#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৪
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
নিজের ভিতরে একরাশ অস্বস্তি নিয়েই পূর্বাশা জায়ানকে বলল – আমাকে নিচে নামিয়ে দিন। আমি হেঁটে যেতে পারবো।
জায়ান পূর্বাশার কথায় কর্ণপাত করলো না তেমন। তাকে কোলে নিয়েই ঢুকলো মেডিকেল সেক্টরে। ধপাস করে ফেললো বিছানার উপর। কোমড় ধরে চেঁচিয়ে উঠলো পূর্বাশা। যে জোড়ে ছুঁড়ে ফেললো তাতে যেন পায়ের থেকে সে কোমড়ে ব্যথা বেশি পেয়েছে সে। পূর্বাশা কোমড় ধরেই শুয়ে পড়লো। জায়ান কিছুটা জোড়ালো ডাকলো ডাক্তারকে, বলল – মিসেস শীও এটাকে দেখুন। এসে থেকে একটার পর একটা ঝামেলা লাগিয়েই রেখেছে। হয় এর ঝামেলা ছাড়িয়ে সোজা করে দিন নয়তো পুরোপুরি ঝামেলা বানিয়ে কয়েকদিনের জন্য বসিয়ে দিন।
মিসেস শীও এগিয়ে এলেন। একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন জায়ানের পানে অতঃপর বসলেন পূর্বাশার পাশে, বললেন – কি হয়েছে?
পূর্বাশা কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই জায়ান ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল – উনার ঐ ছোট খাটো চড়ুই পাখির পায়ের মতো পায়ের উপর থেকে ট্রাক্টর গেছে।
জায়ানের কথায় বিরক্ত হলেন মিসেস শীও তবে বলেন না কিছু। চিন্তিত ভঙ্গিতে সে ধরলেন পূর্বাশার গান পা। একটু নাড়াচাড়া করতেই চেঁচিয়ে উঠলো পূর্বাশা। মিসেস শীও তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিলেন পা খানা, চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করলেন – কিভাবে ব্যথা পেয়েছো পায়ে?
ততক্ষণে ইয়ানও এসে পড়েছে হাসপাতাল সেক্টরে। মিসেস শীও প্রশ্ন করতেই পূর্বাশার আগে উত্তর দিল সে। অপরাধীর কন্ঠে বলল – সাইকেল এক্সিডেন্টে। গতকাল রাতে আমি সাইকেল চালাতে গিয়ে ভুলবশত উনার পায়ে সাইকেল উঠিয়ে দিয়েছিলাম।
জায়ানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। শকুনের মতো দৃষ্টিতে তাকালো সে ইয়ানের পান, ধারালো কন্ঠে শুধালো – আপনাকে জিজ্ঞেস করেছে কেউ?
একটু অপ্রস্তুত হলো ইয়ান, আমতা আমতা করে বলল- না মানে উনি….
– উনি কি? এক্সিডেন্টে পায়ের সাথে সাথে উনার মুখটাও বন্ধ হয়ে গেছে নাকি?
ইয়ান উত্তর দিতে চাইলো কিছু কিন্তু পারলো না। তার আগেই মিসেস শীও পূর্বাশার পা খানা দেখতে দেখতে বললেন – পায়ে ভালোই চোট পেয়েছো। যদিও ভাঙেনি তবে তোমার রেস্টে থাকা উচিৎ কিছুদিন। নয়তো পরে সমস্যা হতে পারে।
মিসেস শীওর কথাটা শেষ হতেই পূর্বাশাকে সাহায্যার্থে এগিয়ে এলো ইয়ান, পূর্বাশার পানে তাকিয়ে শুধালো – তাহলে আমি আপনার ছুটির জন্য আবেদন করে দেই এখনই?
দাঁতে দাঁত চাপলো জায়ান, বলল – কেন এক্সিডেন্টে উনার হাত উড়ে গেছে? উনি আবেদন করতে পারবেন না?
– না উনি আবার কষ্ট করে লিখবেন। তাই ভাবছিলাম আমি….
– অশিক্ষিত মনে হয় উনাকে আপনার? নাকি হাতহীন প্রতিবন্ধী মনে হয়?
জায়ানের কথায় কিছুটা দমে গেল ইয়ান। তবে মনে মনে সে চটেছে বেশ। কে এই ছেলে? পোশাক দেখে তো মনে হচ্ছে একজন প্রশিক্ষক। প্রশিক্ষক প্রশিক্ষকের মতো থাকবি। শিক্ষার্থীদের জন্য এত আলগা পিরিত কিসের। মনে মনে জায়ানের গুষ্টি উদ্ধার করলেও প্রকাশ্যে ভদ্র ছেলের মতো চুপ রইলো সে বলল না কিছুই। তবে চুপ রইলো না জায়ান। সে শক্ত দৃষ্টিতে তাকালো পূর্বাশার পানে, বলল – ঝামেলা ছাড়া চলতে পারেন না আপনি? ঝামেলার বস্তা আপনি একটা। দেশে বসেও ঝামেলা বাঁধাতেন বলেই সম্ভবত আপনার বাবা মা বস্তা ভরে আপনাকে চায়নায় সাপ্লাই করে দিয়েছে।
এতক্ষন জায়ানের কথা শুনে কেউ কিছু না বললেও এবার তাকে ধমকে উঠলো মিসেস শীও, বলল – জায়ান!
জায়ান সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, বলল – ইয়েস মিসেস শীও।
মিসেস শীও কটমট করে তাকালেন জায়ানের পানে, আদেশের সুরে বললেন – এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও
– কিন্তু…
কথাটা আর সম্পূর্ণ করতে পারলো না জায়ান। মিসেস শীও আবার ধমকে উঠলো জায়ানকে, বলল – কি বলেছি আমি। আর এক সেকেন্ডও যেন তোমাকে আমি আমার চোখের সম্মুখে না দেখি।
জায়ান আর কথা বাড়ালো না। একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো ইয়ানের পানে অতঃপর বেরিয়ে গেল মেডিকেল সেক্টরের থেকে। জায়ান বেরিয়ে যেতেই মিসেস শীও তাকালেন ইয়ানের পানে। ছোট চোখ দুটো আরও ছোট ছোট করে বলল – তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? তোমাকেও যেতে বলেছি আমি।
– কিন্তু ম্যাম…
– এক্ষুনি বের হও।
ইয়ান হতাশ হলো। অসহায় দৃষ্টিতে সে তাকালো পূর্বাশার পানে অতঃপর বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। ওরা দুজন বাইরে যেতে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মিসেস শীও। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে তাকালেন পূর্বাশার পানে। আলতো হেসে বললেন – সেদিন তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগই পাইনি একদম। নাম কি তোমার?
সৌজন্যসূচক হাসলো পূর্বাশা, বলল – আমি পূর্বাশা।
– বাহ সুন্দর নাম। আমি শীও। তুমি আমাকে আন্টি বলে ডোকো কেমন।
পূর্বাশা ক্ষানিকটা অবাক হলো। কলেজের হাসপাতাল সেক্টরের একজন ডাক্তার কিনা তাকে আন্টি বলে ডাকতে বলছে। মহিলা এত তাড়াতাড়ি মিশে গেল ওর সাথে। মনের ভিতরে অবকতা থাকলেও বাহিরে তা প্রকাশ করলো না পূর্বাশা। শুধুমাত্র মাথা নেড়ে মিসেস শীওকে বুঝালো সে আন্টি বলেই ডাকবে।
****
সময় গড়ালো কিছুটা। পূর্বাশা খোড়াতে খোড়াতে এসে দাঁড়ালো মাঠের মধ্যভাগে। এতক্ষন সে হাসপাতাল সেক্টরেই শুয়ে ছিল। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষন শুয়ে থাকা যায়? বোরিং লাগছিল ভীষন। তাই হাসপাতাল সেক্টর থেকে এখানে চলে এসেছে সে। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ না করতে পারুক এখানে বসে বসে দেখতে তো পারবে। আস্তে ধীরে মাঠের মধ্যভাগে প্রশিক্ষণ চলা স্থানের একটু পাশে ঘাসের উপর বসলো পূর্বাশা। তখনই তার কর্নে ভেসে এলো কারো কারো কন্ঠস্বর। পূর্বাশা এদিক ওদিক তাকালো, চোখে পড়লো কালকের মেয়েগুলোকে যারা ক্যান্টিনে তাকে গায়ের রং উচ্চতা নিয়ে তিরস্কার করছিলো। পূর্বাশা তাকাতেই তাদের মধ্য থেকে একটা মেয়ে হাত নাড়ালো, হেসে বলল – হাই ডার্কি।
সাথে সাথেই হেসে উঠলো সকলে। তাদের পশেই ছিল সেনজেই, সুজা, আর জেফি। মেয়েগুলোর কথা তাদের কানেও পৌঁছেছে। গতকাল তারা চুপচাপ শুনলেও আজ ফুসে উঠলো। তিনজনই গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েগুলোর সম্মুখে। জেফি ঠোঁট টেনে হেসে বলল – হাই মেকআপ কুইন। কত কেজি মেকআপ মেখেছো মুখে?
ফুসে উঠলো যেন মেয়েগুলো। তাদের মধ্য থেকে একজন রিচা নিজের ডান হাত উঁচিয়ে তার তর্জনী আঙ্গুলটা তুললো জেফির পানে, বলল – ইউ…
সেনজেই একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মুচড়ে ধরলো রিচার আঙ্গুল। ব্যথায় কাকিয়ে উঠলো মেয়েটা। পাশের মেয়েগুলোও কিছুটা চড়াও হলো সেনজেই, সুজা আর জেফির দিকে। তবে করতে পারলো না কিছু। তার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো তাদের প্রধান প্রশিক্ষক। গম্ভীর কন্ঠে বলল – এখানে কি হচ্ছে?
প্রধান প্রশিক্ষকের কন্ঠ পেয়েই চুপসে গেল সবাই। ঝগড়া রেখে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল – কিছু না স্যার।
প্রধান প্রশিক্ষক বোধহয় বিশ্বাস করলো ওদের কথা। সে আর বলল না কিছুই। প্রশিক্ষণের আদেশ দিয়ে প্রস্থান করলো ঐ স্থান ছেড়ে।
____________________________________
রাতের আঁধার ঘনিয়েছে। দিনের সূর্যকে বিদায় জানিয়ে নীল আকাশটা আঁধারে ঢেকে গেছে। যদিও রাত এখনও খুব বেশি গড়ায়নি। ঘড়ির কাঁটায় মাত্র আটটা। পূর্বাশা চুপচাপ বসে রয়েছে তার কক্ষে। সেনজেই, জেফি আর সুজা বাইরে গেছে সেই সন্ধ্যায়। এখনও ফিরেনি। একা একা রুমে বসে বোরিং অনুভব করছে মেয়েটা। সেও অবশ্য যেতে চেয়েছিল কিন্তু তার পায়ের ব্যথার জন্য তাকে নেয়নি কেউ। যদিও পূর্বাশা মেয়েটা একাকিত্বেই বেশি অভ্যস্ত তবে এই কয়দিনে এই মেয়েগুলো কেমন যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তার। এখন আর একা একা ভালো লাগতে চায় না। পূর্বাশার ভাবনার মধ্যেই রুমের দরজা খুলে রুমের ভিতরে ঢুকলো সেনজেই, জেফি এবং সুজা। হাতে তাদের এক গাদা শপিং ব্যাগ। পূর্বাশা সুরু দৃষ্টিতে তাকালো তার রুমমেট তিনজনের পানে, এরা তাহলে শপিং এ গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষনেই তাকে অবাক করে দিয়ে সেনজেই, সুজা আর জেফি এসে তাদের হাতের জিনিসপত্রগুলো রাখলো পূর্বাশার সম্মুখে, সেনজেই বলল – এগুলো সব তোমার জন্য।
পূর্বাশা অবাক হলো বেশ, অবাক সুরেই বলল – আমার জন্য!
– হুম। কিছু বিউটি প্রডাক্ট আছে এর ভিতরে। যতদিন কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে রেস্টে আছো তুমি ততদিন ব্যবহার করবে এগুলো।
জেফির কথা শেষ হতেই সুজা মুখ খুললো, টিভির বিজ্ঞাপনের মতো এক একটা প্রডাক্ট হাতে নিয়ে পূর্বাশাকে দেখিয়ে বলল – এটা তোমার গায়ের রং উজ্জল করবে, এটা স্কীন কোমল করবে, এটা দাগ দূর করবে, এটা তোমার ঠোঁট গোলাপি করবে।
পূর্বাশার অবকতা বাড়লো যেন আরও। এই মেয়েগুলো সেই সন্ধ্যায় থেকে বেরিয়ে তার জন্য বিউটি প্রডাক্ট এনেছে? তাকে সুন্দর করার জন্য? ছলছল করে উঠলো পূর্বাশা। নিজের আপন মানুষদের কাছ থেকে যে মানুষটা সরা জীবনে তিরস্কার ছাড়া কিছুই পেল না সেখানে এই ভিনদেশী পর মানুষগুলো তার জন্য কতটা ভাবছে। তাকে কতটা আগলে রাখার চেষ্টা করছে। পূর্বাশা মনে মনে খুশি হলেও মুখে বলল – এসবের আর কি দরকার ছিল?
– চুপ করো তুমি। তুমি যে কেন সব সময় মন মরা হয়ে চুপচাপ বসে থাকো সেটা কি আমরা বুঝি না? আমাদের এতটাই বোকা মনে হয় তোমার?
সেনজেই থামতেই সুজা বলল – ধরে নাও এগুলো আমাদের তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার।
পূর্বাশা ছলছল নয়নে তাকালো তার ভিনদেশী স্বল্প পরিচিত মানুষগুলোর পানে, ধরা গলায় বলল – ধন্যবাদ তোমাদের।
– ধন্যবাদ দিলে কাজ হবে না। আমাদের এই উপহারের পরিবর্তে আমরা কিছু চাই তোমার কাছে।
জেফির কথায় পূর্বাশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তার পানে, মৃদু কন্ঠে শুধালো – কি?
আলতো হাসলো সুজা, বলল – তোমার বন্ধুত্ব। ।
সুজার কথার সূত্র ধরেই সেনজেই বলল – সারাদিন রুমের এক কোনে একা একা বসে থাকা যাবে না। আমরা এই তিনটা মানুষ যেভাবে হেসে খেলে রুমে থাকি তোমাকেও সেভাবে থাকতে হবে। আমরা তিনজন যেভাবে একে অপরের সাথে মিশি তোমাকেও সেভাবে মিশতে হবে। তোমার ঐ হাসিহীন বিদঘুটে মুখশ্রীকে বিদায় জানিয়ে আমাদের সাথে প্রান খুলে হাসতে হবে। কি দিতে পারবে তো?
এতক্ষন নিজেকে শান্ত রাখলেও এবার আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না পূর্বাশা। এই মেয়েগুলোর কথায় যেন যে আবেগী হয়ে পড়লো ভীষন। হুট করেই কেঁদে উঠলো শব্দ করে। হকচকালো সেনজেই, সুজা আর জেফি? মেয়েটা কেঁদে উঠলো কেন? তারা কি খারাপ কিছু বা তার সামর্থ্যের বাইরে কিছু বলেছে তাকে? অস্থির হলো তিনজনই, ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো পূর্বাশার পাশে। অস্থির কন্ঠে সুজা প্রশ্ন করলো – কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?
– পায়ে ব্যথা করছে কি? নাকি আমাদের কোনো কথায় কষ্ট পেয়েছো?
জেফির প্রশ্নে চোখ তুলে তাদের পানে তাকালো পূর্বাশা। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই বলল – আসলে তোমাদের কথায় আমি একটু আবেগী হয়ে পড়েছিলাম। এভাবে আমাকে কখনও বলেনি বা আমার জন্য কেউ কোনোদিন কিছু করেওনি তো তাই
পূর্বাশার কথায় ক্ষানিকটা অবাক হলো সেনজেই, সুজা আর জেফি। বুঝলো মেয়েটা ঠিক কতটা একাকিত্ব আর কষ্টের মধ্য থেকে দিনযাপন করছিল। তারা তিনজনই হুট করে জড়িয়ে ধরলো পূর্বাশাকে, বলল – তাহলে এখন থেকে রোজ কান্না করার অভ্যাস করে নাও কারন আমরা রোজই তোমার মন ভালো করার চেষ্টায় নামবো।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link
[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]