#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৩
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ চলছে। চারিদিকে ভ্যাপসা গরম। তরতর করে ঘাম ঝরছে সূরার। ভয়ে, অজানা আশংকায় কন্ঠনালী শুকিয়ে গেছে। বার বার শুকনো ঢক গিলেও কন্ঠনালী ভেজানো সম্ভব হচ্ছে না। হঠাৎ লক্ষ্য করলো বদমাশ ছেলে গুলো ওর হাত ছেড়ে দিয়ে ঠিক ওর পেছনে ভয় মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে আছে। কৌতূহলবশত পেছনে ঘুরতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল সূরার। মিসবাহ্ কে সূরা এখানে এই মুহূর্তে আশা করেনি। সূরা লক্ষ্য করলো জনাব আজকে ব্লাক শার্ট, ব্লাক ডেনিম প্যান্ট, চোখে সানগ্লাস, শুভ্র লোমশ হাতে শোভা পাচ্ছে ব্লাক ঘরি। ব্লাক মার্সিডিজ গাড়িতে একটু হেলিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলতে গেলে পুরোই ব্লাক কম্পানি। স্টাইল দেখেই সূরার শরীর রাগে ,ক্ষোভে, দুঃখে জ্বলে উঠলো। সে বিপদে পড়েছে আর ওই দিকে মহামান্য মহাশয় স্টাইল নিয়ে ব্যস্ত। সূরার মনে হলো মিসবাহর শুভ্র মুখে কয়লার কালি মাখিয়ে দিতে। কিন্তু সূরার বেহায়া মন বলছে লোকটাকে আজ একটু বেশিই সুদর্শন লাগছে। একটু বেশিই আকর্ষণীয়। ছেলেরা এতো আকর্ষণীয় হতে নেই এই হাড় জ্বালানো বজ্জাত লোকটা কি জানে না? নাকি মেয়েদের এ্যটেনশান পাওয়ার পাঁয়তারা করছে। অসভ্য বেহায়া লোক একটা। সুন্দর শব্দটা মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এখানে ঠিক উল্টো। এই লোকটাকে সাংঘাতিক মাত্রায় সুদর্শন পুরুষ বলা চলে। সূরা মনকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। রাগ হচ্ছে তার। খুব রাগ। এদিকে মিসবাহ্ তার নয়নাক্ষীকে দেখছে। রাগে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। মেয়েটি উজ্জ্বল শ্যামলা। চোখে মুখে অঢেল মায়া ।এক কথায় মিসবাহর প্রাণনাশিনী সে। তার প্রাণভোমরা। নাহ্ আর সহ্য হলো না সূরার। মুখের কাপড় সরিয়ে ইচ্ছা মতো ছেলে তিনটাকে ব্যাগ দিয়ে মারতে শুরু করল।
“হা***জাদা,গা**ধার দল, আমাকে নিয়ে যাস। চিনিস আমি কে? গ্ৰামের মেয়ে আমি। নাম ইনশিরাহ্ সূরা। কু***দল একদম মেরে গুম করে দিব।”
সূরার কাছে মার খেয়ে ছেলে তিনটা কোনো মতে জান নিয়ে পালিয়ে গেল। এখানে থাকা মানে মৃত্যু কে আহ্বান করা। মিসবাহ কে ওরা আগে থেকেই চিনে। এই মানুষ বেশি সুবিধাজনক না। সূরা হাপিয়ে গেছে।হাটুতে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সূরা। গলা শুকিয়ে গেছে। একটু পানি প্রয়োজন। মিসবাহ্ সামনে এসে পানি এগিয়ে দিল।
“পানি খাও। গালাগালি করে হাপিয়ে গেছো। তোমার মুখ থেকে বর্ষিত পুষ্প ঝরার ফলে কন্ঠনালী অবরোধ করছে।একটু ভিজিয়ে নাও।”
সূরার মনে হলো ওর শরীরে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এটা কোনো কথা। গালাগালি করে নাকি গলা শুকিয়ে গেছে।আর ওর যে ভয়ে জান পাখি যায় যায় সেটা কিছু না। নিজে তো নবাব মিসবাহ্ হয়ে দাড়িয়ে ছিলেন আর এদিকে একটা মেয়ে যে ওদের মারলো সেটা চোখে পরল না। শুধু গালাগালি করতে দেখলো। চোখে কি ন্যাবা হয়েছে। যত্তসব! সূরা রাগে পানি লাগবেনা বলতে চাইলেও কি মনে করে বললো না। হাত বাড়িয়ে পানি নিয়ে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিল সে। এবার শান্তি লাগছে। সূরা কিছু না বলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে মিসবাহ্ শান্ত স্বরে বলে উঠলো
“সুর আজ থেকে আমি তোমাকে বাড়ি পৌছে দিব এবং তুমি যেখানে যাবে তোমাকে দিয়ে আসব। একা চলাফেরা করার প্রয়োজন নাই।”
সূরা মিসবাহর শান্ত চোখে চোখ রাখল। এই লোকটার চোখের গভীরে কি জানি খুজে পায় সূরা। বেশিক্ষণ তাকানো যায়না সে চোখে। চোখ সরিয়ে নেয় সে। কঠিন স্বরে বলল
“দেখুন দয়া করে দূরে থাকুন আমার থেকে। আপনি কি বুঝতে পারেন না আমি আপনার সান্নিধ্য চাই না। আমি নিজেকে রক্ষা করতে জানি। এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতিতে আমি নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেছি। আমার আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”
মিসবাহ্ জানে তার সুনয়নী বড্ডো নিষ্ঠুর। আগের মতোই শান্ত, গম্ভীর গলায় বলল
“জেদ করোনা সুর। গাড়িতে ওঠো।”
সূরা একটু চেঁচিয়ে উঠল
“আমাকে সুর বলে ডাকবেন না। আমি এই অধিকার আপনাকে দিইনি। আমাকে সুর বলে শুধু আমার আপন মানুষ ডাকে। আর কেউ না। আপনি আমার কেউ না। বুঝতে পেরেছেন।”
স্মিত হাসি ফুটে উঠল মিসবাহের ঠোঁটে। সূরার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল
সে
“সুর বলার অধিকার শুধু তোমার আপনজন দের আছে তাইতো? কিন্তু তুমি কি জানো মাকহুল সিকদার মিসবাহ্ কে কখনো কেউ অধিকার দেওয়ার অধিকার রাখে না। আমার অধিকার আমি নিয়ে নিতে জানি। সুরজান তুমি বড্ডো অবুঝ। তুমি কি জানো তোমার চোখের ভাষা আমি বুঝি। আর ঘাড়ত্যারামি না করে গাড়িতে ওঠো। গো নাউ।”
শেষের কথাটা একটু জোরে বলল মিসবাহ। ঈষৎ কেঁপে উঠল সূরা। এভাবে কেউ ধমকায়?বাজে লোক। তোর বিয়ে হবেনা।বিয়ে হলেও পেত্নী হবে তোর বউ । বাসর করতে পারবি না তার আগেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাথরুমে কাটাবি সারা রাত। অসভ্য অসভ্য অসভ্য লোক। আরশোলার জুস খাওয়াবো আমি তোকে। বজ্জাত একটা। সূরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে ওঠে বসল। মিসবাহ ডাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল
“এবার থামো। আর কতো গালাগালি করবে আমাকে। বিষম খাবো তো এবার।”
সূরা চমকে উঠলো। পাশে মিসবাহর দিকে তাকিয়ে দেখলো মিসবাহ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি তার। লোকটাকে হাসলে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। চোখ বন্ধ করে নিল সূরা। জানালার দিকে মুখ করে বসে রইল।আড়চোখে কয়েক বার মিসবাহর দিকে তাকিয়ে ছিল সূরা। যতবার তাকিয়েছে ততবারই দেখা মিলেছে মিসবাহর ঠোঁটে মোহনীয় হাসি। লোকটাকে হাসলে মন্দ লাগে না। বাসার কাছে এসে গাড়ি থামাতেই সূরা কোনোদিকে না তাকিয়ে নেমে বাসায় চলে যায়। এতক্ষণ ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এই লোকটা আশেপাশে থাকলেই অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। সূরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিসবাহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিরবির করে বলে
“পৃথিবীর নিষ্ঠুর কন্যা তুমি। একরাশ মুগ্ধতা তুমি সুরজান। তুমি কি বোঝো তোমার সান্নিধ্য পাওয়ার লোভে এই লোভীর আঁখিজোরা তৃষ্ণার্ত। বোঝো না নিষ্ঠুর শ্যামকন্যা।”
সূরা চোখের আড়াল হতেই মিসবাহর চোখে হিংস্রতা প্রকাশ পায়। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বাঁকা হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয় সে।
★★★★★★
রাত্রির বারোটার কাঁটা অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। তবু সুখনীড়ে তিনজোরা চোখে ঘুম নেই। বাড়ির ছেলে এখনো আসেনি।সবার চোখের মনি সে। মাহমুদ সিকদার এবং তার সহধর্মিণী মুনতাহা সিকদার তাদের ছেলে ফেরার অপেক্ষায় বসে আছেন। ষোড়শী কন্যা মেহেরও জেগে ভাই এর জন্য অপেক্ষা করছে। সুখনীড়ে সুখের অভাব নেই। মাহমুদ সিকদারের বাবা দাদারা ছিলেন জমিদার মানুষ। তার দাদার একটাই ছেলে আর তিনি হলেন তার বাবা। এদিকে মাহমুদ সিকদারের বাবার দুই ছেলে এক মেয়ে। তার বোন এখন কানাডায় স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করছেন। ছোট ভাই কোথায় আছে কেমন আছে তিনি জানেন না। ভাইটা তার বড়ো আদরের ছিল। একটা ভুলের জন্য হারিয়ে ফেলল। ভাইয়ের কথা মনে হলে এখনো হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয় তার। বাবার অঢেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও মাহমুদ সিকদার নিজে কিছু করতে চেয়েছিলেন। এখন ঢাকা শহরে নামকরা প্রাইভেট হাসপাতাল আছে তার। তিনি চান তার সন্তানরাও তার মতো কিছু করুক। বাবার টাকায় না নিজের যোগ্যতায়। ছেলে তার যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। সে এখন প্রফেসর পাশাপাশি তার হসপিটালের একজন নামকরা হার্ট সার্জন। মেয়েটি ভারি মিষ্টি। দশম শ্রেণীতে পরছে। ডুপ্লেক্স বাড়িটি বাইরে থেকে বেশ নজরকাড়া। ভেতরে আরো বেশি সুন্দর করে সাজানো। বাড়ির প্রত্যেকটা রাজকীয় আসবাবপত্র সাজানো দেখেই যে কেউ বলতে বাধ্য এই বাড়ি ভালোবাসা দিয়ে মুড়িয়ে রাখা। রাত সাড়ে বারোটার দিকে মিসবাহকে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে মুনতাহা সিকদার বসা থেকে উঠে দাড়ালেন। কঠিন স্বরে বলে উঠলেন
“ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে আসো। তোমার জন্য সবাই না খেয়ে বসে আছে।”
মায়ের কথা শুনে মিসবাহ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।সে বুঝে না এতোবার বলার পরেও না খেয়ে অপেক্ষা করার মানে কি? এই নিয়ম জমিদারদের বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। তার বাবার মতে সারাদিন সবাই ব্যস্ত থাকলেও রাতের খাবার যেনো একসাথে খাওয়া হয়। কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে নিজের জন্য নির্ধারিত রুমে চলে গেল মিসবাহ। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পরল সে। ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন। বেসিনে হাত ধুতেই লাল তরল জাতীয় পদার্থে পানি প্রায় রক্তিম হয়ে উঠলো। বাঁকা হাসলো মিসবাহ।
চলবে…..