অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয় #লাবিবা_আল_তাসফি ১১.

0
454

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

১১.

সূউচ্চ প্রাচীরে ঘেরা বাড়িটা প্রিয়তার ভিষণ পছন্দ হলো। বাড়ির সদর দরজা পেরোতেই সামনে পিচদেওয়া সরু রাস্তা। যার দুধারে বাহারি গাছের সমারোহ। দুতলা বাড়িটার অধিকাংশ জায়গা থেকেই রং খসে পড়েছে। বাড়িটায় যে বহুদিন ধরে রঙের আচর পরেনি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। প্রিয়তার বেশি পছন্দ হলো ছোট্ট শান বাঁধানো পুকুর ঘাটটা। টলমলে পানিতে তাকালে নিজের অবয়ব স্পষ্ট দেখা যায়। এতবড় বাড়িটা এই ভর দুপুরেও কেমন ঝিমিয়ে আছে। প্রিয়তা যখন এসবে বিভোর তখন আয়াজ কিছুটা রসিকতা করে বলল,

‘ আপনার নিজগৃহে আপনাকে স্বাগতম প্রিয়।’

‘হুম?’

‘কিছুনা। ভিতরে চলুন।’

আয়াজ হাসে। প্রিয়তা ছোট ছোট চোখে তাকায়। আয়াজ কেন হাসলো সে বুঝতে পারেনা। তবে তার এখন কেমন কেমন লাগছে। সেদিন রাতের ঘটনার পর দুদিন তার সাথে আয়াজের কোনো যোগাযোগ ছিল না। না আয়াজ তার খোঁজ নিয়েছছ আর না সে নিয়েছে। তবে হুটহাট করেই মন খারাপের মেঘ ছেয়ে যেত। চোখের জল ঝড়েছে কয়েকবার। কখনো বা ভিষণ রকম জেদ চেপে বসতো মাথায়। এই পিচ্চি অভদ্র ছেলের সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। পরক্ষনেই হু হু করে কেঁদে উঠত মন। তাকে ভুলে থাকাটা এত বেদনার কেন?
আজ প্রিয়তা দুটো ক্লাস করিয়ে ছুটি নিয়েছে। মনের সাথে সাথে শরীরটাও ভিষণ খারাপ। স্কুল থেকে বেরিয়ে বাসের জন্য দাড়াতেই সেখানে আয়াজের আগমন ঘটে। পরনে তার থ্রিকোটার প্যান্ট এবং হাফ হাতার টিশার্ট। প্রিয়তার বুকের ভেতর দামামা বেজে ওঠে। ছেলেটা এত আকর্ষণীয় কেন? এই যে তার কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে! তার ভেতর পুষে রাখা রাগ গলে যাচ্ছে। প্রিয়তা চোখ সরিয়ে নেয়। এই অভদ্র ছেলের দিকে দ্বিতীয়বার তাকাবেনা সে। আয়াজ এগিয়ে এলো। প্রিয়তার শাড়ির আঁচল তুলে মুখ মুছল। প্রিয়তা‌ হকচকাল। চোখ বড় করে বলল,

‘কি হচ্ছে আয়াজ! লোক দেখছে তো!’

আয়াজ আশপাশে তাকালো। তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোক কেমন ভাবে তাকিয়ে আছে। আয়াজ মিষ্টি করে হাসলো। মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল,

‘মুখের ঘাম মোছার জন্য বউয়ের আঁচল বেষ্ট। তাই না চাচা?’

লোক দুটো কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। প্রিয়তা চোখ গরম করে। তবে আয়াজ পাত্তা দেয় না। প্রিয়তার পিছু পিছু বাসে ওঠে। বাস থেকে নামার পর এক প্রকার হুমকি ধমকি দিয়েই সে প্রিয়তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। যদিও প্রিয়তাকে এভাবে ধমকে আনা সহজ ছিল না আয়াজের পক্ষে। শাকিলা বেগম কল করে বলায় প্রিয়তা রাজি হয়েছে। তা দেখে আয়াজ প্রিয়তাকে খোঁচাতে বাদ রাখেনি। দুষ্টু হাসি দিয়ে ছোট ছোট করে বলেছিল,

‘কি ভেবেছিলেন? একা বাসায় আপনায় হরণ করতে নিয়ে যাচ্ছি? আপনার ভাবনাগুলোতো ভিষণ দুষ্টু প্রিয়! আপনাকে দেখে তো বোঝা যায় না এত দষ্টু চিন্তা নিয়ে ঘুরছেন!’

প্রিয়তা চোখ কপালে তুলে তাকায়। মুখের কি ভাষা ছেলের! একদম রসাতলে চলে গিয়েছে ছেলেটা!
__________

বর্তমানে আয়াজদের লিভিংরুমে বসে আছে প্রিয়তা। তার সামনের টেবিল জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রকম খাবার। তার শরীরের তাপ বেড়েছে কিছুটা। কোনো কিছুই খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। খুব ছোট থেকেই অসুস্থ হলে সে খেতে পারে না। খাবার দেখলে বমি বমি পায়। এখনো তার ভিন্ন কিছু নয়। তবুও প্রিয়তা এক টুকরো আপেলে ছোট ছোট করে কামড় বসাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর শাকিলা তাকে তাড়া দিচ্ছে খাওয়ার জন্য। প্রিয়তা অসহায় চোখে আয়াজের দিকে তাকায়। কিন্তু আয়াজ তার দিকে নজর দিল না। সে তো সোফায় আধশোয়া হয়ে গেইম খেলায় ব্যস্ত।

‘আপনিই কি আমার হতে চলা ভাবী?’

কন্ঠস্বর অনুসরণ করে বা দিকে তাকায় প্রিয়তা। ছিমছাম গঠনের একটা ছেলে হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ফুটবল। পরনে জার্সি। মুখমন্ডল ঘর্মাক্ত। মাত্রই মাঠ থেকে খেলে ফিরেছে। প্রিয়তা ভিষুম খেল। খুকখুক করে কেশে উঠলো। শাকিলা বেগম ব্যস্ত হলেন। এগিয়ে এসে পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরলেন। আয়ানকে চোখ রাঙালেন। আয়ান ঠোঁট উল্টে ভাইয়ের দিকে তাকালো। আয়াজ কপালে ভাঁজ ফেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ান মুখ কালো করে বলল,

‘কি করেছি আমি? এভাবে কেন তাকাচ্ছো সবাই?’
কথা শেষ করে পরপর প্রিয়তার দিকে তাকালো আয়ান। মুখ ভার করে শুধাল,

‘নট ফেয়ার ভাবী। কতটা এক্সাইটেড ছিলাম আমি তা তোমার চিন্তা ধারণার বাহিরে। ভেবেছিলাম তুমি আমার পার্টনার হবে। আমরা দুজন মিলে এ বাড়িকে ছোটখাটো একটা সার্কাস বানাব। কিন্তু প্রথম দিনেই তুমি আমার শত্রু বনে গেলে! এটা সত্যিই বেদনাদায়ক।’

আয়ান অসহায় মুখ করে চলে গেল। প্রিয়তা গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল কেবল। শাকিলা হেসে জানালেন,

‘ওর কথায় কিছু মনে করো না। ও আয়াজের ছোট চাচ্চুর ছেলে। আয়ান। ভিষণ দুষ্টু।’

প্রিয়তা হাসলো। সে জানে না ঐই মুহূর্তে কি বলা উচিত তাই হাসিকেই উত্তর হিসেবে বেছে নিল সে। শাকিলা আবারো বললেন,

‘দেখো তোমায় ঢেকে এনে এখন নিজেই ব্যস্ততা দেখাচ্ছি। কিছু মনে করো না। আজ বাড়িতে কেউ নেই। রিতাও তার বাবার বাড়িতে।’

প্রিয়তা হেসে বলল,

‘কোনো ব্যাপার না আন্টি। আমি আপনাকে হেল্প করি? কাজ করতে করতে নাহয় গল্প হবে।’

শাকিলা বেগমের মুখ উজ্জ্বল হলো। মেয়েটার অমায়িক ব্যাবহার তাকে মুগ্ধ করেছে। কি ভিষণ মিষ্টি মেয়েটা! যেন কোন স্বর্গদূত! শাকিলা বেগমের ভিষণ আফসোস হলো। কি হতো যদি মেয়েটার বয়স আর একটু কম হতো? প্রিয়তাকে দেখলে তার বয়স বোঝা যায় না ঠিক। প্রিয়তাকে তার পছন্দ হয়েছে এটাও ঠিক। তবুও তার মনে একটু খচখচানি রয়েই গেলো। মেয়েটা যে তার ছেলের থেকে পাঁচ বছরের বড়! আয়াজের বাবা কি এই সম্পর্কে সম্মতি দিবেন?
__________

গ্রীষ্মের শেষ প্রায়। প্রকৃতি হুটহাট নিজের রূপ বদলে ফেলছে। কখনো ভিষণ রোদ কখনো বা ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি। বর্তমানে আকাশে মেঘ করেছে। ভিষণ রকম অন্ধকার। বাতাস বইছে শো শো করে। ভাব এমন যেন এখনি বৃষ্টি নামবে। ভাসিয়ে দিবে এ ধরণীকে। কিন্তু প্রিয়তা জানে বৃষ্টি হবে না। থেমে যাবে কিছুক্ষণের মাঝে। মেঘ কেটে সূর্যি মামা উঁকি দিবে। হেসে বলবে,’হাভ সাম ফান?’

প্রিয়তার কথা সত্যি হলো। মেঘ কেটে গেছে। উজ্জ্বল আলোয় ছেয়ে গেছে সর্বত্র। প্রিয়তা সরল হাসলো। গুনগুন করে গান ধরলো। আজকাল তার খুব সুখ সুখ অনুভব হয়। মাজা অবদি ছড়ানো চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে খোপা বাঁধলো। মনে পড়লো আয়াজ তার চুল দেখে বলেছিল,

‘চুল সামলাতে নিশ্চই আপনার ভিষণ কষ্ট হয় প্রিয়? বিয়ের পর আপনার চুল সামলানোর দায়িত্বটা আমি নিয়ে নিলাম। এই সামান্য কটা দিন নাহয় একটু কষ্ট করে নিন।’

প্রিয়তার ঠোঁটের কোণে হাসি মিলল। আয়াজের কথা মনে পড়লে আজকাল তার ভিষণ লজ্জা লাগে। কেমন করে যেন তাকায় ছেলেটা। একদম বুকে এসে লাগে। প্রিয়তার ফোন বেজে উঠলো। প্রিয়তা ব্যস্ততা দেখালো না। ফের আয়নায় নিজেকে একবার দেখে উঠলো। ধীর পায়ে এগিয়ে বিছানা থেকে ফোন তুলে নিল। ফোনের ট্রেনে আজের নাম্বর ভেসে উঠেছে। প্রিয়তা আয়োজন নাম্বার সেভ করেনি। সেভ করার মতো উপযুক্ত কোনো নাম সে আয়াজকে দিতে পারেনি। তবে নম্বরটা তার ভিষণ পরিচিত।

‘এত দেরী কেন হলো প্রিয়তা?’

‘চুল বাঁধছিলাম।’

‘আচ্ছা।’

এরপর নিশ্চুপ। কিছুসময় পর আয়াজ আবার বলল,

‘একটু বের হতে পারবেন?’

‘যদি বলি না তবেকি বের হতে মানা করবে?’

‘দুঃখীত। না বলে কোনো অপশন আপনার বরাদ্দ নেই। রেডি হয়ে নিন। টাইম থার্টি মিনিট।’

কল কেটে গেছে। প্রিয়তা ফিচেল হাসলো। অতঃপর বসে গেলো পোশাক বাছাইয়ের জন্য। আজকের এই সুন্দর পরিবেশে তাকেও সুন্দর লাগা চাই।

চলবে……..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here