#পদ্মমির
#পর্ব_18
#ইলমা_বেহেরোজ
আমির গামছা হাতে নিয়ে, হাত উপরে তুলে ইশারা দেয় জাদভকে। যার অর্থ, নাটকের সমাপ্তি।
পর্ব এগারো
কয়েকদিনের বর্ষণ শেষে আজ হাসছে আকাশ। পদ্মজা ছাদ থেকে চুল শুকিয়ে এসে দেখে আমির অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। ও বাধা দেয়। বার বার বলতে থাকে, ‘যদি কেউ আমার ক্ষতি করতে চায় তাহলে তো আপনারও করবে।’
‘কিছু হবে না।’ হাতে ঘড়ি পরতে পরতে বলল আমির।
‘হাতে আঘাত পেয়েছেন। দয়া করে যাবেন না।’ আমি ব্যগ্র কণ্ঠে বলল, ‘রাতে তো বলেছি, অফিসে যেতে হবে। এভাবে দূরে থাকলে লোকসানই হবে শুধু। তুমি চিন্তা করো না। বাজারে গাড়ি এসেছে। গাড়িতে চড়ে যাব আবার গাড়ি চড়েই ফিরে আসব।’
‘ওরা যদি আপনাকে দেখে অনুসরণ করে!’
আমির পদ্মজার কপালে, গালে, ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, ‘আমি সেই সুযোগ দেব না। বিশ্বাস রাখো!’
স্বামী অনুগত পদ্মজা এরপর আর কিছু বলতে
পারল না। সৃষ্টিকর্তার পর সবার উর্ধ্বে সে শুধু আমিরকেই বিশ্বাস করে। আমির শুকতারা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। পদ্যজা ঠিক ততক্ষণ ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ আমিরকে দেখা গেল। আমিরও শেষ প্রান্তে গিয়ে ফিরে তাকাল। একজন অপরজনকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায়।
পদ্মজা রুমে এসে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আমির সামান্য মাথা ব্যথা নিয়ে বের হলেও ওর সবকিছু বড় অশান্ত পড়ে সেখানে ক্ষত নিয়ে বেরিয়ে গেল। তার উপর অজ্ঞাত
কারো হুমকি তো রয়েছেই।
ও কাপড়চোপড় ভাঁজ করল, ঘরের টুকটাক কাজ করল। তাতেও যখন শান্তি হলো না তখন বোরকা পরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এলাকা ঘুরে দেখল। দুপুরে চিঠি লিখতে বসল। প্রথম চিঠি ফরিনার জন্য-
10:20
প্রিয় আম্মা,
কেমন আছেন? বাড়ির সবাই কেমন আছে? আমি আর আপনার বাবু আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আপনি কি আমার উপর খুব বেশি রাগান্বিত? চিঠির কোনো উত্তর পাঠান না যে! নদীর তীরে বসেও বৃষ্টির জলের জন্য চাতকের যে দীর্ঘশ্বাস, স্বামীর ঘরে সুখে থেকেও আপনার চিঠির আশায় তেমনই আমার দীর্ঘশ্বাস। খুব মনে পড়ে আপনাকে আম্মা। আপনার রাগ করার কারণ ও অধিকার দুটোই আছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আম্মা, আপনার ছেলে অভিমানে থাকলেও আমার কোনো অভিমান নেই আপনার প্রতি। আমি ভাগ্যকে কবুল করতে জানি। যা হয়েছে ভাগ্যে ছিল বলে হয়েছে। এতে আপনার কোনো দোষ নেই। ইদানীং আপনাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। আমি আসতে পারি না আমি নিরুপায়… অসহায়। আপনার ছেলের আদেশ অমান্য করতে পারি না। বিয়ের পর আপনিই আমাকে বলেছিলেন, সোয়ামির সব কথা হুনবা, বইতে কইলে বইবা, হুইতে কইল। হইবা, কখনো অমান্য করবা না।’
আমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম, করেছি, করি এবং সারাজীবন করব। অনুগ্রহ করে, আপনি একবার ঢাকায় আসুন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। উত্তর পাই বা না পাই আমি আপনাকে সবসময় চিঠি লিখব। আমার ভালোবাসা নিবেন।
ইতি পদ্মজা।
চিঠিটি যত্ন করে ভাঁজ করে একপাশে রেখে আরেকটা চিঠি লিখতে শুরু করল ও-
প্রিয় পূর্ণা,
আমার চোখের মণি, আজ কোনো উপদেশ দেব না, বকব না, শাসন করব না; আজ অন্য কথা বলব।
বাড়ির পাশে মেলা হচ্ছে যা দেখে তোকে খুব মনে পড়ছে। আমার কাছে মেলা মানেই তুই, তুই মানেই মেলা। মনে আছে, যখন তোর আট বছর ছিল কাউকে না বলে একা একা আসিদপুরের মেলায় চলে গিয়েছিলি? সেদিন কী কান্নাটাই না করেছিলাম। ভাগ্য ভালো ছিল বলে, ফিরে এসেছিলি। সেদিনের পর থেকে মেলা দেখলেই ইচ্ছে করে তোকে এনে ছেড়ে দেই। আমার যদি কখনো সামর্থ্য হয়, তোর জন্য একটা ঘর করব যেখানে শুধু সব সাজগোজের জিনিসপত্র থাকবে। আমি আজ মেলায় যাব তোর জন্য চুড়ি, কাজল, লিপস্টিক, পায়েলসহ অনেককিছু কেনার জন্য। তুই কিন্তু…
এতটুকু লিখে আর লিখল না, হাত থেমে গেল।
এই চিঠি পর্ণাকে দেয়া ঠিক হবে না। ও অকারণে
প্রচুর সাজগোজ করে যা দৃষ্টিকটু; এই চিঠি পেলে আশকারা পেয়ে যাবে। পদ্মজা চিঠিটি ভাঁজ চিঠিটি ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিল। বাড়ির সবার জন্য একটা চিঠি লিখল। তারপর দুটো চিঠি খামে ভরে রাখে। আমির আসলে পোেস্ট অফিসে পাঠানোর ব্যবস্থা।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে টের পেল মাথা ঘুরাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ মাথা ধরে রাখে, রান্নাঘরে যায়। সেখান থেকে নিচ তলায় নেমে আসে ভুবনের সঙ্গে গল্প করার জন্য। হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে যায় মেঝেতে। পতনের শব্দ শুনে ভুবন ছুটে আসে। পদ্মজা অচেতন হয়ে পড়ে আছে। ভুবন শঙ্কিত। ডাকতে থাকে, ‘বুবু ও বুবু, বু-বু… উঠো, বুবু, ও বুবু?’
অনেকক্ষণ ডেকেও যখন সাড়া পেল না। তখন আতঙ্কে আমিরের অফিসের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে থাকে। তার এতটুকু বোধশক্তি কাজ করেনি যে, প্রথমে ডাক্তার ডেকে আনা উচিত। ভুবনকে ভীত, দিশাহীন অবস্থায় দৌড়ে বাড়ির ভেতর থেকে বের হতে দেখে জাদভ বাড়ির ভেতর ঢুকল। পদ্মজাকে সিঁড়ির নিচে পড়ে থাকতে দেখে একজনকে ডেকে ডাক্তার আনতে পাঠায়। সে পদ্মজার পাশে অপেক্ষা করছে। কোলে করে রুমে নেয়ার সাহস পাচ্ছে না। বুঝতে পারছে না, স্পর্শ করলে আমির রেগে যাবে? নাকি এই অবস্থায় এখানে ফেলে রাখার জন্য রেগে যাবে?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গতকালের সেই মেয়েটিকে ডেকে নিয়ে আসল। মেয়েটির নাম রোজিনা। রোজিনা একজন মহিলার সাহায্যে পদ্মজাকে রুমে নিয়ে যায়।
জাদও শুকতারা থেকে বের হয়ে রাসেল নামে একজনকে ডেকে আমিরের অফিসে সংবাদ পাঠায়।
পদ্মজার সঙ্গে আলাপের সময় কথায় কথায় ভূবন আমিরের অফিসের ঠিকানা জেনেছিল। সে বাসে উঠে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই নেমে পড়ে। সেখান থেকে আবার অফিসের দিকে পায়ে হেঁটে রওনা দেয়। দেরি হচ্ছে, এতক্ষণ ধরে পদ্মজা একা অচেতন হয়ে পড়ে আছে সিঁড়ির নিচে, সেসব তার মাথায় নেই। সে শুধু ভাবছে, আমিরকে জানাতে হবে। ততক্ষণে রাসেল পৌঁছে গেছে আমিরের অফিসে। রাসেলকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে রফিক। সারাদিন অনেকে অজানা মানুষই অফিসে আনাগোনা করে তাই ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিল। কিন্তু যখন হন্তদন্ত হয়ে আমির বের হলো, রফিক সক্রিয় হয়ে উঠল। আমিরের গাড়ির পিছু নিল।
শুকতারা থেকে বের হওয়ার ঠিক আড়াই ঘন্টা পর ডুবন অফিসে পৌঁছায়। আলমগীরের সঙ্গে ওর দেখা হয়। কাঁদতে কাঁদতে পদ্মজার অসুস্থতার খবর বলে। আলমগীর জানায়, আমির ইতিমধ্যে চলে গেছে।
দূর থেকে তাদের দুজনের কথপোকথন দেখে রফিকের একান্ত খাস লোক পারভেজ। ডুবনকে যখন ট্যাক্সিতে তুলে দেয় আলমগীর তখন পারভেজ টেক্সিটিকে অনুসরণ করতে শুরু করে।
অন্যদিকে, রফিক মাওলা আমিরের পিছু নিলেও কিছু দূর গিয়ে একটা গলিতে আমির নেমে অন্যদিকে চলে যায়। সেখান থেকে ট্যাক্সি নেয় মুজ্জা কলোনির উদ্দেশ্যে। রফিক বুঝতেই পারে না কখন নেমে পড়েছে আমির। শেষ অবধি গাড়িটি ঘুরে অফিসের
সামনে এসে থামল। রাগে রফিক কিড়মিড় করে।
উঠে। আমির চোখে ধূলো দিয়ে চলে গেছে!
কিন্তু ভুবনকে অনুসরণ করে পারভেজ পৌঁছে যায় মুজ্জা কলোনিতে! ধরে ফেলে আমির ও পদ্মজার অস্তিত্ব! তথ্যটি জানাতে সে বাজার থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে রফিকের সঙ্গে।
সংবাদটি জানার পর চোখ দুটি চকচক করে উঠে রফিক মাওলার। তার পরিকল্পনা, আমিরের থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়ার। এমনকি শুর সুন্দরী স্ত্রী পদ্মজাকেও। সেদিন এক পলক দেখেই প্রেমে পড়ে গেছে। সর্বক্ষণ ওই সুন্দর মুখটা চোখে ভাসে। আগে লোভ ছিল আমিরের সাম্রাজ্যে এখন তার রানীকেও চাই! রফিক উৎফুল্ল হয়ে ডান হাত দিয়ে বাম। হাতের তালুতে ঘুষি দিয়ে বিড়বিড় করে, ‘তোমাকে আমি নেব পদ্মজা… আমি তোমাকে নেবই।’
রাতের দ্বিতীয় প্রহর। চাঁদের মলিন আলোর দিকে এক নয়নে তাকিয়ে আছে পদ্মজা। আমির ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। বাড়ির সামনে উঠানের ছোট ছোট গাছগুলোতে মিটমিট করে আলো জ্বলছে। জোনাকি পোকারা উড়ছে। আমির প্রকৃতির সৌন্দর্যে খুব কম মুগ্ধ হয় তাই চোখ ফিরিয়ে নিল।
দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখেছিল পদ্মজা শুয়ে আছে।
দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখেছিল পদ্মজা শুয়ে আছে।
আমিরের বরাবরই পদ্মজার সামান্য অসুস্থতা
নিয়েও বাড়াবাড়ি করার অভ্যাস আছে, তাই তখনই
জোরাজোরি করে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়।
সেখানে গিয়ে জানতে পারে, দূর্বলতা ও রক্তে শর্করার
মাত্র। হ্রাস পাওয়াতে এমন হয়েছে। ঋতুস্রাব
না হওয়ার কারনও এটা। নিজের খেয়াল রাখলে,
ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করলে ঠিক হয়ে যাবে।
পদ্মজা যখন বুঝতে পারল, সে মা হচ্ছে না; তার সঙ্গে
কোনো মীরাক্কেল ঘটেনি ওর চোখেমুখে অমবস্যার
আঁধার নেমে আসে। কিঞ্চিৎ হলেও আশা করেছিল,
জাদু ঘটবে। ও নিশ্চুপ হয়ে যায়।
Follow
সন্ধ্যা থেকে একা একা ছাদে বসে আছে। আমির পদ্মজার পাশে পাটির উপর বসল। তাকিয়ে দেখল পদ্মজা কাঁদছে। অন্যবার কাঁদতে দেখলে অস্থির হয়ে যায় কিন্তু এই মুহূর্তে শান্ত রইল। কেঁদে হলেও ভুলে যাক নিজের বন্ধ্যাত্বের যন্ত্রণা। ও পদ্মজার হাত নিয়ে চুমু খায়। পদ্মজা অন্য হাতে চোখের জল মুছে অনুরোধ করে বলে, ‘আমায় একটু একা থাকতে দিবেন?”
আমির সেকেন্ড কয়েক পদ্মজার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘যেভাবে তোমার শান্তি সেভাবেই তোমাকে থাকতে দেব।’আমির পদ্মজার ছাদের দরজার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পদ্মজার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে জানে, আমির পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে, দরজার আড়ালে থাকুক, ওখানেই থাকুক।
পদ্মজার দুই চোখে নহর বইছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে হেমলতার উদ্দেশ্যে বলে, ‘আমার পাপ কী আম্মা?’
চলবে,,,,,,