#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৬.(অন্তিম)
চাদর গায়ে বাগানের বেঞ্চিতে বসে আছে প্রিয়তা। সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে এসে পড়ছে। হালকা ঠান্ডা বাতাস আর রোদ মিলে সুন্দর একটা অনুভূতি হচ্ছে।
‘ভাবী ক্রিকেট খেলবেন?’
আয়ান ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। খেলার প্রস্তুতি নিয়েই তবে এসেছে। প্রিয়তা ঘুরৈ বসলো। হাসি মুখে বলল,
‘তো দেবর সকাল সকাল ব্যাট হাতে যে! চাচিমা বুঝি ঘুম?’
আয়ান মাথা দুলিয়ে হাসলো।
‘মা ঘুম বলেই আমি এখানে। নয়তো এতক্ষণে স্কুলের দ্বিতীয় তলির কর্ণারের রুমটার শেষ বেঞ্চে নাক টেনে ঘুমাতে হতো।’
কথা শেষে আবারো হাসলো আয়ান। প্রিয়তা আকাশ সমান বিষ্ময় নিয়ে বলল,
‘সে কি কথা! স্কুল বুঝি ঘুমানোর জায়গা?’
আয়ানের মুখ ভাব পরিবর্তন হলো না। ব্যাট দিয়ে ছয় মারার মতো অঙ্গভঙ্গি করে বলল,
‘সবার জন্য ওটা পড়াশোনার জায়গা হলেও আমার জন্য একান্তই ঘুমানোর জায়গা। ওখানে তো আর মা নেই যে আমাকে ঘুমাতে দেখলেই ধমকে উঠবে।’
বলেই হেসে ফেলল আয়ান। প্রিয়তাও ফিক করে হাসলো। ছেলেটা ভিষণ চঞ্চল। ওর চঞ্চলতা ট্রেনের গতিকেও হার মানাবে। মনের দিক থেকেও ভিষণ ভালো। কত সহজেই প্রিয়তাকে আপন করে নিয়েছে। কোনো কথা শেয়ার করতে দ্বিধা নেই যেন। প্রিয়তা এ বাড়িতে এসেছে এক মাস হয়েছে। তরিকুল সাহেব নিজে গিয়ে তার হাত ধরে অনুরোধ করেছিল ফিরে আসার জন্য। সে আর না করে কিভাবে? বাবার মতো মানুষটার চোখের পানি তার হৃদয়কে শিথিল করে দিয়েছিল। তার পরদিনই সব কিছু নিয়ে ফিরে এসেছিল এ বাড়িতে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকেই প্রিয়তার ভিষণ রকম পছন্দ হয়।
___________
প্রিয়তার আজকাল সময় কাটতে চায়না। জবটা ছেড়ে দিয়েছে সে। ওদিকে নজর দিতে গেলে সংসারের প্রতি উদাসীনতা চলে আসে। প্রিয়তা তা চায় না। সে তার মন প্রাণ উজাড় করে দিতে চায় সংসারে। রোজ সকালে আয়াজের জন্য টিফিন রেডি করে দেওয়া তার খুব পছন্দের কাজের মধ্যে একটি।
‘প্রিয় আমার খাবার রেডি? লেইট হচ্ছে তো!’
আয়াজ হাতের ঘড়ি ঠিক করতে করতে রান্নাঘরের সামনে এসে দাড়িয়েছে। প্রিয়তা ঝটপট আয়াজের জন্য টিফিন বাটিতে তুলে দিচ্ছে। শাকিলা বেগম প্লেটে পরাটা আর ভাজি নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
‘নাস্তা না করে কোথায় যাচ্ছ?’
‘নাস্তার সময় নেই মা। বাবা বকবেন লেইট হলে।’
‘আমি তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। নাও হা করো আমি খাইয়ে দিচ্ছি। সময় লাগবে না বেশি।’
আয়াজ হা করলো। শাকিলা বেগম যত্ন নিয়ে ছেলের গালে খাবার তুলে দিতে লাগল। প্রিয়তা তা দেখে মুচকি হাসলো। মায়ের যত্ন বুঝি এমন মধুর হয়!
‘কাকিমা তুমি তোমার অতবড় ছেলেকে এখনো গালে তুলে খাইয়ে দিচ্ছ। আর আমি ছোট হওয়া সত্ত্বেও মা আমাকে মাছের কাটা বেছে দিতে চায়না।’
ভিষণ উদাস হাওয়ার ভান করল আয়ান। ছেলেটা মাছের কাটা ভয় পায়। অদ্ভুত হলেও সত্যি। মাছের কাটা বাছার ভয়ে সে মাছ খেতে নারাজ। ছোট চাচি ওর ভয় দূর করতেই কাটা বেছে দিতে চায়না। দুনিয়াতে এত অদ্ভুত অদ্ভুত ভয়ঙ্কর জিনিস থাকতে মাছের কাটাকেই কেন ভয় পেতে হবে?
এর মাঝেই প্রিয়তা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিল। আয়াজের খাওয়া শেষ হতে এক প্রকার দৌড়ে বের হয়ে গেল সে।
‘দেবরকে উদাস কেন লাগছে?’
‘ভাবছি জেলেনি বিয়ে করবো। যে মাছ ধরতে পারে সে নিশ্চই মাছ বাছতেও পারবে কি বলেন ভাবী?’
প্রিয়তা বিজ্ঞদের মত মাথা নাড়াল। সম্মতি জানিয়ে বলল,
‘সে তো অবশ্যই।’
‘তাহলে আমার বিয়ের একটা ব্যবস্থা করে ফেলেন ভাবী। অনেকদিন হলো সরষে ইলিশ খাইনা।’
আয়ানের কন্ঠে উচ্ছাস। শাকিলা ধমক দিলেন।
‘খাবার টেবিলে এত কথা কেন আয়ান? তোমার মা কোথায়? এখনো ওঠেনি?’
এর মাঝেই তিনি নেমে এলেন। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
‘রাতে ঘুম হয়নি ভাবী। মাজাটা যা ব্যাথা। সকালের দিকে একটু চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। এই একটু দেরি হলো।’
মায়ের কথায় আয়ান ফোড়ন কাটলো।
‘হ্যাঁ মা এজন্যই রাত এগারোটার পর তোমার রুমের পাশ থেকে কেউ হাঁটতে পারেনা। গরিলার নাক ডাকার মতো অদ্ভূত সব শব্দ ভেসে আসে।’
আয়াজের কথায় প্রিয়তা মজা পেল। ঠোঁট টিপে হাসলো। শাকিলা বেগম না হাসলেও তার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে তিনিও হাসি চাপিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ছোট চাচি তেতে উঠলেন।
‘তুমি বেশি বকবক করছো আজকাল আয়ান। এমন হলে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিব।’
অবস্থা বেগতিক দেখে শাকিলা বেগম কথার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। এভাবেই তিনি আয়ানকে বাঘের কবল থেকে বাঁচিয়ে নিলেন।
____________
চোখের পলকে সময়গুলো কিভাবে যেন পার হয়ে যেতে লাগলো। দিন থেকে মাস মাস গড়িয়ে বছর হতে চলল। প্রিয়তাকে যেন আয়াজ সুখের চাদরে আগলে রেখেছে। কোন দুঃখ যেন তাকে ছুঁতেই পায় না। এত এত সুখের মাঝে হঠাৎ করেই একটা খারাপ সংবাদ এসে প্রিয়তাকে মুচরে দিল। ধুপ করেই যেন ভেঙে গেল তার পাশের সুখের দেয়াল। তার মামা মারা গিয়েছে। এমন একটা সংবাদের জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এতটা বছর ধরে যে মানুষটা বটগাছের মতো ছায়া হয়ে ছিল তার মাথার উপর সেই মানুষটার মৃত্যু সংবাদ শোনার মতো ভয়ংকর আর কি বা হতে পারে। প্রিয়তার দুনিয়াটা যেন সেখানেই থমকে গিয়েছিল। তার গগণবিদারী আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লো বাড়ির আনাচে কানাচেতে। কেঁপে উঠলো যেন গহিনে থাকা ক্ষুদে প্রাণগুলোও। তার কান্না আর আহাজারি সহ্য করতে না পেরে শাকিলা বেগম সমেত আয়াজ প্রিয়তাকে নিয়ে প্রিয়তার মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। পুরো পথটাই প্রিয়তা কেঁদে কেঁদে চললো। কোনো রকম শান্তনা বাণি পারেনি তার এ কান্নাকে থামাতে।
বাড়ি ভর্তি লোক। তবে বাড়িতে কোনো আমেজ নেই। নেই কোনো আনন্দ। সকলে নিরব থেকে তাদের দুঃখ প্রকাশ করছে। ভীর ঠেলে প্রিয়তাকে নিয়ে এগিয়ে গেল আয়াজ। এতটুকু পথ আসতে আসতেই মেয়েটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে। সুজলা এলোচুলে বিদ্ধস্ত হয়ে বসার রুমে বসে আছে। তাকে ঘিরে ধরে আছে আর ছয় কি সাতজন মহিলা। পাশেই তুলি পানির জগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা কেমন পাথরের মতো হয়ে গেছে। এত ভীরে কেউ হয়তো মেয়েটার দিকে নজর দিতেই সময় পায়নি। রত্নাকে কোথাও দেখা গেল না। প্রিয়তাকে দেখা মাত্রই সুজলা চিৎকার করে উঠলো।
‘এই বান্দির ঝি! তুই কেন আসছিস? বের হ আমার বাড়ি থেকে। এই মুহূর্তে বের হ।’
সুজলা এমন দিনেও এই আচরণ করবে এমনটা বুঝতে পারেনি আয়াজ। শাকিলা বেগম তব্দা খেয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি এসবের কিছুই বুঝতে পারছেন না। এর মাঝে প্রিয়তা কেঁদে উঠলো। সুজলার পা জড়িয়ে ধরে মেঝেতে বসে পড়লো।
‘মামি এভাবে বলো না। আমি থাকতে আসিনি মামি। মামাকে একবার দেখেই চলে যাব। আমি আর কখনো আসব না বিশ্বাস কর।’
প্রিয়তার এই আহাজারিতে পাথর নরম হলেও সুজলা নরম হলো না। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা কখনো সুধরায় না। কোনো পরিস্থিতি পারে না তাদের জঘন্য রূপ থেকে তাদের বের করে আনতে। সুজলাও তাদের মধ্যে একজন। আয়াজ এমন জঘন্য মহিলার সাথে তর্কে যেতে চায়না। তাই এক প্রকার জোর করেই প্রিয়তাকে সাথে নিয়ে বের হয়ে আসে। পৃথিবীতে যদি খারাপ মানুষের কাউন্টিং করা হয় তবে এই মহিলাই হবে প্রথম। এমনটাই ধারণা আয়াজের।
ফিরে আসার পর গুমট হয়ে পড়েছিল প্রিয়তা। আয়াজ শত চেষ্টা করেও প্রিয়তার সাথে কথা বলতে পারেনি। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিল। থকনা কিছুটা সময় নিজের মতো!
মন খারাপের স্থায়িত্ব হলো সপ্তাহ খানেক। আজ সপ্তাহ খানেক বাদে প্রিয়তা রান্নাঘরে এসেছে শাকিলা বেগমের সাথে রান্না করতে। বউমার এ কাজে শাকিলা ভিষণ খুশি হলো। এ কয়দিন মেয়েটা রুম বন্ধ করে ছিল তাতে যেন বাড়িটাও আঁধারে তলিয়ে ছিল।
‘মা বাবা আজ বাসায় আছেন?’
‘হ্যা। আজ অফিসে যাবেন না শুনলাম।’
প্রিয়তা সুন্দর করে এক কাপ লাল চা বানালো। তার হাতের চা তরিকুল সাহেবের পছন্দ। এ সময় তিনি বাড়িতে থাকলে স্টাডি রুমেই থাকেন। তাই প্রিয়তা সেদিকেই পা বাড়ালো।
‘বাবা আসবো?’
তরিকুল সাহেব বই থেকে চোখ সরিয়ে তাকালেন। প্রিয়তাকে দেখা মাত্র তার মুখে হাসি ফুটলো। হেসে বলল,
‘মা যে! আসো আসো। কতদিন বাদে মুখখানা দেখলাম।’
প্রিয়তা মুচকি হাসলো। চা এগিয়ে দিতেই তিনি চায়ের কাপ নিয়ে তৃপ্তি নিয়ে চুমুক বসালেন। উৎসাহ নিয়ে বললেন,
‘জানো মা তোমার হাতের চায়ের স্বাদ একদম আমার আম্মার বানানো চায়ের মতো। আলাদা একটা তৃপ্তি আছে।’
প্রিয়তা এ কথা জানে। যতবার প্রিয়তা তাকে চা দেয় প্রত্যেকবার তরিকুল সাহেব অতি আগ্রহ নিয়ে তাকে এই একই কথা শোনায়। প্রিয়তার এতে বিরক্ত লাগে না। বিষয়টা তার খুব অদ্ভুত ভাবে ভালো লাগে।
_____________
সকাল সকাল প্রিয়তার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে এলো। মাথাটা ধরে গেছে। উঠে বসে গরম চোখে আয়াজের দিকে তাকালো।
‘কতবার না করেছি এত সাউন্ড দিয়ে টিভি না দেখতে? আমাকে কি একটু ঘুমাতেও দিবে না?’
আয়াজ করুণ চোখে তাকালো। তার কোলে বসে আছে তিন বছর বয়সী আজরা। যে কর্টুন দেখে খিলখিল করে হাসছে। প্রিয়তা কি বলবে খুঁজে পেল না। এতদিন শুধু আয়াজ ছিল। এখনতো তাকে জালানোল জন্য আরো একজন আছেন। এরা বাপ মেয়ে মিলে তার জীবনটা নিমপাতা করে তুলছে।
‘আপনি আমাদের শত্রু কেন ভাবছেন বউ? আমরা তো একটু কার্টুন দেখছি মাত্র। তাই না মাম্মা?’
মাথা দুলালো আজরা। ছোট ছোট করে বলল,
‘মাম্মা শত্তু।’
আয়াজ ফিক করে হেসে ফেলল। গালে চুমু খেয়ে বলল,
‘চলো আমরা ঘুরে আসি। মাম্মা এখনি নয়তো পিটুনি দিবে।’
যাওয়ার পূর্বে আয়াজ প্রিয়তার উদ্দেশ্য একটা কিস ছুড়ে দিল। যা দেখা মাত্র প্রিয়তা চোখ গরম করে তাকালো। কিন্তু ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে মেয়ে সহ আয়াজ বের হয়ে গেল। প্রিয়তা সেদিকে তাকিয়ে হাসলো। এখন আর তার ঘুম হবে না।
আজরা দেখতে অনেকটা আয়াজের মতো হয়েছে। একদম বাপকা বেটি। স্বভাব ও বাপের মতো। বদ মেজাজি একরুখে ধরণের। এই ছোট বয়সেই মেয়ের এত জেদ বড় হলে যে কি হবে! মায়ের থেকে বাপের সাথেই তার ভাব বেশি। প্রিয়তার মাঝেমধ্যে মনে হয় সে ভুল করে এই দুজনের দুনিয়ায় চলে এসেছে। কিন্তু মেয়েটা তার ভিষণ মিষ্টি। সাথে মেয়ের বাপটাও। দুজনকে দেখলে কেবল দেখতেই মন চায়। এত আদুরে কেন তার প্রিয় মানুষগুলো!
সমাপ্ত