অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয় #লাবিবা_আল_তাসফি ৬.

0
212

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

৬.

বাসের জানালা থেকে বাইরে তাকিয়ে ব্যস্ত শহর আর একের পর এক ফেলে যাওয়া বিশাল দালান দেখছিলো খুব মনোযোগ দিয়ে প্রিয়তা। এই জিনিসটা তার খুব ভালো লাগে। মনে হয় একেরপর এক বিল্ডিং পেছনের দিকে ছুটছে। তখনি পাশ থেকে কাতর স্বরের আওয়াজ এলো,

‘আপনি আমার খোঁজ নিলেন না কেন প্রিয়? আমি ভিষণ অসুস্থ। একবার ছুঁয়ে দেখুন।’

কথাটা বলে নিজের কপাল এগিয়ে আনলো আয়াজ। প্রিয়তা হকচকালো। চকিত দৃষ্টিতে আয়াজের পানে চাইল। আয়াজ কখন বাসে উঠে তার পাশের সিট দখল করে বসেছে তা তার খেয়ালে নেই। আয়াজের মুখটা ভিষণ শুকনো লাগছে। চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। চুলগুলো অযত্নে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। সুন্দর ওষ্ঠজোড়া নিলচে বর্ণ ধারণ করেছে। প্রিয়তা ব্যস্ত হাতে আয়াজের কপাল ছুঁয়ে দিলো। শরীরের তাপ অনেক বেশি। প্রিয়তা প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘অসুস্থতা নিয়ে এখানে কি করছ? বাসায় ফিরে যাও।’

‘আপনাকে দেখতে এসেছি।’

আয়াজের উত্তরে প্রিয়তা মুখ গম্ভীর করে নিল। শাসনের স্বরে বলল,

‘তোমার পাগলামি মাত্রা অতিক্রম করছে আয়াজ।’

এ প্রসঙ্গ আয়াজের ভালো লাগলো না। সে নিভু গলায় বলল,

‘এভাবে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। আপনার কাঁধে একটু মাথা রাখি?’

প্রিয়তা সাথে সাথে উত্তর দিলো,

‘একদম না।’

প্রিয়তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়াজ তার মাথা এলিয়ে দিল প্রিয়তার কাঁধে। প্রিয়তা মানা করলো না আর। থম মেরে বসে রইল। আয়াজ মুচকি হাসলো। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। শুধাল,

‘আপনার চোখে কি আমার সুদর্শন রূপ স্কান করতে পারে না? আপনি কখনো মুগ্ধতা নিয়ে আমায় দেখেন না কেন প্রিয়? অফিসের প্রত্যেকটা মেয়ে আমার দিকে কেমন করে তাকায়। এই দেখুন সামনের সিটে বসা মেয়ে দুটোও বারবার মাথা ঘুরিয়ে আমায় দেখছে। আপনার খারাপ লাগছে না?’

আয়াজের কথা অনুসারণ করে সামনে তাকাতে দেখল সত্যিই দুটো মেয়ে বারবার আয়াজের দিকে তাকাচ্ছে। মুচকি মুচকি হাসছে। প্রিয়তার গায়ে যেন আগুন ধরে উঠলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল,

‘এই মুহূর্তে তুমি বাস থেকে নেমে যাবে। নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।’

আয়াজ মাথা উঁচু করে প্রিয়তার দিকে চাইল। প্রিয়তার লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগায় আঙ্গুল ছুঁয়ে বলল,

‘কিন্তু আমি আরো কিছু সময় আপনার সাথে থাকতে চাই।’

প্রিয়তা রেগে যেয়ে কিছু বলতে নিতেই ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে তার কথা বন্ধ করে দিল আয়াজ। মুচকি হেসে বলল,

‘আপনি ভিষণ হিংসুটে প্রিয়। তারা আমায় আপনার থেকে নিতে পারবে না। কেবল দূর থেকে দেখতে পাবে। এতটুকুও আপনি মেনে নিচ্ছেন না। ভেরি ব্যাড!’

অকপটে বলা এমন সত্যকথা হজম করা কঠিন হলো প্রিয়তার কাছে। যতনে লুকিয়ে রাখা সত্য এভাবে প্রকাশ পাক তা সে কখনোই চায়নি। মুখ জানালার দিকে ঘুরিয়ে চুপ করে বসে রইল সে। আয়াজ হাসলো। নিঃশব্দ সেই হাসিতে শরীর দুলে উঠলো। প্রিয়তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? আপনাকে ভীষণ আদুরে লাগছে। একটু ছুঁয়ে দেই?’

আয়াজের লাগামহীন কথায় শীরায় শীরায় রক্ত জমে গেল যেন। জোর গলায় বাস থামাতে বলতেই বাস থেমে গেলো। কোনো কথা ছাড়াই বাস থেকে নেমে গেল প্রিয়তা। আয়াজ বাঁধা দিল না। সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখল। শরীরের তাপ বাড়ছে। সে কি মরে যাচ্ছে? আগামী কালের গরম সংবাদ হবে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে শহীদ হয়েছেন একুশ বছর বয়সের এক তাগড়া জুবক। কথাটা ভাবতেই হাসি পেলো। এমনটা হলে খারাপ হয়না। সে মারা গেলে প্রিয়তা ভিষণ দুঃখ পাবে সে জানে। তার জন্য প্রিয়তাকে কাঁদতে দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগবে। এসব ভাবতে ভাবতে বাসের সিটেই ঘুমিয়ে পড়লো আয়াজ।

____________

সূর্যের আলোতে উজ্জল এক ঝকঝকে সকাল। বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো প্রিয়তার। মামা বাড়িতে থাকলে তাকে রান্নাঘরে খুব একটা যেতে হয়না। কাজের মেয়ে আর মামি দুজন মিলেই সামলে নেয় সবটা। ঘড়িতে বেলা দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। আজ শুক্রবার তার ছুটির দিন। প্রিয়তা সময় নিয়ে বেড থেকে উঠল। বালিশের তলা থেকে ফোন বের করতেই দেখলো বাইশটা মিসডকল। ফোন সাইলেন্ট থাকায় সে টের পায়নি। প্রিয়তা ফোন হাতে অপেক্ষা করলো। ওপারের ব্যক্তি আবারো তাকে কল করবে। মিনিটের মাথায় পরিবেশ কাঁপিয়ো ফোন ভাইভ্রেট হলো। প্রিয়তা অলস ভঙ্গিতে ফোন কানে ধরলো।

‘মরার মতো ঘুমাও তুমি প্রিয়তা? আমি শিওর মৃত ব্যক্তিও এতবার কল করলে বিরক্ত হয়ে জেগে উঠবে কল রিসিভ করতে।’

‘এটাই মৃত আর জীবিত ব্যক্তির মধ্যে তফাৎ।’

‘আচ্ছা সে কথা থাকলো। বিগত দশ মিনিট জাবত আমি তোমাকে টুয়েন্টি প্লাস কল দিয়েছি। আমার জীবন থেকে অমথা টেন মিনিট মাইনাস হলো যার ঋণ পরিশোধ হওয়ার নয়। আজ আমাদের ক্যাম্পাসে দেখা করার কথা মনে আছে তো? ভুলে গেলেও প্রবলেম নেই আমি মাত্রই মনে করিয়ে দিয়েছি। আর হ্যাঁ মনে করে প্লিজ আমার ফোনো সাতটাকা পঁচিশ পয়সা লোড করে দিও। এই টাকাটা তোমার জন্য অযথা নষ্ট হলো। আমি অপচয় একদম পছন্দ করিনা ইউ নো! টাটা।’

টুট টুট করে ফোন কেটে গেল। এতকিছুর মাঝে প্রিয়তা একটা কথা বলার সুযোগ মাত্র পেল না। এই মাত্র যে ফোনে কথা বলল এটা টিয়া। টিয়ার মতোই প্রচুর কথা বলে মেয়েটা। ভিষণ পড়ুয়া স্বভাবের মেয়ে হলেও রিটেক না দিয়ে কোনো সেমিস্টার পাশ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এবং কৃপনতায় সেরা। ক্যান্টিনের মামার কাছে দু টাকা বাকি ছিল। তিনদিন ঘুরে দু টাকা আদায় করেছিল। তা নিয়ে বন্ধুমহলে হাসাহাসি হলে সে মুখ গোমড়া করে বলেছিল,

‘এই দু টাকার সাথে আর দুটাকা যোগ করলে একটা সমুচা হয়ে যাবে। তাহলে অযথা টাকাটা অন্যকে কেন দেব? মামাকে দু টাকা দিলেকি সে বাকি দুটাকা মাফ করে একটা সমুচা দিবে?’

প্রিয়তা ফোন রেখে সময় নিয়ে তৈরি হলো। আকাশি রঙের কুর্তির সাদে সাদা প্যান্ট সাদা ওড়না। পুরো একটা আকাশ যেন নিজের শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে সে। রুম থেকে বের হতেই সুজলা মুখ বাঁকিয়ে বললো,

‘এত রঙঢঙ করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আজ যে ছুটির দিন দুটো কাজ করলেও তো হয়। তা নয় মহারাণী গায়ে হাওয়া লাগাতে বের হচ্ছেন। আমার হয়েছে যত জালা।’

রত্না সবজি কাটতে কাটতে বলল,

‘কি কইলেন খালা? আপাই তো সব কাজকাম করে। খালু আসলেই সে একটু ছুটি পায়। আপনে হুদাই আপাকে দূষমন সাজান কেন?’

সুজলা গরম চোখে তাকাল। ধমক দিয়ে বলল,

‘ছোট মুখে বড় কথা বলবি না। নিজের কাজ কর। আসছে সাফাই গাইতে।’

প্রিয়তা মুচকি হেসে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে এলো। আজকের পরিবেশ ভিষণ সুন্দর। একদম তার মনের মতো। কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখলো মোরে চায়ের দোকানে বসে দু ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট গুঁজে আয়েশ করে ফুক দিচ্ছে আয়াজ। সুন্দর মুডটা মুহূর্তেই বিরাস হয়ে গেলো। চোখ কুঁচকে তাকালো আয়াজের পানে। আয়াজের সিগারেট খাওয়ার স্টাইলটা ভালো লাগলো প্রিয়তার। মানুষ বুঝি সিগারেটেও এত সুন্দর করে টান দিতে পারে?
আয়াজের নজর প্রিয়তার দিকে পরতেই সে দ্রুত হাতে সিগারেট ফেলে দিয়ে দাঁড়াল। প্রিয়তার দিকে এগিয়ে আসতেই প্রিয়তা প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘তুমি নেশা কর?’

‘যাস্ট মাঝেসাঝে সিগারেট। এটাকে নেশা বলে না।’

প্রিয়তা নাক কুচু করলো। আয়াজের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলল,

‘দু হাত দূরে সরে দাঁড়াও। ভিষণ বাজে গন্ধ। এসব ছাইপাশ খেয়ে আমার ত্রিসিমানায় আসার চেষ্টা করবে না।’

আয়াজ সরল না। বরং আরো একপা এগিয়ে দাঁড়াল।প্রিয়তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘আপনি একবার আমার হয়ে যান। এসব ছাইপাশ ছেড়ে দিব ফর সিওর। কেবল এবং কেবল আপনাতে মত্ত হব।’

প্রিয়তা বড় চোখ করে তাকাল। কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। নিজেকে শান্ত রেখে শক্ত কন্ঠ বলল,

‘তুমি দিনদিন বেশরম হচ্ছ আয়াজ।’

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here