যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে #পর্ব_১ #তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

0
645

” তুমি বরং অন্য কাউকে বিয়ে করে নাও কন্ঠ।”
দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে রেগে উপরোক্ত কথাটি প্রহর চৌধুরী কন্ঠকে বললো। কন্ঠ ছলছল নয়নে প্রহরের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার সকল চঞ্চলতা নিমিষেই যেনো স্তব্ধ হয়ে গেছে। অস্ফুটে স্বরে ম্লান হেসে কন্ঠ বললো,
” বিয়ে করতে কি তোমাকে কখনো বলেছি আমি? ”
” কন্ঠ তোমার সমস্যা কী? সব সময় এরকম ব্যাকুল হয়ে থাকো কেনো বলো তো? তোমার এই চঞ্চলতা সব সময় ভালো লাগে না আমার। আরেকটু হলে গাড়ির নিচে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যেতে তুমি। আর আমি স্ট্রোক করতাম। ”
কন্ঠের গলা কান্নায় ধরে এসেছে। সে যতোই যা করুক তবুও প্রহর কেনো তাকে অন্যত্র বিয়ে করতে বলবে? একথা শোনার চেয়ে তো কন্ঠর গাড়ির নিচে পড়ে চ্যাপ্টা হওয়া ঢেরবেশি ভালো ছিলো। কন্ঠ চুপ করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আজকে প্রহর ও কন্ঠের সম্পর্কের দু’বছর হলো। সেই উপলক্ষে প্রহর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সারাদিন ঘোরাঘুরি করার প্ল্যান করেছিলো। একেই তো কন্ঠ যথা সময়ে আসেনি তার উপর তাড়াতাড়ি রাস্তা পাড় হওয়ার জন্য শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দৌড়ে এসেছিল প্রহরের কাছে। সেই নিয়ে প্রহরের রাগ! প্রহরের কোনো কথাই যেনো তার কানে যাচ্ছে না। প্রহরের বিরক্তির মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। কন্ঠর নীরবতা দেখে প্রহর ফের বললো,
” এখন হুতুমপেঁচার মতো মুখ করে না দাঁড়িয়ে থেকে যেখানে যাওয়ার কথা ছিলো সেখানে চলো। আর রাস্তা পার হওয়ার সময় হাত শক্ত করে ধরে রাখবে। মনে থাকবে?”
কন্ঠ দু’দিকে মাথা নাড়লো। কন্ঠর ছেলেমানুষী দেখে প্রহর এবার না হেসে পারলোনা না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। দু’দিকে মাথা নাড়লো কী বেঝাতে? প্রহর আশেপাশে একবার দেখে হুট করে কন্ঠকে জড়িয়ে ধরে আবার চোখের পলকেই ছেড়ে দেয়। কন্ঠর ঠোঁটের কোণে এবার মুচকি হাসি ফুটেছে। হাজারও মানুষের ভীড় থাকলেও প্রহরের এই হুটহাট জড়িয়ে ধরার ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে কন্ঠর।
” হ্যাঁ মনে থাকবে। আর কখনো রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পাড় হবো না। কিন্তু তুমিও আর কখনো এরকম বকাবকি করবা না প্লাস বিয়ের কথাও বলবা না। ওকে?”
” ওকে মহারাণী। আপনিও দয়া করে একটু স্থির হয়ে হাঁটাচলা করবেন। এখন চলুন। ”
প্রহরের হাতে হাত রেখে কন্ঠ হাঁটছে এবার।

প্রহরের সাথে কন্ঠের আলাপ হয়েছিল আড়াই বছর আগে কোনো এক মেঘলা বিকেলে। প্রহর তখন লেখাপড়া শেষ করেছে সবে। মার্কেটিং জবেও নতুন বলা চলে। মার্কেটিং চাকরির সুবাদে প্রহরকে বলতে গেলে দেশের সব জেলায় ঘুরতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কাজ করতে হয় প্রহরকে। আষাঢ় মাস,আকাশে কালো মেঘের ছোটাছুটি। শেষ বিকেলে কন্ঠ স্যারের বাসা থেকে টিউশন পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরছে। সাথে আছে অনিমা আর অর্ষা। সামনেই এইচএসসি পরীক্ষা হওয়াতে লেখাপড়ার চাপ একটু বেশি ছিলো। তাই ক্লাসের পাশাপাশি এক্সট্রা প্রাইভেট পড়তেও হতো বিকেলে।
” তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চল রে অর্ষা বৃষ্টি নামবে হয়তো। ”
” তোর মতো হরিণের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আমরা হাঁটতে পারি না কন্ঠ। তুই বরং আমাদের দুজনকেই তোর ঘাড়ে নিয়ে তারপর তাড়াতাড়ি চল।”
কন্ঠ সব সময় খুব দ্রুত হাঁটে। আর সেই নিয়ে অনিমা আর অর্ষাও মজা করে। কন্ঠ অনিমার কথা কানে নিলো না। হঠাৎ করেই তার মনে হলো ঠোঁটের লিপস্টিক একটু কম হয়েছে। অথচ এখন তো বাসায় ফিরছে সে লিপস্টিকের কি কোনো দরকার আছে? কিন্তু কন্ঠর আছে প্রয়োজন। অনিমা কিংবা অর্ষাকে ওদের ফোন বের করে দিতে বললে নির্ঘাত ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করবে। ফোনের ক্যামেরা থাকলে লিপস্টিক একটু সুন্দর করে দেওয়া যেতো ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেলো কন্ঠর। এমনিতেই মেয়েটার হুটহাট মুড সুইং হয়। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রাস্তার পাশে একটা বাইক নজরে পড়লো কন্ঠর।
” তোরা সামনে যা আমি আসছি।”
কন্ঠ ওদের দুজনকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো বাইকের আয়না দেখে ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে।
” এক্সকিউজ মি আপু,এটা আমার বাইক। কাইন্ডলি একটু সরবেন? আমার তাড়া ছিলো।”
কাজের সময় কারো হস্তক্ষেপ অপছন্দ কন্ঠর। লিপস্টিক দেওয়া শেষ করে পেছনে ফিরে তাকালো সে। সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
” এতো তাড়া কীসের শুনি একটু? আমি কী অনন্তকাল ধরে আপনার বাইক আঁটকে রাখতাম! যত্তসব গেলাম আমি। ”
তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে গিয়ে লোকটার সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়লো কন্ঠ। মেজাজ তার এখন সপ্তম আসমানে। এই লোকটা যদি খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে না থাকতো তবে তো কন্ঠ পড়তো না।
” ইশ! এতো অস্থির হয়ে চলাফেরা করলে তো সমস্যা। উঠুন উঠুন। ”
” হয়েছে হয়েছে। আপনার জন্যই তো ধপাস করে পড়লাম আমি। ”
প্রহর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু কন্ঠ প্রহরের হাত না ধরে নিজে নিজে উঠে দাঁড়ালো। প্রহরের যে দেরি হয়ে যাচ্ছে সেটা বেমালুম ভুলে গেলো সে। এমন হরিণীর মতো চঞ্চল মেয়ে এ জীবনে আর দেখেনি সে।
” ও আচ্ছা। আমি আসলে বুঝতে পারিনি আপনি এরকম ঘোড়ার মতো ছুট লাগাবেন। ”
” আমি ঘোড়া? ”
” না আমি বললাম ঘোড়ার মতো ছুট লাগানোর কথা। বাই দ্য ওয়ে আমি এখন আসছি।”
প্রহর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে বাইকে চড়ে ছুটলো তার গন্তব্যে। কন্ঠ ততক্ষণে তার বান্ধবীদের কাছে পৌঁছে গেছে। গেলো লিপস্টিক মাখতে আর ফিরলো কি-না গায়ে ধুলোবালি মেখে। কেনো যে তার বাবা-মা এখনও ফোন কিনে দেয়নি সেই নিয়ে কন্ঠর ভীষণ রাগ হচ্ছে এখন। সবকিছুর জন্য দায়ী ইফতি ভাইয়া। উনার জন্যই এইচএসসি পাশ করার পরে ফোন পাবে কন্ঠ।
” তোর এই অবস্থা হলো কীভাবে কন্ঠ? ”
অনিমার প্রশ্নে কন্ঠ কিছু বলার আগেই অর্ষা বলে উঠলো,
” কীভাবে জানিস না? নিশ্চিত ছুটছিল হাঁটার বদলে! ”
কন্ঠ কারো কথা শোনে না আর। মনে মনে তার ইফতিকে গালাগালি করতে করতে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। সেদিনের দেখা অচেনা লোকটাকে এতটা ভালোবেসে ফেলবে সেটা কি কন্ঠ বুঝেছিলো তখন!

সন্ধ্যা নেমেছে। মল্লিক বাড়িতে সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকার নিয়ম নেই। তবুও আজ কন্ঠ এখনো বাড়ি ফেরেনি বলে কন্ঠর মা শারমিন সুলতানা ভীষণ রেগে গেছেন। এমনকি কলও রিসিভ করছে না কন্ঠ। মেয়েটা অতিরিক্ত চঞ্চল বলে শারমিন সুলতানা সব সময় চিন্তিত থাকেন। উঠোনে দাঁড়িয়ে বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। কন্ঠর বাবা রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরেন না। কন্ঠর বাবা মজিদ মল্লিক আর কন্ঠর একমাত্র চাচা জাহাঙ্গীর মল্লিক এক বাড়িতে থাকে। শহর থেকে একটু ভেতরে তিনতলা বাড়িতে দুই ভাইয়ের পরিবার একত্রে বাস করে। জাহাঙ্গীর মল্লিকের দুই ছেলে,ইফতি ও সমুদ্র। কন্ঠ বংশের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় সকলের ভীষণ আদরের সে।
” বড়ো মা কন্ঠ ফেরেনি এখনো?”
ইফতির কন্ঠে পেছন ফিরে তাকালেন শারমিন সুলতানা। ছেলেটাও ঘরে ফিরলো কিন্তু কন্ঠ এখনো ফিরলো না। এমনিতেই আজকাল ভীষণ ঠান্ডা পড়ছে।
” না ইফতি। কল দিচ্ছি তা-ও ধরছে না। চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। ”
ইফতি গম্ভীর রাগী স্বভাবের মানুষ। শ্যামবর্ণ চেহারায় চোখদুটো সব সময় লাল থাকে বলে বেশ ভয়ংকর লাগে দেখতে তাকে। কলেজের প্রভাষক হিসেবে সবে জয়েন করেছে সে। শিক্ষক হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে বেশ কড়া ইফতি। কন্ঠের বেপরোয়া, চঞ্চল স্বভাবের জন্য ইফতির সাথে তার জমে না কখনো। কিন্তু সমুদ্রের সাথে কন্ঠর গলায় গলায় ভাব। সমুদ্র আর কন্ঠ দু’জনেই সমবয়সী।
” ওকে ফোন কিনে দেওয়া ভুল হয়েছে তোমাদের। অনার্সে পড়ুয়া মেয়ে হয়েও বাচ্চাদের মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্ম করে। দাঁড়াও আমি একটু এগিয়ে দেখি।”
ইফতি গায়ের চাদরটা আরেকটু ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলো। শারমিন সুলতানা অসহায় দৃষ্টিতে ইফতির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। আজকে ইফতির বকা শুনতে শুনতে কন্ঠর অবস্থা খারাপ হবে।

“আজকে বাড়ি ফিরে যে কী অবস্থা হবে তাই ভাবছি।”
গাড়ি থেকে নামলো কন্ঠ। প্রহরও গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বাসা থেকে এক বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাবে বলে বেরিয়ে ছিলো কন্ঠ। এই বয়সের মেয়েরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করলেও কন্ঠের কপালে সেসব নেই।
” কিচ্ছু হবে না। বলবে বান্ধবী ছাড়তে দেরি করেছে। অর্ষাকে তো বলাই আছে, কল দিলেও সে-ও একই কথা বলবে। এখন যাও। আমি দাঁড়িয়ে আছি। ”
” তুমি যাও দাঁড়াতে হবে না। দশ মিনিট হাঁটলেই চলে যাবো। কেউ দেখে ফেললে শেষ আমি। ”
” ওকে আমি যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো। আর একটু সাবধানে চলাফেরা করবে।”
কন্ঠ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। প্রহর গাড়ি স্টার্ট দিতেই কন্ঠর দৃষ্টি পড়ে ইফতির দিকে। আজকে যে ইফতি ভাইয়া তাকে পানির সাথে গুলিয়ে খাবে সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই তার। এতক্ষণে প্রহরের গাড়ি দূরে চলে গেছে। কন্ঠ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে ইফতি একেবারে কাছাকাছি এসে পড়েছে।
” কন্ঠ এসব কী ধরনের অসভ্যতা? বড়ো মা আর আমি কতবার কল দিয়েছিলাম তোকে? ফোনটা কি ব্যাগে রেখে দেওয়ার জন্য কিনে দেওয়া হয়েছে? ”
” ফোনের চার্জ শেষ ভাইয়া। বিশ্বাস না হলে দেখো বন্ধ হয়ে গেছে, খুলছে না। ”
কন্ঠ আগেই জানতো এমন কিছু হতে পারে। তাই বুদ্ধি করে ফোনের ডাটা অন রেখে ইউটিউবে ভিডিও চালিয়ে রেখেছিল সারাদিন। ইফতিও কম যায় না। হেঁচকা টানে কন্ঠর ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে ফোন বের করে সত্যি সত্যি চার্জ শেষ হয়েছে কি-না পরীক্ষানিরীক্ষা করলো। না, কন্ঠ সত্যি বলেছে।
” হুম বুঝলাম। তা রাত হলো কেনো?”
” অর্ষা ছাড়ছিল না। তুমি চাইলে বাসায় গিয়ে ওকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে নিও।”
” কিন্তু তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলি এতক্ষণ? আমি দূর থেকে দেখলাম কখন থেকে দাঁড়িয়ে? ”
হঠাৎ করে কন্ঠ ‘আহ’ করে উঠলো। পড়েই যাচ্ছিল বলে ইফতি ধরে ফেললো।
” পায়ে ব্যথা পেয়েছি ভাইয়া, রিক্সা থেকে নামতে গিয়ে। ”
“হয়েছে। এখন বাসায় চল। বড়ো মা চিন্তা করছেন।আমি ধরেছি আস্তে আস্তে চল।”
ইফতির হাত ধরে অল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির দিকে এগোলো কন্ঠ। মনে মনে প্রেমের গুষ্টিকে গালাগালি করছে সে। জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলেনি কন্ঠ। অথচ এই প্রেম করতে গিয়ে কতশত মিথ্যা গল্প আওড়াচ্ছে আজকাল। মাঝে মধ্যে তো কন্ঠর মনে হয় প্রেম একটা লস প্রজেক্ট ছাড়া কিচ্ছু না।

চলবে,

#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

কেমন হয়েছে জানি না। তবে ভালো করার চেষ্টা করবো। কেমন হচ্ছে জানাবেন কিন্তু। ❤️

পরের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=385947600752858&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here