#পদ্মমির
#পর্ব_26
#ইলমা_বেহেরোজ
বিনিময়েও পদ্মজাকে অন্তত এক রাত কাছে পাবার বাসনা জেগেছে মনে। পদ্মজাকে নিয়ে নষ্ট সব চিত্র ঘুরে বেড়ায় মানসপটে। আমির চুক্তি বাতিল করার আগে লোকদের পাঠিয়েছিল পদ্মজাকে তুলে আনতে। কিন্তু আমির হুট করে গুটি পাল্টে দিল। যেহেতু আমির ইয়াকিশাফির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করেছে তাই এই মুহূর্তে নতুন পদক্ষেপ না নেয়াটাই উত্তম বলে মনে হচ্ছে রফিকের। কিছুদিন যাক, তারপর পদ্মজাকে যেভাবে হোক তুলে আনবে – মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রফিক। অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে একটা হোটেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে সকালের নাস্তা সাড়ল সে। যখন পুনরায় গাড়িতে উঠে তখন আকাশের মেঘ নিংড়ে ঝরতে শুরু করেছে ধরনীতে। এদিকের রাস্তা ভাঙা। একপাশে নদী, অন্যপাশে এবড়োখেবড়ো বিস্তৃত ক্ষেত। রাস্তা খাড়া থেকে ঢালু হচ্ছে। গাড়ির গতি কমাতে ব্রেকে পায়ের চাপ দিল রফিক। কাজ করছে না রেক! আবার ব্রেকে চাপ দিল। গাড়ির গতি বাড়ছে! বুক কেঁপে উঠল তার। সামনে তাকিয়ে দেখে একটা বাস আসছে। রফিকের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আগের চেয়ে জোরে ছুটছে গাড়ি, প্রতি মুহূর্তে গতি বাড়ছে। বার বার ব্রেক চাপল সে, কাজ হলো না। গাড়ির উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তার। কে ব্রেক নষ্ট করল? প্রথমে চোখের পর্দায় ভেসে উঠল আমিরের মুখ! বাসের ড্রাইভার দ্রুত গতিতে গাড়িটিকে এগোতে দেখে ভড়কে যায়। দ্রুত মোড় পরিবর্তন করে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। কিছু দূর এসে বাস থামিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। যাত্রীরাও সেদিকে তাকাল। তাদের চোখের সামনে রোলার কোস্টারের মতো ছুটতে থাকা গাড়িটি একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে নদীতে। ঝড়ো হাওয়া আর বজ্রপাতের বিকট শব্দে প্রত্যেকের বুকের ভেতর শুরু হয় কম্পন। তাই আর কেউ ওদিকে পা বাড়াল না। বাসটি নিজের গন্তব্যের দিকে ছুটতে শুরু করল।
ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বসে কিছু দলিলপত্র দেখছিলেন কুতুবউদ্দিন। সকাল থেকে তার তার মেজাজ বিগড়ে আছে। প্রথমে শুনলেন, বকুল বাড়িতে নেই। বাড়িতে পাঁচ জন কাজের মহিলা থাকা সত্ত্বেও বকুলকে রাখা হয়েছিল, তার ব্যক্তিগত সব কাজের জন্য। বকুলের হাতের চা কুতুবউদ্দিনের দিনকে সুন্দর করে। এতো ভালো চা যে কী করে বানায় এই মেয়ে ভেবে পান না তিনি। বেশ কয়েকবার রান্নাঘরে গিয়ে দেখেছেন, বকুল কীভাবে চা তৈরি করে। অন্যরা যেভাবে বানায় সেভাবেই, অথচ স্বাদটা আলাদা হয়! তাই স্বাভাবিকভাবেই বকুলের হাতের চা না পেয়ে সকালটা মন্দ হয়ে উঠে। স্ত্রীর কাছে শুনেছেন, মাঝরাতে বকুলের বাবা উল্লাহ এসে মেয়েকে নিয়ে গেছেন। তার স্ত্রী নাকি খুব অসুস্থ। সারাক্ষণ, মেয়ে মেয়ে করছে। এদিকে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হবার কথা ছিল। আবহাওয়ার কারণে সেটা বাতিল করতে হয়েছে। কিছুক্ষণ পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে সামান্য বিষয় নিয়ে তর্ক হয়েছে। দিনটা বড় অলক্ষুণে! কিছুই ঠিকঠাক যাচ্ছে না। টেলিফোন বাজছে। কুতুবউদ্দিন এতে বিরক্তবোধ করলেন। গজগজ করতে টেলিফোন কানে তুললেন, ‘কে বলছেন?’ ওপাশ একটা চেনা স্বর বলল, ‘স্যার, আমি পারভেজ। আপনার ছেলে হামজাকে পাওয়া গেছে।’ কুতুবউদ্দিন চমকে উঠলেন। হামজা পলাতক: অনেকের সন্দেহ কুতুবউদ্দিন হয়তো নিজের ছেলেকে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আদৌ তা সত্য নয়। হামজাকে পুলিশ গ্রেফতার করার পূর্বে কুতুবউদ্দিনের সাথে তার বাকবিতণ্ডা হয়। সেই অভিমান থেকে জেল থেকে পালানোর পরও বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কুতুবউদ্দিন চারিদিকে লোক লাগিয়েছেন, ছেলেকে খুঁজে বের করতে। খুঁজে পেলে দেশ থেকে নিরাপদে বের করে দিবেন। 51% তিনি চারপাশ দেখে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘কোথায়… কোথায় আছে আমার ছেলে?’ ‘মুর্শিদি জঙ্গলের লোহার গম্বুজে।’ এটা শুনে কুতুবউদ্দিনের পা থেকে মাথার তালু অবধি কেঁপে উঠল। এই লোহার গম্বুজকে ঘিরে রয়েছে এক গুপ্ত সৃস্মৃতি, তার প্রথম হত্যার স্মৃতি! তখন কুতুবউদ্দিনের বাইশ বছর, বেকার। তার বড় ভাই কাসেম ছিল দেশের একজন স্বনামধন্য মন্ত্রী। তার সামনে- পেছনে, ডানে-বামে ছিল শত্রুর মেলা। কুতুবউদ্দিন ক্ষমতার লোভে পড়ে বিপক্ষ দলের চক্রান্তে জড়িয়ে নিজের হাতে লোহার গম্বুজে পুড়িয়ে মেরেছিলেন কাসেমকে। তার হাতে হত্যার দায়িত্ব ছিল, কিন্তু কোথায় হত্যা করেছে তা কাউকে কখনো বলেননি। তাহলে হামজা কী করে ওই গম্বুজে গেল? ওপাশ থেকে পারভেজ বলল, ‘হামজা রাতে এখান থেকে চলে যাবে। তার সঙ্গে আরো দুজন আছে।’ কুতুবউদ্দিন কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল। তিনি অবাক হয়ে ভাবছেন, হামজা কী কাকতালীয়ভাবে ওখানে পৌঁছাল? নাকি এর পিছনে অন্য কারণ আছে? ভেবে কোনো কূল কিনারা মিলল না। বুকে একটা সূচ ক্রমাগত আঘাত করছে যেন। কাসেম নিখোঁজের তদন্ত এখনো চলছে। কেউ যদি জেনে যায় তাহলে কী হবে? কুতুবউদ্দিন জানে, তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। ওই গম্বুজে গেলেও কেউ প্রমাণ পাবে না। তবুও তিনি ভয় পাচ্ছেন। বিশ্বস্ত তিনজনকে নিয়ে কুতুবউদ্দিন রওনা হোন লোহার গম্বুজের উদ্দেশ্যো চলার পথ শেষ হচ্ছে না। আঁকাবাঁকা রাস্তা আর বৃষ্টির জন্য গাড়ির গতি বাড়ানোও সম্ভব নয়। কুতুবউদ্দিনের বুকে দুরুদুরু কাঁপুনি।
চলবে,,,,,