#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৫।
খাবারের পাঠ চুকতেই ফারজাদ বলল,
‘আমাদের একবার এখন থানায় যেতে হবে।’
প্রিয়তা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল, থেমে বলল,
‘কেন?’
‘অফিসার ডেকেছেন আবার।’
‘ঐ লোকগুলো ধরা পড়েছে?’
‘হ্যাঁ। তবে এর পেছনের আসল ব্যক্তিকে এখনো ধরা যায়নি।’
প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জিজ্ঞেস করল,
‘যেতেই হবে?’
প্রিয়তার দিকে চাইল ফারজাদ। তার যেতে না চাওয়ার কারণটা উদঘাটনের চেষ্টা চালাল। তবে ব্যর্থ হয়ে বলল,
‘জি। অফিসার বলেছেন যেহেতু, যেতেই হবে। আপনি তৈরি হয়ে নিন।’
প্রিয়তা মাথা হেলিয়ে গেস্ট রুমে গেল। খারাপ লাগছে ভীষণ। ওয়াদি ধরা পড়ুক সেটা ভীষণ ভাবে চায় সে। তবে কোথাও একটা যেন দুটানা অনুভব করছে, অস্থির লাগছে। ওয়াদির ব্যবহারে হৃদয় মারাত্মক ভাবে জখম হলেও, তার জন্যই আবার এই বেহায়া হৃদয় ব্যথিত হয়ে উঠছে। প্রিয়তা ঢোক গিলল। মাথা চেপে ধরে শান্ত করল নিজেকে। আর যাই হোক, একজন নারী পাচার লোককে সে ভালোবাসতে পারে না, কখনোই না।
তৈরি আর কী হবে, সব ড্রেস তো ব্যাগেই রয়ে গিয়েছে যে ব্যাগ হয়তো এখনো ওয়াদির বাড়িতে পড়ে আছে। তাই কোনোরকম চুল বেঁধে বেরিয়ে এল সে। বসার ঘরেই দিলরুবা বেগম আর ফারজাদ বসা। প্রিয়তার উপস্থিত দেখে ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,
‘তৈরি?’
‘জি।’
দিলরুবা বেগম খেয়াল করে বললেন,
‘দুই দিন যাবত একই কাপড় পরে আছো, ড্রেস চেঞ্জ করলে না কেন?’
প্রিয়তা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
‘আমার ব্যাগটা ঐ বাড়িতেই রয়ে গিয়েছে; আমার সব কাপড়সহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র টাকা পয়সা ঐ ব্যাগেই।’
দিলরুবা বেগম অসহায় ভাবে মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। ফারজাদ নির্বাক। কথা বলার সময় যে অসহায়ত্বের ভারে মেয়েটার গলার স্বর থেমে থেমে আসছিল, সেটা সে বুঝতে পারছিল বেশ। দিলরুবা বেগম বললেন,
‘মৌমির জামা খুব সহজেই তোমার হয়ে যাবে, আশা করছি। চলো, ওর একটা জামা পরে নিবে।’
প্রিয়তা অস্বস্তি বোধ করলেও উপায়ান্তর না পেয়ে রাজী হলো। কিছুক্ষণ পরেই মৌমির একটা সাদা রঙের সেলোয়ার কামিজ পরে বের হলো সে। মাথায় ঘোমটা টানা। অস্বস্তিতে মূর্ছে আছে বদন। সে ফারজাদের সম্মুখে গিয়ে বলল,
‘চলুন।’
একপলক চাইল ফারজাদ। ফোনটা পকেটে পুরে বলল,
‘জি, আসুন।’
বাড়ির বাইরে আজ গাড়ির বদলে বাইক দেখে অবাক হলো প্রিয়তা। হঠাৎ আজ বাইক কেন? প্রশ্নটা মনে মনে আওড়ালেও মুখে ঠিক বলার সাহস পেল না। ফারজাদ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল,
‘উঠে বসুন।’
বাইকে বসা মানেই দুজনের খুব কাছাকাছি থাকা, ভীষণ রকমের অস্বস্তি হচ্ছে প্রিয়তার। কোনোরকমে উঠে বসল সে। মাঝখানে ফাঁকা রাখল অনেকটা। ফারজাদ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল,
‘গাড়িটা অফিসের ছিল, অফিসে রেখে এসেছি। বাইকটা নিজের। এত দূরের রাস্তা অন্য গাড়ি করে গেলে আপনার জন্য কষ্ট হয়ে যেত।’
প্রিয়তার ভাবল, তার মনের প্রশ্নটা ফারজাদ টের পেল কী করে? সে বলার আগেই কেমন উত্তর দিয়ে দিল।
ফারজাদের বাইকের গতি একেবারেই ক্ষীণ। যতটুকু না হলেই নয়, ঠিক ততটুকুই। তাও যথেষ্ঠ চিন্তিত সে, মেয়েটা কোনোরকমে আলগা হয়ে যে বসে আছে সেটা সে বেশ বুঝতে পারছে। অস্বস্তি তারও হচ্ছে বরাবর কিন্তু, এছাড়া উপায়ও ছিল না কোনো। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
‘না না, ঠিক আছি আমি।’
মুখে ঠিক থাকার কথা বললেও ভেতরে সে মোটেও ঠিক নেই। এভাবে বাইকে বসা যায় নাকি! তার উপর এত দূরের রাস্তা এখন এভাবেই যেতে হবে।
________
সন্ধ্যা নেমেছে। পশ্চিমাকাশের লাল আভা বুজে গিয়ে এখন কালোতে ছেঁয়েছে। পাখিরা নিড়ে ফিরেছে কয়েক ক্ষণ আগেই। থানার ভেতরের আম গাছটার কাছে বাইকটা থামাল ফারজাদ। বাইক থেকে নেমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল প্রিয়তা। সে যে না পড়ে এতদূর অবধি আসতে পেরেছে সেটাই ঠের।
প্রিয়তাকে নিয়ে থানায় প্রবেশ করে ফারজাদ। তারা থানায় পৌঁছাতেই গমগম হয়ে উঠে চারপাশ। সাংবাদিকরা যেন প্রিয়তার অপেক্ষাতেই ছিলেন। এত সাংবাদিক দেখে প্রিয়তা ঘাবড়ে যায়। চট করে লুকিয়ে যায় ফারজাদের পেছনে। ফারজাদ অবাক হয়। ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, লুকাচ্ছেন কেন?’
‘সাংবাদিকদের সামনে আমি যেতে চাই না। আমি চাই না এই খবর আমার মা বাবা অবধি যাক। প্লিজ, উনাদের চলে যেতে বলুন।’
প্রিয়তার পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ফারজাদ সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘দেখুন, উনি উনার পরিচয় গোপন রাখতে চাইছেন। আপনারা প্লিজ কেউ ভিডিয়ো করবেন না। উনার সেইফটি ম্যাটার করছে এখানে। আই হোপ, ইউ উইল আন্ডারস্টেন্ড।’
সাংবাদিকরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাদের সহকর্মীদের বলল ক্যামেরা অফ রাখতে। জানাল, তারা শুধু ভয়েস নিবে কোনোপ্রকার ভিডিয়ো করা হবে না। প্রিয়তা চট করে মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর ফারজাদের আঁড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
‘ঠিক আছে, মুখে আমি সব বলতে পারব।’
পুলিশসহ সকল সাংবাদিকদের আরো একবার ঘটনার আদ্যোপান্ত জানাল প্রিয়তা। পুলিশ বলল, প্রিয়তার নামটাও যেন গোপন থাকে। সাংবাদিকও তাই করবে বলে জানাল। প্রিয়তা পুলিশকে ওয়াদির সেই বাড়ির ঠিকানাটা দিয়েছে। যদিও সে জানে, এতকিছু হওয়ার পর ওয়াদি মোটেও সেখানে আর থাকবে না। তাও, একবার তদন্ত করে আসার মাঝে তো ভুল কিছু নেই।
থানা থেকে বের হতে হতে রাত আটটা। প্রিয়তাকে সাথে করে বাইক চালিয়ে কিছুদূর গিয়েই থামল ফারজাদ। প্রিয়তা থামার কারণ বুঝতে পারল না। আশেপাশে বেশ কোলাহল। বোরকা পরা বেশিরভাগ ভাগ মহিলারা কেনাকাটায় ব্যস্ত। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল,
‘আমরা এখানে কেন থেমেছি?’
ফারজাদ সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,
‘চলুন।’
বাইকের চাবি পকেটে পুরে ফারজাদ সামনের দিকে এগুতে লাগল। প্রিয়তাও তাই বাধ্য হলো পা চালাতে। একটা কাপড়ের দোকানের সামনে গিয়ে থামল তারা। ফারজাদ বলল,
‘যা যা প্রয়োজন এখান থেকে কিনে নিন।’
প্রিয়তা চমকাল। হতভম্ব হয়ে বলল,
‘আপনি আমাকে জামা কাপড় কেনার জন্য নিয়ে এসেছেন?’
‘জি। পুলিশ ঐ বাড়িতে তদন্ত করে বাড়ি থেকে আপনার ব্যাগ পেলে জানাবেন বলেছেন; কিন্তু তার আগ অবধি তো আর এক কাপড়ে থাকা সম্ভব না। তাই আপাতত প্রয়োজন মেটানোর মতো কিছু কিনে ফেলুন।’
প্রিয়তা নিষ্পলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। এত ভালো মানুষটাকে নিয়ে কত খারাপ ভেবেছিল সে। ছি! এখনো সে মানুষ’ই চিনে উঠতে পারল না।’
ফারজাদ দোকানের বাইরে দাঁড়ান। প্রিয়তা একটা সেলোয়ার কামিজ পছন্দ করল। দাম জিজ্ঞেস করল দোকানদারকে। দোকানার বলল, তেইশশো টাকা। দাম শুনে রেখে দিল প্রিয়তা। বলল, সস্তার মাঝে কিছু দেখাতে। দোকানদার এক হাজারের ভেতর কিছু জামা দেখালে, প্রিয়তা সেখান থেকে একটা পছন্দ করল। ফারজাদের দিকে চাইল সে। তার মনোযোগ মোবাইলের স্ক্রিনে। ডাকবে ভেবেও ডাকতে পারছে না। তবে তাকে স্বস্তি দিয়ে ফারজাদ নিজ থেকেই চাইল। জিজ্ঞেস করল,
‘পছন্দ হয়েছে?’
প্রিয়তা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘জি।’
ফারজাদ এগিয়ে এসে দোকানদারকে প্যাক করে দিতে বলল সেটা। দোকানদার একটা ব্যাগে কাপড় ভরে এগিয়ে দিল ব্যাগটা। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,
‘একটাই শুধু?’
‘জি।’
ফারজাদ তখন পাশ থেকে আরো দু সেট নিয়ে দোকানদারকে বলল, এগুলোও প্যাক করে দিতে। প্রিয়তা অস্থির সুরে বলল,
‘এতগুলো লাগবে না তো।’
‘একটা ড্রেস কয়দিন পরবেন?’
প্রিয়তা জবাব দিল না। টাকা মিটিয়ে দিল ফারজাদ। দোকানদার ব্যাগগুলো প্রিয়তার হাতে দিতে দিতে বলল,
‘স্যার, ম্যাডাম কিন্তু ভীষণ ভালো। যেখানে অন্যসব বউয়েরা চায় স্বামীর টাকা নষ্ট করে ইচ্ছে মতো শপিং করতে সেখানে ম্যাডাম আপনার টাকা খরচ’ই করতে যাচ্ছেন না। এমন বউ পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার।’
দোকানদারের কথা শুনে প্রিয়তার যেন অস্বস্তিতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই কথাগুলো বলার কি খুব দরকার ছিল? কোনোরকমে ব্যাগগুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সে। তবে ফারজাদ এক মিনিট দাঁড়িয়ে জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। দোকানদারের দিকে চেয়ে রাশভারী স্বরে বলল,
‘উনি আমার বউ নন।’
চলবে…
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/