নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৩২

0
198

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩২

“তোমরা এই পূর্ণিমাতে নদীতে কী করছ? পূর্ণিমার আলোয় সবকিছু উজ্জ্বল দেখা গেলেও খরস্রোতা ঢেউ তোমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পানির ধারা বৃদ্ধি পাওয়ার আগে এখান থেকে চলে যাও তোমরা।” নৌকা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় এক মাঝি সাবধান করে দেয় অপূর্বদের। বৈঠা নিয়ে ঠেলে সামনে যাওয়ার প্রয়াস করতেই অপূর্ব একটা জ্বলন্ত আলোর পথের সন্ধান পেল। দাঁড়িয়ে অপূর্ব বলে, আমি অপূর্ব। আপনাদের চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে। আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করুন।”

“আপনি চেয়ারম্যান ভাইয়ের ছেলে? আগে বলবেন তো বাবা। তা আমাদের কাছে আপনাদের কী সাহায্য লাগবে? আমরা সব করব।”

“আপনারা একটু নদীতে নেমে আরুকে এনে দিবেন। কিছুক্ষণ আগে ঐ পাড়ার ব/খা/টে ছেলে কালাচাঁন আমাদের বাড়ির মেয়ে নিয়ে জোর করে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। আপনারা একটু দেখুন না?” অপূর্বর ভাঙা গলায় এক মাঝি ও দুই জেলে বিচলিত হয়ে উঠল। একজন জেলে অন্য জেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে, “এখনো বসে আছিস কেন? চেয়ারম্যান বাড়ির মেয়ে। যেভাবে হোক আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে।”

জেলেদের কাছে এক ধরনের টর্চ লাইট থাকে। যা বিদেশ থেকে শুভাকাঙ্ক্ষিদের মাধ্যমে দেশে আনা হয়। যা দিয়ে নদীর অনেক গভীরে যাওয়া যায়। দুটো জেলে লাইট দুটো নিয়ে ঝাঁপ দিল জ্বলে। নিভু নিভু আলোয় তখন জ্বলছে হারিকেন। তুর ছুটে গিয়ে খবর পৌঁছে দিয়েছে ‘সাত ভাই চম্পা’ নিবাসে। সবাই ছুটে এসেছে নদীর পাড়ে। জেলেরা কিছুক্ষণ তল্লাশি করে ভেসে উঠে পানিতে, পায় না আরুর সন্ধান। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “মনে হয় ভেসে গেছে স্রোতে। পানির নিচে কেউ নেই।”

পারুল হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। নদীতে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। মোতাহার আহসান পারুলকে একহাতে আগলে নিয়ে জেলেকে বলে, “তোমাদের পরিচিত কেউ নেই? খবর দিয়ে সবাই একসাথে খুঁজতে থাকো।”

“চেয়ারম্যান সাহেব, এত সময় নেই। আমরা নিজেদের মতো চেষ্টা করছি।” বলেই অনেকটা এগিয়ে আবার ডুব দিল জেলে। এক মুহুর্তের আগেই ভেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, “পেয়েছি। এইখানে আছে‌। তবে মেয়েটার গলায় একটা কলস বাঁধা। আবার একটা ছেলে হাত ধরে আছে শক্ত করে। কতটা পানি খেয়েছ, জানা নেই। আপনারা একটা কাঁচা ডালের ব্যবস্থা করে দিল। কলস ভেঙে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।”

নৌকাতে জীবন বাঁচাতে বড় বড় দা রাখা হয়। দা বের করে এগিয়ে দিতেই অপূর্ব একটা ছোটো গাছের ডাল একবারে কেটে নিয়ে এলো। মাঝিসহ মোট তিনজনে পানির নিচে চলে গেল। আরু চেতনাহীন। ওর বুকের উপরে কলসখানা। আরুর একহাত কালাচাঁন শক্ত করে ধরে আছে। আরু অন্যহাত দিয়ে কালাচাঁনের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে, দেখে বোঝা যাচ্ছে। ডাল দিয়ে কলস চূর্ণ বিচূর্ণ করে তিনজনে দুজনকে আলাদা করে উপরে তুলে দিয়ে এলো। আরুর শাড়িটা বোধহয় জলের বেগে এলোমেলো হয়ে গেছে। গলার সাথে এখনো বাধা কলসের অংশ ও দড়ি। আরুকে উপরে তুলতে বিলম্ব হলেও আরুর উপর ঝাপিয়ে পড়তে কারো বিলম্ব হলো না। আরুকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পারুল বলে, “আরু, কথা বল মা। আমি আর কখনো তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করব না। তুই একবার চোখ মেলে তাকা।”

অপূর্ব তার ভেজা পোশাকটা জড়িয়ে দিল আরুর দেহে। আরুর কোনো শ্বাস পড়ছে না। অপূর্ব পেটের উপর প্রেষ করতে করতে বলে, “তোমরা দাঁড়িয়ে না থেকে আরুর হাত পায়ের তালু ম্যাসাজ করে দাও।”

অপূর্বর অদম্য কাজে আরুর মুখ থেকে গরগর করে পানি পড়তে থাকে। অন্যদিকে জেলেরা তখন কালাচাঁনকে বাঁচাতে ব্যস্ত। মুখের উপর মৃদু চপল দিতে থাকে, কিন্তু এতেও আরুর শ্বাস পড়ে না। অপূর্ব বুঝে গেছে, একটাই উপায় আছে। কেবল সেভাবেই জ্ঞান ফেরানো সম্ভব। অপূর্ব শার্ট নিয়ে নিজেকে যথেষ্ট আড়াল করে নিয়ে ঝুঁকে গেল আরুর মুখের উপর। আশেপাশের সবাই তখন অন্যদিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর অপূর্ব সরে শার্টটা জড়িয়ে দিল আরুর গায়ে। তিন সেকেন্ড পর আরু ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস গ্ৰহণ করে। মাটি থেকে পিঠটা একটু উপরে উঠে গেল। সবাই তখন আরুকে ঘিরে ধরল। অপূর্ব বারণ করে, “একটু ফাঁক করে দাঁড়াও। অক্সিজেন নিতে দাও।”

আরু শ্বাস নিলেও জ্ঞান ফিরল না। ওর শরীরে যে ধুম জ্বর ও মাথা ভার ছিল। এভাবে দীর্ঘক্ষন ফেলে রাখলে আরুর অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে। অপূর্ব অতি যত্নে আরুর গলা থেকে ভাঙা কলসের অংশসহ দড়ি খুলে ফেলল। অতঃপর অপূর্ব আরুকে কোলে তুলে হাঁটার প্রয়াস করে, কিন্তু তার মচকে যাওয়া পা ও অসাড় শরীর নিয়ে হাঁটতে পারছে না। তখন ইমদাদ হোসেন ছুটে আসে। মেয়েকে কোলে নিয়ে নৌকার মাঝিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমাদের একটু ওপার ছেড়ে দাও ভাই। এতটা পথ হেঁটে যাওয়া ঠিক হবে না।”

“তা কি বলতে হয়? কে কে যাবেন, আসুন।” মাঝি বলতেই পারুল এগিয়ে যায়। মোতাহার আহসান দুইহাত পেছনে রেখে বলে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস ওকে? আরু আমার বাড়ি থেকে হারিয়ে গেছে। আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারলেও, ও একটুও সুস্থ নয়।‌ ওকে সুস্থ করে তবেই তোরা বাড়িতে যাবি। তাছাড়া কাল সবাই দেখবে চেয়ারম্যান মোতাহার আহসানের ভাগ্নেকে মা/রার জন্য একে কেমন শা/স্তি দেই? দেখবে‌ নি/ষ্ঠু/র আমিকে। বাড়ির দিকে চল।”

মোতাহার আহসান মুখের উপর কেউ কোনো বাক্য করতে পারে না। এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। অপূর্ব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যায় পেছনে পেছনে। মোতাহার আহসান নৌকার তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। যেভাবে আমার ভাগ্নিকে আমাদের হাতে তুলে দিলেন। বলুন, আপনাদের কী চাই? আমার বোনের কলিজাকে ওর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, প্রয়োজনে আমি আমার কলিজা আপনাদের হাতে তুলে দিবো।”

“আমার মতো দরদি চেয়ারম্যান এই সুন্দরনগরে পেয়ে আমরা ধন্য। আপনার কলিজা আমাদের চাই না। আপনি এভাবেই আমাদের পাশে থাকুন। বিদায় দিন, আজ আমরা আসি।”

“আসুন। (প্রহরীদের উদ্দেশ্য করে) এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন আপনারা? ঐ শু/য়ো/রটাকে নিয়ে গোয়াল ঘরে ফেলে রাখুন। আগামীকাল সকালে পুরো গ্ৰামকে আমার বাড়িতে হাজির থাকতে বলবেন। কালকে ওর শা/স্তি হবে।” বলেই মোতাহার আহসান বাড়ির দিকে গেল। পেছনে পেছনে গেল তার তিন ভাই ও বাবা।
_
আরুর চেতনা ফিরেনি। আরুর অসুস্থ শরীর নিয়ে কয়েক মুহূর্ত পানির ভেতরে ছিল বলে হাত পা সাদা হয়ে গেছে। দড়ি থাকার কারণে গলায় একটা কালচে দাগ দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব ডাক্তারি সরজ্ঞাম নিয়ে আরুর চিকিৎসা করল প্রাথমিকভাবে। ইনজেকশন পুশ করে হাতটা ধরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ ফেলল। অনুভব করে পালস রেট। এই হাতটা দিয়ে রক্ত চলাচল করছে। অপূর্বর এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল, এই হাতটা জীবিত অবস্থায় সে দেখতে পারবে না। আরুর জীবিত থাকলেও ততক্ষণ অপূর্বর স্বপ্ন মনে হবে, যতক্ষণ আরু ডাকবে না অপূর্ব ভাই বলে।

অপূর্বর বড্ড ইচ্ছে করল, আরুকে বুকে নিয়ে তার হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলাচলের শব্দ শুনতে। কিন্তু আশেপাশের মানুষগুলোর কারণে সেটা অসম্ভব। বিয়ের আগেই আরুকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যাপারটা তাকে বেশ ভাবাচ্ছে। আজ রাতে আরুর পাশে তার বাবা মা থাকবে। নিজের কাঙ্ক্ষিত স্পৃহাকে বুকে চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় অপূর্ব। আরুর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “রাতে আরুর জ্ঞান ফিরতে পারে। দুধ ছাড়া গরম কিছু খাওয়ালে ভালো হতো। এমনিতেই গায়ে ধুম জ্বর। দুধ খাওয়ালে টাইফয়েড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর রাতে যতই জ্বর বাড়ুক আমাকে বলবেন। অনেকক্ষণ পানির ভেতরে ছিল। তাই পানি দিলে ঠান্ডায় জ্বর বেড়ে যেতেই পারে। উঠি!”

আচ্ছা ঘরের ভেতরে কি, কোনো অদৃশ্য গাছের শিকড় প্রবেশ করেছে? তাহলে অপূর্বর পা কেন আটকে যাচ্ছে। কেন আরুর বিপরীত দিকে পা চলছে না?

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
আরু এতকিছুর পরেও বেঁচে আছে কেন? উত্তর আপনারা দিয়েন, না পারলে আগামীকাল আমি দিবো। 🫶

লেখিকা অসুস্থ।‌অনেক কষ্টে আজকের পর্ব দিয়েছে। সুস্থতার উপর নির্ভর করবে আগামী পর্ব।🙃

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৩

রাতে হঠাৎ করেই তাপমাত্রা নেমে গেল। আর্দ্র হয়ে গেল গ্রামের পরিবেশ। কুয়াশায় দূরের কিছু সুব্যক্ত নেই। মশারা বৈরী আবহাওয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করল গোয়াল ঘরে। মশার তাণ্ডবে গরুরা মাঝরাতে হাম্বা হাম্বা ডেকে উঠে। সেই গোয়ালে ফেলে রাখা হয়েছে কালাচাঁনকে। পাঁচ গরুর ছোটাছুটিতে একের পর এক পাদাঘাত পড়ল কালাচাঁনের দেহে। বেদনাক্রান্ত দেহ নিয়ে পল্লব উন্মুক্ত করতেই কালাচাঁন উঠে বসে। মৃত্যু থেকে করব পর্যন্ত দেহ থাকে ব্যথাহীন। কিন্তু কালাচাঁন তেমন কিছু অনুভব না করে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেহ। গোয়ালঘরের দরজা দিয়ে ফকফকা পূর্ণিমার আলো দেখে তার উপলব্ধি হলো কিছুটা। সে যে চেয়ারম্যান বাড়িতে তালাবদ্ধ আছে। দরজা ধরে ধাক্কা দিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলে, “কে কোথা আছো? দরজা খুলে দাও। শুনতে পারছ, দরজা খোলো। গোলাপী, কোথায় তুমি?”

আহসান বাড়ির সদস্যরা নির্ঘুম রাত্রিযাপন করছে। কালাচাঁনের শব্দটা কানে পৌঁছালেও প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠটা আরুর কানে লাগে। ইমদাদ হোসেন মৃধার ঘুমে চোখ লেগে আসলেও মেয়ের দিকে চেয়ে আছে পারুল। আচমকা আরু তন্দ্রার মাঝে কেঁপে ওঠে। শুণ্য গলা থেকে অযথা কলসের দড়ি খোলার চেষ্টা করতে করতে ব্যক্ত করে বাক্য, “আমি ম/র/ব না। আমি বাঁচতে চাই কালাচাঁন। পৃথিবীতে সাতজন মানুষ দেখতে একরকমের। তোমার ভালোবাসার জোরে তাদের একজনকে তুমি খুঁজে নাও। তোমার ভালোবাসার তুলনা হয় না। কিন্তু তোমার ভালোবাসার ছলে আমার এই জীবনটা কেড়ে নিও না। আমাকে বাঁচতে দাও।”

পারুল গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখলেন আরুকে। আরুর বন্ধ চোখ থেকে পানি ঝরছে। তাপমাত্রা বোধহয় ১০৪° এ পৌঁছেছে।‌ মেয়ের গোঙানির শব্দ শুনে ইমদাদ হোসেন উঠে আলো জ্বালিয়ে দিলেন। আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে, “আরু মা, চোখ মেলে তাকা। তোকে কেউ মারবে না।”

আরু ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল বাবা মায়ের দিকে। তবে মনের ভেতরে দানা বাঁধা ভয় থেকে মুক্তি মিলে না। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “ঐ দেখো কালাচাঁন। আমাকে নিয়ে ঝাঁপ দিল জলে। আমাকে বাঁচাও।”

আরুর এই কণ্ঠ যথেষ্ট ছিল সবাইকে ঘর থেকে নিয়ে আসতে। অপূর্ব ছুটে এসেছে সবার প্রথমে। আরুকে উত্তেজিত হতে দেখে ছুড়ে দেয় প্রশ্ন, ” ফুফু-ফুফা, আরুর কী হয়েছ? এমন করছে কেন?”

“জানি না, হঠাৎ করে কেমন ভয় পেয়ে চলেছে।”

“এখনো ও সেই মুহুর্তটা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। তাই এমন করছে।” বলেই অপূর্ব আরুর মাথায় হাত রাখে। আরু উন্মাদের মতো ইমদাদ হোসেনকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। অনিতা অপূর্বর শুষ্ক মুখমণ্ডলের পানে চেয়ে অনুভব করল, ছেলের কষ্ট। দ্বিধা নিয়ে পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, “অপূর্ব ডাক্তার মানুষ, ও আরুকে পারবে ঐ অবস্থা থেকে বের করে আনতে।”

অপূর্ব মুগ্ধ হয়ে মায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই তিনি আশ্বস্ত করলেন অপূর্বকে। অপূর্ব বিছানায় বসে আরুর মাথায় হাত রাখতেই পদ্মবতী খুঁজে নিল তার জলকে। দুহাত অপূর্বর চিবুকে‌ রেখে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি এসেছেন? কালাচাঁন আমাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তার ভালোবাসাকে ইতিহাস করে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু আমি তো ওকে ভালোবাসি না। আপনি আমাকে বাঁচান।”

“পারুল, আরু দুদিন কিছু খেয়েছে কিনা জানি না। এসো, ওরজন্য হালকা কিছু তৈরি করে নিয়ে আসি।” পারুলকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে অনিতা রান্নাঘরে গেল। পারুলসহ বাকি তিন বউও গেল রান্নাঘরে। ইমদাদ হোসেন লজ্জায় উঠে গেলেন মোতাহার হোসেনের সাথে কথা বলতে‌। শেফালী কড়া ডোজের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। তিস্তা সুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে, “সবাই ওদের স্পেস দিতে চলে গেছে, তুমি হা করে তাকিয়ে কী দেখছ? বউকে আদর করে দু খানা কথা বিয়ের পর তোমার মুখ থেকে আমি শুনিছি। বিয়ের আগে ভালোবাসা উতলে পড়ছিল। বড় ভাইকে দেখে শেখো। (বিরতি দিয়ে) দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে চলো।”

“তুমিই তো বললে, দেখতে।”

“তুর তুই ঘরে যায়। তোর ভাইয়ের নাকে দড়ি বেঁধে আমিও ঘরে যাচ্ছি।” তিস্তা থামার পূর্বেই সুজন ছুটে গেল ঘরে। তুরও ফিরল শেফালীর কাছে। দরজাটা ভিড়িয়ে নবদম্পতি তাদের নতুন ঘরে ফিরে গেল। দৃষ্টির অগোচরে চেনা মানুষগুলো চলে যেতেই অপূর্ব আরুকে টেনে নিল হৃদমাঝারে। আরু বিড়ালছানার মতো লেপ্টে করে গেল কালাচাঁনের নামে তার অভিযোগ। অপূর্ব আদুরে গলায় আরুকে বলে, “পদ্মবতী, তুমি অপূর্বর হৃদমাঝারে আছো! এই দেহে যতক্ষণ প্রাণ নামক অদৃশ্য বস্তুটা অর্পিত থাকবে, ততক্ষণে তুমি এরচেয়ে বেশি নিরাপদ কোথাও থাকবে না। আমার চোখে নিজের চোখ রেখে একবার দেখো, এই চোখের গভীরতা। তুমি নদীর জলে নয়, তোমাকে হারানোর ভরে জমিয়ে রাখা চোখের জলে তুমি ডুবে যাবে। এই ডোবা মানে, আমার প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ভুলে যাবে সব উন্মাদনা। তাকাবে কি আরুপাখি?”

আরু তাকালো সেই চোখে। হারালো সেই মায়াডোরে। ভয়ের মাত্রা হুরহুর করে নামল শুণ্যে। চোখ বন্ধ করলেই গড়াল জমিয়ে রাখা পদ্মবতীর অশ্রু। অপূর্ব অতি আদরে নিজের ললাট ঠেকিয়ে দিল আরুর ললাটে। জমিয়ে রাখা দুঃখের সময়টাকে গাঢ় নিঃশ্বাসের সাথে ফেলে দিল। অপূর্ব খুব শীঘ্রই আরুকে ঘরণী করে তুলবে! খুব শ্রীঘ্রই!
আরুর খবর পৌঁছে গেছে ময়নার কাছে। ছানাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে উড়ে এসে থেমেছে আরুর ঘরের জানালায়। পুনরাবৃত্তি করল একটি বর্ণ, “আরুপাখি! আরুপাখি! আরুপাখি!”
__
আহসান বাড়িতে মানুষ ধরে না, তবুও এসেছে বিচার দেখতে। সচরাচর বাড়িতে বিচার কাজ সম্পন্ন না করলেও এই প্রথম সেই কাজটি করতে রাজি মোতাহার আহসান। আরুকে একটা চাদর প্যাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে বিচারে। এলোমেলো চুলগুলো হাত‌খোঁপা করে আঁচল তুলে দিয়েছে মাথায়‌। ফ্যাকাসে মুখ জানান দিচ্ছে জ্বরের তীব্রতা। মোতাহার আহসান আরুর অবস্থা দেখে বলেন, “বোন, একটা চেয়ার এনে বসা মেয়েকে।”

“না ভাইজান, বিচারের সময় সবাই দাঁড়িয়ে থাকে। আমি চাইনা আরুর তা অমান্য করুক।” আরুকে ধরে বলে পারুল। তবুও অনিতা ছোটো একটু টুল এনে দেয় বসতে। মোতাহার আহসানের আদেশে এবার তা খেয়ানত করার স্পর্ধা খুঁজে পায় না পারুল। বিচারকার্য পরিচালনার সিংহাসনে বলে বলেন, “ঐ শু/য়ো/রের বাচ্চাটাকে এখানে নিয়ে আসুন। ওর মাকে এনেছেন?”

“জি, চাচা।” প্রহরীরা বলেই চলে গেল গোয়ালঘরের উদ্দেশ্য। গোয়ালঘর থেকে বিষ্ঠাতে‌ লেপা কালাচাঁনকে নিয়ে হাজির হয় বিচারসভায়। নিমগাছের সাথে বেঁধে ফেলে তারপরে। কালাচাঁনকে দেখে ভয়ে জড়সড়ো হয়ে যায় আরু। মোতাহার আহসান উপস্থিত গ্ৰামের সামনে নিজের মতামতের রাখে, “আমার ভাগ্নির বিচার এখানে হচ্ছে না, এখানে বিচার হচ্ছে একটি মেয়ের। যাকে এই কালাচাঁন অ/পহ/র/ণ করে নিয়ে গেছে। তারপরের দিন গলায় দড়ি বেঁ/ধে মেয়েটিকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। তাই আমি গতকাল রাতে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই কালাচাঁনকে একশো একটা বে/তের বাড়ি দিয়ে জুতার মালা গলায় পরিয়ে আপনারা গ্ৰাম থেকে বের করে‌ দিবেন। এই সুন্দরনগর গ্ৰামে এই ছেলের ছায়াও যাতে না পড়ে।”

তখনই সেখানে হাজির হয় সুন্দরী। একমাত্র ছেলে তার। ছেলের হয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে মিনতি করে, “আমার ছেলে ভুল করেছে সাহেব। ও অনেক বড় অন্যায় করেছে। ওকে এই শাস্তি দিবেন না। ক্ষমা করে দিন।(বিরতি টেনে) আমি আরুকে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে যাবো প্রয়োজনে।”

অনিতা এবার স্বামীর পক্ষ নিয়ে সুন্দরীকে বলে, “ছেলেকে আপনি মানুষ করতে পারেননি। একজনকে ভালো লাগতেই পারে। ঘটকের মাধ্যমে বিয়ে প্রস্তাব পাঠাবেন, পছন্দ হলে বিয়ে নয়তো সেখানেই শেষ। রাজি নয় বলে জোর করে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া কেমন রীতি? একটু হলে..

বলতে গিয়ে কেঁপে উঠলেন অনিতা। কেঁপে উঠে উপস্থিত সবাই।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here