স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৩

0
367

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

কথাটা বলে একটু থামলেন ডালিয়া বেগম, নাক ছিটকে বললেন – ছোট বেলা থেকে ঐ চেহারা নিয়ে তো আমাদের কাউকে শান্তি দেয়নি ঐ মেয়ে। এখন ম’রা’র সময়ও শান্তি দিল না। আমাদের মান সম্মান আর কিছু রইলো না এই সমাজে, ছিঃ ছিঃ।

আহমেদ সাহেব অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন বোনের পানে। চাইলেন তাকে কিছু শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু পারলেন না। তখনই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে এলেন তার মেয়ের চিকাৎসারত ডাক্তার। আহমেদ সাহেব ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে, বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন – আমার মেয়ে! মেয়ে কেমন আছে এখন?

– আপনার মেয়ে এখন আশঙ্কামুক্ত। হাত কাটার অস্ত্রটা ততটা ধারালো না হওয়ায় হাতের মূল শিড়া কাটেনি। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছে আপনার মেয়ে।

কথাটুকু বলেই ডাক্তার চলে গেলেন নিজের কার্যে। আহমেদ সাহেব যেন এতক্ষনে প্রান ফিরে পেলেন, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন একটা। তার মেয়ে যে বেঁচে আছে এই অনেক। সৃষ্টিকর্তার কাছে লাখ লাখ শুক্রিয়া এ যাত্রায় তার মেয়েকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য।

***

কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই পূর্বাশার সাথে করার অনুমতি দিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মেয়েটার সাথে দেখা করার অনুমতি পেতেই একে একে সকলে দেখা করতে গেল তার কেবিনে। কিন্তু পূর্বাশার মনটা যে এখনও বেহায়া নির্লজ্জ বেশ। তার মন এই মুহূর্তে এসেও নক্ষত্রকে একটা বার দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলো। কেবিনের চারপাশে চোখ বুলালো পূর্বাশা, সবাইকে দেখতে পেলেও নক্ষত্রকে নজরে পড়লো না তার। হয়তো সে আসেনি, কিন্তু এতকিছুর পরও মেয়েটার বেহায়া মনটা আশা করেছিল সে আসবে। আচ্ছা সে কি শেনেনি পূর্বাশার মৃ’ত্যু’র পথে পা বাড়ানোর কথা, আ’ত্ম’হ’ত্যা’র কথা। ডালিয়া বেগম যখন শুনেছেন তখন অবশ্যই সেও শুনেছেন। কিন্তু আসেনি। তবে কি সে ম’রে গেলেও তাকে শেষ একটা বারের জন্যও দেখতে আসতো না নক্ষত্র? হয়তো আসতো না। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো পূর্বাশা, মনে মনে বলল – যাকে আমার কান্নার শব্দ প্রতিহত করতে পারেনি। তাকে আমার মৃত্যুর সংবাদ প্রতিহত করতে পারবে না কখনও।

ডালিয়া বেগম পূর্বাশার কেবিনে প্রবেশ করেই মুখ বাকালেন। মেয়েটাকে শুনাতে চাইলেন কিছু তিক্ত বানী, কিন্তু পারলেন না। পূর্বাশার সম্মুখে তিনি মুখ খুলতেই সে কথা অন্য কথায় নিয়ে ঘুরিয়ে দিলেন জুলিয়া বেগম। শুধু ঐ একবার নয়, কেবিনে অবস্থানরত অবস্থায় তিনি যতবারই মুখ খুলেছেন ততবারই তার কথাকে অন্য কোনো কথায় নিয়ে ঘুরিয়ে দিয়েছেন জুলিয়া বেগম অথবা আহমেদ সাহেব। পূর্বাশা অবশ্য বুঝতে পেরেছে সবটা। কিন্তু বলল না আজ কিছুই, কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না তার আর। নিজের ভাগ্যের কাছে যে সে আবারও হেড়ে গেল একবার। মুক্তি পেয়েও যেন পেল না। আবারও ফিরে এলো এই তিক্ত বি’ষা’ক্ত জীবনে। পূর্বাশার সাথে দেখা করে সবাই চলে গেলেন শুরু রয়ে গেলেন না আহমেদ সাহেব এবং পাখি বেগম। পাখি বেগম গিয়ে বসলেন মেয়ের মাথার কাছে, কান্নারত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন – এমন কেন করলি মা? আজ যদি তোর কিছু হয়ে যেত তবে কি নিয়ে বাঁচতাম আমরা?

পূর্বশা মায়ের কথার উত্তর দিল না কোনো। মাথা নিচু এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো নিচের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আহমেদ সাহেব, বললেন – তুমি একটু বাইরে যাবে পাখি?

পাখি বেগম না বললেন না আর। তিনি জানেন বাবার সাথে তার মেয়ের বন্ধন দৃঢ় বেশি। এ নিয়ে যদিও সর্বদাই তার অভিযোগ ছিল প্রচুর। বাবা মেয়ের মহব্বত দেখে সর্বদাই তিনি তেতে উঠতেন, বলতেন – টানা ৯ মাস ১৭ দিন গর্ভে ধরে এত কষ্ট করে জন্ম দিয়েছি আমি আর মেয়ে কিনা বাবা বলতেই অজ্ঞান।

তবে আজ আর তিনি বললেন না কিছুই। হয়তো বাবার কাছেই মেয়ে মুখ খুলবে। কোনো কথা না বলে চুপচাপ কেবিন থেকে বাইরে চলে গেলেন পাখি বেগম। কেবিন ফাঁকা হতেই একটা মোড়া টেনে পূর্বাশার পাশে বসলেন আহমেদ সাহেব, হাত রাখলেন মেয়ের মাথায়। কোমল কন্ঠে বললেন – কেন, কি কারনে তুমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছো আমি জিজ্ঞেস করবো না তোমাকে। তবে এইটুকু বলবো তোমার সিদ্ধান্তে ভুল ছিল। আমি তোমাকে ঠিক ভুল সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছি আগেই। তারপরও এমন একটা ভুল সিদ্ধান্ত আশা করিনি তোমার থেকে।

একটু থামলেন আহমেদ সাহেব আবার বললেন – আ’ত্ম’হ’ত্যা কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। জীবনে হাসি কান্না, দুঃখ কষ্ট সব আছে। এখন সুখের সময় আমরা সুখটা স্বাচ্ছন্দ্যে মেনে নিবে আর কষ্ট হলে কিংবা বিপদ এলে যে তা থেকে পালিয়ে যেতে চাইবে তা তো ঠিক নয়। যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়ে আমাদের তা কঠোরভাবে মোকাবেলা করে সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে, এটাই জীবনের নিয়ম নীতি। সম্মুখে বিপদ কিংবা কষ্ট দেখে জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচা নিশ্চই কোনো সত্যিকার্থে মানুষের কাজ নয়। আমি তোমাকে বারবার বলেছি জীবন একটা লড়াইয়ের স্থান। এখানে কঠোরভাবে লড়াই করে, সকল দুঃখ কষ্টের মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে হবে।

পূর্বাশা মন দিয়ে শুনলো বাবার কথা। মনে মনে নিজের সিদ্ধান্তের জন্য যেন কিছুটা অনুশোচনা হলো তার। নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেই সে বলল – আমাকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিবে বাবা?

আহমেদ সাহেব এবারও জিজ্ঞেস করলেন না কিছু। মেয়ে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিষয়ে জানতে একদম আগ্রহী নন তিনি। এই মুহূর্তে তিনি শুধু মাত্র আগ্রহী মেয়ের খুশি এবং মেয়ের ভালোতে। মেয়ের অসুস্থ মলিন মুখপানে তাকিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন আহমেদ সাহেব, বললেন – কোথায় যেতে চাইছো তুমি?

পূর্বাশা এবার মুখ তুলে তাকালো বাবার পানে, বলল – এই সমাজ, এই শহর, এই মানুষগুলোর থেকে দূরে, বহুদূরে কোথাও।

আহমেদ সাহেব পরম যত্মে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলেন মেয়ের মাথায়, বললেন – তুমি যা চাইছো তাই হবে তবে তার আগে যে তোমাকে কথা দিতে হবে একটা।

বাবার মুখে শর্তের কথা শুনেও কোনো উৎসাহি ভঙ্গিমা দেখা গেল না পূর্বশার চোখমুখে। মলিন নিরুৎসাহিত কন্ঠেই সে প্রশ্ন করলো – কি শর্ত?

– জীবনে যতই প্রতিকূল পরিস্থিতি আসুক না কেন তুমি আর এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিবে না কখনও।

পূর্বাশা ছলছল নয়নে তাকালো বাবার মলিন মুখ পানে। মনে মনে ভীষন অনুতপ্ত হলো সে। কে বলেছে, তাকে ভালোবাসার মানুষ নেই। আছে তো এই যে তার বাবা মা ছোট ভাই বোন দুটো। এই মানুষ গুলোর ভালোবাসা উপেক্ষা করে কিনা সে নিজের মুক্তির আশায় এত বড় একটা পদক্ষেপ নিয়েছিল? শুধু মাত্র এই সমাজ, কিছু বি’ষা’ক্ত মানুষ আর নক্ষত্রের জন্য যার জীবনে জায়গা নেই কোনো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই পূর্বাশা কথা দিল, বলল – কথা দিলাম বাবা।

_____________________________________

কেটে গেল দিন চারেক। পূর্বাশাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। এদিকে আহমেদ সাহেবও মেয়েকে শিক্ষার্থী ভিসায় চীনে পাঠানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে সব। যদিও তিনি চাইলে ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতেও মেয়েকে পাঠাতে পারতেন কিন্তু ওসব দেশে সাহসে কুলায়নি তার। ওসব দেশে তার আত্মীয় স্বজন নেই কোনো। পূর্বাশা ওইসব কোনো দেশে গেলে সারাক্ষণ মেয়ের চিন্তায় থাকতে হবে তাদের। আর চীনে পূর্বাশার মামাতো ভাই তৃষাম শিক্ষার শুবাদে থাকে, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সে। আর চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদম খারাপ নয়। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চীনের অবস্থানও রয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে চীনও উন্নত রাষ্ট্র। তারা পড়াশোনার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে প্রচুর। সব মিলিয়ে আহমেদ সাহেব মেয়েকে চীনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মূলত তৃষানের মাধ্যমেই এত তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থাো করতে পেরেছেন সে। পূর্বাশার IELTS টা আগেই করা ছিল বিধায় সমস্যা হয়নি বেশি। কিছুদিনের মধ্যেই সে পাড়ি দিতে পারবে এই সমাজ এই শহর ছেড়ে দূরে দেশে। দূরে চলে যেতে পারবে নক্ষত্র নামক পুরুষের ছায়া থেকে।

***

পড়ন্ত বিকেল। আকাশের এক কোনে লালাভ ধারনকৃত সূর্যটা ঢলে পড়েছে। পাখিরা উড়ে উড়ে নীড়ে ফিরছে তাদের। পূর্বাশা নিজের রূমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে সূর্যের বিদায়ে এ মলিন ধরনীকে। তখনই তার পিছনে অনুভব করলো কাউকে। ফিরে তাকালো না সে। অদূরে বিদ্যুতের তারের উপর বসা অদূরে একলা এক শালিকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল – কি খবর নক্ষত্র ভাই? হঠাৎ এলে যে…

নক্ষত্র কিছুটা ইতস্ততবোধ করলো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এ কয়দিনে সে একবারও মেয়েটাকে দেখতে আসেনি ভেবেছে কেউ যদি তাকে সন্দেহ করে কিংবা পূর্বাশা সবাইকে বলে দেয় তার কথা। মেয়েটা তো আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছে তার জন্যই, মেয়েটার জীবনে এমন দূর্দশার জন্য সেই দায়ী। যদিও এ নিয়ে কোনো অপরাধবোধ নেই নক্ষত্রের। তার ভাবনা মতে চ্যালেঞ্জে জেতার জন্য সে এমন অভিনয় করেছে আর তা স্বীকারও করেছে। ওমন একটা মেয়েকে কি সত্যি সত্যি ভালোবাসা যায় নাকি? এ জন্য পূর্বাশার মতো মেয়ের এমন একটা সিদ্ধান্ত অবশ্যই বোকামীর পরিচয় দিয়েছে তার কোনো ভুল নেই এখানে। তার ভুল হতো যদি সবটা স্বীকার না করে দিনের পর দিন মেয়েটার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যেত। অবশ্য বাঙালিদের একটাই দোষ এরা কখনও নিজেদের অন্যায়, ভুল দেখে না। এরা যত অন্যায়ই করুক না কেন এরা সবসময় অন্যের ভুল ধরার জন্য মুখিয়ে থাকে। নক্ষত্রকে চুপ করে থাকতে দেখে তার দিকে ফিরে তাকালো পূর্বাশা, আবার বলল – কেন এসেছো নক্ষত্র ভাই?

– শুনলাম বিদেশ যাচ্ছিস।

পূর্বাশা দৃষ্টি সরালো নক্ষত্রের দিক থেকে। বারান্দার গ্রিল গলিয়ে আবারও সেই একাকী শালিকের পানে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে জবাব দিল – হুম।

নক্ষত্র এবার নিজের পক্ষে কিছুটা সাফাই দিতে চাইলো। পূর্বাশাকে বুঝাতে চাইলো এখানে তার কোনো দোষ নেই, নিজের পক্ষে সাফাই দিতে নক্ষত্র বলল – দেখ পূর্বা তুই যাই করেছিস বা করছিস এখানে আমার কিন্তু দোষ নেই কোনো। হ্যা আমার দোষ হতো যদি সবটা লুকিয়ে রেখে দিনের পর দিন তোর সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতাম। কিন্তু আমি তা করিনি আমি চ্যালেঞ্জে জিতেই তোকে বলে দিয়েছি সবটা। তারপরও এমন একটা বোকামী কি করে করলি তুই?

বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখেই মলিন হাসলো পূর্বাশা, মলিন কন্ঠেই বলল – আমাদের আবারও জন্ম হোক নক্ষত্র ভাই। দোয়া করি, সে জন্মে আপনি আমার প্রণয়ে আসক্ত হন, আমি তখন আপনাকে ধোঁকা দিয়ে বুঝিয়ে দেব আজ আমার অবস্থান।

নক্ষত্র পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পূর্বাশার পানে, বলল – অভিশাপ দিচ্ছিস?

পূর্বাশা বাইরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিযে এবার তাকালো নক্ষত্রের পানে, মৃদু হেসে বলল – আপনাকে অভিশাপ দেওয়ার সাধ্য যে আমার নেই নক্ষত্র ভাই। আমি বরং আপনাকে দোয়াই করলাম।

চলবে……

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here