কাব্যের_বিহঙ্গিনী #পর্ব_১ #লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

0
727

“তুমি যেই মেয়ের জন্য আমার মেয়েকে রিজেক্ট করছো। কিন্তু সত্যি তো এটাই সেই মেয়েটা এই বাড়ির কেউ নয়। ও আমার মেয়ে নয়। এমনকি ওর সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্কও নেই।’

যাদের এতকাল নিজের মা বাবা বলে জানতো। হুট করেই এতবছর পর সে আসল সত্য জানতে পারলো। আসলে এরা তার আপন মা বাবা নয়, এই বাড়িটা তার নয়, এমনকি এ পরিবার টাও তার নয়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে একটা মানুষের কি আচরণ করা উচিত। এটা জানা নেই মেহবিনের? কিন্তু সে নিজের সম্পর্কে জানার পরেও দুই হাত ভাঁজ করে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের মানুষ গুলোর দিকে। এই মানুষগুলোই তার পরিবার হিসেবে সকলে জানতো। যে পরিবার কে এতকাল নিজের পরিবার হিসেবে জানলো, যে বাড়িটা কে নিজের বাড়ি বলে জানলো,যাদেরকে এতকাল নিজের বাবা মা বলে জানলো। আসলে তারা মেহবিনের আপন কেউ নয়‌। হুট করেই এত বড় সত্য জানতে পেরে পুরো আহমেদ ভিলা একদম শান্ত হয়ে গেছে। অথচ এই বাড়িটায় আজ সকাল থেকেই অনুষ্ঠানের আমেজ ছিল। এখন সবার দৃষ্টি মেহবিনের দিকেই কিন্তু তার কোন রিয়াকশন নেই। হুট করেই মেহবিনের মা সাবিনা আহমেদ বললেন,,

“এসব কি বলছেন আপনি? দয়া করে চুপ করুন।”

এ কথা শুনে মিস্টার আলম আহমেদ ক্ষিপ্ত কন্ঠে আবার ও বললেন,,

“কেন ? আমি কেন চুপ করবো। এটা তো সত্যি এই মেয়েটা আমাদের কেউ নয়। এই মেয়েটাকে আমরা রাস্তায় পেয়েছিলাম। আমাদের গাড়ির সাথে ভুলবশত ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্ট হয়েছিল। যার জন্য ওকে আমরা আমাদের সাথে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওকে এনে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। ওকে না আনলে নিজের মেয়ের এতো বড় সর্বনাশ দেখতে হতো না। আজ এই মেয়ের জন্য আমার মেয়ের হওয়া বিয়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ ছেলে জানালো তার আমার মেয়ে শিলাকে নয় এই মেয়েটাকে পছন্দ।”

“এখানে ওর দোষ কোথায়? মেহবিন তো বলেনি তাকে পছন্দ করতে। এখানে মেহবিনের কোন দোষ নেই।”

“তুমি চুপ করো। রাস্তার মেয়ের জন্য তুমি আমার সাথে তর্ক করছো।”

“মেহবিন রাস্তার মেয়ে নয়। ও আমার মেয়ে শুনেছেন আপনি।’

বলতে বলতেই সাবিনা আহমেদ মেহবিনের সামনে গিয়ে কেঁদে উঠলেন। মেহবিন ছিল সবার থেকে দূরে ড্রাইনিং টেবিলের ওখানে। মেহবিন এখনো চুপচাপ হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার মা নামক মানুষটার দিকে। মিসেস সাবিনা মেহবিনকে জরিয়ে ধরে আবার ও কেঁদে দিলেন আর কান্না মাখা কন্ঠে বললেন,,

“তুই আমার মেয়ে মেহবিন! কি হয়েছে আমি তোকে জন্ম দিই নি? কিন্তু আমি তো তোকে তোর সাত বছর বয়স থেকে লালন পালন করেছি। আমি তোর মা মেহবিন। যে যাই বলুক তুই আমার সন্তান।”

বাকি সবাই কি বলবে সকলেই ব্যাপারটায় হতভম্ব হয়ে আছে। একটু আগেই যে মেয়েটাকে নিয়ে সবাই রাগ পোষন করছিল এখন তার জন্য মায়া কাজ করছে। কিন্তু এর মাঝে সব থেকে খারাপ লাগছে প্রতীকের তার জন্যই এতোবছরের রাজ সামনে এসেছে । সে যদি মেহবিন কে না পছন্দ করে শিলাকে পছন্দ করতো তাহলে এই ঘটনা ঘটতোই না।

ফ্ল্যাশব্যাক,,,

আলম আহমেদ আর প্রতীকের বাবা বিজনেস পার্টনার। তারা এই সম্পর্ক টাকে মজবুত করার জন্য ঠিক করে তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবেন। মেহবিন আর শিলা এক বছরের ছোট বড়। আলম আহমেদ তার মেয়ে শিলার সাথে প্রতীকের বিয়ের কথাবার্তা বলেন। প্রতীক মেয়ের সাথে আলাদা দেখা করতে চায় এটা নিয়ে কেউ দ্বিমত করেনি । মেয়েকে একা কিভাবে পাঠাবে তাই মেহবিন কেও শিলার সাথে পাঠায়। মেহবিন প্রথমে রাজি না হলেও মায়ের জোরাজুরিতে রাজি হয়ে যায়। মেহবিন ভালোমতো বোরকা হিজাব নিকাব বেঁধে যায়। আর শিলা একটা সুন্দর থ্রিপিস তার সাথে হিজাব। প্রতীক ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল প্রতীকের প্রথম নজর যায় মেহবিনের দিকে যদিও তার চেহারা দেখেনি তবে ধার্মিক মেয়ে দেখে তার ভালো লাগে। অতঃপর ওদের পরিচয় হয় প্রতীক আর শিলা কথা বলতে থাকে। মেহবিন ফোন বের করে কিছু একটা করতে থাকে। এমনকি একবার তাকিয়ে প্রতীকের দিকে আর তাকায় নি। খাওয়ার অফার করলে মেহবিন জানিয়ে দেয় সে কিছু নেবে না শুধু এক কাপ কফি ছাড়া। তাই বাধ্য হয়ে প্রতীক ওর জন্য কফি আর নিজেদের জন্য খাবার অর্ডার করলো। কফি আসলেই ওদের কে কথা আর খেতে বলতে বলে ও রেস্টুরেন্টের অন্য জায়গায় চলে গেল। খাওয়া হয়ে গেলে যেন ওকে ফোন করে সেটাও বলে গেছে। শিলা নিজের অনেক কথাই বললো কিন্তু প্রতীক কেন যেন সেই স্বল্পভাষী মেহবিনের কথাই ভাবলো। কিন্তু পরক্ষনে নিজেকে ধাতস্থ করতে ভাবলো তারা বাবা শিলার সাথে বিয়ের কথা বলেছে মেহবিনের সাথে নয়। এভাবেই চলতে লাগলো কিন্তু বারবার মেহবিনের আচরণগুলোই চোখের সামনে ভেসে উঠতো। এই জন্য প্রতীক শিলার সাথে বেশি ফোনে কথা বলতে শুরু করল । তবুও মেহবিন কে মাথা থেকে বের করতে পারছিল না। দশ দিন পর আজ একেবারে পাকা কথা বলার দিন ছিল।সবাই আজ আহভেদ ভিলায় আলম আহমেদ এর ভাই বোন ও তাদের পরিবারের লোকজন ছিল। কিন্তু প্রতীকের পক্ষে শিলাকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাই হুট করেই সে বলে উঠলো তার শিলাকে নয় মেহবিন কে পছন্দ। এতেই যেন আহমেদ ভিলায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। শিলা আর আলম আহমেদ রেগে গেলেন। এরপর প্রতীক আর আলম আহমেদ এর মাঝে কথা কাটাকাটি হলো একপর্যায়ে তিনি বলে উঠলেন মেহবিন ওনার নিজের মেয়ে নয়।”

বর্তমান,,

সাবিনা আহমেদ মেহবিন কে জরিয়ে ধরে কাঁদছেন কিন্তু মেহবিনের কোন প্রতিক্রিয়া নেই সে স্তব্ধ হয়েই আছে। শিলা এতক্ষন রেগে থাকলেও মেঘের জন্য তার এখন খারাপ লাগছে। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছে দুজনে শিলার চোখ দিয়েও দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। কিন্তু প্রতীকের দিকে তাকাতেই মেহবিনের জন্য কষ্টটা রাগে পরিনত হলো। এতদিনে শিলা প্রতীককে ভালোবেসে ফেলেছিল ও ভাবলো মেহবিনের জন্যই এমনটা হলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকার পর মেহবিন সাবিনা আহমেদ কে ধরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল। সাবিনা আহমেদ কান্না মাখা কন্ঠে বলল,,

“মেহবিন তুই কষ্ট পাচ্ছিস? একদম কষ্ট পাবি না।আর তুই স্তব্ধ হয়ে আছিস কেন?”

মেহবিন সাবিনা আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,,

“স্তব্ধ হয়ে কোথায় আছি? আমি তো শুধু চুপ হয়ে আছি। কারন এই বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। সবথেকে বড় কথা কি জানো মামনি? সত্য থেকে কখনো পালানো যায় না। আর কিছু সত্য থেকে তো একেবারেই নয়। আমি কিছু ভুলি নি মামনি সাত বছরের বাচ্চা কিছু ভুলে না। এক্সিডেন্ট হয়েছিল তো কি হয়েছিল? এক বছর কথা বলতে পারছিলাম না তো কি হয়েছিল? পুরোনো কথা মনে করতে গেলে একটু হায়পার হয়ে যেতাম কারন পুরোনো কিছু আমার সহ্য হতে চাইতো না। সব মনেছিল আমার কিন্তু যখন স্বাভাবিক হলাম তখন তোমরা এই আমাকে জানতে চাও নি। তাই আজ এই অবস্থা।

এই মুহূর্তে মেয়েটা মুচকি হাসছে ব্যাপারটা সবাইকে অবাক তো করলো বটে কিন্তু সাবিনা আহমেদ এর বুকে যেন আরো আগুন জ্বালিয়ে দিল। তিনি বুঝতে পারলেন মেয়েটা ভেতরে ভেতরে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। মেহবিন মায়ের দিকে তাকিয়ে তার চোখ মুছিয়ে দিল। আর বলল,,

“উঁহু কান্না নয় আমার খুব ঘুম পাচ্ছে এখন। এদিকে একটু মিটিয়ে নিই তারপর একটা ঘুম দিব। এই সময়টায় একটু ঘুমের প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। ”

সবার থেকে দূরে দেখে কেউ কিছু শুনতে পেল না‌। মেহবিন এবার প্রতীকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,,

“আমি যদি ভুল না হই তাহলে আমাদের দেখা একবার হয়েছিল তাও আবার আপুর সাথে। আর আজ হলো। সেদিন আমার চেহারা টা অব্দি আপনি দেখেন নি। আজ দেখলেন তাহলে আমায় কিভাবে পছন্দ করতে পারেন আপনি? সবথেকে বড় কথা এই দশদিন এ কি করে বুঝলেন আপনার আপুকে নয় আমাকে পছন্দ। এতো তাড়াতাড়ি কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে এটা আমার মনে হয় আপনার মোহ ছাড়া কিছু নয়।”

প্রতীক মাথা নিচু করে বলল,,

“তুমি ঠিক বলেছো কিন্তু আমি প্রথম দেখাতেই তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি। তোমার চেহারা দেখিনি ঠিকই কিন্তু তোমার ব্যবহারে আচরনে মুগ্ধ হয়েছি । যা শিলার ক্ষেত্রে একবার ও আসেনি। আমি ওর সাথে কথা বলতাম কিন্তু ফিল,,

“আমি আর কিছু শুনতে চাই না মিস্টার আপনি যা বলছেন তা সম্ভব নয়। তাছাড়া,,

তখন আলম আহমেদ বললেন,,

‘হয়েছে আর ভালোগিড়ি দেখাতে হবে না। তুমি এখন এখান থেকে চলে গেলেই আমি খুশি হবো। নিজের রুমে যাও। আমরা আমাদের পারিবারিক বিষয় বুঝে নেব তোমায় ভাবতে হবে না।”

মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওপরে চলে গেল। সাবিনা আহমেদ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন। এরপর শিলা প্রতীকের সামনে গিয়ে ইচ্ছে মতো অপমান করলো আলম আহমেদ ও বাদ রইলেন না। প্রতীক তার পরিবার নিয়ে চলে গেল। আলম আহমেদ স্তব্ধ হয়ে সোফায় বসে পরলেন বড়রা সবাই ব্যাপারটা জানতো তাই কোন রিয়াক্ট করলো না। কিন্তু ছোটরা কিছু জানতো না শিলা ওর বাবার সামনে গিয়ে বলল,,

“আজ এটা কি বললে তুমি পাপা মেহবিন আমার বোন নয় ,তোমার সন্তান নয়। তাহলে ছোটবেলায় কেন বলেছিলে ও আমার বোন। কেন বলেছিলে ও একটা জায়গায় থেকে হাড়িয়ে গিয়েছিল কয়েকবছর পর তোমরা ফিরে পেয়েছো। আমি তোমাদের মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম ওর সাথে আমাদের কোন কিছু মিল নেই কেন? তোমরা কেন বলেছিলে ব্যতিক্রম হয় তাই এরকম। আজ বুঝতে পারছি সব। ও যদি আমার বোন না হয়েই থাকে তাহলে তোমরা ওকে এখানে এনেছো কেন?”

তখন আলম আহমেদ বললেন,,

“আমার ভুলের জন্য!”

“মানে?”

“মানে আমি আর সাবিনা একটা কাজ থেকে ফিরছিলাম। একটু বেখেয়ালে গাড়ি চালাচ্ছিলাম ।আর মেহবিন আমার গাড়ির সামনে পরেছিল। কিভাবে কি হয়েছিল সেটা আমি নিজেও জানি না। ও খুব মাথায় আর পায়ে আঘাত পেয়েছিল। ওকে হাসপাতালে নিলে ডাক্তার দেখে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মেহবিন কিছু বলতে পারে না। কিন্তু ডাক্তার বলে ও বোবা নয় হয়তো অতিরিক্ত টেনশন আর ভয় থেকে কথা বলতে পারছে না। ওকে সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতে হবে। নাহলে হয়তো আর কোনদিন কথা বলবে না। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটাকে চিনি না জানি না । মেহবিন তোমার মায়ের আঁচল খুব শক্ত করে ধরেছিল তোমার মায়ের খুব মায়া হয় তাই তোমার মা বলে ওকে নিয়ে আসতে আমাদের সাথে। এমনিতেও সাবিনা আর মা হতে পারবে না বলে আমি ওকে নিয়ে আসি। তোমাকে বললে তুমি কিভাবে রিয়াক্ট করো তাহলে মেয়েটার ওপর খারাপ প্রভাব পরতে পারে। মেয়েটার অবস্থার জন্য আমরা দায়ী ছিলাম। তাই তার ভালোর জন্য তোমাকে বলেছিলাম তোমরা বোন। ”

সব শুনে শিলা একটু কষ্ট পেল তবে মুখ ফুটে বলল,,

“মেহবিন এসব জানতো তাইনা? তাই তো আজ কোন রিয়াক্ট করলো না তাই না।”

“আমি জানি না। ডাক্তার বলেছিল ও ওর নাম ছাড়া বাকি সব হয়তো ভুলে গেছে। কারন ও যখন কথা বলতে পারতো না তখন ওকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর পরিচয় কি লিখে দিতে কিন্তু ও ওর নাম ছাড়া আর কিছু লিখতে পারতো না। মা বাবার কথা শুনলেই হায়পার হয়ে যেত।তাই ডাক্তার ওকে পুরোনো জিনিস মনে করাতে না করেন এতে ওর ক্ষতি হতো। তাই ওকে পুরোনো সব বাদ দিয়ে আমরা ওর মা বাবা হিসেবে পরিচিত হই আর তুমি ওর বোন এটা ওর পরিবার ব্যস এটুকুই।

শিলা আর কিছু বললো না ওপরে চলে গেল। সকলে নিজেদের উত্তর এমনিতেই পেয়ে গেল। শিলা রুমে যাওয়ার আগে মেহবিনের রুমে উকি দিল মেহবিন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ দিয়ে। এই মুহূর্তে শিলার মেঘকে সহ্য হচ্ছে না তাই আর ভেতরে গেল না। রাতে সকলকে খাবার খাওয়ার জন্য ঠিক দেওয়া হলো বাদ যায়নি মেহবিন ও। কিন্তু মেহবিন আসেনি বলেছে সে খাবে না।কেউ জোর ও করেনি। তবে সাবিনা আহমেদ মেহেবিনের রুমে গেলেন ওর সাথে থাকবে বলে। সাবিনা আহমেদ গিয়ে দেখলেন মেহবিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তিনি গিয়ে বললেন,,

“মেহবিন তুই কি ঘুমিয়ে গেছিস?”

“আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না প্লিজ একা ছেড়ে দাও।”

“খিদে পায়নি তোর ?”

“খিদে পেলে নিশ্চয়ই নিচে গিয়ে খেতাম তাইনা। ”

“তুই এতো সহজে সব কিভাবে মেনে নিতে পারিস?”

“কারন আমি সহজ জীবন পছন্দ করি।”

“তোর পরিচয় কি মেহবিন? আমি জানতে চাই। তোর যদি সব মনেই থাকে তাহলে কেন তুই আমাদের বললি না?”

এবার মেহবিন চোখ খুললো । এতক্ষন চোখ বন্ধ করেই সে জবাব দিচ্ছিল। এখন সে উঠে সাবিনা আহমেদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল,,

” আমার পরিচয় যদি বলি তাহলে আমি মেহবিন মুসকান নামক একজন মানুষ। আর তোমরা যদি তার মা বাবা না হও তাহলে সে এতিম। এই পৃথিবীতে এখন তার জানামতে হয়তো আপন বলতে কেউ নেই।”

“সেদিন কি হয়েছিল মেহবিন তুই রাস্তায় ওভাবে এসেছিলি কেন?”

“একটু বাঁচার আশা নিয়ে। যাই হোক মাথায় হাত বুলিয়ে দাও আমি ঘুমাবো। তখন ঘুম আসেনি আমার এখন একটু ঘুমাতে দাও।”

সাবিনা আহমেদ আর কিছু বললেন না। মেহবিন ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু সত্যি কি ঘুমালো নাকি ঘুমের ভান ধরে পরে রইলো কে জানে।

অতঃপর এক নতুন সকালের আগমন। মেহবিন ফজরের নামায আদায় করে নিল সাবিনা আহমেদের সাথে। মেহবিন গিয়ে তার পড়ায় মনোযোগ দিল এবার সে ঢাকা মেডিকেল এ পড়ছে এবার এমবিবিএস ফাস্ট ইয়ার তিনমাস হলো ভর্তির। দেখতে দেখতে এভাবেই তিন দিন কেটে গেল। সব আত্মীয় স্বজন সবাই চলে গেছে নিজেদের বাড়ি। এ তিনদিনে মেহবিনের সাথে সাবিনা আহমেদ ছাড়া আর কেউ কথা বলেনি। এমন কি একসাথে বসে খাবারও খায় নি। মেহবিনই সবার শেষে খেয়েছে হয়তো অন্যদের কে ফেস করতে চায় নি। আজ সকালে ব্রেকফাস্ট করার জন্য মেহবিন কে ডেকেছেন আলম আহমেদ। মেহবিন ও চুপচাপ এসেছে সবাই চুপচাপ খাচ্ছে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শিলা হুট করেই বলল,,

“একজন অনাথের আঠারো বছর হয়ে গেলে তার আর অনাথ আশ্রমে থাকার নিয়ম নেই। তাই না পাপা?”

শিলার কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো শুধু চমকালো না মেহবিন। আলম আহমেদ বললেন,,

“হুম আমি তো সেটাই জানি। কিন্তু হুট করে তুমি এটা কেন বলছো?

“না এভাবেই কিছু না।”

তখন মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

“কথা টা দ্বারা কি বোঝাতে চাইছো আপু?”

“তুই তেমন কোন ইম্পোর্টেন্ট মানুষ নস যে তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। রাস্তার মানুষ রাস্তার মানুষের মতোই থাক। একদম আমার সাথে কথা বলতে আসবি না।”

তখন সাবিনা আহমেদ মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,,

“শিলা ভদ্র ভাবে কথা বল।”

“রাস্তার মেয়ের সাথে কিভাবে কথা বলবো তা নিশ্চয়ই তোমার থেকে শুনবো না। অবশ্য তোমাকে কি বলবো তুমি তো আবার রাস্তার মেয়েটাকেই বেশি ভালোবাসো কি না। আমার তো মনে হয় তুমিও ওর মতো রাস্তাতেই থাকতে কোন এক সময় তাই তো এতো খাতির।”

মেহবিন একথা শুনে রেগে শিলার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

“মুখ সামলে কথা বলো উনি তোমার মা এটা ভুলে যেও না।”

“আমার মুখের ওপর কথা বলার সাহস তোকে কে দিল। আমার নখের যোগ্যও নস তুই। এতোদিন আবার বাবার টাকায় ফুটানি মেরেছিস। সেদিন মাকে বলছিলি তুই অনাথ আমি শুনেছি তখন তুই অনাথ। তারমানে তোর সব মনেছিল। মানে তুই ভালো একটা জীবন পাওয়ার জন্য মিথ্যা বলেছিস আর অভিনয় করেছিস তোর নাম ছাড়া কিছুই মনে নেই। এতো লোভ তোর এতো লোভ। যার জন্য লোভে পরে তুই প্রতীককেও নিজের হাতে করে নিলি। সেদিন আবার ভালো সাজলি।”

“না জেনে কোন কথা বলবে না আপু।”

“তোর মতো অনাথের কাছে থেকে আবার কি জানতে হবে। লোভী একটা তোদের রাস্তার মেয়েদের লোভ তো হবেই নিশ্চয়ই তোর মাও তোর মতো লোভী ছিল আর রাস্তার মেয়ে ছিল।

মেহবিন এতক্ষন শান্ত স্বরে কথা বললেও এবার রেগে শিলার গাল চেপে ধরলো। আর চিৎকার করে বলল ,,

“এই শিলা আহমেদ আমার মায়ের আজেবাজে কিছু বলবে না। নাহলে এখানেই পুতে রেখে দেব।”

সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হলো যে কেউ কিছু ঠাহর করতে পারল না। এদিকে শিলার গাল মনে হচ্ছে এখনি শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে। শিলার মা এলেন মেহবিন কে ছাড়াতে কিন্তু মেহবিন ছাড়লো না। আলম খান বেশ রেগে গেলেন তিনি শক্ত হাতে মেহবিন কে ছাড়িয়ে ছুড়ে মারলেন। কিন্তু কোথায় মারলেন সেটা দেখলেন না। ওখানে একটা অ্যাকুরিয়াম ছিল একটা। মেহবিন অ্যাকুরিয়ামের সাথে গিয়ে ধাক্কা লেগে মাথা ফেটে একটু রক্ত পরতে লাগলো। তা দেখে মিসেস আহমেদ দৌড়ে গিয়ে মেহবিনকে ধরেন। রক্ত দেখে সবাই একটু হতভম্ব হয়ে যায় তবুও শিলার আর আলম আহমেদ এর রাগ কমে না। আলম আহমেদ রেগে বললেন,,

“ভুলে যেও না তুমি কে? তোমার সাহস কি করে হয় আমার মেয়েকে আঘাত করার?”

মেহবিন এ কথা শুনে মিসেস আহমেদ কে ছাড়িয়ে আলম আহমেদ এর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

“না আমি ভুলে যাই নি আমি কে! ভুলে যাই নি বলে আপনাকে আমি কখনো আপুর মতো তুমি করে সম্মোধন করতে পারি নি। ভুলে যাই নি বলে আপনাকে আপুর মতো কোনদিন জরিয়ে ধরিনি। ভুলে যাই নি বলেই আপনার কখনো আদর স্নেহ না পেলেও একটা টু শব্দ করি নি। ভুলে যাই নি বলে আপনার সব ভুল আর অবহেলা মেনে নিয়েছি। ভুলে যাই নি বলে কখনো আপনার কাছে কোন কিছু আবদার করি নি।”

আলম আহমেদ মেহবিনের কথা শুনে ভাবতে লাগলো সত্যি মেহবিন আগ বাড়িয়ে কিছু চায় নি। মিসেস আহমেদ সর্বদা মেহবিনের প্রয়োজনীয় জিনিস এর বন্দোবস্ত করে রাখতেন। প্রয়োজন ছাড়া মেহবিন কখনো শখের জন্য চেয়ে টাকাও নেয় নি। কিন্তু তিনি দমতে চাইলেন না। তাই তিনি বললেন,,

“সবকিছু ঠিকঠাক পেলে আবদার কে করে?”

তখন মেহবিন তাচ্ছিল্য হেঁসে বলল,,,

“সত্যিই কি সবকিছু পেয়েছি আমি। আবদার বলতে বোঝেন তো পছন্দের জিনিস তাদের তৎক্ষণাৎ চাই। আর সেটা যেন পাওয়া যায় তাই ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মায়ের কাছে আবদার করে। কিন্তু মনে করুন তো আপনি আমার পছন্দের জিনিস আগ বাড়িয়ে কখনো দিয়েছেন। আমার তো মনে পরে না। আপুর আইসক্রিম খেতে মনে চেয়েছে বলে আমারও যে আইসক্রিম খেতে মনে চাইবে এটা ধারনা করা ভুল। শপিং এ গেলে সবাই পছন্দ করে যেটা ধরিয়ে দিতো আমি সেটাই নিতাম এর মানে এটা নয় যে আমার ঐ জিনিস গুলোই পছন্দ অন্য পছন্দ হয় নি। সবার পছন্দ এক কখনোই হয় না। যাই হোক সেসব বাদ দিন।

এবার শিলা বলল,,

“তোকে এতো ভালো একটা জীবন দিয়েছে সেটাই যথেষ্ট নয় কি?”

“কেন দিয়েছে সেটা তোমার পাপাকে জিজ্ঞেস করোনি? তোমার পাপা নিজের স্বার্থপরতার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তার গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়েছিল আর মামনির জন্য এখানে আনে নি। সত্যি তো এটাই তোমার পাপা একটা স্বার্থপর!

একথা শুনে শিলা হতভম্ব হয়ে গেল। আলম খান ও একটু ভয় পেল কিন্তু তিনি দমলেন না। তিনি বললেন,,,

“আমি কি স্বার্থপরতা করেছি এখন দেখছি কারো ভালো করাও ভুল।”

“নিয়ত সঠিক হলে ভালো করা ভুল নয় কিন্তু সত্যি তো এটাই আপনি স্বার্থপরতার জন্য এখানে এনেছিলেন। গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট হলে আপনারা হাসপাতালে নিয়ে যান ঠিকই কিন্তু তার কিছুক্ষণ পর পুলিশ ওখানে গিয়ে আপনাদের জেরা করলে আপনি পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে মিথ্যে বলেন যে আমি আপনার সন্তান। কিন্তু পুলিশ এর বিশ্বাস হয় না তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে আপনি তার আগে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আপনার কথা মানতে বলেন এমনিতেও কথা বলতে পারছিলাম না। এই সুযোগ এ আপনার আমার মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলাটাই তার জন্য প্লাস পয়েন্ট ছিল। তারা যাওয়ার আগে আপনাকে ওয়ারনিং দিয়ে যায় বাসায় গিয়েও চেক করবে আপনি মিথ্যা বলছেন কি না। আর করেছিলোও তাই। এই জন্যই আপনি এই নাটক সাজান আমার ভালোর জন্য নয় নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য। আমি যেন নিজের পরিচয় কাউকে না বলি এর জন্য আপনি আমাকে বলেছিলেন সব মনে থাকলেও যেন আমি মা বাবার নাম না উচ্চারণ করি । তাদের কথা শুনে হায়পার হয়ে যেতাম এটা আপনার শেখানো বুলি ছিল। যদিও আপনার কথায় আমি হায়পার হতাম না সত্যি সত্যিই হায়পার হয়ে যেতাম। আপনি কি ভেবেছেন আমি আমার ব্য্যাপারে সব শুনেও চুপ থাকবো শুধু ভালো জীবন পাওয়ার জন্য না এটা আমি না। কারন আমার মা আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে সত্যের মোকাবেলা করতে হয়। শুধু আপনার কথা ভেবেই আমি চুপ ছিলাম কারন কোথাও না কোথাও গিয়ে আপনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আর শিলা আহমেদ তুমিও তোমার পাপার মতোই একটা স্বার্থপর যখন তোমাদের স্বার্থে আঘাত লাগলো তখন দেখিয়ে দিলে তো নিজেদের বাবা মেয়ের আসল রুপ। আর হ্যা আমার মা কোন লোভী নয় আর রাস্তার মেয়েও নয়। সে ছিল রানী আর আমার আইডল কারন সে আর যাই হোক নিজের স্বার্থপরতার জন্য কাউকে ইউস করতে শেখায় নি।”

এটুকু বলেই মুচকি হেঁসে কপালে হাত দিল মেহবিন এখন রক্ত পরছে না কিন্তু রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। সে ওপরে চলে গেল কিন্তু নিচে তিনটি মানুষ সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। শিলা রেগে তার বাবার দিকে চাইলো। আলম আহমেদ মাথা নিচু করে রইল কারন মেহবিনের সব কথাই সত্য ‌ কিছুক্ষণ পর মেহবিন বোরকা হিজাব নিকাব বেঁধে একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে নিচে নামলো। এটা দেখে কারোরই বুঝতে বাকি নেই মেহবিন চলে যাচ্ছে। মিসেস আহমেদ মেহবিনের সামনে গিয়ে বলল,,

“এসব কি মেহবিন? তুই কোথাও যাবি না।”

” যে স্থানে অপমান হয় সেই স্থান থেকে প্রস্থান করাই উত্তম।”

তখন শিলা বলল,,

“তোর মনে হয় না তুই এখান থেকে বেরিয়ে বড় একটা ভুল করছিস।”

তখন মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“মেহবিন তার জীবনে বড় ভুল দুবারই করেছিল। সেই ভুল মেহবিন আর করবে না। বরঞ্চ আজ এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমার সবথেকে ভালো একটা সিদ্ধান্ত। বারো বছর আশ্রয় দেওয়ার জন্য শুকরিয়া সবাইকে। আর সবকিছুর জন্য ও শুকরিয়া।

মেহবিন দুই পা বাড়ালো মিসেস আহমেদ গিয়ে মেহবিন কে জরিয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। আর বললেন,,

“তুই কোথায় যাবি কিভাবে থাকবি?”

মেহবিন তাকে ছাড়িয়ে বলল,,

“চিন্তা করো না সেদিন আলম আহমেদ এর কথা শুনেই বুঝেছিলাম এই বাড়িতে আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিছু না কিছু করে এই খারাপ সময় টা কাটিয়ে নিতে পারবো। তবে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো তো আমি। আমি কি আমার মামনি কে ভুলে যেতে পারি। সবকিছুর জন্য শুকরিয়া মামনি। নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ আর হ্যা আমার জন্য দোয়া কোরো।”

“আমার দোয়া সবসময় তোর সাথে আছে। কিন্তু তুই কিভাবে,,

“আল্লাহ ভরসা মামনি। আল্লাহ তায়ালা উত্তম কর্মবিধারক। আল্লাহর ওপর ভরসা করা মানুষগুলো কখনোই খালি হাতে ফিরে আসে না –
”অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফল হয়েছে”
( সূরা মুমিনুন-০১)।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

যে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। (সূরা আত-তালাক্ব:৩)

নিশ্চয় আল্লাহ (তার উপর) নির্ভরকারীদের ভালবাসেন। (সূরা আলে-ইমরান:১৫৯)

আপাতত কিছু দরকার নেই,আল্লাহ আমাকে
অনেক ধৈর্যশীল করে দিক, খা’রাপ মুহূর্তগুলো
সহ্য করার জন্য। একদিন তো আমিও প্রশান্তির হাসি হাসবো ইনশাআল্লাহ।

বলেই মেহবিন চলে গেল। তিন জোড়া চোখ শুধু দেখেই গেল কিছু বলতে পারলো না। মেহবিনের গন্তব্য এখন কোথায় সেটা মেহবিনই শুধু জানে হয়তো কোন অজানা গন্তব্যের দিকে।

~ চলবে,,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। গল্পের সূচনাটা কেমন হয়েছে জানাবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here