শিশির_ভেজা_শিউলি #পর্ব_১৬ #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
436

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_১৬
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কতো লড়াই না করতে হয়। পেটের ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে মানুষ ছুটে চলে জীবিকার সন্ধানে। কেউ সৎ পথে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে তো আবার কেউ অসৎ পথ বেছে নেয়। অসৎ আর সৎ কর্মের একটা উদ্দেশ্য আর তা হলো পেটের ক্ষুধা নিবারণ করা। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মুল্যবান সম্পদ টাকা কে ধরা হয়। সামান্য এই টাকা অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী।টাকা আছে তো পৃথিবীতে তোমার সম্মান আছে, সম্পদ আছে, সচ্ছলতা আছে, ক্ষমতা আছে।যদি বলতেই হয় তাহলে টাকা আছে তো সব আছে। সত্যি কি সব আছে? টাকা থাকলেই কি মনুষ্যত্ব আছে প্রত্যেকের মাঝে? সুশিক্ষিত হলেও কি মানুষ স্বশিক্ষিত হতে পেরেছে? যার যতো আছে তার আরো বেশি চাই। এই চাহিদা পূরণের তাগিদে মানুষ নিজের শিক্ষা, মনুষ্যত্ব, আত্মসম্মানবোধ, মায়া-মমতা, বিসর্জন দিতেও দ্বিতীয়বার ভেবে দেখছে না। আজ মানুষ নিজের স্বার্থ রক্ষায় এই সুন্দর পৃথিবীকে নিষ্ঠুরতার তকমা লাগিয়ে দিয়েছে।হায় রে মানুষ! গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ট হয়ে রাস্তার পাশে এক কুকুর তৃষ্ণার্ত হয়ে শুয়ে আছে।প্রথমে একটু ছায়া পাবার আশায় এক দোকানের সামনে শুয়েছিল কুকুরটি। কিন্তু হায়! এই নিষ্ঠুর মানুষগুলো তাকে ঠাঁই দিল না। তৃষ্ণার্ত কুকুরটি রাস্তার একপাশে শুয়ে পড়ল। এতক্ষণ হিমশীতল রেস্টুরেন্টের কাঁচের দরজার ভেতর থেকে সব দেখছিল সূরা‌। মানুষের মনুষ্যত্ব আছে কি তাহলে? ভেতর থেকে কেউ বলে উঠলো “নেই, মনুষ্যত্ব নেই।” চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো সূরা।দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে গেল সে। পাঁচ জোড়া চোখ তাকে দেখছে।তারা বুঝতে পারছেনা সূরা হঠাৎ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল কেন। শুধু একজন মুচকি হাসলো তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।সূরা রেস্টুরেন্টের বাইরে রাস্তার পাশে এক দোকান থেকে এক বোতল পানি ,আর এক প্লেট ভাত কিনলো। কুকুরটির সামনে গিয়ে ভাত আর বাটিতে পানি ঢেলে দিল।কুকুরটা দাঁড়িয়ে পরে বাটি থেকে পানি আগে খায়।সূরা মুচকি হাসলো কুকুরটার কান্ড দেখে।এর জন্য হয়তো বলা হয়েছে পানির অপর নাম জীবন।পানি খেয়ে কুকুরটি সূরার দিকে তাকালো কিছুক্ষণ।দুই তিন বার ঘেউ ঘেউ করে ভাত খাওয়ায় মন দিল।হয়তো সে সূরাকে ধন্যবাদ দিল। বোধগম্য হলো না সূরার।সে কুকুরটির গায়ে হাত বুলিয়ে আবার রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে গেল। নির্ধারিত টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো সূরা।সবার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে শান্ত স্বরে বলল

“ওদের মারলেন কেন আপনারা? মিথ্যা শুনতে আসিনি আমি এখানে।সত্যি বলবেন।”

সবাই সূরার দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢক গিলে।তখন রাস্তায় রায়হানের সাথে সূরার দেখা হয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে তারা। রায়হান জানায় সে কোনো এক কাজে মিসবাহর কাছে এসেছিলো।সূরা যখন বলে বাসায় যেতে হবে পরে কথা হবে তখনই কোথায় থেকে টিনা ও দুইজন ছেলে এসে দাঁড়ায় সূরার সামনে।সূরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।কারন টিনার মাথায় ব্যান্ডেজ আর ছেলে দুইটার হাত ভাঙ্গা।কেউ যে ইচ্ছে করে হাত ভেঙ্গে দিয়েছে বুঝতে বাকি নেই সূরার। সেদিন সূরাকে প্রোস্টিটিউট বলা ছেলেটা বলে ওঠে

“সূরা আমাদের মাফ করে দাও। সেদিন যা বলেছি বা যা হয়েছে তার জন্য আমরা দুঃখিত।তোমার কাছে আগেই ক্ষমা চাইতাম কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তোমার পা ফ্র্যাকচার হয়েছে, তার জন্য তুমি রেস্টে আছো।উই আর রেলি ভেরি সরি ফর দ্যাট। প্লীজ ফরগিভ আস।”

সূরা কি বলবে বুঝতে পারছেনা।কেউ যে এদের মেরেছে বাজে ভাবে সে বুঝতে পারছে।আর এটা কাদের কাজ হতে পারে সেটাও জানা তার।সূরা বলল

“আমি ওই সবকিছু ভুলে গেছি ভাইয়া। আপনাদের এই অবস্থা কি করে হলো?”

ছেলেটা কিছু বলার আগে টিনা বলল “সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম।”

“সবাই?”

সূরা প্রশ্নাত্মক চাহনিতে বলে।টিনা আর কিছু না বলে সূরা কে পাশ কাটিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। মুহুর্তেই ধুলো উড়িয়ে গাড়িটি চোখের আড়াল হয়ে যায়।।এতক্ষণ রায়হান আয়েসি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে।সূরা এবার রায়হান কে বলল মিসবাহ কে ডাকতে। রায়হান যা বুঝার বুঝলো। আজ আর রক্ষে নেই। সূরায় সবাইকে রেস্টুরেন্টে ডেকেছে। জিহাদ, রাফি, সিহাব একপাশে বসে আছে, রায়হান, মিসবাহ একপাশে আর এক পাশে সূরা সবার মুখোমুখি বসে।সূরা শক্ত কন্ঠে আবার বলল

“আমি কিছু জিজ্ঞাসা করেছি? কেন মারলেন তাদের?”

মিসবাহ চেয়ারে গা এলিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে ফোন স্ক্রল করছে। দেখে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে সে আর তার ফোন ছাড়া অন্য সবকিছু এই মুহূর্তে তার কাছে তুচ্ছ। এখন ফোন স্ক্রল না করলে জীবন যৌবন সব বৃথা যাবে তার।সূরা কটমট করে মিসবাহর দিকে তাকায়। কিন্তু দেখো, মহামান্য মহাশয়ের আশেপাশের জাগতিক কোনো ভাবাবেগ থাকলে তো।সূরার গা রাগে ক্ষোভে রি রি করে উঠে।সে এবার বন্ধুদের দিকে হিংস্র চাহনি নিক্ষেপ করে। জিহাদ, রাফি, সিহাব একটু ঘাবড়ে গেলেও জিহাদ মেকি হেসে বলে

“ওই এমন করে চেয়ে আছোস ক্যান? বাচ্চার প্রান নিবি নাকি? আর বিদ্যার রানী, কে কাকে মেরেছে?তখন থেকে কি এক প্যাচাল নিয়ে পড়ে আছিস বলতো? আমি তো ভাবলাম তুই খাওয়াবি তাই রেস্টুরেন্টে ডেকেছিস। দেখ আমি খেয়েও আসিনি।”

রাফি আমতা আমতা করে বলল” হ্যাঁ আমিও তো না খেয়ে আসলাম। ভাবলাম তুই আমাদেরকে রেস্টুরেন্টের ভালো ভালো খাবার খাওয়াবি।”

সিহাব বলল” তাই তো। আমরা টিনা আর ওর ফ্রেন্ডস কে মারিনি বিশ্বাস কর।”

জিহাদ ব্যস্ত কন্ঠে বলল”হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি আমরা মারিনি ওদের।”

তাচ্ছিল্য হাসলো মিসবাহ। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তিনজন কে উদ্দেশ্য করে বলল “বলদ কোথাকার। ”

থতমত খেয়ে গেল ওরা।সূরা বাঁকা হেঁসে বলল”আমি তো একবারও টিনা বা তার ফ্রেন্ডস দের মারার কথা বলিনি।তাহলে তোরা জানলি কিভাবে আমি ওদের কথায় জানতে চাইছি? তোরাই মেরেছিস তাইনা?”

ওদের তিনজনের মুখ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। রায়হান এবার একটু নড়েচড়ে বসে।হাসি মুখে বলল

“সূরা ওরা তোমার সাথে যা করেছে তার জন্য ওদের আরো কঠিন শাস্তি পাপ্য।আর তাছাড়া আমরা যে মেরেছি এতো নিশ্চিত হয়ে কিভাবে বলছো তুমি?”

মিসবাহ চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো রায়হানের দিকে।এটা কোনো প্রশ্ন হলো। সবগুলো গাধা। রায়হান ঠোঁট উল্টে ইশারায় বোঝালো ওর মাথা আপাতত ফাঁকা মাঠে মতো।সূরা প্রশ্ন শুনে হাসলো। শান্ত স্বরে বলল

“আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার আজ প্রায় মাস পেরিয়েছে। কিন্তু ওরা আজ এসে মাফ চাইছে। ওদের হাত, মাথার ব্যান্ডেজ দেখে বোঝা যায় ক্ষতটা এখনো তাজা।আর আমার জানা মতে ওরা সেই ঘটনার পরে কেউই এখানে ছিল না। ডিপার্টমেন্ট থেকে স্টাডি ট্যুরে গিয়েছিল কিছু দিনের জন্য।কাল সন্ধ্যায় এসেছে। আপনারা সুযোগ পেয়ে কাল ওদের মেরেছেন তাই তো?

চারজনের মুখ ছোট হয়ে গেল।তারা ভাবতে পারেনি সূরা বুঝে যাবে সব। জিহাদ বিরবির করে বললো “বিদ্যার রানীর জয় হোক।”

মিসবাহ বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে সূরার দিকে। ফোন টা টেবিলের উপরে রেখে আয়েস করে বসলো সে।হাত দিয়ে সামনের চুলগুলো যত্ন সহকারে পেছনে ঠেলে দিল।হালকা কেশে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো চারজন এবার মিসবাহর দিকে তাকিয়ে আছে একটু বাঁচার আশায়।এখন শেষ ভরসা মিসবাহ। সূরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মিসবাহর দিকে। মিসবাহর সহজ স্বীকারোক্তি

“তুমি একদম ঠিক ধরেছো।আমরা পাঁচজন মেরেছি তাঁদের।”

চারজনের চোয়াল ঝুলে পড়ার দশা।কি হলো ভরসা করে।সেই তো সূরা একটু পরে তাদের ফাঁসির রায় ঘোষণা দিল বলে। জিহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।আজ আর রক্ষে নেই ।সূরা শক্ত কন্ঠে বলে “কেন মেরেছেন?”

মিসবাহ নড়েচড়ে বসে। জিহাদ চোয়াল শক্ত করে বলে ” আমি,রাফি আর সিহাব মেরেছি আমাদের প্রানপ্রিয় বান্ধবীকে অসম্মান করার জন্য। কলেজের সবার সামনে তাকে অপমান করার জন্য। তোকে ওরা অসম্মান করবে আর আমরা এমনি এমনি ছেড়ে দিব ওদের।”

রায়হান মুচকি হেসে বলল “আর আমি মেরেছি আমার মিষ্টি পরী নামক বোনটাকে থাপ্পর মারার জন্য।তাকে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করার জন্য।বুঝলে মিষ্টি পরী।”

সূরা ছলছল চোখে হাসে। এই মানুষগুলোর এতো ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা কি আছে তার।জানা নেই সূরার।সূরা এবার মিসবাহর দিকে তাকায়। শান্ত স্বরে বলে
“আপনি কেন মেরেছেন স্যার?”

মিসবাহ ক্ষীন হাসলো।সূরার মুখোমুখি হয়ে শান্ত স্বরে নিজের মনের সরল স্বীকারোক্তি দিল

“তুমি কি জানো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে তোমাকে কলঙ্কিত করার অধিকার একমাত্র আমার।তোমার কলঙ্কে কলঙ্কিত হওয়ার অধিকারও একমাত্র আমার। তোমার কলঙ্কে কলঙ্ক গায়ে লেপ্টে নিব একমাত্র এই আমি। তোমাকে কলঙ্ক দেওয়ার অধিকার আমি কাউকে দেয়নি সুরজান।”

সূরার কপোল ছুঁয়ে একফোঁটা অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।সিক্ত করে কপোল, চিবুক, হৃদয়।সূরা ভেজা কন্ঠে বলল

“কলঙ্কিনী কে কলঙ্ক দিয়ে কলঙ্কিত করা যায় না ডাক্তার।”

মিসবাহ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার সুরজানের দিকে। সূরার অশ্রু মুছে দিতে নিজের হাতটা বাড়িয়েও আবার গুটিয়ে নেয়। তার প্রেয়সীর অশ্রু পরম যত্নে মুছে দেওয়ার অধিকার যে তার নেই।সূরা মিসবাহর গুটিয়ে নেওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে। ভেতরের যন্ত্রনা কাকে বোঝাবে সে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল ,”কেন হাত সরিয়ে নিলেন ডাক্তার?কেন আপনার ওই হাতের উষ্ণ ছোঁয়া আমার কপোলে অনুভব করতে দিলেন না। এই সমাজ নিষ্ঠুর কেন ডাক্তার?”কিন্তু হায়!বলতে পারলো কই। ভেতরের হাহাকার চাপা পড়ে গেল।সূরা নিজেকে সামলে ক্ষীন কন্ঠে বলল

“এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আমার জন্য না ডাক্তার।পরকালে আমার রব জান্নাতে আমায় পুরষ্কার হিসেবে কিছু দিতে চাইলে আমি আমার ডাক্তার কে চাইবো। তখন আমার হবেন তো?”

#চলবে……

(গল্প টা ভালো লাগলে ফলো এবং রেসপন্স করে পাশে থাকুন।পাঠক পাঠিকা আপনারা পাশে থাকলেই গল্প এগিয়ে নিতে সাহস পাবো নয়তো ইতি টানা লাগবে হয়তো।😢)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here