শিশির_ভেজা_শিউলি #পর্ব_১৭ #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
659

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_১৭
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

নীলাভ আকাশে কালো মেঘের ছড়াছড়ি। মেদিনীর বুকে বৃষ্টি নেমেছে কিছুক্ষণ আগেই। মেঘের গর্জনের বিকট শব্দে টিকে থাকা দায়। দরজা জানালার কপাট একটা আরেকটার সাথে বারি খেয়ে বিকট আওয়াজ হচ্ছে। কিন্তু সেই আওয়াজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর কর্নপাত হচ্ছে কিনা বোঝা মুশকিল। বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে সূরার মুখোস্রি। ঠান্ডা অনিলে শিরশির করে উঠছে সারা অঙ্গ। তবুও সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। ভিজে যাচ্ছে দেখেও তার কোনো ভাবাবেগ নেই। আজ পাঁচ দিন হলো মিসবাহর সাথে দেখা হয়নি তার আর না কথা হয়েছে। সেদিনের পর আর বাসা থেকে বের হয়নি সূরা। দিয়া সিহাবের সাথে ফোনালাপ করতে ব্যস্ত ছিল। দরজা জানালার বিকট শব্দে বিরক্ত হলো বটে।অপরপাশের মানবটিকে অপেক্ষায় রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা বন্ধ করে দিল সে।জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলো বারান্দায় সূরা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মেঘের বিকট গর্জনে লহমায় কেঁপে উঠলো দিয়া। কিন্তু সূরা দিব্যি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া বারান্দার দিকে গেল। সূরার পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখলো সে। সূরার কোনো পরিবর্তন হলো কিনা বোধগম্য হলো না দিয়ার।কিয়ৎ বাদে সূরা আকাশের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো

“বৃষ্টি বিলাস করবি দিয়ু?চলনা আজ একটু বৃষ্টি বিলাসী হয় দুজনে।”

নিঃসংকোচ আবদার তার।দিয়া আর না করতে পারলোনা।সূরার হাত ধরে বাসার বাইরে গেল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ছাদে গেল তারা। লহমায় সারা শরীর সিক্ত হলো বৃষ্টিতে।সূরার কোমড় পর্যন্ত চুল, পড়নের কালো জামাটি শরীরের সাথে বৃষ্টির পানিতে ভিজে লেপ্টে গেল। সূরা আকাশের দিকে তাকালো। কালো মেঘের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে আলোর দেখা মিলছে।গর্জে উঠছে আকাশ।জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব। এতো অস্তিত্বের ভীড়ে সূরার অস্তিত্ব কোথায়?জানা নেই সূরার। অস্তিত্বহীন পথিকের মতো সে খুঁজে ফেরে নিজের একটুখানি সত্তা। আকাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে দিয়ার দিকে তাকালো সূরা।মেয়েটা তার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল সে জানে।পূর্নদৃষ্টি দিল সে।দিয়া ফর্সা, দুধে আলতা গায়ের রং বললেও ভুল হবে না। কোমড় পর্যন্ত লম্বা চুল।এক কথায় অতি সুন্দরী রমণী সে।সূরা মুচকি হাসলো। দিয়ার হাত ধরে ছাদের মেঝেতে বসে পড়লো দুজনে।দিয়া ক্ষীন স্বরে বলল

“কী হয়েছে সূরা?মন খারাপ?কাল তো একটা মাত্র পরীক্ষা আছে তারপরেই আমরা সবাই গ্ৰামে যাবো।দেখবি অনেক মজা হবে। পাঁচদিন ধরে দেখছি ঠিক মতো খাচ্ছিস না,ঘুমোস না,কি এতো ভাবিস জান?”

সূরা মুচকি হাসলো।বলল “আচ্ছা দিয়ু তুই খুশি তো সিহাবের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ায়?দেখ যদি তোর ইচ্ছে না থাকে আমি এই সম্পর্ক হতে দিবনা।তুই জানিস তো আমি সবসময় আছি তোর সাথে।”

“আমি সিহাবকে ভালোবাসি সূরা।সেও আমাকে ভালোবাসে।ওই বাড়ির প্রত্যকটা মানুষ আমাকে কখনো এটা মনে করতে দেইনি যে আমি এতিম।আমি জানি তুই সবসময় আমার পাশে আছিস।এখন এসব কেন বলছিস জানিনা কিন্তু আমি খুব হ্যাপি সূরা।আমিও একটা পরিবার পাবো।”

সূরা দিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে “আমি জানি তুই খুশি কিন্তু তোর অভিভাবক হয়ে একটু খোঁজ নিলাম আরকি।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো দুই বান্ধবী। হাসতে হাসতে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে সূরা। হকচকিয়ে গেল দিয়া। দুইহাত দিয়ে সূরার মুখ আজলায় পুরে ব্যস্ত কন্ঠে বলে

“কি হয়েছে জান? কাঁদছিস কেন। কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল।চল নিচে যায়। অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিস।চল জান।”

সূরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বৃষ্টির পানিতে অশ্রুর নোনাজল মিলেমিশে একাকার। ভেজা কন্ঠে আওরালো কিছু হৃদয় নিংড়ানো হাহাকার

“আমার কষ্ট হচ্ছে দিয়ু।আমাকে মুক্তি দে এই কষ্ট থেকে।দিতে পারবি বল,দিতে পারবি একটু মুক্তি। বুকে অসহনীয় ব্যথা আমার সহ্য হয়না। আল্লাহ!এ কোন অসহনীয় যন্ত্রনা? নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমায় এই কোন পরীক্ষায় ফেলেছেন আপনি? ওরা সবাই আমায় কলঙ্কিত করেছে। আমি সহ্য করতে পারিনা সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। আমার চোখ জ্বালা করে। বুকের চিনচিনে ব্যাথায় আমি কঁকিয়ে উঠি আপনি কি দেখেন না?ওরা এই সুন্দর পৃথিবীকে আমার কাছে কাঁটাযুক্ত বাগিচা বানিয়ে দিয়েছে।আমি সে কাটার বিষে মরে যাচ্ছি।”

দিয়া হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠে।এই মেয়ের কষ্ট যে তারও সহ্য হয়না। জড়িয়ে ধরে আগলে নেয় বোন সমতুল্য বান্ধবীকে। কষ্ট যদি একটু কম হয় সেই প্রয়াসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কিন্তু হায় এই কষ্ট, হাহাকার, বিষাদ, নিদারুন যন্ত্রনা কি কম হবার।

★★★★★★

ধরনী যখন নিকষকৃষ্ণ আঁধারে তলিয়ে যায় তখনই উদয় হয় দিবাকরের। আলোকিত করে ধরনী।অংশুর বুঝি এতে অহমিকার শেষ নেই। কিন্তু সে কি জানে ধরনী তিমিরে তলিয়ে যায় বলেই তার উদয় হয়। অন্ধকার আছে বলেই আলোর অস্তিত্ব আছে। মানবজীবনে দুঃখ কখনো স্থায়ী না। দুঃখ আছে বলেই আমরা সুখ অনুভব করতে পারি। আজ শেষ পরীক্ষা সূরার। কাল বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর উঠেছিল দিয়া আর সূরার। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল দুজনে। ওষুধের প্রভাবে সকালে দেরি করে ঘুম ভেঙেছে দুজনের।দেরি হওয়ায় না খেয়েই কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে দুজন।দিয়ার এখনো জ্বর কমেনি।সূরা একটু সুস্থ বোধ করছে। কিন্তু মনটা ভীষন দুর্বল‌।পাত্তা দিল না সূরা।দুজনে প্রায় একপ্রকার দৌড়ে ক্লাসরুমের সামনে থামলো। হাঁপিয়ে উঠেছে দুজন। অলরেডি খাতা দিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন দেওয়া বাকি।সিহাব,রাফি, জিহাদ এতক্ষন ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওদের রোল প্রায় পাশাপাশি হওয়ায় এক ক্লাসরুমে সিট পড়েছে পঞ্চপান্ডবের। তিনজনের মুখে যে একটু হাসি ফুটেছিল মিসবাহর বলা কথায় সেটুকুও মিলিয়ে গেল। মিসবাহ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো

“এক্সামহলের একটা নিয়ম আছে। মিনিমাম ত্রিশ মিনিট আগে এখানে প্রেজেন্ট থাকতে হবে। নতুন করে কি নিয়ম শেখানো প্রয়োজন আপনাদের? এখন আমরা চাইলেই আপনাদেরকে এক্সাম এটেন্ড করতে না দিতেও পারি।”

সূরা আর দিয়া মাথা নিচু করে নেয়।তারা জানে অন্যায় করেছে আর এখন মিসবাহ চাইলে পরীক্ষায় না বসতে দিতেও পারে। এক্সাম হলের আর একজন প্রফেসর বলে উঠলো

“ড.মিসবাহ আমার মনে হয় তাদের দুজনকে ভেতরে আসতে দেওয়া উচিৎ।তারা হয়তো ইচ্ছে করে দেরি করেনি।”

“এক্সকিউজ অসংখ্য থাকতে পারে কিন্তু রুলস ইজ রুলস।”

দিয়া কম্পমান স্বরে বলে উঠে “সরি স্যার।আর কখনো এমন হবেনা। কাল রাতে দুজনের জ্বর আসায় ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম। তাই সকালে উঠতে দে,,,,,

“স্যাট আপ মিস দিয়া।আমি কোনো এক্সকিউজ চাইনি আপনার থেকে।”

মিসবাহর গুরুগম্ভীর কন্ঠে দিয়া আবার মাথা নিচু করে নেয়।সূরার ভ্রু কুঁচকে যায়। আজ এই লোক এমন করছে কেন? গাঁজা টাজা খেয়ে এসেছে নাকি? সূরা এবার মুখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো মিসবাহর দিকে। আপনাআপনি চোখ ছোট ছোট হয়ে যায় সূরার। সবসময় পরিপাটি থাকা পুরুষ আজ কেমন যেন এলোমেলো। চুলগুলো আজ আর গোছানো নেই। পড়নের শার্ট টাও কুঁচকানো।এমন এলোমেলো হয়ে কলেজে কে আসে? আজব। আর সে যদি হয় কলেজের প্রফেসর তাহলে তো কথাই নেই। মিসবাহর সাথে চোখাচোখি হওয়ায় চোখ সরিয়ে নিল সূরা। মিসবাহ চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে সূরার দিকে। মেয়েটাকে আজ প্রায় এক সপ্তাহ পর দেখছে সে।সেই দিনের পরে আর দেখা মিলেনি তার শশীকান্তার। আজ সূরার সাথে দেখা হবে ভেবে তাড়াহুড়ো করে আসা। কাল সিহাবের থেকে শুনেছিল জ্বর উঠেছে মহারানীর।তাও আবার বৃষ্টিতে ভিজে।পরীক্ষার সময় এতো অবহেলা সহ্য হয়নি মিসবাহর। কাল রাতে ফোন দিয়েছিল সে সূরাকে। কিন্তু এই নিষ্ঠুর, পাষাণ রমনী রাস্তার ছ্যাচড়া প্রেমিক ভেবে যা না তাই শুনিয়ে দিয়েছে। শক্ত কন্ঠে সূরা ফোনের অপর পাশ থেকে বলে

“রাস্তার ছ্যাচড়া পুরুষের মতো করছেন কেন স্যার? আপনি বুঝতে পারেন না পছন্দ করি না আমি আপনাকে? একদম আমাকে আর ফোন দিবেন না।”

মিসবাহ ভেবে পায় না এখন কি বলা উচিৎ তার? “কেমন আছো সুরজান” বলায় এতো রাগ কেন রাগিনীর। মিসবাহ দীর্ঘশ্বাস গোপনে ফেলে শান্ত স্বরে বলে

“জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছো কেন সুর? কাল এক্সাম অথচ এতো অবহেলা কেন?”

সূরা শক্ত কন্ঠে বলে উঠে “আমি মরি বাঁচি তাতে আপনার কি? আপনার কি লজ্জা নেই? কেন আমায় বিরক্ত করেন?”

ফোন কেটে দেয় সেই নিষ্ঠুর রমনী। মিসবাহ বরাবরই শান্ত, গম্ভীর প্রকৃতির। একটুতে বিচলিত হওয়া তার ব্যক্তিত্ব না। কিন্তু বুকে যে চিনচিনে ব্যাথা তার কি উপশম দিবে সে? নিজের মাঝের তান্ডব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সে ।যার ফলস্বরূপ এমন রূঢ় ব্যবহার তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সূরা আর দিয়াকে নিজের সিটে গিয়ে বসতে বলল মিসবাহ। এক্সাম শুরু হলে সবাই গতবছরের কষ্ট খাতায় লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সামান্য খাতার লিখা গুলোই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। এক্সাম আওয়ার শেষ হলে সবাই একে একে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। রুম থেকে বের হতেই মুঠোফোনের বার্তা আসার শব্দে ব্যাগ থেকে যন্ত্রটি বের করে সূরা। মুঠোফোনের স্ক্রিনে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা

” ব্যক্তিগত চন্দ্রের জ্যোৎস্নায় তনু মন সিক্ত করতেও বুঝি এতো অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়? কাতর তৃষ্ণার্ত চোখের তৃষ্ণা বুঝি এ জনমে মিটবে না।আমার ব্যক্তিগত চন্দ্রের প্রতি এতো অবহেলা আমি মেনে নেবনা সুরজান।”

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here