#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#লেখিকা_সিনথীয়া
#অন্তিম_পর্ব
আহমেদ সাহেব ঘুরে তাকালেন পৃথার বাবার দিকে। পৃথা আর স্বাধীনকে নিয়ে ওনার সামনে বসালেন,
– সুজন, এই দেখ তোমার মেয়ে আর মেয়ের জামাই। কেমন লাগছে ওদের?
সুজন সাহেবের চোখে পানি, ঠোটে হাসি।
– এটা স্বাধীন তাই না?
স্বাধীন এগিয়ে এসে ওনার হাত ধরলো,
– জ্বী বাবা।
– বাবা, তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। তুমি আমার পৃথাকে খুব সুখে রেখ কেমন?
– বাবা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। পৃথাকে আমি কখনো কোনো কষ্ট দিব না। ও আমার সাথে সবসময় খুশি থাকবে ইনশাআল্লাহ।
হঠাৎ সুজন সাহেবকে একটু উত্তেজিত মনে হলো। মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি,
-পৃথা, যা তো মা। আমার ডায়েরিটা নিয়ে আয়। আমি এই মুহূর্তটা তাড়াতাড়ি লিখে নেই, নয়তো পরে একদম ভুলে যাব।
পৃথা হেসে উঠে দাড়ালো। রুমে যেয়ে ডায়েরি নিয়ে আসলো। তবে আসার সময় রিণিতার রুম থেকে ভীষণ কান্নার শব্দ পেল ও। পরক্ষণেই দরজাটা খুলে বের হলো রিণিতা। সামনে পৃথাকে দেখতে পেয়ে মনে হলো যেন রাগ আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল ওর। তেড়ে আসলো পৃথার দিকে,
-কুলক্ষিণি মেয়ে কোথাকার। আমার সুখ সহ্য হয় না তোর তাই না? আমার পছন্দকেই কেড়ে নিতে হলো তোর?
পৃথা এতোটাই অবাক হয়ে গেল রিণিতার কথায় যে ও জবাব দিতে পারলো না। পরিস্থিতি বেশামাল দেখে স্বাধীন এসে দাড়ালো দুজনের মাঝখানে,
– রিণিতা, আপনি কিভাবে কথা বলছেন আমার স্ত্রীর সাথে?
স্বাধীনকে দেখে একদম চুপশে গেল রিণিতা। ইয়াসমিন পেছনে ছিল, মেয়ের কাধে হাত দিতেই রিণিতা ঘুরে ওনার বুকের ওপর আছড়ে পরে মরা কান্না শুরু করলো। কোনো ভাবেই থামানো যাচ্ছিলো না ওকে।
এদিকে সুজন সাহেবও বেশ রেগে গেছেন। ইয়াসমিন আর রিণিতার ওপর রাগ ঝাড়া শুরু করলেন তিনি। একচোট ঝগড়া বেধে গেল সুজন সাহেব আর ইয়াসমিনের মাঝে। কেউ কারও কাছে সপার্দ হতে নারাজ। আহমেদ সাহেব বুঝলেন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিনি সাথেসাথেই স্বাধীনের দিকে তাকালেন,
-বাবা, তুমি পৃথাকে নিয়ে এখন এই বাসা থেকে চলে যাও।
-কিন্তু ফুফা, বাসার এরকম অবস্থা রেখে কেমনে যাব আমরা?
– বাবা, পৃথার ওপর এখন ওর সৎ মার আর সৎ বোনের ক্ষোভ প্রচুর। ও যতক্ষণ এখানে থাকবে ততক্ষণ ওরা শান্ত হবে না। তাই তুমি ওকে নিয়ে যাও। এখানে সব শান্ত হলে আমি কল দিব তোমাকে।
পৃথা কেঁদে দিল,
– ফুফা, কিন্তু বাবার কি হবে? উনি এভাবে চিৎকার করলে ওনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে তো।
– আমি আর বেলাল আছি এখানে মা। আমরা খেয়াল রাখবো সুজনের। ওর কিছু হবে না। ইয়াসমিনকেও কিছু শিক্ষা দেওয়া জরুরী। রিতার সাথে ও নিজেও তাল দিয়েছিল তোর জীবন নষ্ট করায়, আমরা সেটাও জেনেছি। তাই আজ এই অত্যাচারগুলো ওর প্রাপ্য। তুই যা মা, স্বাধীনের সাথে। আমরা দেখছি এখানে কি হয়।
আর কোনো কথা হলো না। স্বাধীন কাদঁতে থাকা পৃথাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলো। ওকে নিয়ে একেবারে পৌছালো নিজের এপার্টমেন্টে। সারা রাস্তাই পৃথা থম মেরে বসে ছিল গাড়িতে। নিঃশব্দে শুধু চোখের পানি পরছিল ওর। স্বাধীনও চুপ করে থেকে শুধু ড্রাইভ করলো।
ফ্ল্যাটে ঢুকে পৃথা চুপচাপ যেয়ে সোফায় বসলো। ড্রয়িংরুমের জানালার সব পর্দা খুলে দিল স্বাধীন। মুহূর্তেই আলোকিত হয়ে গেল পুরো রুমটা। এরপর স্বাধীন এসে বসলো পৃথার পাশে। এক হাত দিয়ে ওর কাধ জড়িয়ে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসলো। সাথেসাথেই নিজের মাথা এলিয়ে দিল পৃথা। স্বাধীন নিজের গাল ঠেকালো ওর মাথায়,
– তুমি কেন এতো টেনশন করছো? ফুফা আর চাচু আছেন তো ওখানে। ওনাদের সামনে ইয়াসমিন আন্টি কিছুই করতে পারবেন না বাবার সাথে।
– বাবাকে আজ প্রথমবার এতো উত্তেজিত হতে দেখলাম আমি। ভয় লাগছে, নিজের ব্যালেন্স না হারিয়ে ফেলেন তিনি।
– এরকম কিছুই হবে না পৃথা। তুমি চিন্তা…
এর মাঝেই স্বাধীনের ফোন বেজে উঠলো। বেলাল সাহেবের কল দেখে উঠে পরলো পৃথা, স্বাধীনের বুক থেকে। আগ্রহ নিয়ে শুনতে চাইলো ওপাশের কথা। স্বাধীন ওর চাচার কথা শুনে একটা স্বস্তির দম নিল। এপাশ থেকে বললো ও,
– ভালো হয়েছে চাচু। তুমি নিয়ে যাও বাবাকে। হ্যা হ্যা…. কোনো সমস্যা নেই। পৃথা আছে আমার কাছে।…. না… আজ আর না আসি তোমার ওখানে। কাল অফিসের পর পৃথাকে নিয়ে একেবারে আসবো।… ঠিক আছে চাচু। ওকে রাখলাম।
ফোন রাখার পর স্বাধীন পৃথার উৎসুক চেহারার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিল,
– বাবা আর আন্টির ঝগড়া থেমেছে। বাবা নাকি বলে দিয়েছেন তিনি আন্টির সাথে আর থাকতে চান না। এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে তবে এখন পরিস্থিতি শান্ত। তবে এক বাসাতেই আন্টির সাথে বাবাকে একা রাখাটা নিরাপদ মনে করেননি ফুফা আর চাচু। তোমার ফুফুর বাসাতেও যেহেতু সমস্যা তাই চাচু নিজের সাথে বাবাকে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের পুরানো বাসায়। ওখানেই আপাতত বাবা থাক। আমরা কাল অফিস থেকেই দেখা করতে যাব ওনার সাথে। নাকি…. তুমি এখনি যেতে চাও?
স্বাধীন যতক্ষণ কথা বলছিল, একে একে সব দুর্ভাবনা দূর হচ্ছিল পৃথার। স্বাধীনের কথা শেষ হতে পৃথা খেয়াল করলো ও আর টেনশন করছে না। সাথে এটাও বুঝলো যে স্বাধীন আজ ওর চাচার বাসায় যেতে চাচ্ছে না। চাচ্ছে পৃথার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। হঠাৎ আরেকটা ব্যাপার খেয়াল হলো পৃথার, এতো কষ্টের মাঝে ও ভুলেই গিয়েছিল যে স্বাধীন আর ও এখন এক হয়ে গেছে। ওদের মিলনে আর কোনো বাধাই বেঁচে নেই। মনটা তখন খুশিতে নেচে উঠলো পৃথার। স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি নিয়ে বললো,
– আজ থাক্। কাল যাব বাবাকে দেখতে। আজ তোমার সাথে থাকতে চাই।
স্বাধীনের চোখ খুশিতে ভরে যেতে দেখলো পৃথা। জড়িয়ে ধরলো ওকে স্বাধীন,
– Preetha now you are completely mine. আজকের পর আর তোমাকে নিজের কাছ থেকে সরাবই না আমি। তুমি আর ওই বাসায় ফেরত যাবা না। এখানেই থাকবা আমার সাথে।
পৃথা, সরে, স্বাধীনের সামনে এসে অবাক চোখে প্রশ্ন করলো,
– তা কেমনে হয়? আমার সবকিছু তো ওই বাসায়?
-সো? সব জিনিস কেনা যাবে। আর যদি চাও, একদিন আমার সাথে যেয়ে সব গুছিয়ে নিয়ে আসবা। তাহলেই হবে। কিন্তু আমি আর কোনোভাবেও তোমাকে নিজের থেকে দূরে করবো না। আর এমনিতেও আমরা স্বামী স্ত্রী, আমরা আলাদা থাকবো কেন?
– বাবার কি হবে তাহলে?
– বাবাকে এই বাসায় নিয়ে আসবো। আমাদের সাথেই থাকবেন তিনি। আর শোনো এটাতো টেম্পরেরি এরেঞ্জমেন্ট। আমাদের এখানে বেশিদিন থাকতে হবে না। গতকাল রাতেই আমার আব্বু, আম্মুর সাথে কথা হয়েছে। সব জানানো হয়েছে তাদের। ওনারা অলরেডি দেশে আসার টিকেট কাটবেন আজকে। ওনারা এসে গেলেই আমাদের বিয়ের প্রোগ্রামটা করে তোমাকে তুলে নিব। তারপর সোজা এমেরিকা, আমাদের বাসায়।
স্বাধীনের পরিকল্পনা গুলো ওর আলিঙ্গনে জড়িয়েই শুনছিল পৃথা। বেশ ভাল লাগছিল ওর। মনে হচ্ছিলো যেন কোনো স্বপ্নে ভাসছে ও। হঠাৎ ওকে একটা নড়া দিল স্বাধীন,
– পৃথা শোন, কাল পরশুর মধ্যেই তোমার আর বাবার ভিসার জন্য এপ্লাই করে ফেলি কি বলো? এর জন্য যা যা কাগজ দরকার তা জোগাড় করতে হবে আমাদের।
অবাক হলো পৃথা,
– আমার বাবার ভিসা?
-হ্যা। কেন?
-মানে… বাবাও আমাদের সাথে যাবেন?
– অবশ্যই যাবেন! এটা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে নাকি? আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম যে বাবাকে নিয়ে যেয়ে আমি ডাক্তার দেখাতে চাই….
স্বাধীন কথা শেষ করতে পারলো না কারণ হুট করে ওর মুখ বন্ধ করে দিল পৃথা নিজের ঠোট দিয়ে। জোড়ে জড়িয়ে ধরে স্বাধীনকে কাছে টেনে আদর করলো ও। স্বাধীন আকস্মিকতায় শুধু জড়িয়ে ধরতে পারলো ওকে কোনোমতে। কিছু মুহূর্ত পর ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর গালে নিজের হাত রেখে পৃথা বললো,
– I love you a lot. আমার জীবনে এসে আমাকে তুমি অনেক সৌভাগ্যবতি বানিয়ে দিয়েছো। আমার সাথে আমার বাবার খেয়াল রাখার জন্য আমি সারাটা জীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। I really love you.
ওদের মাঝের মুহূর্তটা কেমন যেন ভারী হয়ে যাচ্ছিলো। স্বাধীন হঠাৎ পৃথার সামনে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। সেই হাত কোনো সময় নষ্ট না করে ধরে ফেললো পৃথা এবং সেই হাত ধরেই ও প্রবেশ করলো স্বাধীনের বেডরুমে।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পৃথা পরলো এক আজব ঝামেলায়। ওর চিন্তিত চেহারা দেখে ওকে জিজ্ঞেস করলো স্বাধীন,
– কি হয়েছে পৃথা?
– আমি কি পরে অফিসে যাবো?
– মানে?
– আরে, কালকে তো হুট করে চলে আসলাম বাসা থেকে। কিছুই তো নিয়ে আসতে পারিনি। গতরাতে তো তোমার শার্ট পরে ঘুমালাম….
– ইশ! আর মনে করিয়ে দিও না পৃথা, যা লাগছিল না তোমাকে….
লজ্জায় লাল হয়ে গেল পৃথার মুখ,
– অসভ্য ছেলে কোথাকার, চুপ করো! ওই সব না ফ্যান্টাসাইজ করে সলিউশন দাও, কি পরে যাই অফিসে।
স্বাধীন হেসে দিল নিজের স্ত্রীর কথায়। তারপর ওর হাত ধরলো,
– এইদিকে আসো।
বেডরুমে পৃথাকে নিয়ে যেয়ে নিজের আলমারি খুললো স্বাধীন। একপাশে ঝোলানো শাড়িগুলো দেখে হা হয়ে গেল পৃথা। সাথে সাথেই মনে পরলো, সিলেটে কেনা শাড়িগুলো তো স্বাধীন নিজের সাথে নিয়ে এসেছিল।
– এগুলা পরে অফিসে যাব?
– তো আর কোনো চয়েস আছে তোমার?
– কিন্তু এগুলো তো গর্জিয়াস খুব। অফিসে কেমনে পরি?
– আজ পরো। কারণ আজ অফিসে এমনিতেও কোনো কাজ হবে না।
-মানে? কেন?
পৃথার এই প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে রহস্যময় একটা হাসি দিল স্বাধীন।
পুরো একটা সপ্তাহ পর পৃথা আর স্বাধীন অফিসে আসলো। স্বাধীনকে গাড়ি অফিসের আগের মোড়টাতে থামাতে বললো পৃথা। অবাক চোখে স্বাধীন তাকালো,
– এখানে কেন? আজকেও লুকাতে চাচ্ছো তুমি?
লজ্জা পেল পৃথা,
– আরে ধুর! এমনেই…. আমাকে এখানেই নামাও তো।
স্বাধীন হেসে আর কথা বাড়ালো না। ছেড়ে দিল পৃথাকে ওখানেই। অফিসের আলাদা ভাবেই প্রবেশ করলো দুজন। পৃথা নিজের ডিপার্টমেন্টে যেতেই হইচই পরে গেল। একে তো এতোদিন পর ফিরেছে ও এর জন্য। আর আরেকটা হলো ও শাড়ি পরেছে বলে। নুপুর ওকে দেখে উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো,
– কি ব্যাপার পৃথা? আজ অফিসের পরে বিশেষ কোথাও যাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি তোমার? শাড়ি পরার পেছনে কারণ কি বলো তো?
নিতাও তাল ধরলো নুপুরের,
– সত্যি পৃথা আপু, বলেন না। কোনো স্পেশাল কারো সাথে দেখা করতে যাবেন নাকি? হাহাহা।
পৃথা লজ্জায় নিজে হাসবে না ওদের থামাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। ঠিক তখনই স্বাধীনের পিওন এসে বললো যে স্বাধীন সবাইকে কন্ফারেন্স রুমে ডেকেছে।
এ টিমের অন্যদের সাথে পৃথাও যেয়ে দাড়ালো রুমে। সিয়ামেরও দেখা মিললো সেখানে। কিছুক্ষণ পর স্বাধীন আসলো। সবার দিকে তাকিয়ে একটা চমৎকার হাসি দিয়ে প্রথমে একে একে সবার খোজ নিয়ে নিল । তারপর নিজের কথা শুরু করলো ও,
– আসলে আমি আপনাদেরকে এখানে কোনো অফিসের কাজে ডাকিনি। বরং বলা যায় একটি ব্যক্তিগত বিষয় আপনাদের সাথে শেয়ার করার জন্য ডেকে এনেছি।
একটু থামলো স্বাধীন। এখন একটু একটু লজ্জা চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে ওর। সিয়াম আর পৃথা ছাড়া বাকিরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে চোখে প্রশ্ন নিয়ে। এমন সময় স্বাধীন হাত বাড়ালো
– পৃথা….
সবার চোখ এক সাথে ঘুরে গেল পৃথার দিকে। লাজুক চোখে মাথা নিচু করে হাসছে তখন পৃথা। স্বাধীন কয়েক পা এগিয়ে ওর হাত ধরে সবার সামনে নিয়ে আসলো। সবার থমকে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে দুজনেই হাসলো একটু। তারপর বললো স্বাধীন,
– আমি আপনাদের জানিয়েছিলাম যে আমার বিয়ে আগেই হয়ে গেছে। Today I am honoured to introduce my wife to you, Mrs. Preetha Hasan.
পুরো রুমটাতে এক বিন্দু আওয়াজ হলো না। এ টিমের সদস্যদের একেক জনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো যেন কোন এলিয়ন দেখছে তারা। অবশ্য এলিয়েন দেখার থেকে কম অবিশ্বাস্য খবর ছিলোও না এটা তাদের জন্য। কোনোমতে মুখ খুলতে পারলো নুপুর,
-পৃথা…. স্যারের ওয়াইফ?… কেমনে?….মানে…কখন?
স্বাধীন হেসে জবাব দিল,
– আমি বুঝতে পারছি আপনারা এটা শুনে নিশ্চয়ই খুব শক্ড হয়েছেন। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে এই বিষয়টা আমরা আপনাদেরকে আগে জানাতে পারিনি। আসলে কিছু ফ্যামিলি ইশুজ ছিল বলে আমাদের বিয়ের প্রোগ্রামটা আগে করা হয়নি,শুধু কাবিন করে রাখা ছিল। তাই আমরা বেশী কাউকে এ নিয়ে কিছু বলিনি। তবে এখন আপনাদেরকে বলছি কারণ আমাদের বিয়ের প্রোগ্রাম অতি শিঘ্রই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবং আপনারা সবাই তাতে ইনভাইটেড। আশা করি আমাদের দুজনকে নিজেদের বেস্ট উইশেস দিতে অবশ্যই আসবেন প্রোগ্রামে।
এতোক্ষণে সবার মাঝে হাসি ফুটে উঠলো। হঠাৎই চিৎকার দিয়ে নিজেদের খুশি প্রকাশ করলো। মেয়েরা ততক্ষণে পৃথাকে ঘিরে ফেলেছে। নিতা তো বলেই ফেললো,
– নুপুর আপু, আমি বলেছিলাম না, স্যার মনে হয় পৃথা আপুকে পছন্দ করেন? দেখসেন আমার প্রেডিকশন্ কেমনে ঠিক হয়ে গেল।
বাকিরা হো হো করে হেসে দিল এ কথায়। এরপর কনফারেন্স রুমেই জমলো খানিকক্ষণের জন্য আড্ডা। স্বাধীনের সকালে বলা কথাটাই ফলিত হলো। আসলেই আজ অফিসের কাজে তেমনই কারও মন বসলো না। স্বাধীন- পৃথার ব্যাপারে সব ডিপার্টমেন্টেই জানাজানি হয়ে গেল পরের এক ঘন্টার মাঝেই। সবাই একে একে এসে পৃথাকেই মূলতো উইশ করে যাচ্ছিলো।
মোটামোটি এভাবেই পার হয়ে গেল দিনটা আজ অফিসে। মাঝখানে আরেকটা ভালো খবর শুনতে পেল পৃথা। স্বাধীনের বাবা ফোন করেছিলেন। তাদের আসার তারিখ ফিক্স হয়ে গেছে, এটা জানালেন। শুনেই স্বাধীন নিজের মতন কাজে লেগে গেল। অফিস শেষে চাচার বাসায় যেয়ে,ওর চাচাকে নিয়ে স্বাধীন বিয়ের প্রোগ্রামের একটা খসড়া তৈরী করলো। পৃথা শুধু ওর বাবার পাশে বসে স্বাধীনের কাজ গুলো দেখছিল আর মনে মনে তৃপ্ত হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে লজ্জা পেয়ে হাসছিলও ও। স্বাধীনের হঠাৎ খেয়াল করলো ব্যাপারটা। ডিনারের জন্য যখন সবাই ব্যস্ত হয়ে পরলো তখন এক কোণায় নিয়ে গেল পৃথাকে স্বাধীন,
– তুমি তখন আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসছিলা কেন?
– কই? নাতো?
-হাসছিলা। আমি দেখেছি। এই দেখো এখনো হাসছো তুমি। বলো না, কেন হাসছো?
– হাসছি তোমার কান্ড কারখানা দেখে। নিজের বিয়ের ঢোল নিজেই বাজাচ্ছো। সব কাজ নিজেই করছো। একটুও লজ্জা শরম নাই তোমার।
– আরে? এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আমি না করলে এসব করবে কে, বলো শুনি? আর আমি কি নতুন বর নাকি? তেরো বছরের পুরাতন বর বুঝলা?
-বুঝছি বুঝছি, বুড়ো হয়ে গেছ তুমি।
– হ্যা….কি? কি বললা তুমি পৃথা?
কিন্তু পৃথা কই? ততক্ষণে ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে ওখান থেকে পালিয়ে গেছে।
বিশ দিন পর। আজ পৃথা আর স্বাধীনের বিয়ে। গত দশ দিন আগে পৃথার শ্বশুর শাশুড়ি আর ননদ এমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছে। ওদের সাথে কাটানো এই সময়টুকু পৃথার জীবনের সবচাইতে সুন্দর সময় মনে হয়েছে। বিশেষ করে স্বাধীনের মা আসার পর থেকেই ওকে নিজের মাঝে আগলে রেখেছেন ঠিক সেই ছোটবেলার মতন। মাতৃ স্নেহের স্বাদ অনেক বছর পর পেয়েছে পৃথা, সেটাকেই নিজের মাঝে বেধে রেখেছে ও।
বিয়ের তিনদিন আগে জোর করে স্বাধীনকে গুলশানের বাসা থেকে বের করে ওর চাচার বাসায় পাঠানো হয়েছে। প্রথমে তো কোনোভাবেই পৃথাকে ছেড়ে যেতে রাজি হচ্ছিলো না ও, পরে মায়ের বকা খেয়ে পা বের করতেই হয়েছে বাসা থেকে। গত দুইদিনে হলুদ, মেহেদির প্রোগ্রামেই শুধু দেখা হয়েছে দুজনের। আজ প্রতিক্ষার প্রহর শেষ স্বাধীনের, এর জন্য সে মহা খুশি।
ওদের বিয়েতে সিলেট থেকে নাশিদরা সবাই এসেছে। রোজি চাচি এসে পৃথাকে যে কতো আদর করলেন তা বলার বাইরে। নিজের একমাত্র ফুফু, সৎ মা আর বোন কেউই পৃথার কোনো অনুষ্ঠানেই যখন উপস্থিত থাকলেন না, তখন রোজি চাচিই নিজ উদ্যগে পৃথার পাশে এসে দাড়ালেন। স্বাধীনের মাকে স্পষ্ট বলে দিলেন তিনি,
– লিজা, আমি এখন থেকে পৃথার মা। তুই নিজের শাশুড়ি হওয়ার দায়িত্ব পালন কর। আমার মেয়েকে যদি কখনো কষ্ট দিয়েছিস তো দেখিস, পাশের বাড়িতেই থাকি কিন্তু, একেবারে মেয়ে নিয়ে চলে আসবো। আর দিব না কিন্তু। হাহাহা।
বিয়ের অনুষ্ঠান বেশ ধুমধাম করে পূরণ হলো। পৃথাকে এতোটা বছর পর তুলে নিয়ে আসা হলো স্বাধীনের বাড়িতে। বিদাইয়ের সময় আহমেদ সাহেব দুজনকে আদর দিয়ে বললেন
-আজ, অবশেষে আব্দুল্লাহ চৌধুরী আর মনসুর হাসান সাহেবের ইচ্ছা পূর্ণ হলো। তাদের গভীর বন্ধুত্ব পেল আত্মীয়তার স্বাদ। তোমরা একে অপরের জন্য অনেক বছর অপেক্ষা করেছ। মন থেকে দোয়া কি যেন আর কখনো, একটা মুহূর্তের জন্যও একে অপরের থেকে দূরে না হও দুজন।
এই একই দোয়া করলো বাকি সবাই। সবার উল্লাসে আর ভালোবাসায় বিদায় হলো পৃথার। স্বাধীনের গাড়ি শুধু ওরা দুজনই চলে গেল নিজেদের গুলশানের ফ্ল্যাটে।
আজ বাসাটাকে অনেক সাজানো হয়েছে। ওদের সাথে কাউকে আসতে দেয়নি স্বাধীন। যখন ফ্ল্যাটের সামনে আসলো তখন দরজা থেকেই পৃথাকে স্বাধীন কোলো তুলে নিল। ওর এরকম আচমকা ভালোবাসার ভঙ্গিগুলো পৃথার এখন চেনা, তাই শুধু লজ্জা পেয়ে হেসে দিল ও। পৃথা কে নিয়ে একেবারে নিজেদের জন্য সাজানো বাসর ঘরে পৌছালো স্বাধীন। সেখানেই নামালো ওকে। ঘরটার চারদিকে একবার চোখ বুলালো পৃথা, মনে হচ্ছিলো যেন রুপকথার কোনো গল্পের মাঝে দাড়িয়ে আছে ও।
স্বাধীন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো পৃথাকে,
– পৃথা, আজ থেকে আমাদের একসাথে নতুন জীবনের শুরু তাই না?
– হমমম।
– আজ যদি তোমার কাছে কিছু চাই তাহলে সেটা দিবা আমাকে?
পৃথা ঘুরে তাকালো নিজের স্বামীর দিকে। হেসে ওর গালে হাত দিয়ে বললো,
– বলো কি চাও।
– আমি তোমাকে সম্পূর্ণ রূপে চাই পৃথা। তুমি কি নিজেকে পুরোপুরি আমাকে দিতে পারবা?
পৃথা হেসে দিল আবার। স্বাধীনের ঠোটে গভীর এক ভালোবাসা একে, মুখ ওঠালো ও,
– তেরো বছর আগে, যেদিন আমরা এক বন্ধনে বাধা পরেছিলাম, সেদিন থেকেই আমি পুরোটাই তোমার হয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো তখন সে বুঝটা হয়নি, তবে আস্তে আস্তে বড় হতে হতে সেটা নিজের মাঝে অনুভব করেছি আমি।
একটু থামলো পৃথা। তারপর আবার তাকালো স্বাধীনের চোখের দিকে এক গভীর ভালোবাসা নিয়ে,
– You are my destiny. I was born for you. I was, am and always be competely yours.
সমাপ্ত।