#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৪.
হাঁটার মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তা বারবার আয়াজের পানে তাকাচ্ছে আবার নিজেকে দেখছে। কখনোবা নিরবে দুজনের হাইট মাপছে। সে আয়াজের থেকে অনেকটাই খাটো। মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট লম্বা হলেও আয়াজের কাঁধ সমান তার হাইট।
‘ফুচকা খাবেন?’
প্রিয়তার পেট ভরা। তবুও সে এমন সুন্দর অফার মিস করতে চাইল না। মাথা ঝাঁকাতেই আয়াজ তার হাত ধরে রাস্তা পার হলো। প্রিয়তা আবারো মুগ্ধ হয়ে তাকালো আয়াজের পানে। কত যত্নশীল ছেলেটা। তার মনের মাঝে প্রেমের হাওয়া বইতে লাগলো। এই ছেলের প্রেমেতো সে বহু আগেই পড়েছে। তবুও নতুন ভাবে যেন সে প্রেমে পড়ছে। প্রিয়তা বেশি ঝাল খেতে পছন্দ করলেও আয়াজের জন্য তা পারল না। আয়াজের চোখ রাঙানিতে ভদ্র মেয়ের মতো অল্প ঝালে এক প্লেট ফুচকা নিলো। আয়াজ খেল না।
‘তুমি কেন খাচ্ছ না?’
‘এসব আনহাইজেনিক ফুড আমি পছন্দ করি না।’
প্রিয়তা মুখ বাঁকাল। ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে খোঁচা দিল।
‘নিজে খাওনা কিন্তু বউকে তো বেশ খাওয়াচ্ছ। তাড়াতাড়ি মেরে অন্য একটা বিয়ে করার ধান্দা। বেশ বুঝেছি আমি!’
আয়াজ শীতল চোখে তাকালো। কোনো কথা না বলে প্রিয়তার হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিল। প্রিয়তা সবে তিনটা ফুচকা খেয়েছে। বাকি ফুচকা প্লেট কাত করে ময়লার বালতিতে ফেলে দিল আয়াজ। প্রিয়তা চেঁচিয়ে উঠলো।
‘এই কি করছ! খাবো তো!’
আয়াজ বাঁকা হাসলো। তাচ্ছিল্য করে বললো,
‘যদি মরে যান? দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছে নেই আমার।’
প্রিয়তা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এভাবে ফেঁসে যাবে বুঝতে পারেনি। খুব আফসোস হলো। ওমন কথাটা বলা কি খুব জরুরী ছিল? গাল ফুলিয়ে আয়াজের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল। দ্বিতীয়বার আর সে এই ছেলের পেছনে লাগবে না।
____________
পেপার হাতে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন তরিকুল সাহেব। শাকিলা উশখুশ ভাবে পায়চারি করছে। এতবছরের সংসারে এখনো তিনি স্বামীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন না। তার উৎকণ্ঠা চোখের আড়াল হলো না তরিকুল সাহেবের। তিনি আড় চোখে অবলোকন করে বললেন,
‘কিছু বলবে?’
শাকিলা সাহস পেল। এগিয়ে এসে পাশে বসলো। ধরে আসা গলায় বললো,
‘ছেলেটার খোঁজ নিয়েছেন?’
আয়াজের কথা স্মরণ হতেই চোয়াল শক্ত হলো তরিকুল সাহেবের। হাতের পেপারটা তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে জ্বলন্ত চোখে চাইলেন। তীব্র রাগ নিয়ে তিনি হুংকার ছাড়লেন।
‘তোমার ঐ অভদ্র বেয়াদপ ছেলের কথা আমায় বলবেনা। কতটা অবাধ্য হলে এভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়! আমার সম্মানের কথা একবারও ভাবলো না।’
শাকিলা বেগম অসহায় মুখে তাকালেন। অনুনয় করে বললেন,
‘ছোট ও। না বুঝে ভুল করে ফেলেছে। আপনি এভাবে রাগলে মানায়?’
তরিকুল সাহেব বিরক্তি নিয়ে স্ত্রীর দিকে চাইলেন। কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বললেন,
‘তোমার ছেলে যে ছোট বিয়ে করার সময় মাথায় ছিল না তার? তুমি বা কোন আক্কেলে ছোট ছেলের বউকে ধেই ধেই করে বরণ করতে গেলে! বোঝাতে পারলেনা সে ছোট বিয়ে করার বয়স হয়নি!’
শাকিলা হতাশ হলেন। বাপ-ছেলে কেউ কারো থেকে কম না। এভাবে চললে এর শেষটা কিভাবে হবে! সে তো মা! সন্তান বাড়ির বাহিরে আছে। কি অবস্থায় আছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দুদন্ড স্থির থাকতে পারছেন না তিনি। একটা মাত্র ছেলে একটুনাহয় অবাধ্য হয়েছে। তাই বলে এভাবে বের করে দিতে হবে কেন? চোখ জ্বলে উঠলো তার। ভিষণ অভিমান হচ্ছে তার। ছেলেটাও বা কম কিসে? বাপ বলল অমনি সুরসুর করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মায়ের কথা একবার ও ভাবল না। শাকিলা শব্দ করে রুমের দরজা বন্ধ করলেন। ছেলে বাড়ি ফিরলে তবেই এই দরজা খুলবে। অন্যথায় সে রুমের বাহিরে এক পা ও ফেলবে না। আর নাইবা খাবে। দেখা যাক পানি কতদূর গড়ায়।
___________
রোদ ঝলমলে সকাল। প্রিয়তার অফ পিরিয়ড চলছে। আয়াজকে কয়েকবার কল করেও পেল না। প্রিয়তা ওদিকে তেমন পাত্তা দিল না। হয়তো ব্যস্ত আছে।
‘প্রিয়তার মুখ উজ্জ্বল লাগছে খুব। কারণ কি?’
প্রিয়তা তাকালো। তার সামনের ডেস্ক থেকে শর্মিলা ম্যাম হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে প্রশ্ন করেছে। তিনি এই স্কুলে সবথেকে সিনিয়র। বয়স চাকরি দুদিক থেকেই। তাছাড়া ভিষণ মিশুক। কেমন হেসে হেসে কথা বলে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। বিয়ের কথা বলেকি সে সবাইকে একটু চমকে দিবে? কিন্তু হাতে টাকা নেই। এভাবেতো বলা যায় না। তাই সে চেপে গেলো। মিষ্টি হেসে বলল,
‘আমার হাসতে মানা?’
‘তা নয়। তবে তোমার হাসি তো ধুমকেতুর মতো। বহু অপেক্ষার পর দেখা মেলে। তাই কিউরিয়াস!’
প্রিয়তা মুচকি হাসলো। কোনো জবাব দিলো না। কি বা জবাব দিবে?
আজ বহুদিন পর নিখিলের সাথে দেখা। অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই দেখা হয়ে গেল।
‘কেমন আছেন ম্যাডাম? আপনাকে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তো খোঁজ পাওয়া যায় না।’
অনেকটা টিটকারী করেই বলল নিখিল। প্রিয়তার মন আজ ভীষণ রকম ভালো। মন ভালো উপলক্ষে নিখিলের এই সামান্য কথাকে গায়ে মাখাল না সে। সৌযন্যমূলক হেসে বলল,
‘এই একটু ব্যস্ত ছিলাম মাত্র।’
‘এতটাই ব্যস্ত যে সামান্য ম্যাসেজ ওপেন করার সময়টাও হয়নি!’
নিখিলের কন্ঠ জুড়ে হতাশা। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট গুলো অভিমাণ হয়ে বের হতে চাইল। নিখিল রুখল। তার সামনের এই রূপবতী রমনীর কৃষমতা নেই তার হৃদয়ের ব্যাথা অনুভব করার। তার অভিমান গুলোকেও হয়তো সে অবহেলায় উড়িয়ে দিবে ঠিক যেভাবে মেয়টার মোবাইলে এক অংশে তার পাঠানো ম্যাসেজ গুলো পড়ে রয়েছে নিদারুণ অবহেলায়। নিখিল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মুখে মিথ্যা একটুকরো হাসি ঝুলিয়ে ব্যাথিতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘এক কাপ কফি একসাথে বসে খাওয়ার মতো বন্ধুত্বটুকু আছে নিশ্চয়ই!’
প্রিয়তা নিখিলের আকুতি ভরা দৃষ্টি দেখলো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সম্মতী জানালো। প্রিয়তার বলতে ইচ্ছা হলো,’আমার যদি আরো একটা হৃদয় থাকতো সেখানেও হয়তো আপনাকে দেওয়ার মতো বিন্দু জায়গা অবশিষ্ট থাকতো না। আমার পিচ্চি বরটা জানেন তো ভিষণ হিংসুটে। দুটো হৃদয়েই থাকতো তার রাজত্ব। আপনি তখনো কষ্ট পেতেন। এখনো পাচ্ছেন। এটা আপনার ডেস্টিনি। যা হয়তো আপনিই চেয়ে এনেছেন!’
মানুষের ডেস্টিনি সত্যিই অদ্ভুত। কেউ জানে না তার ভাগ্যে কি আছে। কি হবে বা হতে চলেছে। প্রিয়তাও কি জানত সে তার অতি বরক্তিকর এক পিচ্চিকে এতটা ভালবেসে ফেলবে। কিংবা তার সাথেই ঘর বাঁধবে! কিন্তু সেটাই হয়েছে। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে মানুষের জীবনে। কিছু ঘটনা খুব নাটকিয় ভাবে ঘটে যা নিঃসন্দেহে কোনো অস্কার প্রাপ্ত সিনেমাকে হার মানাবে। ঠিক প্রিয়তার জীবনের গল্পের মতো করে।
এই রেস্টুরেন্টে প্রিয়তা আগেও এসেছে। নিখিলের সাথেই। এখানের কফিটা ভালো। পরিবেশটাও ভিষণ সুন্দর। এমন নিরব পরিবেশ আয়াজের ভিষণ পছন্দ। প্রীয়তা চট করে ভাবল আয়াজকে সাথে নিয়ে এখানে একদিন আসবে। দুজন এই নিরব পরিবেশে কিছুটা সময় পার করবে।
কফি এসেছে। প্রিয়তা তৃপ্তি নিয়ে কফিতে চুমুক বসালো। উদাস গলায় বলল,
‘আপনার বোধহয় একটা বিয়ে করে ফেলা উচিত নিখিল। এভাবে অন্যের বউয়ের পেছনে ছোটা মোটেই শোভনীয় নয়।’
নিখিল প্রিয়তার কথা বুঝলো না। প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো। প্রিয়তার মায়া হলো। মানুষের হৃদয় ভাঙতে ভিষণ রকম দুঃখ দুঃখ অনুভব হয়। তার ও হচ্ছে। প্রিয়তা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিল। কিন্তু বলার সময় এলোমেলো অগুছালো হয়ে গেল।
‘রিসেন্টলি একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’
নিখিল আগ্রহ নিয়ে চাইল। ভ্রুদয়ের মাঝে সামান্য ভাঁজের সৃষ্টি হলো। নিখিলের আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়েই প্রিয়তা ঝটপট বলল,
‘বিয়ের মতো অত্যন্ত চমৎকার কাজটা আমি করে ফেলেছি।’
চলবে……..