#পদ্মমির
#পর্ব_17
#ইলমা_বেহেরোজ
ফুলগাছের টবগুলো জলে পরিপূর্ণ হয়েছে, পাতাগুলো গাঢ় সবুজ রং পেয়েছে। ভুবন নিচ তলার দরজায় বসে একমনে বৃষ্টি দেখছে। সে কখনো অনুমতিবিহীন দ্বিতীয় তলায় যায় না। সকালে পদ্মজা খেতে দিয়েছিল। ভুবন আগে একবেলা খেত। পদ্মজার চাপাচাপিতে এখন তিন বেলা খায়। কিছুদিন পর পদ্মজা… ওর বুবু চলে যাবে, ভেবে বড্ড মন খারাপ হয় ভুবনের।
পদ্মজা মাথা তুলে বলল, ‘শরীরটা মুছে দেই?”
আমির চোখ বোজা রেখেই বলল, ‘পরে। এখন শুয়ে থাকো। বৃষ্টির দিন কেউ বিছানা ছাড়ে?’
‘এখানে আসার পর থেকে শুধু শুয়ে-বসেই কাটাচ্ছি। এভাবে অলস হয়ে যাব।’
‘কোথায় শুয়ে-বসে কাটালে? কাঁথা সেলাই করেছ, দুইবেলা রাঁধো, ঘরদোর গুছাও, কাপড় ধুয়ে দাও, বই পড়, আচার বানানোও শুরু করেছ। আমাকে সময় দাও তুমি?’
‘কী! সময় দেই না? সারাক্ষণই তো লেপ্টে থাকেন। রাত- দিন মিলিয়ে মোেট চব্বিশ ঘন্টা। এখানে আসার পর থেকে এক থেকে দুই ঘন্টা বাজারে কাটাচ্ছেন বাকি বাইশ ঘন্টা তো আমার সঙ্গেই থাকেন।’সে থাকি। কিন্তু তোমার মন তো আমার উপর থাকে না।’
এই লোক অকারণে কথা বাড়াবে। পদ্মজা জোর করে উঠে বসল। কুসুম-গরম পানি এনে নরম তোয়ালে দিয়ে আমিরের শরীর মুছে দিয়ে বলল, ‘একটা কথা বলার ছিল। দশটা বলো।’
গতকাল বিকেলে যে চারজন আমাকে সাহায্য করেছিল, ওদের আচরণ দেখে মনে হলো আমাকে চিনে! এমনভাবে ওরা রক্ষা করতে আসল যেন আমি ওদের পরিবারের কেউ।’ পদ্মজার চোখেমুখে বিস্ময়।
আমির বলল, ‘একজন নারীকে হেনস্তা হতে দেখে এগিয়ে এসেছে। এরকম পুরুষ অনেক আছে।’
পদ্মজা ভাবুক হয়ে বলল, ‘কিন্তু, কেমন যেন লাগছে! ওদের চোখেমুখে কিছু একটা ছিল যেটা দেখে ওই লোকটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল। আসলে, আমি বুঝতে পারছি না আমার মনটা কেন ওদের সাধারণ ভাবতে পারছে না।’
আমির ভেতরে ভেতরে ভড়কে যায়। পদ্মজা না
আবার তদন্ত করতে বের হয়। সাহায্য করেছে কেন
সেটা নিয়েও ভাবতে হবে! কী অদ্ভুত নারী সে। ভাগ্যিস, তাকে কখনো সন্দেহ। করে না। আমির বলল, ‘এতো ভেবো না তো। এখানকার মানুষজন অনেক ভালো, মিশুক। তিন-চারদিনে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব হয়েছে।’
পদ্মজা হাসল, ‘সে তো আপনি যেখানে যান সেখানেই বন্ধু হয়।’
‘তবুও এখানে অন্যরকম। আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। কিছু রাঁধো।’
একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখুনি যাচ্ছি।’
পদ্মজা ভাবনা ছেড়ে দ্রুত রান্নাঘরে চলে যায়। আমির ঠোঁট কামড়ে চুপ করে বসে থাকে। যেভাবে হোক এই ব্যাপারটা পদ্মজার মাথা থেকে বের করতে হবে।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির গতি কমলে উঁকি দিয়ে দেখে পদ্মজার উপস্থিতি। সে রান্নাঘরে পুরোদমে ব্যস্তা কলমদানি নিয়ে একটা কাগজে কিছু একটা লিখে, সেই কাগজ, একটি নুড়ি পাথর ও পলিথিন পায়জামার পকেটে রেখে রান্নাঘরের দিকে যায় আমির। পদ্মজাকে ডেকে বলে, ‘পদ্মবতী, ছাদে যাচ্ছি।’
বিকালের দিকে বৃষ্টি একেবারে ক্ষান্ত দেয়। একঝাক সাদা বক উড়ে যাচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। কোথা থেকে খুব কম সময়ের জন্যে অদ্ভুত একটা গন্ধ নাকে ভেসে এলো। মনোেযােগ দিতেই বোঝা গেল ওটা উঠানে থাকা বাতাবি লেবুর ফুল। পদ্মজা ভুবনকে ডেকে বলে ছাদে দুটো বাতাবি লেবুর ফুল দিয়ে যেতে, সে ঘ্রাণ নিবে।
হাওলাদার দম্পতি ছাদে সময় কাটাচ্ছে। ছাদ থেকে সামনের কলোনির ছোট ছোট সব ঘর, মাঠ দেখা যায়। এই বৃষ্টির মধ্যে মেলা হচ্ছে। মেলা দেখেই পূর্ণার কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটা মেলায় যেতে খুব ভালোবাসে।
লোকগুলো কত মহৎ।’ বলল আমির।
পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘কারা?’
আমির ইশারা করলে সেদিকে তাকায় পদ্মজা। গতকালের চারজন লোকসহ আরো বেশ কয়েকজন গরীবদের খাবার, জামাকাপড় দান করছে। এদের সবার মধ্যেই কী যেন একটা মিল আছে। পদ্মজা কিছু বলার আগে আমির বলল, ‘বাজারে শুনেছি, এরা বেশ কিছুদিন হলো এখানে এসেছে। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে টাকা তুলে গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করে। ওদের জীবন এভাবেই কাটে। মানবিকতার সঙ্ঘ গড়ে তুলেছে আর কি!’ পদ্মজা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘আপনাকে যে চারজনের কথা বলেছিলাম, ওইযে মাঝের চারজন।’
আমির অবাক হলো, ‘তাই নাকি? তাইতো বলি, এতো সাহসী কারা!’
পদ্মজা গর্ব করে বলল, ‘এমন মানুষরাই তো সাহসী হবে। আমরাও কিছু দান করি ওদের দানবক্সে?’
‘যখন বাজারে যাব দিয়ে দেব। তাছাড়া ওদের আমার কাছে ধন্যবাদ পাওনা, তোমাকে সাহায্য করেছে।’
পদ্মজা মুগ্ধ নয়নে দেখছে। মানুষ মানুষের জন্য! এই মানুষগুলো নিজের পরিবার ছেড়ে অন্যদের জন্য লড়ে যাচ্ছে। মন থেকে দোয়া করে পদ্মজা, যেন তাদের ভালো হয়। আমির আড়চোখে দেখে পদ্মজাকে।
গতকাল যখন পাশের ভবনের কাহিনি শুনল মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে পদ্মজা বাড়িতে চলে এসেছে, তুলাও চলে গেছে।
সে রেগেমেগে তুলার বাড়ির দিকে যেতে চেয়েছিল, পদ্মজা জোর করে আটকে রেখে সবকিছু খুলে বলে।
আমির অত্যাচারিত মেয়েটির জন্য অন্য বাড়িতে বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে। জমি উদ্ধার করে দিয়ে সেখানে বাড়ি বানিয়ে দেয়ার পণ করেছে। সবকিছু মিলিয়ে পদ্মজা ভারী সন্তুষ্ট।
সন্ধ্যা নামার আগে স্বামীস্ত্রী দুজন নিচে নামার জন্য উদ্যত হয়।
চলবে,,,,,,,