#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
(অনুমতি ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
“বন্ধু চলে গেছে?”
মিশুর প্রশ্নে আরিফা জামান একটু চিন্তিত হলেন যদি একবার হায়পার হয়ে যায় তাহলে সর্বনাশ। তিনি মিশুর কথা সামাল দিতে বললেন,,
‘হ্যা বাড়ি চলে গেছে!”
‘বন্ধু আমাকে না বলেই চলে গেল।”
“তোমার বন্ধুর একটু কাজ ছিল তাই।”
“বন্ধু আর আসবে না তাই না ? আমায় ছেড়ে চলে গেছে।”
‘না না আসবে তো । এখন থেকে তোমার বন্ধু এই গ্ৰামেই থাকবে।”
“আমি বন্ধুর কাছে যাবো।”
‘তুমি না অসুস্থ একটু সুস্থ হয়ে নাও তারপরে যেও।”
‘না আমি এখনি যাবো!”
‘এখন যাওয়া যাবে না।”
এবার মিশু চিৎকার করে টেবিলে থাকা ফুলদানি টা ফেলে দিয়ে বলল,,
“না আমি যাবো! যাবো! যাবো!”
‘মিশু চিৎকার করো না এখন যাওয়া যাবে না।”
‘না আমি এখনই যাবো।”
মিশুর চিৎকারে শেখ শাহনাওয়াজ চলে এলেন। ততক্ষণে মিশু বিছানা ছেড়ে নেমেছে। তিনি এসে মিশুর মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,,
‘কি হয়েছে আমার মিশুমনির?”
‘আমি বন্ধুর কাছে যাবো। কিন্তু আমাকে যেতে দিচ্ছে না বাবা।”
‘আচ্ছা এই ব্যাপার। আজ আর যেতে হবে না কাল যেও। কারন তোমার বন্ধু সেই শহর থেকে এসেছে এখন বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিচ্ছে। আমরা কাল যাবো ঠিক আছে।”
‘আমি এখন যাবো বাবা!”
‘তুমি কি চাও তোমার বন্ধু কষ্ট পাক।”
“আমি গেলে বন্ধুর কষ্ট লাগবে নাকি। বন্ধু আমায় দেখে খুশি হবে তো যেভাবে আমি খুশি হলাম বন্ধুকে বন্ধু বানিয়ে।
“আসলে তোমার বন্ধু এখন রেস্ট নিচ্ছে। যদি এটুকু রেস্ট না নেয় তাহলে তোমার বন্ধুর শরীর খারাপ করবে।”
“আচ্ছা তাহলে আমি আজ যাবো না। কাল যাবো ঠিক আছে।
“এই তো গুড গার্ল। চলো চলো এখন একটু ঘুমিয়ে নাও বন্ধু কি বলেছিল ঘুমাতে।”
‘আমি ঘুমিয়ে গেলে তুমি আবার চলে যাবে না তো?”
‘না না আজ আমি কোথাও যাবো না। কারন আজ আমার কোন কাজ নেই। চলো তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
“হুম হুম চলো।”
মিশু গিয়ে শুয়ে পরলো শেখ শাহনাওয়াজ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আজ প্রথম তার মেয়েটা কারো কাছে যাওয়ার জন্য জেদ করেছে। যে কিনা অপরিচিত মানুষ দেখলে ভয় পায়। বাড়ি থেকে কোথাও যেতে চায় না। তার মেয়েটা তো এমন ছিল না বুদ্ধিমতী একটা প্রানোচ্ছল মেয়ে ছিল। কি থেকে কি হয়ে গেল ভাবতে ভাবতেই ওনার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। আজ খুব করে নিজেকে ভিশন অপরাধী লাগছে তার।
________________
‘ঐ তুই কেরা লো?”
হুট করে এমন কারো কথায় মেহবিন পাশে তাকালো । সেখানে তাকিয়ে সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলো। প্রশ্নটা সেই করেছে । অবশ্য তার পেছনে আরো একটা মেয়ে ছিল তার সমবয়সী। মেহবিন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। আসলে ও বোঝার চেষ্টা করলো প্রশ্নটা তাকেই করেছে নাকি। মেয়েটা আবার বলল,,
‘তাকাই রইছোস কেন? তুই কাগো বাড়ি আইসোস? আমারে চিনোস?”
মেহবিন মাথা নাড়িয়ে মুখ দিয়ে বলল,,
‘না তো চিনি না।”
‘কইলাম না আমি তাজেল তুই চিনোস না ক্যা! আমার গ্ৰামে আইসা আমারে চিনোস না।
“আপনি কখন বললেন আপনি তাজেল? তাছাড়া আমি আপনাকে চিনবো কিভাবে? আমি তো নতুন আজকেই এসেছি।”
‘ও কুলসুম দ্যাখ হেতি আমারে আপনি কইরা কয়।”
বলেই মেয়েটা একটু বোকার মতো হাসতে লাগলো। সাথে অন্য মেয়েটাও তাল মেলালো। তখন মেহবিন বলল,,
“এই আপনারা হাসছেন কেন?”
“তুই আমারে আপনি কইরা কইলি দেইখা।”
‘ওহ আচ্ছা তাই বুঝি। এটা তো আপনার গ্ৰাম আপনার একটা সম্মান আছে না। তাই সম্মান প্রদর্শন করলাম।”
“এতো ভারি ভারি কথা আমার মগজে ঢুকবো না।”
“বড়দের তুই করে বলা ব্যাড ম্যানার্স।”
“বাঁধ মানার!! এনে বাঁধ আবার আইলো কোন থেইকা ?
মেয়েটার এরকম কথা শুনে মেহবিন হাসলো। আর বলল,,
“ব্যাড ম্যানার্স মানে খারাপ আচরন বোঝায়। বড়দের তুই করে বলা উচিৎ না। বড়দের তুমি বা আপনি করে বলতে হয়।”
“তুই তো দেহি নওশি আপার মতো কথা কইতেসোস। নওশি আপাও কয় বড় গো আপনি নাইলে তুমি কইরা কইতে। আচ্ছা তাইলে আমি তোরে তুমি কইরা কমু ঠিক আছে।
“আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু নওশি কে?”
“আমার এক আপা। জানো হে কলেজে পরে।”
“ওহ আচ্ছা!”
“তুমি কি ম্যাডাম? কতো সুন্দর কইরা কতা কও।”
“না আমি ডাক্তার।”
“ওহ তুমি ডাক্তার! ঐ যে সুই দেয়।”
‘ডাক্তাররা কি শুধু ইনজেকশন দেয় আর কিছু করে না।”
“ঐ একটা হইলো আইচ্ছা তুমি কাগো বাড়ি আইছো।”
‘কারো বাড়ি না আমি এখানের হাসপাতালের ডাক্তার ঐ যে বাড়িটা দেখতেছেন ওখানে আমি থাকবো। আজকেই উঠেছি।”
তাজেল নামের মেয়েটা মাথা উঁচু করে দেখলো তারপর বলল,,
‘তুমি ঐ বাড়িতে থাকবা। ঐ বাড়িতে আগে কেও থাকতো না।তা তুমি এই হানে ক্যান বাড়ি ছাইড়া।”
“একটু দোকানে যাবো কিছু জিনিস কিনতে তাই রাস্তায় এসেছি। আপনি যাবেন আমার সাথে আপনাকে চকলেট কিনে দেব।”
“চকলেট কি? তুমি যদি লজেন কিনা দাও তাইলে যামু।”
মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
“আচ্ছা ঠিক আছে লজেন্স দেব।”
“ঐ কুলসুম তুই যাবি চল ডাক্তার লজেন দেব কইছে।”
“হ তাইলে আমিও যামু।”
বলেই মেয়েটা হেঁসে তাজেলের কাছে এলো। মেহবিন হেঁসে ওদের নিয়ে গেল। প্রয়োজনীয় কিছু কিনলো আর ওদের চিপস চকলেট কিনে দিল। ওদের খুশি আর দেখে কে। কুলসুম নামক মেয়েটা চলে গেল চকলেট পেয়ে মেহবিনের অনেক বেশি ব্যাগ হলো দেখে তাজেল বলল,,
“দুইটা ব্যাগ আমারে দাও আমি নিয়া যাইতেছি।”
“লাগবে না আমি পারবো। আচ্ছা আপনার নাম যেন কি বলছিলেন?’
“আমার নাম হইলো শেখ তাজেল! শেখ আমি লাগাইছি আর আব্বা আম্মায় তাজেল রাখছিল।”
“কেন তুমি শেখ লাগিয়েছো কেন?”
“আমি বড় হয়ে নেতা হমু ঐ শেখ হাসিনার মতো তাই। আমগো শেখ হাসিনা দেশ শাসন করে। আমিও দেশ শাসন করুম সবাই আমার কথা হুনবো। তাই শেখ লাগাইছি। তাছাড়া আরেকটা কারনে লাগাইছি আমগো চেয়ারম্যান এর নাম শেখ কি জানি অনেক বড় নাম।আমগো গ্ৰামের সবাই তার কথা হুনে।
“শেখ শাহনাওয়াজ তোমাদের চেয়ারম্যান এর নাম। তা আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে কি করবেন? আর চেয়ারম্যান সাহেব এর নাম শেখ দেখে কেন লাগিয়েছেন।”
“শখ হইছে আমার তাই । তাছাড়া তাগো সাথে আর আমার সাথে অনেক মিল খালি আমার এই জায়গায় না আছে।”
“মানে?”
“মানে হইলো সবাই তাগো কথা হুনে কিন্তু আমার কথা কেউ হুনে না। এই হইলো আমার কাছে না আছে। আর তুমি আমারে তুমি কইরা কোন কেন জানি আমার শরম করতাছে।
“তুমি আবার লজ্জা পাও আচ্ছা তাহলে তুমি করেই বল। আর হ্যা তুমি তো নেতা হতে চাও তাহলে আমি তোমায় নেত্রী বলে ডাকবো।
“আমি তো নেতা হমু তুমি নেত্রী ডাকবা কেন নেতাই ডাকবা। তাছাড়া আমার নাম তাজেল তুমি নেত্রী ডাকবা কেন?
“নেতা বলে নেতা ছেলেদের কিন্তু মেয়ে নেতাদের নেত্রী বলে তাই ডাকবো। তুমি যদি শখ করে শেখ লাগাইতে পারো। তাহলে আজ থেকে আমিও শখ করে তোমায় নেত্রী ডাকবো ঠিক আছে।”
তাজেল দাঁত কেলিয়ে বলল,,
“তাইলে আইচ্ছা।”
মেয়েটা যে কথা গুলো বললো আদতেও এর মানে বোঝে কিনা সেটা জানা নেই মেহবিনের। মেয়েটাকে ভালো করে দেখলো মেহবিন গায়ের রঙ শ্যামলা চুলগুলো এলোমেলো একটা সুতির জামা আর ওপরে সোয়েটার পরে আছে। তবে মেয়েটাকে বেশ লেগেছে তার। মেয়েটার ভেতরে নেতা নেতা একটা ভাব আছে তাই তো সে নেত্রী নাম দিল। বাড়ি এসে যাওয়াতে তাজেল চলে গেল। মেহবিন ও ঢুকলো বাড়িতে। এখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলো। এখানে গ্যাসের চুলা নেই তাই শুকনো খাবার নিয়ে এলো। কাল আনতে হবে সব প্রয়োজনীয় জিনিস সবার আগে একটা ফ্রিজ লাগবে। ভাবতে ভাবতেই ভেতরে ঢুকলো। গ্ৰামের প্রথম রাত টা অন্যরকম একটা অনুভুতি দিল একা দেখে একটু অনুভূতি টা অন্যরকম।
_________________
পরের দিন সকাল বেলা আবুল আর ওর বউ আসলো মেহবিন এর জন্য খাবার নিয়ে। মেহবিন প্রথমে দেখে অবাক হলেও মুখে হাঁসি ফুটে উঠল আর বলল,,
“আবুল ভাই এসবের কি দরকার ছিল?”
“এই বাড়িতে চুলা নাই কাল ফাতেমার মা কইছে আমারে। আর সকালে হেই রান্না কইরা আনছে নাও খাইয়া নাও। দুপুরের জন্য ও আনছি রাতের টা বিকেলে ফাতেমা দিয়া যাইবোনে।”
“ভাবি এসবের আবার!”
“কোনসব আবার তুমি না খাইয়া থাকবা নি। আর একটাও কথা না নাও খাইয়া লও। বিকেলে ফাতেমা আসবোনে আমি অহন যাইগা বাড়িতে কাম আছে।”
“বিকেলে ফাতেমার আসতে হবে না। কিছুক্ষণ পর আমার জিনিসপত্র চলে আসবে সব। আবুল ভাই আপনি একটু থাকেন সাহায্য লাগবে তারা এসে পরছে স্টেশনে।”
“আচ্ছা তাইলে ফাতেমার মা তুমি বাড়ি যাও আমি আফার কাম কইরা একেবারে স্টেশনে যামু।”
যাওয়ার আগে মেহবিন ফাতেমা আর ওর ভাইয়ের জন্য চকলেট দিয়ে দিল। তার কিছুক্ষণ পর একটা মিনি ট্রাকে একটা ফ্রিজ গ্যাসের চুলা মাইক্রোওভেন আরো কিছু জিনিস পত্র এলো মহুয়াপুরে। মেহবিন কে দিতে এসেছে এগুলো। মেহবিনের বাড়ির পাকা রাস্তায় গাড়িটা থামতেই আশেপাশের কিছু মানুষ এগিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে জানতে পারলো মেহবিনের বাড়িতে এসেছে । কিছুক্ষণ পর মেহবিন একটা ফোন কানে নিয়ে রাস্তায় আসলো। দুই জনের সাহায্য নিয়ে ওগুলো ভেতরে ঢুকানো হলো। সকলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো কিন্তু কেউ কিছু বললো না। গ্ৰামের মানুষদের এটাই নিয়ম তারা সবকিছু খুব মনোযোগ দিয়ে দেখবে। কার বাড়ি কে এলো আর কি জিনিসপত্র ঢুকলো।
বিকেল বেলা মেহবিন ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল তখন একজন এলো বাইরে থেকে কেউ ডাকছে। মেহবিন বাইরে বের হয়ে দেখলো ওর নামে পার্সেল এসেছে। একটা ছোট্ট বক্স মেহবিন পার্সেলটা নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। পেছনের বারান্দায় একটা দোলনা আছে সেখানে গিয়ে খুললো প্রথমেই কয়েকটা লাল গোলাপ আর চকলেট দেখতে পেল। তার নিচে চিঠি ফুল গুলো একবার ছুঁয়ে তারপর চিঠিটা খুললো তাতে লেখা,,
প্রিয় বিহঙ্গিনী,
“অবসর সময়ে যদি আমায় মনে পড়ে!! তাহলে একটা চিঠি লিখিও, আর যত্ন করে রেখে দিও, যখন আমাদের দেখা হবে তখন না হয় দিয়ে দিও।
~ ইতি তোমার নামকরনে রাঙানো কাব্য
এটাকে চিঠি বলবে না চিরকুট জানা নেই মেহবিনের। কিন্তু যাই হোক না কেন মেহবিনের মুখে হাঁসি ফোটাতে যথেষ্ট। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
প্রিয় কাব্য,,
“আপনি কি জানেন আপনি আমার অবসরে নয়! আমার সবসময়ে বিরাজ করেন। আপনাকে নিয়ে ভাবার অসীম সময় আমার। আর চিঠি তা তো আছেই অগুনিত।”
_____________
আজ মেহবিনের প্রথম হাসপাতালে যাওয়ার দিন। আবুল কে বলে রেখেছিলো সে এসেছে নিতে। ঘরে তালা মারলো কিন্তু গেট এ তালা না এমনি খোলা রেখেই গেল। হাসপাতালে যাওয়ার পর কয়েকজন বেশ ভালোভাবেই তাকে স্বাগতম জানালো। মেহবিন ভেবেছিল গ্ৰামের হাসপাতাল বেশ ছোট হবে কিন্তু না এই হাসপাতাল বেশ অনেকটাই বড় প্রথমে এটা দেখে অবাক হয়েছে। প্রথম দিনেই বেশ চাপ মেহবিনের যাওয়ার পরেই রুগী দেখতে লাগলো বাকি ডাক্তাররা বলেছিল আজ প্রথম দিন থাক কাল থেকে দেখবে না হয়। মেহবিন তা শোনার মানুষ নাকি সে ঠিকই দেখলো। বড় সরকারি হাসপাতাল দেখে অনেক দূর থেকেও এখানে আসে সকলে। সারাটা দিন বেশ চাপেই গেল তার ডিউটি সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।
“ঐ ডাক্তার তাড়াতাড়ি আসো?
পাকা রাস্তার সামনে তাজেল কে দেখে মেহবিন বলল,,
“কেন নেত্রী তাড়াতাড়ি গিয়ে কি হবে?”
“তোমার খোঁজে চেয়ারম্যান আইছে। তোমার লাইগা অপেক্ষা করতাছে অনেকক্ষণ ধইরা।”
“ওহ আচ্ছা!”
তাজেলের কথায় মেহবিন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আসলো। সে হাসপাতাল থেকে হেঁটেই আসছিল ওখান থেকে পঁচিশ মিনিট হাঁটলেই বাড়ি। মেহবিন এসে দেখলো শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। তিনি মেহবিন কে দেখে বললেন,,
“আপনাকে আমার সাথে একটু যেতে হবে। মিশু দুদিন ধরে আপনার কাছে আসতে চাইছিল কিন্তু বাড়ি থেকে বের করা একটু রিস্ক।”
“কাউকে দিয়ে খবর পাঠাতে পারতেন আমি এমনিই চলে যেতাম। আপনার আসার কি দরকার ছিল চেয়ারম্যান সাহেব। একটা কথা মনে রাখবেন সব কাজ সবাইকে মানায় না।”
“অনেক সময় না মানালেও পরিস্থিতির চাপে পড়ে অনেক কিছু করতে হয়।”
“হুম বুঝলাম!”
“কি বুঝলেন?”
“অনেক কিছুই বাদ দিন আপনি যান আমি আসছি।”
“মিশুকে বলেছি আমিই আপনাকে নিয়ে যাবো। তাই আমার সাথে গেলে উপকার হয়।”
“আপনি যাওয়ার পাঁচ মিনিট পর ওখানে পাবেন আমাকে। হাসপাতাল থেকে এলাম ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে আসি।”
“ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করছি।”
“অপেক্ষা করতে হবে না আপনি যান।”
“এখানে আপনি নতুন একা যাওয়া ঠিক হবে না।”
“একজন চেয়ারম্যান এর সাথে একজন নতুন মেয়ে একসাথে যাওয়াও ঠিক হবে না চেয়ারম্যান সাহেব।”
শেখ শাহনাওয়াজ একবার মেহবিনের দিকে তাকালেন। মেহবিন মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে উনি সামনের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। তা দেখে মেহবিন ভেতরে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে আবার বের হলো যদিও টায়ার্ড লাগছে কিন্তু কিছুই করার নেই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে এই জন্যই বোধহয় চেয়ারম্যান নিয়ে যেতে চাইছিলো। এই বাড়ি থেকে চেয়ারম্যান বাড়ি বেশি দূরে নয় দশ মিনিটের রাস্তা। মেহবিন তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো। ভেতরে ঢুকতেই মিশু বলল,,
“এই তোমার আসার সময় হলো বন্ধু! আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি।”
মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
“হাসপাতালে গিয়েছিলাম। একটু আগে এলাম তারপর চেয়ারম্যান সাহেব বলল তুমি আমার সাথে দেখা করতে চাও তাই এলাম।”
“ভালো করেছো বাবা আমার সব কথা রাখে এই জন্যই তো আমি বাবা কে অনেক ভালোবাসি।”
“তাই বুঝি!”
“হুম এখন চলো। আমি তোমাকে আমার ঘর দেখাই। তারপর আমরা অনেক কথা বলবো আর খেলবো ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে।”
তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
“আপনি মিশুর মনের মতো ওকে সময় দেন রাত হলেও সমস্যা নেই। আপনাকে ভালোভাবে পৌঁছে দেওয়া হবে। আপনার সাথেই আমার মেয়ে এতো তাড়াতাড়ি সহজ হয়েছে আর এটা ভালো লক্ষণ এভাবে চলতে থাকলে আমার মেয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। তাই আপনার যদি একটু কষ্ট ও হয় একটু মানিয়ে নিয়েন।”
মেহবিন কিছু না বলে মুচকি হেসে চলে গেল। ওরা যাওয়ার পর আরিফা জামান বললেন,
“এই মেয়েটাকে মিশুর সাথে মিশতে দেওয়া কি ঠিক হলো। চেনা নেই জানা নেই যদি কোন খারাপ মতলব থাকে।’
“এসব তোমার ভাবতে হবে না আমার মেয়ের কিসে ভালো সেটা একসময় না জানলেও এখন জানি।”
“আচ্ছা বাদ দেন এসব কথা বাবা কবে ফিরবেন?”
“আমি জানি না ওনার সাথে কথা হয় নি।”
“আরবাজ কবে ফিরবে?”
“ওর যখন সময় হবে তখন আসবে।”
“ওহ আচ্ছা!”
______________
ফেসবুকে স্কল করার সময় নতুন এক পোষ্ট সামনে হলো । “কাব্যের বিহঙ্গিনী” পেজ থেকে নতুন এক পোষ্ট করা হয়েছে। সেখানে লেখা ,,,
“মানুষ কি অদ্ভুত তাইনা নিজেরাই কষ্ট দিয়ে বলে কষ্ট হলেও মানিয়ে নিয়েন।”
লেখাটা মাত্রই পোস্ট করা হয়েছে তবুও ধীরে ধীরে যেন লাইক কমেন্টের বন্যা বইয়ে যাচ্ছে। হয়তো সত্যি কথা লিখেছে বলে। মুহুর্তেই চোখটা যেন ভরে উঠতে চাইলো। তখন আওয়াজ এলো ,,,
“কিরে মুখর এতো মনোযোগ দিয়ে কি ভাবিস?”
“বিহঙ্গিনী খুব কষ্টে আছে।”
“কি বললি!”
“আব কিছু না! বিহঙ্গিনীর নতুন পোস্ট দেখেছিস আরবাজ।”
“হুম মাত্রই করেছে মুক্ত নীড় হারা বিহঙ্গিনী বোধহয় ভালো নেই মুখর!”
মুখর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,
“এ আর নতুন কি? এতো কিছুর পরেও নিজেকে সবথেকে সুখী ভাবে সে! যাই হোক বাড়ি যাবি কবে?
‘এখন তো তাড়াতাড়িই যেতে হবে মনে হচ্ছে।”
“দুই দিন পর কাজ কম্পিলিট হয়ে যাবে তারপরেই যাবো। বেশিদিন তার অপেক্ষা করতে হবে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আমি যাই হ্যা আজ দুই বন্ধু অনেক আড্ডা হলো।”
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।ফি আমানিল্লাহ!
“ইনশাআল্লাহ আল্লাহ হাফেজ!”
বলেই সে চায়ের দোকান থেকে উঠে এলো। তখনি একটা ফোন এলো সালাম দিয়ে ধরতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,,
“মুখর কমিশনার স্যার তোমাকে দেখা করতে বলেছে ইটস্ আর্জেন্ট।”
“ওকে স্যার আমি এখনি যাচ্ছি।”
_____________
“মে আই কাম ইন স্যার?”
“ইয়েস কাম!”
“স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?”
“হ্যা মূখর! বসো।
মূখর বসলো তারপর কমিশনার স্যার বললেন,,
“তোমার ট্রান্সফার হয়েছে মূখর!”
“কিন্তু কেন স্যার?”
“অপরাধীদের শাস্তি দিতে। মহুয়াপুর গ্ৰামে কয়েকমাস আগে একটা ডাক্তারের খুন হয়েছে কিন্তু ওখানকার পুলিশ এখনো এর অপরাধী কে ধরতে তো দূর শনাক্ত করতে পারে নি। এমনকি ঐ এলাকার সুইসাইড কেস ও বেড়ে গেছে । গোপন সুত্রে জানা গেছে ওখানে কিছু লোক উধাও ও হচ্ছে। আরো অনেক কিছু ঘটছে কিন্তু ওখানকার পুলিশের এটা নিয়ে কোন হেলদোল নেই। আমি যদি ভুল না হই ওখানের পুলিশ স্টেশনে কোন ঘাপলা আছে তাই ঐ গ্ৰামভুক্ত থানায় তোমাকে প্রমোশন দিয়ে ঐ পুলিশ স্টেশনের ইনচার্জ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। এরকম একটা জায়গায় তোমার থেকে যোগ্য কাউকে পাইনি আমি। আশা করি নিরাশ হবো না।”
“ইনশাআল্লাহ স্যার।”
“আমি জানতাম তুমি এমনটাই বলবে।”
“দোয়া করবেন স্যার আমি যাতে ঐ থানার সকল অপরাধকে মুছে দিতে পারি।”
“ইনশাআল্লাহ তুমি জয়ী হবে।”
“ধন্যবাদ স্যার।”
বলেই মুখর স্যালুট দিল । কমিশনার মুচকি হেসে বলল,,
“মুখর শাহরিয়ার এর ইউনিফর্ম এ আরো একটা স্টার যুক্ত হলো। এটা কিন্তু কমিশনার নয় তোমার বাবা বলছে।”
“বাবা তুমিও না।”
“এটা আমার অফিস তোমার বাড়ি না।”
“সরি স্যার।”
“আরে মজা করছিলাম আয় বুকে আয় আজ বড় একটা প্রাপ্তি তোর। আই এম প্রাউড অফ ইউ।
মুখর হেঁসে ওর বাবাকে জরিয়ে ধরলো। আর বলল,,
“তুমি কি খুশি দিলে তোমায় বোঝাতে পারবো না। না চাইতেও কতো বড় উপকার করেছো তার বিন্দুমাত্র ধারনা তোমার নেই।”
মাহফুজ শাহরিয়ার ছেলেকে সামনে দার করিয়ে বলল,,
“আছে আছে ধারনা আছে তাই তো আরো আগে পাঠাচ্ছি।”
“তার মানে তুমি জানো?”
‘তার বিশেষত্ব এটা এই কারনেই আমি তাকে এতো স্নেহ করি। কিন্তু আপনার ট্রান্সফারের কথা শুনে আপনাদের বাড়ির চিফ হোম মিনিস্টার কিন্তু সেই ক্ষেপে যাবে আর দোষ টা তার ঘাড়ে চাপাতে চাইবে দেখে নিয়েন।
মুখর হেঁসে বলল,,
“দাদিজান না এখন আর আগের মতো নেই সেদিনের পর এই চার বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। হয়তো নিজেকে দোষী ভেবে তার ওপর ঝেড়েছে ভূলে যেও না আমাদের সন্ধির কারন সে!”
“হুম এখন বাড়ি চলো বাড়ি দুদিন ছুটি তারপর ব্যাগপত্র গুছিয়ে যাও শ্বশুরবাড়ি।”
“বাবা তুমিও না। চলো বাড়ি গিয়ে দেখি কিভাবে সব সামলানো যায়। তবে হ্যা আমি তার কাছে যাচ্ছি এটা যেন তোমার চিফ হোম মিনিস্টার ভুলেও না জানতে পারে।”
‘আমি পাগল নাকি মস্তিষ্ক ফাঁকা।”
বলেই মাহফুজ শাহরিয়ার হেঁসে উঠলেন সাথে মুখর ও হাসলো। অতঃপর দু’জনে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
____________________
মেহবিনের সাথে কথা বলতে বলতে আর খেলতে খেলতে খেলতে মিশু ঘুমিয়ে পরেছে। মেহবিন না চাইতেও মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। চারিদিকে তাকাতেই দেখলো অনেকগুলো টেডিবিয়ার পুরো ঘরটা অগোছালো অবশ্য মিশু ও অগোছালো থাকে। এক পাশে বুকশেলফ আছে অনেক বই আছে তাতে। মেহবিনের মাথায় কিছুতেই আসছে না । রুমটা দেখতে ভালো একজন কারোর মনে হচ্ছে একটা সময় এই ঘরটা গোছানো ছিল এখন নেই। মেহবিনের বারবার মনে হচ্ছে মিশু আগে এরকম ছিল না কয়েক বছর ধরে এরকম হয়েছে বোধহয়। ওর কথাবার্তার বেশ মার্জিত শুধু একটু অবুঝ তাই। মেহবিন মিশুর চুলগুলো সরিয়ে দিল মুখ থেকে তারপর কপালে একটা চুমু খেল আর বলল,,
“জানিনা তুমি অসুস্থ কিভাবে হলে? তবে তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে বন্ধু। তোমার বন্ধু খুব করে চেষ্টা করবে তোমাকে সুস্থ করে তোলার।”
এটুকু বলেই মেহবিন বের হলো রাত আটটা বাজে। মিশুর থেকে শুনেছে এই বাড়িতে তার মা বাবা ছাড়াও তার একটা ভাই আছে ওর বয়সের ওরা টুইন নাম বলেছে বাজপাখি। এটা শুনে মেহবিনের খুব হাসি পাচ্ছিল তবুও থামিয়েছে। তাছাড়াও এ বাড়িতে মিশুর মামার পরিবার থাকে আরিফা জামানের ভাই আরিফ জামান তার পরিবার মোট চারজন। মিশুর দাদা আছে তার নাম শেখ শাহেনশাহ তাকে দেখে মিশু ভয় পায়।সে আপাতত বাড়ি নেই। শেখ শাহেনশাহ এর ভাইয়ের ছেলে আছে একটা এখানে থাকে। শেখ শাহনাওয়াজ এর কাকাতো ভাই শেখ আমজাদ তার আরবাজ এর থেকে এক বছরের ছোট একটা ছেলে আছে শেখ সায়িদ তিনি বিয়ে করে ছয়মাসের জন্য বিদেশে গেছে কাজে। আর দুইটা মেয়ে জিনিয়া আর মুনিয়া আছে তারাও এইবার কলেজে পরছে সবাই এই বাড়িতেই থাকে । বলতে গেলে চেয়ারম্যান সাহেব এর ভরা সংসার। মেহবিন নিচে আসতেই সবাইকে দেখলো সে একেবারে চেয়ারম্যান সাহেব এর সামনে গিয়ে বলল,,
“আমাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”
“রাত অনেক হয়েছে খাবারটা খেয়ে যান । গাড়ি দিয়ে আপনাকে পৌঁছে দেওয়া হবে।
‘দুঃখিত আপনার প্রস্তাব গ্ৰহন করতে পারছি না। আমার যেতে হবে অনেক রাত হয়েছে গ্ৰামে এটাই অনেক রাত তাই না। রাত বেরুতে বাড়ি ঢুকলে আপনার গ্ৰামের মানুষজন নিশ্চয়ই আমাকে ভালো বলবে না। এমনিতেই একা থাকি বুঝতেই পারছেন আমি কি বলেছি।”
“তাহলে তো আমাকেই যেতে হয় আপনার সাথে।”
‘আপনাকে কষ্ট করতে হবে না আমি গাড়ি করে এমনিই চলে যেতে পারবো।”
‘কুদ্দুস ড্রাইভারকে বল ওনাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে।”
‘জি আচ্ছা চেয়ারম্যানসাব।”
কুদ্দুস চলে গেল এই বাড়ির কেয়ার টেকার তাকে বলা যায় বাইরের সকল কাজ সেই দেখে। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
‘আসেন পুরো পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে ও হলো আরিফা আমার স্ত্রী।”
মেহবিন শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আমি পরে একদিন এসে পরিচিত হয়ে নেব। রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারছেন।”
মেহবিনের কথায় চেয়ারম্যান দমে গেলেন। আর কিছু বললেন না অন্য দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমনিতেও সবাই এ দুদিনে দেখেছে তিনি এই মেয়েকে বেশ সমীহ করে চলেন। মেহবিন আরিফা জামানের দিকে তাকিয়ে বলল,,,
“মিশু ঘুমিয়ে পরেছে পারলে উঠিয়ে খাবারটা খায়িয়ে ওষুধ খায়িয়ে দিবেন। মাথার ব্যান্ডেজটা ভিজিয়ে ফেলেছিল আমি নতুন করে আবার করে দিয়েছি। আশাকরি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
আরিফা জামান একটু মাথা কাত করে বললেন,,
‘ঠিক আছে।”
মেহবিন গায়ে শালটা ভালোভাবে জরিয়ে বের হলো। বাইরেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ও গিয়ে গাড়িতে বসে পরলো। ও যেতেই সকলে প্রশ্ন করল উনি কে? কারন সেদিন তেমন কেও ওকে দেখেনি আজকেও যখন এসেছে তখন সবাই ঘরে ছিল। এমনিতে মিশুর থেকে শুনেছে ওর বন্ধু হয়েছে। আরিফা জামান সকলকে মেহবিনের পরিচয় দিলেন। কিছু লোক মেহবিনের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল। বোরকা হিজাব পরিহিতা একটা মেয়ে শালটা ভালোভাবে জরিয়ে ছিল। গাড়িতে উঠে ফোন স্কল করতেই মেহবিন দেখতে পেল “বিহঙ্গিনীর কাব্য” নামের আইডি থেকে মেসেজ এসেছে তাতে লেখা,,
“মানুষ কি অদ্ভুত তাইনা নিজের কষ্ট না হলেও একান্ত মানুষটার দুঃখে দুঃখবিলাশ করতে ইচ্ছে হয়। শুনো বিহঙ্গিনী প্রকৃতিও বোধহয় চায় কাব্যের বিহঙ্গিনীর কাছে তার কাব্য পৌঁছে যাক। তাইতো এতো আয়োজন আর কিছু ক্ষনিকের অপেক্ষা।”
~ চলবে,,
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্বে নিয়ে কিছু বলে যান।