#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৪
“আপনার উচিত ছিল, ছেলেকে পেয়ে উপস্থিত সবার মাঝে ঠাস ঠাস করে চ/ড় বসিয়ে দেওয়া। আপনি উলটো ছেলের নামে সাফাই গাইছেন। আমাদের বাড়ির মেয়েকে আপনার ছেলের বউ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।” চোখ রাঙিয়ে কথাটা বলে অনিতা। সুন্দরী চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী বলে দ্বিরুক্তি করার সাহস সে খুঁজে পেল না। তবুও ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বাক্য করে, “আমার স্বামী আজ নয় বছর হয়েছে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কালাচাঁন ব্যতিত আমার কোনো সন্তান নেই। একমাত্র ছেলেকে হারালে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। তাই লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ছেলের নামে সাফাই গাইছি। (বিরতি দিয়ে) আমার ছেলে আরুকে অনেক ভালোবাসে। আপনাদের আরুকে আমার ছেলের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিবো।”
সুন্দরীর কথায় আরুর মনে ভয়ের সৃষ্টি হলো। বসা থেকে উঠে ঘরের ভেতরে পা ফেলার চেষ্টা করতে থাকল। তবে তার প্রয়াসকে হাতে ঠেলে অপূর্ব ধরে ফেলল আরুর উষ্ণ হাত। চোখে চোখ স্থায়ী করে সৌজন্য হাসির রেখা ফুটিয়ে আরুর অস্থির দূর করল। মুখে প্রকাশ করে, “একপা এখান থেকে যাবি না আরু। কালাচাঁন তোকে ডিজার্ভ করেনা। বিয়ে তো দূরের ব্যাপার। ওর মুখের দিকে তাকালে তুই ভয় পাস? ও কে? কেন ওকে তোর ভয় পেতে হবে?”
“শুনলেন না, তিনি কী বলল? আমাকে তার ছেলের বউ করে নিয়ে যাবে।” আরু জড়তা নিয়ে বলে। পারুল আগ বাড়িয়ে বলে, “ভাইজান, আপনি কিছুতেই এই কালাচাঁনের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করবেন না। যে ছেলের মায়ের কোল খালি করে সন্তানকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মা/র)তে চায়। সে ছেলের হাতে আমি আমার মেয়েকে তুলে দিবো না। (থেমে) ও একটা উন্মাদ। বিয়ে পর আমার মেয়ের সাথে ঝগড়া বাঁধলে যদি আরু কথা বলা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আরুর গলা কা/ট/তেও ওর সেকেন্ড খানেক সময় লাগবে না।”
বলেই আঁচলে মুখ আড়াল করে কেঁদে উঠে। মোতাহার আহসান দিশেহারা হয়ে উঠল বোনের কান্নায়। বিরাগী হয়ে বলে, “আমি কি একবারও বলেছি ওর সাথে আরুর বিয়ে দিবো? বিয়েতে দুটো মনের পাশাপাশি দুটো পরিবারের মিলের প্রয়োজন। কালাচাঁনের সাথে আরুর মনের কোনো মিল নেই। তাছাড়া একপক্ষিক ভালোবাসা মেনে বখাটে কালাচাঁনের সাথে বিয়ে দেওয়া হলে, বখাটেরা এখন থেকে এই বুদ্ধি অবলম্বন করে গ্ৰামের রূপবতী মেয়েদের বিয়ে করবে।”
সন্তুষ্ট প্রকাশ করে সবাই। মোতাহার আহসানের কথায় সায় দিয়ে তার প্রহরীরা এগিয়ে গেল কালাচাঁনের কাছে। পাঁচটা বেত একত্রিত করে বাধা রাবার দিয়ে। তারপরে প্রহরীরা শুরু করে নির্যাতন। তিনজন প্রহরী একশো একটা আঘাতের পর থামল। কালাচাঁন যাতনায় শব্দ করে কেঁদে চলেছে। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “গোলাপী, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসা কোনো অন্যায় নয় যে, এভাবে আমাকে শাস্তি পেতে হবে। আমি সবার সামনে বাজি ধরে বলতে পারি, আমার চেয়ে তোমাকে এত ভালো কেউ বাসতে পারবে না।”
“ভালোবাসা মানে ভালো থাকার একটা সন্ধান। যার সাথে আজীবন সুখে থাকা যায়। কিন্তু আপনি যেটা করেছেন, সেটা আজীবন ওকে দুঃখে রাখার ব্যবস্থা। অকালে ওর জীবনটা হারিয়ে ফেলা।” ভাঙা গলায় অপূর্ব বলে। ডাহুক পাখিরা তখন এসে উঠানে ডেকে চলেছে ঝাঁক বেঁধে। প্রাহরীরা তার কাজে ব্যস্ত। ছেঁড়া জুতা একত্রিত করে মালা তৈরি করছে। তাদের কাজ সমাপ্ত হতেই কালাচাঁনের গলায় পরিয়ে দিল। গাছ থেকে দড়ি খুলে যখন সেখান থেকে কালাচাঁনকে গ্ৰাম থেকে বের করে দেওয়ার প্রয়াস করে তখন সেখানে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হয় শেফালী। অসুস্থ ও ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “আপনারা কেন ওনাকে গ্ৰাম থেকে বের করে দিচ্ছেন? ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছু করেছে, কালাচাঁন শুধু তার ভালোবাসা প্রমাণ করতে চেয়েছে।”
শেফালীর কথাকে উটকো ঝামেলা বলে উড়িয়ে দিল অনেকে। মণি মেয়ের হাত ধরে নত অথচ ঝাঁজালো গলায় বলে, “এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দিবো। যে মেয়েটার জন্য তুই আজ আমাদের মাঝে বেঁচে আছিস। সেই মেয়েটা তোর জন্য বিপদে পড়েছে। একটা ছেলে ওকে মারতে চেয়েছিল আর তুই তার হয়ে সাফাই গাইছিস? ঘরে যা।”
“ওকে অনেক শাস্তি দেওয়া হয়েছে মা। ওকে দয়া করে গ্ৰাম ছাড়া করতে বারণ করো।”
“কালাচাঁন আরুকে গলায় কলস বেঁধে মারতে চেয়েছিল। বড়মিয়া যে কালাচাঁনকে চুবিয়ে মারার নির্দেশ দেয়নি, এটা কম নয়?” মণির জোরাজুরিতে শেফালী বাধা দেয়। মণির হাত ছাড়িয়ে আরুর কাছে ছুটে যায়। আরুর দুহাত ধরে মিনতি করে বলে, “আরু, তুই অন্তত ওর মনের কষ্টটা বোঝার চেষ্টা কর। তুই তো একজনকে ভালোবাসিস। তাকে না পেলে তোর মনের অবস্থা কেমন হবে? (উদাসীন হয়ে) আমাকে দেখ, তুই জানিস আমি কেন বি/ষ খেয়েছিলাম। ভালোবাসার উর্ধ্বে কিছু নয়।”
আরুর চোখের তারায় ভেসে উঠল কালাচাঁনের সাথে কাটানো সময়গুলো। কোনো এক অদৃশ্য টানে সে সায় দিল শেফালীর সাথে। দৃঢ় এক মনোবল নিয়ে মোতাহার আহসানের কাছে মিনতি করে, “মামা, ওনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আপনি ওনাকে ছেড়ে দিন।”
আরু কালাচাঁনের দিকে তাকালে তার গভীর দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে পারেনা। জ্বরের মাত্রা হু হু করে বেড়ে আরু ঢলে পড়ে ঘটনাস্থলে। আরুকে আগলে নিয়ে অপূর্ব বলে, “বাবা, আপনি যা ভালো বুঝেন, তাই করুন।”
অতঃপর আরুকে পাঁজাকোলা করে অপূর্ব ঘরে চলে গেল। আরুর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে মোতাহার আহসান বিচার কার্য সমাপ্ত করে উঠে দাঁড়ালেন।
__
ভিড় ধীরে ধীরে ছেড়ে যাচ্ছে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে। পারুল ভিড় ঠেলে ঘরে যেতে পারছে না। হঠাৎ সে শুনতে পেল এক মধ্যবয়স্ক লোক বলছে, “মেয়েটাকে ছেলেটা নিয়ে একদিন বন্দিনি করেছে। একদিন কম সময় নয়। মেয়ে আর কুমারী নেই। এই বয়সে এই জোর সহ্য করতে পারেনি। তাই ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ঘনঘন।”
“আমার কিন্তু অন্য কিছু মনে হচ্ছে ভাইজান। আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটা পোয়াতি হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব এখন কার কাছে বিয়ে দিবে মেয়েটাকে?” আরেকজন বলে। তার প্রশ্নের জবাবে পূর্বের লোক বলে, “অনেকে আছে। চেয়ারম্যান সাহেব লুকিয়ে অনেক জমিজমা দিয়ে ভাগ্নিকে বিয়ে দিবে। লোভে সবাই মেয়েকে বিয়ে করবে। তবে যা হলো খারাপ হলো।”
“এজন্য বেশি সুন্দর হতে নেই। ছেলেদের নজর লাগে। আগে তো তানাদের নজর লেগেছিল। ভালো কথা ভাইজান, মেয়েটা না-কি অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেকক্ষণ পানিতে ছিল। বেঁচে আছে কীভাবে?”
“তানাদের জন্য। তারা পানির অনেক গভীরে যেয়ে ফিরে আসতে পারে। তবে আরও দেরি হলে বাঁচানো যেত না। চলো সবাই। ক্ষেতে যেতে হবে।” বলেই সবাই চলে গেল। গ্ৰামবাসীদের কথায় পারুল নিজেও সন্দিহান হলো। দৌড়ে চলে গেল ঘরে। চেতনাহীন আরুকে তখন বৈঠকখানার চৌকিতে রেখেছে। মেয়ের রুগ্ণ মুখের পানে চেয়ে অনিতাকে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “ভাবী, আমার মেয়েটার সাথে কালাচাঁন কী করেছে? আমার মেয়েটার আর বিয়ে হবেনা।”
“থাম! আরুর এই বিপদে কী বলছিস তুই? মেয়েটা বেঁচে আছে, এটা কী কম? এইসব চিন্তা তোর মাথায় কে ঢুকিয়েছে?” সান্ত্বনা দিয়ে বলে অনিতা। পারুল দ্বিরুক্তি করে বলে, “আমি যেটা বলছি, সেটা সত্যি ভাবী? গ্ৰামবাসীরা বলাবলি করছিল। আমার মেয়ের বিয়ে হবেনা।”
“তোর মেয়ের বিয়ে না-হলে আমাকে দিস। আমি আরুকে আমার ছেলের জন্য নিয়ে আসব। একটু সুস্থ হতেই আরুকে আমি নিয়ে আসব।” অনিতা বলে আরু ও অপূর্বর দিকে তাকাল। অপূর্ব আরুর মাথায় জ্বর পট্টি দিচ্ছে। দুজনকে দেখে তার কাছে রাজযোটক ঠেকছে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
দাদিকে হারিয়ে পরিবারে শোকের ছায়া বিরাজমান। এই পরিস্থিতিতে গল্প দেওয়া সম্ভব নয়। তবুও গ্ৰামে এই পরিবেশে এইটুকু লিখলাম। ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করবেন।
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/