি অভিমানী তার সুরজান। ছোট বাচ্চার মতো ঠোঁট উল্টে নালিশ জানাচ্ছে তাকে। হাসলো সে। অমায়িক হাসি। মিসবাহ কে হাসতে দেখে সূরা অভিমানে আরো গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সূরার কান্ড দেখে মিসবাহ এবার শব্দ করে হেসে উঠলো।
★★★★★★
গোধূলি লগ্ন। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। পাখিরা উড়ে যাচ্ছে নিজ ঠিকানায়।হয়তো ঘরে ফেরার তাড়া আছে তাদের।সূরার মাথা ঝিমঝিম করছে।এসব বড়লোকদের গাড়িতে তার পোষায় না।গা গুলিয়ে ওঠে। কিন্তু পাশের মানুষটাকে বলতে নারাজ সে। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। পাশের মানুষটি অতি দক্ষতার সাথে ডাইভিং করছে। সূরা ক্ষীন কন্ঠে বলল
“আর কতক্ষন লাগবে?”
মিসবাহ আড়চোখে দেখলো সূরাকে।মেয়েটা এসি গাড়িতেও ঘেমে গেছে।শুকনো মুখে অসুস্থতা বিরাজমান। গাড়ীতে উঠার আগে পর্যন্ত ঠিক ছিল। হঠাৎ কী হলো? মিসবাহ নরম কন্ঠে শুধালো
“তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে সুর? আমাকে বলো।”
“তেমন কিছু না। কোথায় যাচ্ছি আমরা?আর কতক্ষন লাগবে বলবেন প্লিজ?”
“বেশিক্ষণ না। আধাঘণ্টা মতো। পানি খাবে সুর? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
সূরা তাকালো মিসবাহর দিকে।লোকটার মুখে তার জন্য চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সামান্য বিষয়ে এতো উত্তেজিত কেন হচ্ছে লোকটা? সূরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দুষ্টুমি করে বলল
“আমি ঠিক আছি ভাইয়া।”
ব্যস হয়ে গেল।ভাইয়া শব্দটা মিসবাহর কর্ণপাত হতেই দ্রুত গতিতে গাড়ির ব্রেক করলো সে। পাশ ফিরে আহত দৃষ্টিতে তাকালো সূরার দিকে। আবার ভাইয়া।নাহ্ এই অন্যায় সে কখনো মেনে নিবেনা।ভাইয়া শব্দটা তার কাছে এখন এটোম বম মনে হচ্ছে।বাজে একটা শব্দ।রাগ হলো মিসবাহর।এতো গুলো দিন ধরে অপেক্ষার এই প্রতিদান দিচ্ছে সে। ধমকে উঠলো মিসবাহ
“এই মেয়ে।কোন দিক দিয়ে আমাকে ভাইয়া মনে হচ্ছে? তোমার কোন জনমের ভাই আমি? সেদিন না তোমাকে বললাম আর কখনো ভাইয়া বলে ডাকবে না।চুমু দিয়ে গাল লাল করে দিবো বেয়াদব মেয়ে।”
সূরা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মিসবাহর দিকে। দুষ্টুমি করে বললেও চাচাতো ভাই তো নাকি। ভাইয়া ডাকলে এই লোক এতো রেগে যায় কেন অদ্ভুত। মুখ দেখে মনে হয় তাকে হত্যার জন্য তীর ছুড়েছে সূরা। যতসব ঢং! কিন্তু চুমু দিয়ে কে গাল লাল করে শুনি? এতো দিন ধরে শুনে আসছে থাপ্পর দিয়ে গাল লাল করার কথা।আর আজ এই লোক কথার মানেই পাল্টে দিল। অসভ্য লোক। চুমুর কথা বলতে বাধলোনা একবারও।সূরা কন্ঠে তেজ নিয়ে বলল
“চুমু দিয়ে কে গাল লাল করে শুনি?আর আপনি তো আমার চাচাতো ভাই।তাই ভাইয়া বলেছি।”
“তোমাকে তো আর থাপ্পর দিতে পারব না।তাই চুমু দিতে চেয়েছি।আর একটা কথা চাচাতো খালাতো ফুফাতো যাই বলো না কেন ভাইয়া বলবে না বলে দিলাম। আবার যদি বলেছো তো একটা চুমুও মাটিতে পড়বে না।”
সূরা ভেংচি কেটে বলল”ভাইয়া বলবো না তো কি সাইয়া বলব?”
মিসবাহ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বাঁকা হেসে বলে “বলতে পারো ।আমার কোনো আপত্তি নাই।”
সূরা চোখ ছোট ছোট করে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপরে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বিরবির করে বলে
“নির্লজ্জ, বেহায়া, অসভ্য পুরুষ।”
#চলবে…..