#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৪
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পূর্বাশা বাইরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিযে এবার তাকালো নক্ষত্রের পানে, মৃদু হেসে বলল – আপনাকে অভিশাপ দেওয়ার সাধ্য যে আমার নেই নক্ষত্র ভাই। আমি বরং আপনাকে দোয়াই করলাম।
পূ্র্বাশার কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলতে উদ্যত হলো নক্ষত্র কিন্তু বলা আর হলো না। কিছু বলার জন্য দুই ওষ্ঠ ফাঁক করতেই প্রবেশ করলেন পাখি বেগম। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সে তাকালেন নক্ষত্রের পানে, বললেন – তুমি এখানে কি করছো?
জোরপূর্বক হাসলো নক্ষত্র, বলল – এই তো পূর্বাশার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম একটু। শুনলাম চীনে চলে যাচ্ছে নাকি তাই আর কি।
কথাটা বলে একটু থামলো নক্ষত্র, বলল – এখন আমি আসছি তাহলে।
আর এক মুহুর্তও সময় ব্যয় করলো না নক্ষত্র। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল পূর্বাশার কক্ষ থেকে। নক্ষত্রের উত্তরগুলো সব সহজ এবং সন্দেহীন হলেও ছেলেটার মুখশ্রীর অপ্রস্তুত ভঙ্গি এড়ালো না পাখি বেগমের দৃষ্টি হতে। মনের ভিতরে থাকা সন্দেহে নতুন মাত্রা যোগ হলো যেন আরও। সেদিন পূর্বাশার আ’ত্ম’হ’ত্যা করার চেষ্টার আগে শুধু মাত্র এই বাড়িতে একটা লোকেরা আগমন ঘটেছিল সে হলো নক্ষত্র। এই ছেলের কারনেই কি তাবে সেদিন আ’ত্ম’হ’ত্যা’র মতো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পূর্বাশা? হতেও পারে সেদিন মেয়ের চিৎকার চেঁচামেচি শোনার আগে নক্ষত্রকেই তো দেখেছিল মেয়ের রুম থেকে বেরিয়ে চলে যেতে। আবার এত বড় একটা কান্ড ঘটে গেল। আত্মীয় স্বজন সবাই এলো পূর্বাশাকে দেখতে ভালোবেসে না হোক কটু কথা শোনাতে অন্তত এসেছে অথচ নক্ষত্রের দেখা পাওয়া যায়নি একবারও। এত কান্ডের পর আজ এলো কি মনে করে ? শুধু কি পূর্বাশা চীনে যাচ্ছে সে জন্য? নাকি অন্য কিছু আছে? না এ বিষয়ে কথা বলতে হবে পূর্বাশার সাথে। পাখি বেগম এগিয়ে এলেন মেয়ের কাছে, দাঁড়ালেন পূর্বাশার পাশে। মেয়েটার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালেন অদূরে একাকী শালিকের পানে, নরম কন্ঠেই প্রশ্ন করলেন – নক্ষত্রের জন্য এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি?
পূর্বাশার মুখভঙ্গি এক রকমই রইলো, পরিবর্তন হলো না কোনো। অদূরে শালিকটার পানে দৃষ্টি আটকে রেখেই সে জবাব দিল – আমি কারোর জন্যই কিছু করিনি মা। আমি শুধু মাত্র নিজের একটু শান্তি, একটু মুক্তির পথ খুঁজেছিলাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পাখি বেগম, বুঝলেন মেয়ে তাকে বলবে না কিছুই। একাকী শালিকটার থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে সে তাকালেন মেয়ের পানে, বিষন্ন কন্ঠে বললেন – না গেলে হয় না?
মলিন হাসলো পূর্বাশা, বলল – একটা কথা কি জানো মা, কাছের মানুষদের কাছে কষ্ট বেশি। আমি কেমন? আমার রূপ কেমন? আমার চরিত্র কেমন আমি তা জানি। আর এইসব নিয়ে যখন কোনো অপরিচিত মানুষ কথা বলে কিংবা আঙুল তুলে তখন কষ্ট হয় না। যখন কোনো পরিচিত মানুষ আমাকে চিনে, ছোটবেলা থেকে বড় হতে দেখে আমাকে আদর যত্ম কিংবা ভালো না বেসে আমার আমাকে, আমার চরিত্র নিয়ে, রুপ রূপ নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন কষ্ট হয়, ভীষন কষ্ট হয়। কলিজাটা মনে হয় ফেটে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, বাঁচা দায় হয়ে পড়ে। আমাকে আটকিও না মা, আমার বেঁচে থাকতে হলেও আমার এখন যাওয়া প্রয়োজন। এই চেনা পরিচিত শহর, শহরের মানুষের থেকে অচেনা অজানায় পাড়ি দেওয়া প্রয়োজন।
পাখি বেগম আর কথা বাড়ালেন না। বুঝলেন মেয়েকে আটকানো আর সম্ভব নয় তার। এ কয়দিন চীনে না যাওয়ার জন্য মেয়েকে বুঝিয়েছেন তিনি অনেক কিন্তু মেয়ে বুঝতে চায়নি কিছুই। সে তার সিদ্ধান্তে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও অব্দি। তবুও একবার শেষ চেষ্টা করতে এসেছিলেন কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা যাক, অন্তত সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলেও মেয়েটার এই সভ্যতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অসভ্য সমাজ থেকে চলে যাওয়াই শ্রেয়।
______________________________________
সময় প্রবাহমান। সে বয়ে চলে বাঁধাহীন নদীর স্রোতের মতো। অপেক্ষা করে না কারো জন্য। দেখতে দেখতে এর মধ্যেই কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। পূর্বাশার চীনে যাওয়ার দিনটাও উপস্থিত হলো। সকলকে বিদায় দিয়ে এয়ারপোর্টেও চলে এসেছে পূর্বাশা। যদিও তার বিদায় দেওয়ার মতো কেউই নেই, কাউকে নিজের মুখ থেকে বিদায় জানায়নি সে। তার হয়ে তার মা পাখি বেগমই পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এখানে এসেছে। এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়েই কান্নায় যেন ভেঙে পড়েছেন পাখি বেগম। যে মেয়েকে ছোট বেলা থেকে কাছ ছাড়া করেনি কখনও আজ সেই মেয়ে তাকে ছেড়ে দূরদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। মেয়েটা কিভাবে থাকবে? কিভাবে খাবে? একা মেয়ে মানুষ কোনো বিপদ আপদ হয় যদি। চিন্তায় চিন্তায় দুই দিন আগ থেকে খাওয়া নাওয়া ছেড়েছেন পাখি বেগম। তবুও গললো না তার পাষান মেয়ের হৃদয়। সে একটা কথা অব্দি বলেনি কারো সাথে, বিদায়ও নেয়নি। আহমেদ সাহেব পাখি বেগমের কান্না দেখে শান্তনা দিতে চাইলেন তাকে, বললেন – আহ পাখি এভাবে কাঁদছো কেন? আমাদের মেয়ে কি সারাজীবনের জন্য চীনে চলে যাচ্ছে নাকি? ও আসবে তো আবার। তাছাড়া ওখানে তৃষাম আছে দেখে রাখবে পূর্বাশাকে।
পাখি বেগমের কান্না থামলো না তবুও, কান্নারত অবস্থায়ই সে বলল – তুমি বুঝবে কি? তুমিও তো তোমার মেয়ের মতো পাষান। তোমাদের কি আর কষ্ট আছে?
সে পাষান? হয়তো তাই। নয়তো নিজের এত আদরের মেয়েকে দূর দেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারতো নাকি? বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আহমেদ সাহেবের, মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন – সাবধান যাস, কল করিস।
বাবার কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই পূর্ণতা আর পলাশ এসে জড়িয়ে ধরলো পূর্বাশাকে। তার ছোট ভাই বোন এ দুজন। ছোট বলতে একদমও ছোট নয় পলাশ এবার ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে আর পূর্ণতা এসএসসি দিবে। পূর্ণতা বোনকে জড়িয়ে রেখেই বলল – আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিস আপু?
পলাশও যোগ দিল পূর্ণতার কথার সাথে, বলল – হুম আপু আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিস তুই?
পূর্বাশা হাসলো একটু। এই ভাইবোন দুটো যে ছোটবেলা থেকেই তার বড্ড নেওটা। সে চলে গেলে হয়তো কেঁদে কেটে পড়াশোনা সব লাটে উঠাবে। পূর্বাশা ছোট ভাই বোন দুটোকে বুঝানোর ভঙ্গিতে বলল – আমি একদম চলে যাচ্ছি বোকা? আমি তো পড়তে যাচ্ছি। কলেজের ছুটি পড়লেই চলে আসবো।
পূর্বাশার কথায় কিছুটা অবাক হলো পলাশ। অবাক কন্ঠেই বলল – আপু তুই বিদেশ যাচ্ছিস অন্য দেশে ওখান থেকে কি এভাবে আসা যাওয়া সম্ভব?
– চীন আমাদের দেশ থেকে দূরে নয় বেশি মাত্র দুই আড়াই ঘন্টার ব্যাপার। প্লেনের টিকিট কাটবো আর হয়ে যাবে।
বোনের মুখে আশার বানী শুনে যেন ভরসা পেল পূর্ণতা আর পলাশ। পূর্ণতা বোনকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে বলল – সত্যি তুই আসবি তো আপু।
– আসবো।
কথাটা বলে পূর্বাশা নিজেও জড়িয়ে ধরলো দুই ভাই বোনকে। কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো সে ভাই বোনদের স্বান্নিধ্যে এসে।, চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো তার। পূর্বাশা বুঝলো সে দূর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু আজ যে তাকে দূর্বল হলে চলবে না। তাকে যেতে হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই কুৎসিত সমাজে তাকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। পূর্বাশা ছেড়ে দিল ভাই বোনকে। দেরী হওয়ার অজুহাতে ঢুকলো এয়ারপোর্টে। বুকের উপর পাথর চাপা দিয়েই পূরণ করতে শুরু করলো এয়ারপোর্টের সকল কার্যক্রম। সব কাজ শেষে গিয়ে বসলো প্লেনে। হয়তো একটু পরই সে উড়াল দিবে দূর দেশে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল পূর্বাশা। প্লেনের জানালা থেকে শেষ একবার দেখে নিল তার চিরচেনা শহরটাকে।
*****
সময় গড়ালো কিছুটা। যথাসময়ই প্লেন তার যাত্রা শুরু করেছিল। প্লেন ছাড়ার মাত্র দুই আড়াই ঘন্টার ব্যবধানে পূর্বাশা এখন চীনে। নতুন শহর নতুন দেশ নতুন মানুষের মাঝে। কেমন একটু ভয় ভয় লাগছে মেয়েটার। মনের মধ্যে কিছুটা ভয় চেপে প্লেন থেকে নেমে ব্যাগ লাগেজ কালেক্ট করলো পূর্বাশা। একটু এগিয়ে তাকালো চারপাশে। চারপাশে সকলের মধ্যেই বিদেশি ছোঁয়া। ছেলে মেয়ে উভয়ই শার্ট প্যান্ট আবার কিছু মেয়েরা ছোটখাটো পোশাকেও আবৃত করেছে নিজেদের। শুধুমাত্র তার পড়নেই ভিন্ন পোশাক। নিজের দিকে তাকালো পূর্বাশা, হালকা গোলাপী রঙের একটা সালোয়ার কামিজ জড়ানো তার শরীরে। ওড়নাটাও বেশ ভালোভাবেই দেওয়া, চুলগুলো একটা বিনুনি করে ফেলে এক পাশে। এভাবেও সাদামাটা পোশাকে কেউ বিদেশে পাড়ি দেয়? হয়তো দেয় না কিন্তু পূর্বাশা দিয়েছে। আশেপাশে অনেকেই আড় চোখে দেখছে তাকে। হয়তো তার কুৎসিত চেহারা বা পোশাকের কারনে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেয়েটা। হাতেল ব্যাগগুলো ধরে এগিয়ে গেল আর একটু সামনের দিকে। তৃষামের নিতে আসার কথা তাকে। গতকাল রাতেও কথা হয়েছে তার সাথে। প্লেন ছাড়ার পূর্বমুহূর্তেও সে একটা এসএমএস করে রেখেছে তৃষামকে যে সে রওনা দিয়েছে। কিন্তু তৃষাম কোথায়? আসেনি কি ছেলেটা? পূর্বাশা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল একটা বড় কাগজের উপর। কেউ একজন মুখের উপরে লম্বা করে একটা কাগজ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বেশ মোটা কালির কলম দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লিখে রেখেছে “Purbasha”। যদিও কাগজটা ধরে থাকা মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু পূর্বাশার অশান্ত মনটা শান্ত হলো কিছুটা। কেউ তো তার জন্য এসেছে। কিন্তু এ কে? তৃষামের মতো তো মনে হচ্ছে না। তৃষাম তো এত লম্বা ছিপছিপে নয়। সে ছোট খাটো তবে ফর্সা। তবে কি চীনে এসে লম্বা হয়ে গেল ছেলেটা? মনের মধ্যে একরাশ সন্দেহ নিয়েই সে এগিয়ে গেল ছেলেটার পানে, মৃদু কন্ঠে ডাকলো – তৃষাম ভাই!
সম্মুখে মেয়ালী কন্ঠস্বরে মুখের উপর থেকে কাগজটা সরালো ছেলেটা, চমকালো পূর্বাশা। এ তো তৃষাম নয়। চীন দেশীয় শুভ্র গায়ের রঙের ছোট চোখের অধিকারী এক সুদর্শন মানব। লম্বাটে ফর্সা তৈল চকচকে তার দেহ। তবে নাকটা বোচা নয়, খাড়া আকৃতির। পূর্বাশার জানামতে চীনের নাগরিকদের তো নাক বোচা হয় তাহলে এর নাক খাড়া কিভাবে? নিশ্চই সার্জারি করিয়েছে। এসব দেশে সার্জারি তো স্বাভাবিক ঘটনা। পূর্বাশা গোল গোল চোখে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো ছেলেটাকে। ছেলেটা তার ছোট ছোট মার্বেলের মতো চোখ দিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পূর্বাশার মুখপানে। অতঃপর পকেট থেকে মোবাইল বের করে তাতে থাকা কোনো ছবির সাথে মিলালো পূর্বাশার চেহারা অতঃপর ইংরেজি বাক্যে বলল – লেটস গো। ( চলো যাই )
ছেলেটা স্বাভাবিক কন্ঠে লেটস গো বললেও পূর্বাশা সাহস পেল না তার সাথে যাওয়ার। কে না কে এই ছেলে কে জানে? তৃষাম কোথায়? আসার কথা তো তার ছিল মাঝ খান থেকে এ কে এলো? তৃষাম তাকে পাঠিয়েছে বা কিছু বললও তো না। হুট করে সামনে এসে বলে দিল – লেটস গো। এ কেমন কথা? এ লোক যদি আবার কোনো ছেলে ধরা টরা হয়। হ্যা সে শুনেছে বিদেশে এমন অনেক মেয়েদের এয়ারপোর্ট থেকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গিয়ে পাচার করে দেয়। এই ছেলেটাও যদি ঐ পাচারকারীদের মধ্যে কেউ হয়? না না এর সাথে তার যাওয়া চলবে না কিছুতেই। পূর্বাশার এই মুহূর্তে কান্না পাচ্ছে ভীষণ। একটু শান্তি পেতে সে এসেছিল এই দেশে, এখানে এসে কিনা শেষ পর্যন্ত ছেলে ধরার হাতে পড়লো।
চলবে……
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link
[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]