অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয় #লাবিবা_আল_তাসফি ১২.

0
212

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

১২.

‘আয়াজ আমার কাছে কিছু ঠিক লাগছে না। প্লিজ পাগলামি করো না।’

‘আপনি আমায় ভালোবাসেন প্রিয়তা?’

প্রিয়তা আয়াজের চোখে তাকালো। ছলছল চোখে মাথা উপরনিচ করলো। আয়াজ জোরে শ্বাস নিলো। বলিষ্ঠ হাতে প্রিয়তার হাত আঁকড়ে ধরল। আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘আমরা খারাপ কিছু করছি না প্রিয়। আমরা আমাদের সম্পর্ককে হালাল করছি। নিজেদের সম্পর্কের একটি পূর্ণতার রূপ দিচ্ছি। কেন অযথা ভয় পাচ্ছেন? আমিতো আছি।’

আয়াজের কথা শুনে প্রিয়তাহু হু হু করে কেঁদে ফেলল। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল,

‘আমি তোমাকে হারানোর ভয় পাচ্ছি আয়াজ। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা। একদম চাই না।’

আয়াজ মুচকি হাসলো। আলতো হাতে মুছে দিল প্রিয়তার চোখ। ফিসফিস করে বলল,

‘আমাকে যেন না হারাতে হয় তার ব্যবস্থাইতো করছি।’

‘কিন্তু..’

‘হুসসহ। কোনো কিন্তু না। ভেতরে চলুন। যত লেইট করবেন আমাকে হারানোর সম্ভাবনা তত বাড়তে থাকবে। রিস্ক নিতে চান?’

প্রিয়তা ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে না জানালো। আয়াজ ঠোঁট টিপে হাসলো। কে বলবে এই মেয়ে পেশায় একজন শিক্ষিকা? আয়াজের মনে হচ্ছে প্রিয়তাকে একটা চকলেট দিলেই সে কান্না থামিয়ে ফিক করে হেসে ফেলবে। এত আদুরে কেন তার প্রিয়?
____________

কাজী অফিস থেকে আজ খুব হাসিখুশি মুখে বের হলে দেবো প্রিয়তার মুখটা থমথমে। সে এখনো বুঝতে পারছেনা কি থেকে কি হলো। আজ শুক্রবার হওয়ার সুবাদে সে বাসাতেই ছিল। আয়াজ কল করে ডাকায় সে ফুরফুরে মেজাজে দেখা করতে চলে আসে। কিন্তু আয়াজের বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে সে থমকে যায়। কেমন এলোমেলো হয়ে আছে তার চুল। মুখটাও ফুলে আছে। প্রিয়তা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

‘কি হয়েছে? এমন কেন লাগছে তোমায়?’

উত্তরে আয়াজ যা বলে তা প্রিয়তাকে আবারো কাঁপিয়ে দেয়।

‘আমায় বিয়ে করতে পারবেন প্রিয়?’

‘কি হয়েছে আয়াজ? এসব কেন বলছ?’

‘পারবেন?’

প্রিয়তা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়।

‘অবশ্যই।’

এরপর আয়াজ আর কোনো কথা বলে না। একটা রিকশা ঠিক করে তাতে চড়ে বসে। সুপারমার্কেটের পাশের চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় কাজী অফিস। কাজী অফিসের সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রিয়তা নড়েচড়ে ওঠে। বুকের ভেতর অজানা কারোনে ডিপডিপ করছে। নাকে ছোট ছোট ঘামকণা জমতে শুরু করেছে।

‘এখানে কেন আমরা আয়াজ?’

‘কাজী অফিসে যে কারণে আসে মানুষ সে কারণে।’

এরপর যা হওয়ার সেটাই হয়েছে। আপাতত প্রিয়তা শক্ত করে আয়াজের হাত ধরে আছে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কত কিছু হয়ে গেল তার জীবনে। এখন সে বিবাহিত। তার একটা পিচ্চি বর আছে। প্রিয়তা কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন করল,

‘এখন আমরা কোথায় যাব আয়াজ?’

আয়াজ সময় নষ্ট না করে সহজ গলায় বলে,

‘কুঠিবাড়ি।’

কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে প্রিয়তার ভাবতে। অতঃপর মনে পড়ে এটা আয়াজদের বাড়ির নাম। প্রিয়তার ভিষণ মন খারাপ হলো। আজ তার বিয়ে হলো অথচ তার কোনো পরিবার নেই। না আছে কোনো অভিভাবক। সে নিজেই নিজের সব। আজ মা থাকলে নিশ্চয়ই তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আয়াজের হাতে তুলে দিত। প্রিয়তার বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে পা বাড়ালো তার নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে। তার জানা নেই কি হতে চলছে। কিন্তু তবুও তার কোনো ভয় নেই। পাশের মানুষটার হাতে হাত রেখে সে ভয়হীন ভাবে মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে পারবে।
____________

মাথার উপরের সিলিং ফ্যানটা ভনভন করে ঘুরছে। ভাবসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আয়াজ। শাকিলা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিলো ছেলের দিকে। তোরিকুল সাহেব বিরক্তি নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। পানি শেষ করে আয়াজ বাবার চোখে চোখ রাখল। শান্ত শীতল গলায় বলল,

‘এত জরুরি তলব কেন?’

তরিকুল সাহেব সোজা হয়ে বসলেন। গমগমে সুরে বললেন,

‘তোমাকে কেন জরুরি তলব পাঠানো হয়েছে তার কারণ নিশ্চই আমাকে বলতে হবে না। যথেষ্ট বুদ্ধিমান তুমি।’

‘জি। আমার মনে হয় কারণটা আমি বুঝতে পেরেছি। আর এজন্যই আপনার মতামত শুনতে আগ্রহী আমি।’

তরিকুল সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। ছেলের এমন শান্ত শীতল কন্ঠ তাকে তার জায়গা থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে তিষি ভিষণ বিরক্ত বোধ করলেন। গলার স্বর কঠিন করে তিনি বললেন,

‘সমাজে আমার একটা সম্মান আছে। তোমার এটা ভুলে গেলে চলবেনা। পাঁচ বছরের বড় একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছ। এ কথা লোকে জানলে কি হবে বুঝতে পারছ? তোমার আমার রেপুটেশনের কথা একবার ভাবা উচিত ছিল।’

আয়াজ ধৈর্য হারালো না। তার ভাব-ভঙ্গি স্বাভাবিক। প্রগাঢ় শান্ত কন্ঠে বলল,

‘বিয়েটাতো আমি করেছি বাবা। রেপুটেশন কেন আপনার নষ্ট হবে? কেউ কিছু বলতে এলে তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। আমি বুঝে নিব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন।’

তরিকুল সাহেব খুক খুক করে কেশে উঠলেন। এই মুহূর্তে তার নিজের ছেলেকে চরম অসভ্য অভদ্র বলে মনে হচ্ছে। বাপের থেকে বেশি বুঝতে শিখে গেছে। এই ছেলেকে অসভ্য ছাড়া আর কি বলা যায়?
তরিকুল সাহেব থামলেন। গম্ভীর হয়ে ছেলেকে দেখলেন। তার ছেলের ভেতর আত্মবিশ্বাস জেদ সর্বদাই বেশি। ছেলে যা করছে সব তার জেদ। একবার জেদ থেকে বের হয়ে এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রিয়তাকে তার দেখতে শুনতে খারাপ লাগছ না। কিন্তু তবুও কেন জেন মেয়েটাকে তার ভিষণ অপছন্দ। বয়সে বড় তাই? হয়তো। তরিকুল সাহেব পুনরায় আয়াজের দিকে মন দিলেন। ভিষন গম্ভীর অথচ শান্ত গলায় বললেন,

‘তোমার বউয়ের জন্য এ বাড়ির দরজা বন্ধ। আমার অফিসেও তোমার জায়গা হবেনা যদি তুমি তোমার কথায় অটল থাক। ভেবে দেখো কি করবে। আমার কথা শুনলে বাড়ি ফিউচার সব তোমার হাতের মুঠোয়। আর অন্যথায় সব থেকেও তোমার কিছুই নেই।’

তরিকুল সাহেব সন্তুষ্ট চিত্তে উঠে দাঁড়ালেন। তার ছেলে ভিষণ বুদ্ধিমান। সামান্য একটা মেয়র জন্য সব কিছু সেক্রিফাইস করে বোকামি নিশ্চই করবে না। তিনি আনন্দিত হয়ে শাকিলা বেগমকে ডাকলেন। আবদার করে বললেন,

‘এক কাপ গরম চা আর গরম গরম পাকোরা বানাও তো। তোমার হাতের পাকোরা মিস করছি।’

শাকিলা বেগম তরিকুল সাহেবের হাসি হাসি মুখ দেখে খুশি হলেন। নিশ্চই সব স্বাভাবিক হয়েছে! পরিবারে তাহলে সুখ নামলো বোধহয়!
কিন্তু তিনি জানতেন না পরিবারের শেষ সুখ টুকুও ধূলিস্যাৎ করেই আনন্দে মেতেছে তরিকুল সাহেব।
_________

প্রিয়তা ভিষণ মন খারাপ নিয়ে কাবার্ড থেকে আয়াজের কাপড় বের করে গোছাতে লাগলো। সে একটা পরিবার পাবে একটা মা পাবে এতসব ভাবনা নিয়েই এ বাড়িতে পা রেখেছিল সে। কিন্তু তার মেয়াদকাল এ বাড়িতে একটা রাত ও হলো না। সে কি এমন পোড়া কপাল নিয়েই জন্মেছে? প্রিয়তা আঁচলে চোখ মুছল। একবার ভালো করে আয়াজের রুমটা দেখে নিলো। এই রুমটায় ঢোকার পর তার ভিষণ আপন মনে হয়েছিল। কিন্তু কি হলো? প্রিয়তা উদাস মনে হেঁটে বারান্দায় গেল। আয়াজের রুমের বারান্দাটা বিশাল। জানা অজানা বিভিন্ন ফুলের গাছ আছে এখানে। এখানে বসে চন্দ্রবিলাস করা যেত। মাত্র কয়েক ঘন্টায় প্রিয়তা অনেক কিছুই ভেবে নিয়েছিল কিন্তু তার কিছুই হলোনা ভেবে মুখ কালো করলো সে। এরি মাঝে আজ এলো রুম। প্রিয়তাকে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে দাঁড়ালো। পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে কাঁধ থুতনি ছোয়াল। প্রিয়তা চমকে উঠে চোখ বন্ধ করে নিলো।

‘মন খারাপ কেন বউ?’

আয়াজের মুখে বউ ডাক শুনেই প্রিয়তা কেঁদে ফেলল। আয়াজ থতমত খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ব্যস্ত হয়ে বলল,

‘কাঁদছেন কেন?’

‘তুমি কথা রাখোনি আয়াজ। তোমার পরিবার আমায় মেনে নেয়নি।’

আয়াজ আলতো করে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তাকে। শান্ত করার গলায় বলল,

‘আমি আপনাকে মেনে নিয়েছি প্রিয়তা। এর থেকে বেশি কি চাই আপনার?’

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here