দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ৩৫ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
512

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৩৫
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথ একটু দেরিতে অফিসে পৌঁছানোর কারণে সাথে সাথেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দুপুরের পর ব্রেক টাইমে একটু ফ্রি হতেই সরাসরি দোলাকে কল দিলো। বারকয়েক রিং হওয়ার পর মেয়েটা ফোন ধরলো! দোলা ফোন ধরতেই নিশীথ তৎক্ষণাত ধমকের সুরে বললো,

—এবার কে কে প্রপোজাল দিয়েছে তোমায়?

দোলা যেন বিষম খেলো। সে মাত্রই আয়েশ করে চা খাচ্ছিলো বারান্দায় বসে বসে। সে সময় নিশীথের ফোনকল আসায় সাথে সাথেই একটা ছোট্ট হাসি ফুটে উঠে ওর মুখে৷ সেভাবেই ফোন রিসিভ করতেই লোকটা এভাবে ধমকে উঠলো! ও থতমত খেয়ে বললো,

—কে প্রপোজাল দিবে আমায়? এসব কি বলছেন?

—একদম মিথ্যা কথা বলবেনা, দোলনচাঁপা। আমি সব শুনেছি আন্টির কাছে থেকে!

দোলা বিস্মিত হলো। নিশীথ সব শুনেছে মানে? মায়ের সাথে ওর দেখা হলো কবে? আর দেখা হলেও মা বাসায় এসে এ বিষয়ে ওকে কিছু বলেনি কেন?
দোলার ভাবনার মাঝেই নিশীথ আবারো ওর নাম ধরে ডাকে। দোলা জবাব দিতেই ও বলে,

—খবরদার যদি এরপর আর কিছু লুকিয়েছো আমার থেকে, বলে রাখলাম!

—আমি লুকাইনি তো। মেসেজ দিয়েছিলাম কাল রাতে…

দোলা মিনমিনিয়ে বলে। নিশীথ পালটা প্রশ্ন ছুড়ে,

—ওহ তাই বুঝি? তা কালকের মেসেজগুলো আবার পড়ো দেখি। আমি লাইন এই আছি, আমার সামনে পড়ো কি লিখেছো। ওখানে একবারো তোমার বিয়ের প্রস্তাব আসছে এ ব্যাপারে কিছু বলেছো নাকি আমাকে পড়ে শুনাও! আম ওয়েটিং!

—উফ আপনি এমন করছেন কেন?

দোলা বিরক্ত হয়ে বলে! নিশীথ আগেকার ন্যায় বলে,

—বেশি কথা না বলে যেটা বলেছি সেটা করো। নয়তো স্বীকার করো তুমি আমার থেকে কথা লুকিয়েছো!

জেদি নিশীথের বেবাগিপনায় দোলা পরাজয় স্বীকার করে নেয়। এ লোকের সাথে সে ইহজন্মে পারবেনা! হতাশ কণ্ঠে বলে,

—আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি দুঃখিত আপনার কাছে থেকে কথা লুকোনোর জন্য।

—সবসময় তো এমনই করো। আর কত বার দুঃখিত হবে?

দোলা উত্তর দেয়না। ও কীভাবে বলবে নিশীথ এর বেপরোয়া রাগকে ও ভয় পায়! বিশেষ করে রাকিবের ওই অবস্থা করার পর থেকে নিশীথকে এ সমস্ত ব্যাপারে কোনোকিছু জানাতেও দোলার ভয় লাগে। ও শান্তিপ্রিয় মানুষ, এসব মা’রামা’রি, কি’ল-ঘু’ষি ওর পছন্দ না। অথচ ওর কপালেই কিনা জুটেছে এমন এক প্রেমিক পুরুষ, যে ওর দিকে কেউ তাকালেও তার চোখ তু’লে নিতে দু’বার ভাববেনা!
দোলার ভাবনার মাঝে নিশীথ আবারো চড়া গলায় বললো,

—আমি জাস্ট বুঝিনা, দোলনচাঁপা। তুমি এমন কেন হ্যাঁ? আমায় কি তোমার আপন মনে হয়না? নাকি আমাকেও রাস্তাঘাটের বখাটেগুলোর মতো মনে হয় যে তোমার সাথে অযথা ফ্লা’র্ট করছে বা লাইন মারছে? ডোন্ট ইউ সি এনি ডিফারেন্স ইন মি?

—আপনি এভাবে বলছেন কেন? আমি কি একবারো এসব কিছু বলেছি? আপনি ভুল বুঝছেন!

দোলা তাড়াতাড়ি জবাব দেয়। ও চায়না নিশীথ ওকে ভুল বুঝুক! কিন্তু নিশীথ উল্টো বলে,

—তো আমি কি বুঝবো বলো? কেন তুমি এমন করো আমার সাথে? আমি তো বিয়ের আগে বেশিকিছু চাইনি তোমার কাছে। প্রেমটাও করছিনা আর দশটা কাপলের মতো! শুধু আমি এটুকুই চাই তুমি আমার সাথে তোমার লাইফের সবকিছু শেয়ার করো, আমি তোমার সাথে করবো। কিন্তু এখানেও তুমি আমার কথা শুনোনা! তোমার কোনো কিছু নিয়ে অস্বস্তি লাগলে বা কোনো কিছু তোমায় কষ্ট দিলে সেটা আমায় জানাতে কিসের এত জড়তা তোমার? বলবে আমায় একটু?

দোলা বড়সড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছুক্ষণ ঠান্ডা মাথায় ভেবে নিশীথের উদ্দেশ্যে বলে,

—আপনি আমায় ভুল বুঝছেন আবারো। আমি এমন কিছুই ভাবিনি এবং আমি ইচ্ছা করে আপনার থেকে কথা লুকোইনি। আপনি এটুকু কথাতেই যেভাবে রাগ দেখাচ্ছেন, যদি আমি আপনাকে পুরোটুকু মেসেজে বলতাম তবে কি আপনি শান্ত থাকতেন? নাকি এখনকার মতোই অযথা রাগ করতেন বলেন তো?

নিশীথ চুপ করে রয়। এর উত্তর দেওয়ার কিছু নেই। পানির ন্যায় পরিষ্কার সত্য কথা, তখনো সে অবশ্যই ভীষণ রাগ করতো। কিন্তু তাই বলে কি দোলা ওকে কোনোকিছুই বলবেনা? এ কেমন কথা? আশ্চর্য!
নিশীথ আবারো রাগ করে। গমগমে কণ্ঠে বলে,

—তোমার প্রতি আমার চিন্তা, আমার রাগকে তোমার কাছে অযথা মনে হচ্ছে?

দোলা আবারো মাথা চাপড়ায়! এ কেমন ত্যাড়া লোকের পাল্লায় পড়েছে সে। এতকিছু বললো মেয়েটা অথচ নিশীথ কিনা আটকে গেলো ওই একটা ছোট্ট শব্দে? দোলা নিঃশ্বাস ছাড়ে ফোস করে! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,

—এতকিছু বললাম আমি অথচ ঘুরেফিরে আপনি ওই একটা শব্দে কেন আটকে গেলেন? আগেপিছে কোনোকিছু কানে ঢুকেনি?

মেয়েটার এমন তেজমিশ্রিত আওয়াজে নিশীথ ভ্রু কুচকায়। দোলার উদ্দেশ্যে বলে,

—শুনেছি সবই। কিন্তু আমার খারাপ লেগেছে তুমি আমার রাগকে অযথা বলেছো দেখে।
খানিক থেমে নরম কণ্ঠে বলে,

—তোমার প্রতি প্রকাশিত আমার কোনো অনুভূতিই অযথা নয়, দোলনচাঁপা। হোক সেটা তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কিংবা রাগ। আমার প্রত্যেকটা অনুভুতির পেছনে আলাদা কারণ আছে!

নিশীথের কথাগুলো দোলার অন্তরে ঝড় তুলে। এত সুন্দর করে কেন কথা বলবে লোকটা?
নিশীথ কি বুঝেনা ওর এমন কথায়, ওর প্রত্যেকটা রাগ ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে একটু একটু করে প্রতিনিয়ত দোলার শক্ত মনটা মোমের মতো গলছে?
নাকি ও বুঝে বলেই ইচ্ছা করে এমন করে! দোলা জবাব পায়না। নিশীথের উদ্দেশ্যে নম্র স্বরে বলে,

—আমি আপনার অনুভূতিকে অযথা বলিনি। আপনাকে সম্মান করি, আপনার অনুভূতিকে সম্মান করি। কিন্তু ওইযে আপনি খারাপ লাগার কথা বললেন, আমিও ঠিক একি কারণে আপনাকে কিছু বলিনি। আপনি হয়তো রাগের বশে রাকিবের মতো ওদের সাথে কিছু করে ফেলবেন, তখন যদি লোকে আপনাকে খারাপ বলে? ওটা আমার খারাপ লাগবে। আমি চাইনা আমার কারণে আপনি এরকম কোনো পরিস্থিতিতে পড়ুন। এজন্যই আপনাকে বলিনি!

দোলার কথায় নিশীথ কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায়। ওর দোলনচাঁপা ওকে নিয়ে এতটা ভাবে? ওর তো জানাই ছিলোনা! নিশীথের রাগ কর্পূরের মতো উবে যায়। দোলাকে বলে,

—লোকে আমায় মন্দ বললে তোমার এত খারাপ লাগবে কেন?

নিশীথের প্রশ্নে দোলা লজ্জা পায় ভীষণ। আবেগের বশে এতকিছু মুখ ফস্কে বলে তো দেখছে বিপদে পড়ে গেছে! ও কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে বলে,

—আপনি কি এখন অফিসে?

—হ্যাঁ আমি অফিসে। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। তুমি যে আমায় পছন্দ করো এটা সরাসরি কবে বলবে?

—আমি রাখছি। মা ডাকছে..

—হ্যাঁ, এখন তো মা ডাকবেই। মা, নানি, খালা সবাই একসাথে ডাকবে এখন। ওদের কাছেই যাও! যত্তসব!
নিশীথ রাগে গজগজ করে ফোন কেটে দিলো। দোলা লজ্জায় তাজ্জব বনে গেলো!

এদিকে নিশীথ ভাবলো, এ কেমন মেয়ের প্রেমে মজেছে সে, যে কিনা ওকে সরাসরি ভালোবাসতেও লজ্জা পায়! এমন মেয়ে কি আদৌ হয়? অদ্ভুত! কই ওর আগের গার্লফ্রেন্ডগুলো তো এমন ছিলোনা। ওরা বরং নিজ থেকেই প্রেম প্রেম কথা বলতো। অথচ দোলার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো! সবকিছু আগ বাড়িয়ে নিশীথকেই করতে হচ্ছে। নিশীথ হঠাৎ নিজের ভাবনায় ব্রেক কষে। সে কি দোলাকে ওর আগের প্রেমিকাদের সাথে তুলনা করছে? নাহ! কক্ষনো না। দোলা আলাদা, সব মেয়েই আলাদা। কারও সাথে কারও তুলনা করা উচিত না। নিশীথ এমনটা কখনোই করবেনা। কারণ, দোলা যেমনই হোক না কেন সবকিছু জেনেশুনেই এতকিছুর পরেও নিশীথ ওর দোলাকেই ভালোবাসে। নিশীথের মনেপ্রাণে এখন ওর শুভ্র দোলনচাঁপা ছাড়া অন্য নারীর কথা স্বপ্নেও আসেনা। তাই বাসায় এবার কথা বলে জলদিই স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তর করার পরিকল্পনা করতে হবে!

__________________

আয়মান সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন নিজের কেবিনে। একটা স্টাফকে দিয়ে ছোটভাইকে ডেকে পাঠিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে। মূলত, আরেফিন সাহেবের এখানে আসার অপেক্ষা করছেন তিনি। এরই মাঝে দরজা খুলে উনার রুমে প্রবেশ করলেন আরেফিন সাহেব। বড় ভাইকে দেখে প্রশ্ন করলেন,

—ডেকেছিলেন ভাই? নজরুল এসে বললো ইমিডিয়েট দেখা করতে চেয়েছেন আমার সাথে?

—হ্যাঁ, আমিই ওকে পাঠিয়েছিলাম তোকে ডাকতে। বস এখন। কিছু কথা আছে!

আরেফিন সাহেব বসতে বসতে বললেন,

—হ্যাঁ, বলুন কি কথা! এনিথিং ইম্পর্ট্যান্ট?

—ইম্পর্ট্যান্টই বটে। অনেককিছুই মাথায় ঘুরছে কাল রাত থেকে, ভাবছিলাম নিজের ভাবনাগুলো তোর সাথে শেয়ার করা উচিত। তোর মতামতও জানা যাবে এতে। আমি সঠিক ভাবছি কিনা তুই বলবি আমায়, ঠিকাছে?

আরেফিন সাহেব টেবিল থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ, তিনি কি বলেন এ বিষয়ে নিজের মতামত জানাবেন। কিন্তু আরেফিন সাহেবের ঠিক মাথায় ঢুকলোনা তার বড়ভাই কি নিয়ে এত ভাবছেন! চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আগ্রহের সহিত আয়মান তালুকদারের নিকট চেয়ে থাকলেন উনি। এখন শুধু উনার মুখ খোলার অপেক্ষা!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here