#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৪
নিস্তব্ধ চারপাশ। পিনপিনে নীরবতা বিরাজ করছে পুরো পরিবেশ জুড়ে। এই শীত সমৃদ্ধ পরিবেশেও আদ্রিতা ঘামছে। তার শরীর চুইয়ে বুঝি ঘাম ঝড়ছে। গরমে বিতৃষ্ণা লাগছে। আদ্রিতা নড়ে চড়ে উঠলো। খানিকটা থমকানো কণ্ঠস্বরে বললো,“এসব আপনি কি বলছেন?”
ফারিশের ঠোঁট জুড়ে তখনও মলিন হাসি। ভিতরটা যেন একটু একটু করে খন্ড খন্ড হচ্ছিল। ফারিশ করুণ চোখে প্রশ্ন করলো,“আপনি বুঝতে পারেন নি?”
আদ্রিতা নিশ্চুপ কি বলবে বুঝচ্ছে না। হঠাৎই ফারিশের নজরে আসলো আদ্রিতার ফোনের দিকে। কিছু একটা চলছে। ফারিশ আচমকাই খপ করে আদ্রিতার হাত থেকে ফোনটা নিলো। আদ্রিতা চমকে উঠলো। বিস্ময় নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ফারিশ দেখলো রেকর্ডার অন করা। রেকর্ড হচ্ছিল কতক্ষণ আগের তার আর আদ্রিতার কথা বলার মুহূর্তগুলো। এবার যেন আদ্রিতা পুরোদমে থমকে গেল। ঘাবড়ে গেল পুরো। ফারিশ মোবাইলটা দেখিয়ে বললো,“আমায় আপনি ভালোবাসেন নি আদ্রিতা। আমি বুঝতে পেরেছি। আমার সম্পর্কে জানার জন্য এত নিখুঁত অভিন..।”
ফারিশ চুপ হয়ে গেল। তার নিশ্বাস আঁটকে আসছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। বিশ্বাস করতেও খারাপ লাগছে এতদিন যাবৎ যে মেয়েটাকে নিয়ে এত এত স্বপ্ন দেখলো ফারিশ। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। ছোট্ট সংসার পাতার স্বপ্ন। অথচ যাকে নিয়ে দেখলো সেই মেয়েটা নাকি তাকে ভালোবাসে নি। শুধুমাত্র তার সম্পর্কে জানার জন্য অভিনয় করে গেল।’
ফ্লাসবেক…
চাঁদনীর সাথে সময় কাটিয়ে আদিব যখন বেরিয়ে আসতে চায় হসপিটাল থেকে সেই মুহুর্তেই আদিব দেখতে পায় পুলিশ অফিসার কিশোরকে। যে কি না আদ্রিতার চেম্বারে ঢুকে। আদিব কৌতুহলী এগিয়ে যায় চেম্বারের দিকে।
অন্যদিকে,
আদ্রিতা বাহিরে ফারিশের কাছে যাবে সেই মুহূর্তেই কিশোরকে দেখলো। কিশোর ভিতরে ঢুকেই বললো,“কেমন আছেন ডাক্তার সাহেবা?”
আদ্রিতা বেশ অবাক চোখে তার পানে তাকালো। বললো,“আপনি এখানে?”
কিশোরের মুখ হাসি হাসি। আদ্রিতার সাজগোছ দেখেই মিষ্টি হাসলো সে। বললো,“মাফিয়া সাহেবকে তো ভালোই পটিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তার সম্পর্কে এখনও তো কোনো প্রমাণ পেলাম না।”
আদ্রিতা তখনই বলে,“আমি চেষ্টা করছি তো অফিসার। উনি কাল থেকে কিছু বলবে বলবে বলেও বলছেন না। কাল রাতে ভেবেছিলাম বলবে মোবাইলে রেকর্ড করার জন্য রেকর্ডারও অন করেছিলাম কিন্তু উনি কিছু বলেন নি। অথবা বলতে পারেন নি। দেখুন সেই কক্সবাজার থেকে আমায় আপনারা বিরক্ত করছেন। আমার এখন মনে হচ্ছে আপনার কথা শোনা আমার উচিত হয় নি।”
আদ্রিতার রাগ উঠলো। শুধুমাত্র এই অফিসারের কাজে হেল্প করার জন্য ফারিশের জীবনে ঢুকে আদ্রিতা। কক্সবাজারের সেই ক্যান্সারের কথা বলা লোকটাও মিথ্যে ছিল সে আসলে এই কিশোরের একজন লোক ছিল। সেই আদ্রিতাকে বলে ফারিশ একজন মাফিয়া। দেশ বিরোধী মাফিয়া। কিন্তু তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। ফারিশের পাওয়ার আর বুদ্ধিমত্তার কাছে বার হেরে যায়। যার কারণে তারা তাকে ধরতে পারছে না। এখন আদ্রিতা যেন তাদের সাহায্য করে। কারণ তারা দেখেছে ফারিশ একটু হলেও আদ্রিতার প্রতি উইক। আদ্রিতা শুরুতে এসবে রাজি হতে চায় নি। কিন্তু পরে কিশোরের অনেক অনুরোধের পর রাজি হয়। ভালোবাসাটাকে নোংরাভাবে ব্যবহার করার জন্য আদ্রিতার নিজের দিকে তাকাতেও এখন লজ্জা লাগে।
কিশোর আশপাশ দেখে বললো,“কুল ডাউন ডাক্তার সাহেবা। পারেন নি কিন্তু পারবেন। আমার মনে হয় আজই ফারিশ আপনায় সব বলবে।”
উত্তরে আদ্রিতা কিছু বলে না।’
এদিকে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আদিব সব শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তার নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ডাক্তার ম্যাডাম ফারিশ ভাইয়ের সাথে অভিনয় করেছে। আদিব টের পেল আদ্রিতা চেম্বার থেকে বের হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে সে আড়াল করে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। এরপর কিশোরও বের হলো। আদিব হন্তদন্ত হয়ে যায় কি করবে না করবে বুঝতে বুঝতে সে কল করে ফারিশকে। কিন্তু ফারিশ তার কথা না শুনে একা একাই সব বলে কেটে দেয়। এরপর থেকেই আদিব লাগাতার কল করে ফারিশকে। কিন্তু ফারিশ তোলে না। অতঃপর একান্নবারের কলটা তোলে। আর সব শেষ।’
ফ্লাসবেক ওভার…
—
নির্বিকার চাহনি নিয়ে ফারিশ তাকিয়ে আছে আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার চোখে মুখে ভয়। সে বুঝতে পারে নি। আচমকাই ফারিশ সব জেনে। আদ্রিতা মাথা নুইয়ে রইলো। ফারিশ অসহায় কণ্ঠস্বরে বলে,“এমনটা কেন করলে আদ্রিতা? আমাকে জানার জন্য আর কি কোনো পথ ছিল না?”
আদ্রিতা চোখ তুলে তাকালো ফারিশের দিকে। ফারিশ আবার তাকে তুমি করে বলছে। অথচ এই তুমির মাঝে কোনো ভালোবাসা নেই আছে ঘৃণা। আদ্রিতা জবাব দেয় না। ফারিশ আবার বলে,“কেন করলেন এমনটা?”
আদ্রিতা নিরুত্তর। ফারিশের চারপাশ বুঝি ঘুরছে। তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিষয়টা কোনোভাবেই মানতে পারছে না। ফারিশ শক্ত করে আদ্রিতার দু’হাত চেপে ধরলো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,“আমার দিকে তাকান।”
আদ্রিতা তাকায়। ফারিশের চোখদুটো রক্তলাল বর্ণ ধারণ করছে। আদ্রিতা তাকাতে পারছে না। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে। তাও আদ্রিতা তাকালো। ফারিশ বললো,“কেন করলেন এমন? আমার ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিল না। আমি তো সত্যি সত্যিই আপনায় ভালোবেসেছিলাম। এই হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আপনি এমনটা কেন করলেন?”
আদ্রিতা নিরুপায় কণ্ঠস্বর,
“পুলিশ আমায় বাধ্য করেছিল।”
“একটা মানুষকে ঠকাতে কষ্ট লাগলো না কোনো।”
আদ্রিতা কি বলবে বুঝচ্ছে না। ফারিশ পুনরায় আওড়ায়,“ভালো না বাসার ইচ্ছে যখন ছিল। তখন না বাসতেন এত অভিনয়ের কি দরকার ছিল?”
আদ্রিতা মাথা নিচু করে রয়। ফারিশ আদ্রিতার হাত ছেড়ে দেয়। অনেকক্ষণ চুপ থেকে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে। বুকের বামপাশটা দেখিয়ে বলে,
“আমার ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে আপনি কি টের পাচ্ছেন?”
আদ্রিতার বুক কেঁপে উঠলো সে কথা শুনে। চোখে পানি টলমল করছে। নিজেকে শক্ত রাখা যাচ্ছে না। ফারিশ আর কথা বাড়ালো না। শক্ত কণ্ঠে বললো,“নামুন।”
আদ্রিতা চাইলো ফারিশের দিকে। ফারিশ সরাসরি আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“আমার গাড়ি থেকে নামুন।”
আদ্রিতা কোনোরকম কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,“ফা..রি
পুরোটা শেষ করার আগেই ফারিশ ভয়ংকর রেগে গিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে,“আপনার ওই মুখে আমি আমার নাম শুনতে চাই না। বের হন দ্রুত।”
ফারিশের হুংকার শুনে আদ্রিতা আর বসে থাকতে পারলো না। দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো। ফারিশ বললো,“নিজের ভালো চাইলে আর কোনোদিন আপনার মুখ আমায় দেখাবেন না। ভালো থাকুন সবসময়।”
কথাটা বলেই ফারিশ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। দ্রুত স্পিড বাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল দূরে -সূদুরে। আদ্রিতায় ঠায় দাঁড়িয়ে। তার কষ্ট হচ্ছে। বুক ফেটে যাচ্ছে। জ্বালাপোড়া করছে ভিতরে। আদ্রিতা বুকে হাত দিলো। বিড় বিড় করে বললো,
“এত তো কষ্ট হওয়ার কথা ছিল না আদু। তুই তো শুরুই করেছিলি অভিনয় দিয়ে। তবে কি অভিনয় করতে গিয়ে সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিস ফারিশকে।”
আদ্রিতা আচমকা কেঁদে উঠলো। পরিবেশ তখন প্রবল বেগের বাতাসের ধাক্কায় কাঁপছে। নদীর স্রোতও বইছে অহরহ। সঙ্গে নামছে অন্ধকার। ঘনকালো অন্ধকার।’
—-
রাত তখন আটটা। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ঢুকছে আদিব। তার ফারিশ ভাই কোথায় জানার জন্য মনটা ছটফট করছে। ফারিশ তাকে বলেছিল আদ্রিতাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। একটা সুন্দর বিকেল করবে। কিন্তু কোথায় যাবে তা বলেনি। তবুও আদিব ঢাকার অনেক জায়গায় গিয়েছিল কিন্তু ফারিশকে পায় নি। শেষমেশ হতাশ হয়ে বাড়ি আসলো। আদিব বাড়ির সদর দুয়ার খোলা দেখেই বুঝতে পারলো ফারিশ বাড়িই এসেছে। আদিব দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ফারিশের রুমের দরজা খোলা। আদিব দৌড়ে ঢুকলো ভিতরে। বুক কেঁপে উঠলো তার। পুরো কক্ষের জিনিসপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলেছে ফারিশ। কোথাও কোথাও রক্তের ফোটাও দেখা যাচ্ছে। আঁতকে উঠলো আদিব। পুরো রুমেও চোখ বুলিয়ে ফারিশকে দেখা গেল না। আদিব একটু একটু করে এগিয়ে গেল বেলকনির দিকে। বেলকনির কাছে গিয়ে চোখ দিতেই আরো চমকে উঠলো। ফারিশ পুরো অগোছালো ভঙ্গিতে নিচে বসে আছে। হাত দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। পাশেই মদ আর সিগারেট। ফারিশ মদ খাচ্ছে আবার। গত একমাস যাবৎ ফারিশ এগুলো সব ছেড়ে দিয়েছিল। আদ্রিতার মিথ্যে ভালোবাসা তাকে একটু একটু করে ভালো বানাচ্ছিল। ফারিশ নামাজ পড়াও শুরু করেছিল।’
আদিবের চোখ ভেসে উঠলো। সে দৌড়ে ফারিশের পাশে বললো। অসহায়ত্ব নিয়ে বললো,“ভাই।”
ফারিশ নির্বিকার ভঙ্গিতে আদিবের দিকে তাকালো। শান্ত স্বরে বললো,“তুমি এসেছো আদিব। এত দেরি করলে যে,
আদিবের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ফারিশ বললো,
“আরে তুমি কাঁদছো কেন আমি ঠিক আছি।”
“তুমি ঠিক নাই ভাই।”
ফারিশ মদের গ্লাসে চুমুক দিলো। বললো,“আমি ঠিক আছি আদিব।”
আদিব আবারও বললো,
“তুমি ঠিক নাই ভাই।”
“আমি খুব বোকা তাই না আদিব। না হলে একটা মেয়ে এতদিন যাবৎ আমার সাথে মিথ্যে ভালোবাসার নাটক করলো আর আমি শালার ধরতেই পারলাম না।”
আদিব ড্রিংকের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললো,
“ভাই আমার রুমে চলো আজ তুমি ওইখানেই ঘুমাবে।”
“আমি খুব বোকা তাই না আদিব।”
আদিবের বুক কেঁদে ওঠে। সে বলে,
“তুমি বোকা নও ভাই।”
ফারিশ আচমকাই জড়িয়ে ধরে আদিবকে। আদিব হতভম্ব হয়ে যায়। ফারিশ বলে,
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আদিব। আমি নিতে পারছি না। আমার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। তুমি আমার বুকে গুলি করো আদিব।”
আদিব যেন পুরোদমে থমকে গেল ফারিশের কথা শুনে। এই কোন ফারিশকে দেখছে। আদিব কান্নাভেজা কণ্ঠেই বললো,“ভাই এভাবে বলবে না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে থাকবো।”
ফারিশ জবাব দেয় না। কতক্ষণ পর আবার আওড়ায়,“ও আমায় ভালোবাসে নি আদিব। ও আমায় ভালোবাসে নি। আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। মনে হচ্ছে আমি যেন পুরোটাই শেষ হয়ে গেলাম।”
ফারিশের নেশা হয়ে গেছে। শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আদিব বহুকষ্টে তাকে ধরে দাঁড় করালো। এগিয়ে যেতে যেতে বললো,“সব ঠিক হয়ে যাবে ভাই। সব ঠিক যাবে।”
ফারিশ মাতাল স্বরে আবারও শুধায়,“ও আমায় ভালোবাসে নি আদিব,ও আমায় ভালোবাসে নি।”
#চলবে…
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। এত অপেক্ষার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আসলে গত কয়েকদিন যাবৎ অত্যাধিক মাথা যন্ত্রণায় ভুগছি। যার কারণে গল্প লিখতে পারি নি।]
#TanjiL_Mim♥️