#পদ্মমির
#পর্ব_19
#ইলমা_বেহেরোজ
রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি বইটি হাতে নিতেই সেখান থেকে একটি পৃষ্ঠা পড়ল মেঝেতে। আমির উৎসুক হয়ে পৃষ্ঠাটি হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল। সেখানে ঘরের আদলে আঁকা একটি সাদাকালো বোটের ছবি। সুন্দর করে নকশা করা। পানিতে ভাসমান বোটটির সমাপ্তি সীমানায় হুবহু তার গঠনের একজন পুরুষ লম্বা চুলের এক নারীকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আসমান ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে তাদের উপর।
ছবিটির নিচে ছোট করে সাক্ষর করা পদ্মজা।
আমির মুচকি হাসল। ছবিটি অনেকক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখল। ডানে তাকিয়ে দেখে পদ্মজা কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। শেষ রাতে বৃষ্টি হবার পর সকালে ভালোই ঠান্ডা পড়ে। ও পৃষ্ঠাটি যত্ন সহকারে ভাঁজ করে বুকপকেটে রেখে দেয়।
পদ্মজা এপাশ থেকে ওপাশ হয়। শেষ রাতের দিকে যখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হয় তখন রুমে ফিরেই গুয়ে পড়েছিল। আমিরও নিশ্চুপে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে
ঘমিয়ে পড়ে। উঠেছে এই মাত্র। সে বান্নাঘরে গিয়ে আটা দিয়ে রুটি বানায়, ডিম বাজে। পদ্মজার জন্য সকালের নাস্তা প্লেটে আলাদা করে সাজিয়ে রেখে বাকিটুকু নিজে খেল।
শুকতারা থেকে বের হওয়ার সময় উঠোনের ইশান কোণে ভুবনকে বসে থাকতে দেখতে পায়। বিষাদে ভরা ওর সারামুখ। গতকাল বাড়ি ফেরার পর আমির রাগের মাথায় দুটি থাপ্পড় মেরেছিল, পদ্মজাকে একা ফেলে যাওয়ার জন্য। রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে।
ভুবন ওখানেই কান্না করতে শুরু করে। আমির ওর কান্নাকে পিছনে ফেলে চলে যায় উপরে। ভুবন এখনো বাড়ি ছেড়ে যায়নি বলে আমির অবাক হয়।
সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভুবন চোখ তুলে তাকাল।
আমিরকে দেখে দুই পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল, ‘আমি বুঝি নাই। আমি বুবুল খাল।প চাই নাই। আমালে বুবুল কাছে থাকতে দেন সাহেব।
ছেলেটা সরল। পদ্মজাকে ভালোবাসে তাতে
সন্দেহ নেই। আমির ডান দিকে ইশারা করে বলে,
‘আগাছাগুলো কেটে রাখিস। আর দেখিস, বাড়িতে
যেন কেউ না ঢুকে আমি বাজার থেকে আসছি।’
ভুবন চমকে তাকায়। এই বাড়ি ছাড়তে হবে ভেবে সারারাত ঘুমায়নি সে। গুনগুনিয়ে কেঁদেছে। আমিরের মন এতো দ্রুত নরম হবে ভাবেনি। ওর চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে খুশি। যে স্নেহার্ড, ভালোবাসাময় আচরণ পদ্মজার থেকে পেয়েছে, তা ছেড়ে যেতে চায় না ভুবন। সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পূর্বেই আমির শুকতারা থেকে প্রস্থান করল।
বাজারে আলমগীর অপেক্ষা করছিল। আমিরকে জানায়, রফিক মাওলা একা নয়। ওর সাথে কুতুবউদ্দিনও আছে। কুতুবউদ্দিন চাচ্ছে, আমিরের জাহাজে করে তার দুই ছেলেকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। সব ধরনের তথ্য সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করে আলমগীর। আমির শুধু চুপ করে গুনে। সে চাইলে, কুতুবউদ্দিন কিংবা রফিক মাওলা যে ই হোক, তাদের উপর সরাসরি আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু এতে তার ক্ষতি হবে। দেশের একজন নেতাকে হত্যা করলে তদন্ত শুরু হবে জোরালোভাবে। এতে বেরিয়ে আসবে আমিরের পরিচয়। তবে সে ইতিমধ্যে অনেককিছু ভেবেছে। কোনটাকে বাস্তবায়ন করবে তা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে।
গুরুগম্ভীর আলোচনা শেষ করে আমির পকেট
থেকে পদ্মজার আঁকা ছবিটা বের বলল, ‘পদ্মজার
জন্মদিনের আগে হুবহু এরকম একটা বোট লাগবে।’
অনেক সুন্দর। কে এঁকেছে?”
আলমগীর বিস্ময় নিয়ে তাকায়। এতো ঝামেলার মাঝেও আমির- ও কিছু ব্লতে পারল না। আমির বলল, ‘হাতে এক সপ্তাহ।’
‘এতো কম সময়ে কীভাবে হবে?’
‘যতজন লোক লাগে লাগাও, যত টাকা লাগে দিয়ে দাও।’
আমির যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে আর কিছু করার নেই। আলমগীর পৃষ্ঠাটি নিতে গেলে আমিরের হাতে কালি
দেখতে পেল। বলল, ‘রান্না করেছিস?’ আমির একটু অপ্রস্তুত হলো। আলমগীর ঠোঁট চেপে হাসল। আমির চায়ে চুমুক দিয়ে গম্ভীরমুখে বলার চেষ্টা করল, ‘হাসছ
কেন?
‘পাঁচ বছর আগের আমির আর এখনের আমির, কত তফাৎ।’
আমির কিছু বলল না। সে নিজের মধ্যে কোনো পার্থক্য পায় না। মনে হয়, সারাজীবন পদ্মজার সঙ্গেই তার দিন কেটেছে। ভেবে অবাক হয়, একসময় তার জীবনে পদ্মজা ছিল না। তখন কীভাবে জীবন কেটেছিল? কী অর্থ ছিল জীবনের?
আলমগীর বলল, যেদিন পদ্মজার সঙ্গে তোর বিয়ে হলো সেদিনও ভাবিনি, তাদের সংসারটা এতোদিন গড়াবে। পদ্মজাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলি সেদিন কী ভেবেছিলি ওর সাথে এতগুলো বছর কাটাবি?”
‘ভাবার সুযোগই পাইনি।’
‘বাড়ি ফেরার পর?’
‘পদ্মজাকে আমার চাই, সারাজীবনের জন্য।’
আলমগীরের ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হয়। ভালোবাসার অনুভূতি তার অজানা নয়া পাত্রী দেখতে গিয়ে যখন প্রথম রূম্পাকে দেখেছিল, বুকের ভেতর কিছু একটা হয়ে ‘গয়েছিল। সুখকর তোলপাড় উঠেছিল। কবুল বলার দিন ভেবেছিল, রূম্পার সঙ্গে একটা সুন্দর
জীবন কাটাবে। কিন্তু রূম্পা সব জেনে গেল।
সেদিনই রূম্পাকে হত্যা কল্প হতো শুধুমাত্র তার
ভালোবাসার দোহাই দিয়ে, পাগল বানিয়ে বাঁচিয়ে
রাখা হয়েছে।আজ কতগুলো বছর হয়ে গেল, তারা আলাদা থাকে। আলমগীরের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
‘ভাবিকে একবার দেখে আসো।’
চলবে,,,,,,,,