#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৭
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
এতক্ষন পর শান্ত মেয়েটাও মুখ খুললো। গলা উঁচিয়ে অনুনয়ের সুরে বলল – আপনারা থামুন এবার। প্লীজ থামুন, একটা সামান্য বিষয় নিয়ে আমার আর এসব ভালো লাগছে না।
জায়ানের ক্রোধ বাড়লো। ক্রোধে যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে। এতক্ষন তাকে যে এই ছেলেটা কথা শোনাচ্ছিলো তখন তো মুখ খোলেনি পূর্বাশা।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে শুধু। যেই মাত্র সে এই ছেলেটার বিরুদ্ধে কিছু বলল বা করলো অমনি আলগা পিরিত জেগে উঠলো এর। কি সুন্দর তাকে বাঁচানোর জন্য নিজের বন্ধ মুখ খুললো। তীব্র ক্রোধে ফুঁসে উঠলো জায়ান, দাঁতে দাঁত চেপে বলল – ভালো লাগছে না নাকি এই ছেলেটার জন্য হৃদয়ে প্রেম উতলে উঠছে কোনটা? ওকে কিছু বললে আপনার গায়ে ফোস্কা পড়ছে নাকি? চীনে আসতে পারলেন না দুদিন এর মধ্যে নিজের জালে ছেলেদেরও মাতোয়ারা করে ফেলেছেন? বলি চরিত্রের দোষটা কি বাংলাদেশ থেকেই ছিল নাকি এদেশে এসে সুন্দর সুন্দর ছেলে দেখে হয়েছে?
পূর্বাশা এবার আর সহ্য করতে পারলো না। এই ছেলেটা এদেশে আসার পর থেকে তাকে শুধু অপমানই করে যাচ্ছে একের পর এক। এখন তার চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলছে? এই প্রথম নিজের স্বপক্ষে প্রতিবাদ করলো পূর্বাশা। রুখে দাঁড়ালো জায়ানের বিরুদ্ধে। শক্ত কন্ঠে বলল – একদম বাজে কথা কথা বলবেন না? অনেক বলেছেন আপনি আর অনেক সহ্য করেছি আমি। কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার আপনাকে আমি দেইনি। সুতরাং নিজের সীমার মধ্যে থাকুন মিস্টার জায়ান।
ছিটা মেরে জায়ান নিজেকে ছাড়িয়ে নিল তৃষাম আর চ্যাং এর বন্ধন থেকে। এগিয়ে গেল পূর্বাশার পানে। ক্রোধিত কন্ঠে বলল – আমাকে অধিকার দেননি তো কাকে দিয়েছেন ঐ ছেলেটাকে? আগে নিজের চরিত্র ঠিক করুন তারপর অন্যকে সাবধান করতে আসবেন।
পূর্বশা ফুঁসে উঠলো আরও। এই প্রথম বোধহয় এতটা রেগেছে মেয়েটা আর নিজের স্বপক্ষে কাউকে উত্তর দিচ্ছে সে নয়তো বরাবরই সবার তিরস্কার শুনে মাথা নিচু করে চলে যাওয়াটাই তো তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তবে আজ কেন সেই অভ্যাসের বিপরীতধর্মী হয়ে উঠলো সে জানা নেই। তবে জায়ানের প্রতিটি কথার জবাব দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। তীব্র ক্রোধ নিয়ে জায়ানের দিকে দুই কদম এগিয়ে গেল পূর্বাশা। পা উঁচু করে ধরলো জায়ানের শার্টের কলার অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল – আমার চরিত্রে সমস্যা? তো আমার থেকে দূরে থাকতে পারেন। এসে থেকে তো একটা দিনও আপনার সম্মুখে আমি যাইনি বরং বারবার আপনি এসেছেন আমার কাছে। আবার অপমানও করেছেন। আগে নিজের নোংরা মানসিকতা পরিবর্তন করুন। তারপর আসবেন আমার চরিত্র ঠিক করতে।
জায়ান ঝাড়া মেরে নিজের কলার ছাড়িয়ে নিল পূর্বাশার হাত থেকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল – হাউ ডেয়ার ইউ। তোর সাহস কি করে হলো আমার কলার ধরার? ঐ নোংরা হাতে আমাকে স্পর্শ করার।
– আমার হাত নোংরা নাকি আপনার মন নোংরা। নিজের মনটা আগে শুদ্ধ করুন দেখবেন পৃথিবীর সবকিছু শুদ্ধ হয়ে যাবে।
– একদম বড় বড় কথা বলবি না আমার সাথে। তোর মতো বা’জা’রি মেয়েদের আমার ভালোভাবে চেনা আছে। সব সময় শুধু লেগে থাকা, আর নিজের ঐ নোংরা ছোঁয়ায় ছেলেদের ভুলাতে চাস।
কথাটা বলে জায়ান তাকালো ইয়ানের পানছ, দাঁতে দাঁত চেপে বলল – ঐ তো একটা জুটিয়েছিস তোর ধাঁচেরই। তাতে হয়নি তোর এখন আবার আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছিস?
– আপনাকে ছুঁতে আমার বয়েই গেছে। আপনার মতো নোংরা মানসিকতার পুরুষকে ছোঁয়ার মতো রুচি পূর্বাশার নেই। আমি দেখতে কুৎসিত হতে পারি কিন্তু আমার মনটা আপনাদের মতো কুৎসিত নয়।
একটু থামলো পূর্বাশা আবার বলল – আচ্ছা আমাকে নিয়ে আপনার সমস্যাটা কোথায়? কি করেছি আমি আপনার? এখানে আসার পর থেকেই দেখছি আমাকে অপমান করা ছাড়া আপনার পেটের ভাত হজম হচ্ছে না। আপনার সাথে আমার শত্রুটা কিসের?
দাঁতে দাঁত চাপলো জায়ান, রুক্ষ কন্ঠে বলল – শুনতে চাস তোকে নিয়ে আমার সমস্যা কি? ওকে ফাইন। তোকে নিয়ে আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তুই বাঙালি। আই হেট ইউ এন্ড আই হেট বাঙালি পিপল। বুঝেছিস তুই? আমি তোকে এবং তোর ঐ বাঙালি জাতিকে ঘৃনা করি। বাঙালিরা ধোঁকাবাজ, প্রতারক হয়। যেমন এক ধোঁকাবাজ পুরুষ ঠকিয়েছিল আমার….
এই টুকু বলেই থেমে যায় জায়ান। মুহুর্তেই কেমন যেন দূর্বল হয়ে পড়লো ছেলেটা। কারো দিকে না তাকিয়ে হুট করেই হনহন করে চলে গেল সকলের সামনে থেকে।
জায়ান চলে যেতেই কান্নায় ভেঙে পরে পূর্বাশা। এতক্ষন জায়ানের সম্মুখে সাহস করে শক্তি সঞ্চয় করে কথা বললেও ভিতরে ভিতরে জায়ানের কথাগুলো তাকে ভেঙে দিচ্ছিলো খুব বাজেভাবে। হ্যা ছোটবেলা থেকে সে মানুষের অপমান, লাঞ্চনা আর তিরস্কার পেয়ে পেয়েই বড় হয়েছে। কিন্তু এতটা কষ্ট হয়নি তার কখনও। তার চেহারা নিয়ে মানুষ হাজার কটুক্তি করলেও তার চরিত্র নিয়ে এতটা বাজেভাবে কেউ বলেনি কখনও। এতগুলো মানুষের সম্মুখে এভাবে তাকে অপমান না করলেও তো পারতো ঐ মানুষটা। সে কি করেছে? তার তো কোনো দোষ ছিল না এখানে। সে পড়ে যেতে নিয়েছিল তখন ইয়ান ছেলেটা এসে ধরেছে তাকে। সে তো বলেনি ইয়ানকে ধরতে। আচ্ছা সে কি এতটাই খারাপ যতটা জায়ান বলে গেল? কান্নার বেগ বেড়ে গেল পূর্বাশার। সকলে মিলে শান্তনা দিচ্ছে তাকে। তৃষামও জায়ানের ব্যবহারে আজ প্রচন্ড হতবাক হয়েছে। সে জানে জায়ান বদমেজাজি ধরনের। তাই বলে শুধু শুধু এতটা রিয়েক্ট করতে দেখেনি তাকে কখনও। আজ কি একটু বেশিই করে ফেললো না জায়ান? হ্যা জায়ান তার বন্ধু তাই বলে তাকে নিজের বোনকে অপমান করার কিংবা বোনের চরিত্র নিয়ে কথা বলার অধিকার তো সে দেয়নি। জায়ানের উপর তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লো যেন সেও।
__________________________________
রাত বেড়েছে। চারদিকে ছেয়ে গেছে গাঢ় অন্ধকারে। ব্যস্ত শহরটাও যেন নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে অনেকটা। হয়তো ঘুমিয়েছে সবাই। শুধু ঘুম নেই জায়ানের দুই চোখে। অন্ধকার কক্ষে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে সে। মুখশ্রীতে স্পষ্ট মলিনতা তার। তখনকার ঝামেলার পর আর হোস্টেলে ফিরেনি সে, নিজ ফ্ল্যাটে এসেছে। কলেজের কাছাকাছিই নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে তাদের। তবে কোনো এক অজানা কারনে সে নিজের ফ্ল্যাটে থাকে না। এত বিশাল ফ্ল্যাট রেখে পড়ে থাকে ঐ হোস্টেলের ছোট সিটটা দখল করে। তখন পূর্বাশাকে ঐ বাজে বাজে কথাগুলো শুনিয়ে যেন তীব্র অপরাধবোধ আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে তাকে। আজ বোধহয় একটু বেশিই করে ফেললো সে। মেয়েটাকে ওভাবে অতটা বলাও ঠিক হয়নি তার। কিন্তু কি করবে সে? তারও বা কি করার আছে? না পারছে সে মেয়েটার দিকে এগুতে আর না পারছে পিছিয়ে আসতে। আর না পারছে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে। সেই প্রথম দিন থেকে ঐ মেয়েটার প্রতি আকর্ষন বেড়ে যাচ্ছে তার। কি আছে ঐ কৃষ্ণবর্ণের কু’ৎ’সি’ত ছোটখাটো মেয়েটার মধ্যে যা অন্য কোনো মেয়ের মধ্যে নেই? কলেজে সুদর্শন পুরুষ হিসেবে বেশ সুখ্যাতি রয়েছে তার। কত মেয়ে এ পর্যন্ত তাকে নিজেদের মায়াজালে আবদ্ধ করার জন্য চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু কখনও কোনো নারীর প্রতি সে এতটা আকর্ষণ অনুভব করেনি যতটা করেছে এই বাঙালি মেয়েটার প্রতি। কেন? কেন এমন হচ্ছে। বাঙালি এই শব্দটাকেই তো সে ঘৃনা করে ছোট বেলা থেকে। বাঙালি! এই শব্দটার সাথে তার রক্ত, তার অস্তিত্ব মিশে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে তবুও এই শব্দটার প্রতি তার আকাশ সম ঘৃনা। আর সেই সে কিনা জীবনের এই ক্ষনে এসে বাঙালী এক মেয়ের প্রতিই নিজের আকর্ষন অনুভব করছে? তবে কি সেও বহু বছর আগে সংগঠিত হওয়া সেই ভুলটার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে যাচ্ছে আবার? না সেই ভুল সে করতে পারে না। সবটা জেনেশুনে একই আগুনে সে ঝাঁপ দিতে পারে না, কিছুতেই না। উঠে দাঁড়ালো জায়ান। ঐ মেয়েটার সাথে হয়তো তার দূরত্ব বজায় রাখাই উত্তম।
____________________________________
রাতের আঁধার কেটে ভোরের দেখা মিলেছে। সূর্যটাও আজ বেশ উজ্জ্বলভাবেই জায়গা করে নিয়েছে আকাশের এক কোনে। সারারাত নিজের ফ্ল্যাটে কাটিয়ে মাত্রই সে কলেজে ফিরেছে। কলেজ গেট দেখে ঢুকতে নিতেই তার দৃষ্টি আটকালো গেটের অন্যপাশে ছোট একটা দোকানে। পূর্বাশা খাবার কিনছে। সারারাত যার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে, দূরত্ব বজায় রাখবে বলে জিকির পড়েছে সকালে উঠেই সে এসে সামনে হাজির। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো জায়ান। কিন্তু মেয়েটা এত সকালে এখানে কেন খাবার কিনছে? কলেজ থেকে তো সকালের খাবার দেওয়া হয় তাহলে এখানে এসে খাবার কেনার মানে কি? জায়ান গেটের কাছেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো তার। দোকানীর সাথে কেমন দাঁত কেলিয়ে কথা বলছে মেয়েটা। দোকানীর সাথে এত হাসাহাসি কিসের এই মেয়ের? জায়ানের ভাবনার মধ্যেই দোকান থেকে খাবার নিয়ে গেটের দিকে এলো পূর্বাশা। জায়ানও নড়লো না। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রইলো পূর্বাশার পানে। হয়তো ভেবেছিল মেয়েটা এসে তার সাথেও একটু কথা বলবে। কিন্তু না, পূর্বাশা আজ তাকে পাত্তাই দিল না একদম, ফিরেও তাকালো না একবার। অপরিচিত মানুষের মতো পাশ কাটিয়ে চলে গেল। জায়নের চক্ষুদ্বয় ছোট ছোট হয়ে এলো। তাকে এড়িয়ে চলে গেল মেয়েটা? তাকে? এত বড় সাহস মেয়েটার? পরক্ষনেই জায়ানের মনে পড়লো সে তো এই মেয়েটার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায়। কাল রাতেই না পন করলো? এখন যদি এই মেয়েটাও তাকে এড়িয়ে চলে তাহলে তো তার আরও ভালো হওয়ার কথা। তাহলে সে কেন রেগে যাচ্ছে? জায়ান আর দাঁড়ালো না ওখানে সোজা চলে এলো হোস্টেলে নিজ কক্ষে। তার হোস্টেল কক্ষের দরজা আটকানো এখনও। হয়তো তৃষাম আর চ্যাং ঘুমাচ্ছে এখনও। জায়ান হাত উঁচিয়ে দরজা ধাক্কা দিল, খুললো না কেউই। এবার আর একটু জোরে ধাক্কা দিল। মিনিট খানেক যেতেই খুলে গেল দরজাটা। দরজার সম্মুখে দৃশ্যমান হলো তৃষামের ঘুম জড়ানো মুখশ্রী। জায়ান অবাক হলো ক্ষানিকটা। এত তাড়াতাড়ি তো তৃষাম ঘুম থেকে ওঠে না। আজ উঠলো যে। জায়ান কিছুটা অবাক সুরেই শুধালো – বাহ আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেছিস যে। কোনো কাজ আছে নাকি?
তৃষাম উত্তর দিল না কোনো। দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল সে। ঠাস করে একটা শব্দ করে আটকে দিল ওয়াশ রুমের দরজাটা। তৃষামের ওয়াশরুমের দরজা আটকানোর শব্দে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসালো চ্যাং। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেন মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে পড়েছে তার। কিছুটা চিল্লিয়ে সে বলল – কে! কে!
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল জায়ান। কালকে পূর্বাশার সাথে করা ব্যবহারে যে তৃষাম রেগে আছে বেশ ভালো বুঝতে পারছে সে। একটু বেশিই করে ফেলেছিল কে কাল। অতটা রিয়েক্ট না করলেও বোধহয় চলতো। মনে মনে তীব্র অপরাধবোধে জর্জরিত হলেও মুখে সে স্বীকার করতে অনিচ্ছুক জায়ান। কারো কাছে ক্ষমা চাইতে যে তার কঠিন ইগোতে লাগবে। তাই এই মুহূর্তে চুপ রইলো সে। নিজের অন্যায় জানার পরও কারো সম্মুখে স্বীকার করলো না তা।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link
[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]