এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️ #লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️ — পর্বঃ৩৫

0
356

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৫

পৃথিবী তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। গাঁ কাঁপা এই শীতে বেশিরভাগ মানুষই ল্যাপকম্বল জড়িয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। অথচ ঘুম নামক এই শান্তির ভিড়ে অশান্তি নিয়ে বেলকনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আদ্রিতা। তার ভিতর পুড়ে ছারখার হচ্ছে। ফারিশের সেই ঘৃণা ভরা চোখ। নিশ্বাস আঁটকে আসার মুহূর্ত। কথা বলার ধরণ, কণ্ঠস্বর সব আদ্রিতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আদ্রিতা বুঝতে পেরেছে, সে কাজটা ঠিক করে নি। পুলিশের কথা শুনে ফারিশের সাথে অন্যায় করেছে। ভুল করেছে, না ভুল নয় ভয়ংকর অপরাধ। যে অপরাধের ক্ষমা নেই। আদ্রিতার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আদ্রিতা ফারিশকে সত্যিই ভালোবাসে। শুরু থেকেই ফারিশকে তার ভালো লাগতো। তার কথা বলার ধরণ, হঠাৎ করে রাগ দেখানো। সব। কক্সবাজারের কিছু মুহূর্তও তার পছন্দের। বিশেষ করে রাতের সেই আলাপন। কিন্তু আদ্রিতা বুঝতে পারে নি তার ভালো লাগা আসলে ভালোবাসা ছিল। আদ্রিতার মনে পড়লো কক্সবাজার থেকে সেই ফেরত আসার দিনটা। সোহেল গাড়ি আনতে লেট করায় তাকে কল করে তখন একটা লোক আদ্রিতাকে প্রশ্ন করে “আপনি ডক্টর আদ্রিতা তো?”

আদ্রিতা তক্ষৎনাৎ পিছন ঘুরে চায়। অনাকাঙ্ক্ষিত লোকটিকে দেখতে পেয়ে বলে,“জি। আমি ডক্টর আদ্রিতা।”

তখনই লোকটি বলে,“আসলে ম্যাডাম আমার বাবার বিষয়ে কিছু কথা ছিল।”

আদ্রিতা তখনও বুঝতে পারে নি লোকটি আসলে একজন পুলিশ ছিল। বাবার ক্যান্সারের কথা বলে আদ্রিতা আর সেই লোকটি গিয়ে বসে আধ ফাঁকা এক রেস্টুরেন্টে। যেহেতু সোহেল আসতে লেট করছিল তাই আর বারণও করতে পারে নি আদ্রিতা। তখনই লোকটি বলে,
“সরি ম্যাম পাবলিক প্লেসে কথাগুলো বলা যেত না তাই মিথ্যে বলে এখানে আনা লাগলো”

আদ্রিতা বেশ অবাক হয়ে বলে,“মানে?”
লোকটি দ্রুতই বলে,“আসলে ম্যাডাম আমি একজন পুলিশ। গত তিনদিন যাবৎ আপনায় যে লোকটার সাথে দেখা যাচ্ছে ফারিশ মাহমুদ। আপনি কি জানেন উনি কে?”

আদ্রিতা বিনাদ্বন্দে বলে,“জি। জানি। উনি একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক।”

লোকটি হাসে। বলে,“না আপনি ভুল জানেন উনি আসলে একজন মাফিয়া। দেশ বিরোধী মাফিয়া। ওনার অনেকগুলো বেআইনি কারখানা আছে। এই ধরনের নানা কিছু বলে আদ্রিতাকে।”

কিন্তু আদ্রিতা মানতে চায় না। আদ্রিতাকে অনেক অনুরোধ করা হয়। শেষমেশ উপায় না পেয়ে রাজি হয়। আদ্রিতা কাজটা করার সময়ও জানতো না ফারিশ সত্যিই একজন মাফিয়া। এমনকি গত দু’দিন আগেও ধরতে পারে নি। সে ভেবে নিয়েছিল পুলিশগুলো তাকে মিথ্যে বলেছে। ফারিশ খারাপ মানুষ নয়। হয়তো সন্দেহের বসে ওসব বলছে। আদ্রিতা ফারিশের সাথে অভিনয় করবে ভেবে মিশলেও। তার করা আচরণ। কোনোটাই অভিনয় ছিল না। যা করেছে সব মন থেকে। মাঝরাতে ফারিশের সাথে ঘুরতে যাওয়া, ফোনে কথা বলা, ফারিশের জন্য কালকের সাজার মুহুর্তটা সব মন থেকে করা। আদ্রিতা বুঝতেই পারে নি সে এতদিন অভিনয় করে নি। সত্যিই ভালোবেসেছিল ফারিশকে। ফারিশের প্রতি তার অনুভূতি কোনোটাই মিথ্যে ছিল না। কিন্তু এগুলো এখন ভেবে কোনো লাভ নেই আদ্রিতা এবার যতই ফারিশকে বোঝাক ফারিশ তাকে বিশ্বাস করবে না। কোথাও গিয়ে আদ্রিতা অন্যায় তো করেছে। ফাস্টলি বাংলো বাড়ির ঠিকানা আদ্রিতাই কিশোরকে দেয়। তারা পুরো বাড়ি খোঁজ করে কিন্তু কিছুই পায় না। আদ্রিতা তা শুনে খুশি হয়। অনেক কিছু বলেও কিশোরকে। ফারিশের বলা কথাগুলো আদ্রিতা সিরিয়াস নেয় নি প্রথমে কিন্তু ফারিশের বলা গাড়িতে বসে কথাগুলোর মধ্যে পপিগাছ– এটা আদ্রিতাকে ভাবাচ্ছে। পরে ভাবছে পপিগাছ থেকে পাওয়া একটা অংশ যা ‘মরফিন’ নামে পরিচিত যা দিয়েই ঔষধ বানানো হয়। এখানে খারাপের কিছু নেই।”

আদ্রিতা চোখ খুলে চাইলো। তার নিশ্বাস আটকে আসছে। দম বন্ধ হওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছে। আদ্রিতা ভেবেছিলাম ফারিশের কথার মধ্যে যদি মাফিয়া-টাইপ কিছু না থাকে তবে কিশোরকে তা দেখিয়ে শাসাবে। কিন্তু তার আগেই সব শেষ। ফারিশের কথাও আর শোনা হলো না।’

আদ্রিতা নীরবে চোখের পানি ফেললো। আদ্রিতার ফোন বাজলো তখন। এতরাতে কল। আদ্রিতা হেঁটে তার রুমের মধ্যে গেল। ঘড়িতে দু’টো ছাড়িয়ে। কলটা কেটে গিয়ে আবার কল বাজলো। কিশোর কল করেছে। আদ্রিতার চরম বিরক্ত লাগলো। কিশোর সবসময় এই টাইমেই কল করে। কারণ সে জানে আদ্রিতা বেশির ভাগ সময়ই এই টাইমে তার চেম্বারের থাকে। আদ্রিতা প্রথমে কলটা তুলবে না ভাবলো। কিন্তু পরে আবার তুললো। বিরক্ত নিয়ে বললো,“হ্যালো।”

ওপাশ থেকে কিশোরের কণ্ঠ শোনা গেল। সে বললো,“কিছু কি পেয়েছেন ডাক্তার সাহেবা?”

আদ্রিতা তেতে উঠলো,“কি পাবো বলুন তো। শুধুমাত্র আপনাদের জন্য একটা মানুষের সাথে আমি বেইমানি করেছি। শুধুমাত্র আপনাদের জন্য তাকে আমি কাঁদিয়েছি। ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়। বুঝতে পেরেছেন সে কোনো মাফিয়া নয়। আর হ্যা ফারিশ সব জেনে গেছে। আমি যে আপনাদের কথা শুনে তার জীবনে ঢুকেছিলাম সব জেনে গেছে। আর ফোন দিবেন না আমায়। আবারও বলছি ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়। তার পিছনে না ছুটে যে আসল দোষী তাকে ধরুণ।”

কল কেটে দিলো আদ্রিতা। মোবাইলটা ছুড়ে মারলো খাটে। তার কিছু ভালো লাগছে না। সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে।’
—-
বছরের শেষ দিন আজ। আজকের দিন পেরিয়ে রাত বারোটা পার হলেই নতুন বছরের আগমন হবে আর পুরনো বছরের ছুটি। ফারিশ ঘুমোচ্ছে। গভীর ঘুমে মগ্ন সে। কাল আদিব তাকে নিয়ে আসে আদিবের ঘরে। বিছানায় শুয়ে দেয়। কম্বল জড়িয়ে দেয় গায়ে। কনকনে শীতের মাঝে কম্বলের ছোঁয়া লাগতেই ক্লান্তিত দেহখানা নিস্তেজ হয়ে পড়ে বিছানায়। ফারিশ ঘুমিয়েছে টের পেতেই আদিব চলে যায় ফারিশের রুমে। তছনছ করা রুমটা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’

সূর্যের প্রখর তেজে ফারিশের ঘুমটা ভাঙতে থাকে হঠাৎ। কিছু একটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আদ্রিতার সেই ঠোঁট, না ঠোঁট নয়। ঠোঁটের জড়ানো কথা। আদ্রিতার পলকহীনভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকা, কনকনে শীতে আদ্রিতার কোলে শুয়ে থাকার সুন্দর মুহূর্তটা। কালকের সেই ভয়ংকর মুহূর্ত, কক্সবাজার থেকে ফেরার মুহূর্ত, রেস্টুরেন্টে খাওয়া,আদ্রিতাকে কোলে তোলা। সবই ফারিশের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কিন্তু এসবের মাঝেও কিছু একটা নজরে আসলো ফারিশের তা হলো আদ্রিতার চোখ। কি মায়াবী সেই চোখ জোড়া। ফারিশের আচমকা মনে হলো,“এত সুন্দর মায়াবী চোখজোড়াও কি ফারিশের সাথে মিথ্যে খেলা খেললো।”

আচমকাই চোখ খুলে চাইলো ফারিশ। আশপাশটা দেখতে লাগলো খুব। বুঝলো আদিবের রুমে সে শুয়ে আছে। ফারিশ শোয়া থেকে উঠে বসলো। মাথা তার ভাড় হয়ে আছে। মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে। ফারিশ কতক্ষণ নিজের মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। মুখ থেকে অস্পষ্টনীয় কণ্ঠে বললো,“আমাকে ভেঙে দেয়ার জন্য দারুণ পথ বেছে নিয়েছিলেন ডাক্তার ম্যাডাম। কিছুটা সফলও হয়েছেন বলা যায়।”

ফারিশ হেঁসে ফেলে। ফারিশকে ভেঙে দেয়া সত্যিই কি খুব সোজা। কালকের দিনটা তার বিষাক্ত ছিল। কিন্তু আজকের সকালটা তা নয়। ফারিশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে বুঝায়,“জীবন তো কম আঘাত দেয় নি ফারিশ। তোর তো ফুলহীন একটা বাগান ছিল,অথচ সেই বাগানে সামান্য একটা ছোট্ট ছুরি এসে তছনছ করে দিলো। কিন্তু ছুরি তো জানে না। ফারিশের ফুলহীন বাগান কতটা শক্তপোক্ত আর চওড়া। এক ছুরি দিয়ে তো একদিনের মধ্যে বাগান শেষ করা যাবে না।”

ফারিশ গম্ভীর এক আওয়াজে আদিবকে ডাকলো। বললো,“আদিব…

আদিব তখনই দৌড়ে আসলো। কিচেনে কাজ করছিল। আদিব বললো,“কি হয়েছে ভাই?”

ফারিশ তাকালো আদিবের দিকে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“গাড়ি বের করলো খুলনার ফ্যাক্টরিতে যাবো?”

আদিব বেশ বিস্মিত হয় বলে,“আজই যাবেন ভাই?”
ফারিশ বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলে,“হুম।”
—-
নিজের চেম্বারের চুপচাপ বসে আছে আদ্রিতা। মনমরা লাগছে নিজেকে। তখনই ঝড়ের বেগে তার চেম্বারে ঢুকলো আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী। মৃদুল তো চেঁচিয়ে বললো,“উড়ে দোস্ত বিয়া খামু?”

ওর কথা শুনে হেঁসে ফেললো সবাই। আশরাফ মৃদুলের মাথায় চাটি মেরে বললো,“আরে হাঁদা তুই বিয়া করবি বিয়া তো খামু আমরা।”

মৃদুল দাঁত কেলিয়ে বলে,“ওই একই হইলো। তোগো চাইয়া বেশি খামু আমি। ইয়া ইয়া মুরগীর রোস্ট।”

মৃদুলের কথায় আবারও হাসলো সবাই। শুধু হাসলো না আদ্রিতা। কারণ সে তো মগ্ন অন্যকোথাও!’

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here