নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৩১

0
211

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩১

আরু কুঁড়েঘরের একপাশে শুয়ে আছে। বিরতিহীন ধারায় কেশে চলেছে। শত হোক, ভালোবাসার মানুষ , তাকে যাতনা দেওয়া সাজে না। আরু ভার মাথা নিয়ে হেলান দেয় কুঁড়ের তৈরি দেয়ালে। ঘরে কিছু খড়কুটো ছাড়া কিছু নেই। জমানো খড়কুটোর পাশে পরে আছে অবশিষ্ট কিছু বিড়ির টুকরো। আরু হাত দিয়ে শরীরের তীব্রতা পরখ করে নেয়। সেদিন জোরজবরদস্তি করে আরুকে ডিঙিতে তোলার সময় ভিজে জবুথবু হয়েছিল। ভেজা অবস্থা থেকে ঠান্ডা তাকে আপন করে নিয়েছে। দীর্ঘক্ষণ তৃষ্ণার্ত থাকার কারণে খালি ঢোক গলা বেয়ে নেমে যেতে বাঁধা পায়। আরু ফোঁস করে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে মাটির কলসের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে যায়। কলস থেকে নারিকেলের খোলসে পানি ঢেলে নিজের তৃষ্ণা নিবারণ করে।

তখনই শুনতে পেল কালাচাঁনের মুগ্ধ করা গানের সুর। পরেনা চোখের পলক, কী তোমার রূপের ঝলক। আমি জ্ঞান হারাবো, মরে যাবো।
বাঁচাতে পারবে না কেউ।

কালাচাঁন চাবি দিয়ে তালা খুলবে এমন সময়ে দেখতে পেল আম গাছের ডালের সাথে বিঁধে রাখা একটা পাটের থলে। আরুর জন্য কবিরাজের থেকে জরিবুটি আনতে বলেছিল, তা এনে বাইরে রেখে দিয়েছে। কালাচাঁন থলে নিয়ে তালা খুলে প্রবেশ করে ভেতরে। আরুকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে স্ফুটিত হয় জোড়াল হাসি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে খাবার বের করে কালাচাঁন। দেড় দিন না খেয়ে থাকাতে পেটে মোচড় দিয়ে উঠে আরুর। ক্লান্ত আরু নিজ থেকে খাবার কোলে তুলে নেয় খাওয়ার উদ্দেশ্যে। আরুর জীর্ণদশা দেখে কালাচাঁন খাবার নিয়ে নেয়। নিজের হাতে মেখে খাইয়ে দেয় আরুকে। আরুর চোখে পানি চলে এসেছে। সে লক্ষ্য করে কালাচাঁনের চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। তাকে এই জীর্ণদশা সহ্য হচ্ছে না বোধহয় কালাচাঁনের। সত্যিকারের সেই ভালোবাসা। কালাচাঁনকে খাওয়ানো শেষ করে পাটের থলে থেকে একটা নতুন শাড়ি আরুর সামনে রেখে বলে, “এটা পরে নিও গোলাপী। তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে আমার অন্তঃকরণ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়।”

“আমার বাইরের অবস্থা দেখে আপনার এই অবস্থা, ভেতরের অবস্থা দেখলে কী করবেন?”

“গোলাপী, আমার দোষটা আসলে কোথায়? সেই সাড়ে চার বছর ধরে একটু একটু করে তোমাকে ভালোবেসে চলেছি। আমার গায়ের রঙ কালো। বিধাতা করেছে কালো, আমি করব কী?” কালাচাঁনের অনুভূতি পূর্ণ কণ্ঠটা শুনলে মৃ/ত্যুদ/ন্ড প্রাপ্ত আ/সামী/র আদেশেও জল্লাদ পিছিয়ে যাবে। এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না। যার বাম পাঁজর দিয়ে নারী সৃষ্টি, সে ভালো না বাসলেও মিলন তার সাথেই লেখা। হোক সে কাঁলাচানের মতো পা/গ/লা প্রেমিক। সেখানে আরু একটা মানুষ। আরু জ্বর যখন হুরহুর করে বেড়ে যাচ্ছিল, তখন অপারক হয়ে কালাচাঁন আরুর মাথায় পানি ঢেলেছিল। জীবনে এক গ্লাস পানিও সে ঢেলে খায়নি। সে রাত জেগে প্রিয়তমার সেবায় নিয়োজিত ছিল। আরুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। বেড়ার পাশে পড়ে থাকা *দা* তুলে নিয়ে কালাচাঁনের দিকে এগিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “নিন, এটা দিয়ে আমাকে দ্বি খণ্ডিত করে ফেলুন। দুইজন মানুষ আমাকে এত করে চায়, অথচ আরু মাত্র একটি। কারো গোলাপী, কালো পদ্মবতী। আমাকে দুই টুকরো করলে অপূর্ব ভাইও পাবেন, আপনিও পাবেন।”

“অপূর্বকে তুমি ভালোবাসো। তাহলে কেন সেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে ‘বিয়ের কথা?’ আমি সেদিন ভেবেছিলাম, তুমিও আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছ। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আরো গাঢ় হতে শুরু করেছিল। শোনো গোলাপী, তুমি যদি আমার নাহয় তুমি কারো নয়। তুমি যদি আমার হও। তবে তুমি আমার।” আরুর হাত থেকে কালাচাঁন *দা* নিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। কালাচাঁনের দৃঢ় গলায় আরু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আরুর কাঁধ শক্ত করে ধরে জবাব চাইছে কালাচাঁন। আরু হাত দুটো সরিয়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। গতকাল মাথায় পানি দেওয়ার কারণে পানি অনেকটা নরম। আরু সেই মাটি মুঠো করে ধরে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত ঘটাতে থাকে। কালাচাঁনের সহ্য হয় না আরুর কান্না। ঘরের পানি ভর্তি কলসটা তুলে সম্পূর্ণ পানি ফেলে দেয় মেঝেতে। চুষে নেয় শুষ্ক মাটি। কলসের ভেতরে ঢুকলো দড়ি। একহাতে আরুর হাত ধরে, অন্যহাতে কলসখানা তুলে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। আরুর রুগ্‌ণ দেহ অনেকটা গিয়ে হার স্বীকার করে। কিন্তু ক্ষান্ত হয় না কালাচাঁন। আরুকে নদীর ধারে এনে বজ্রকণ্ঠে বলে, “আজ এই নদী সাক্ষী হয়ে থাকবে আমাদের ভালোবাসার। কারো মৃ/ত্যুতে কারো জীবন থমকায় না, তাই তোমাকে সাথে নিয়ে আমি দুজনের জীবন থমকাবো।”

বলেই কলস ভর্তি করে নিল নদীর পানিতে। আরুর দেহে কাঁপন সৃষ্টি হলো। জোরপূর্বক বেঁধে দিল তা আরুর গলায়। আরুর পীড়িত দেহ পেরে উঠল না কালাচাঁনের সাথে। কাতর স্বরে বলে, “দেখ কালাচাঁন, আমি চেয়ারম্যান বাড়ির ভাগ্নে। একবার যদি জানতে পারে কেউ, তুই আমাকে মে/রেছিস। তোকে কেউ আস্ত রাখবে না।”

“হা! হা! হা! হাস্যকর। আমি তো তোর সাথেই ইতি টানতে চলেছি জীবনের। আমাকে পাবে কোথায়?” অপূর্বর কণ্ঠে আরু ভীত হয়ে উঠে। জীবনের মায়া। ছুটে যায় গলায় ভারী কলস নিয়ে। বেশিদূর যাওয়ার আগেই কালাচাঁন তাকে থামায়। আরু কাতর হয়ে বলে চলেছে, “আমি ম/র/ব না, দয়া করে আমাকে ছাড়ুন।”
__
অপূর্ব তার পা নিয়ে বোনদের কাঁধে ভর করে পেরিয়ে এসেছে এতটা পথ। নদীর ধার দিয়ে সরু রাস্তা পার হওয়ার সময় কানে এলো ফিসফিস শব্দ। আলোর বিন্দুমাত্র রেখা নেই। অপূর্বর মন ছটফট করছে। অপূর্ব বিচলিত হয়ে বলে, “যেভাবে হোক আজ রাতের ভেতরে আরুকে উদ্ধার করতে হবে। আরু যে আমার অর্ধ অঙ্গ। আমি ওর কষ্ট অনুভব করতে পারছি।”

“শান্ত হন ভাই, কালাচাঁন আরুর জন্য খাবার নিয়ে গেছে। আমার মনে হয়, কালাচাঁন ওর অযত্ন করবে না। আমরা চাচাকে জানাই, কালাচাঁনদের আম বাগান সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। চাচাকে জানালে, লোক লাগিয়ে আরুকে বের করে আনতে এক মুহুর্তও লাগবে না।” তিস্তা বলে সান্ত্বনা দেয় অপূর্বকে। আরও কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই অন্তঃকরণ সিগন্যাল পাঠায়, আরু সন্নিকটে। অপূর্ব তখন উদাসীন হয়ে উঠল। পাশেই ফিসফিস কথোপকথন ও পানির শব্দ শুনতে পেল। ছুটে গেল সেখানে। টর্চের আলোটা দুজনের মুখে পড়ে। অপূর্ব দেখতে পায় অচেনা আরুকে। বাক্য হারিয়ে ফেলে। তখনই কালাচাঁন আরুর হাত ধরে ঝাঁপ দিল পানিতে। তিনজন মানুষ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ধ্যান ভাঙতেই অপূর্ব দুই বোনের হাত ছাড়িয়ে নিজেও ঝাঁপ দিল নদীতে। অথচ সে সাঁতার জানে না। তুর ও তিস্তা অপূর্বকে ধরতে গিয়েও ধরতে পারেনা। পূর্ণিমা তিথি বলে তখন নদীর পানি তটের অনেক উর্ধ্বে। দুইজন মানুষ ছিটে গেলেও আরু বোধহয় কলসের ভারে তলিয়ে গেছে নদীর তলদেশে। কিছুক্ষণ পর অপূর্ব ভেসে উঠল। সাঁতার দেওয়ার চেষ্টা করছে। একবার তার মাথা দেখা যাচ্ছে, আরেকবার দেখা যাচ্ছেনা। অপূর্ব যে তুরের আপন ভাই। তুর ঝাঁপ দিয়ে নদীতে। পূর্ণিমা হওয়ার কারণে পানির পাশাপাশি অনেক স্রোত। তুর বহু কষ্টে অপূর্বকে তুলে আনে পাড়ে। অপূর্ব হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “ওটা আরুই ছিল। ওরা কেন ভেসে উঠছে না?”

“তুই সিউর ওটা আরু ছিল?”

“শুধু আরু নয়, কালাচাঁনও ছিল। আরুর গলায় আমি একটা কলস দেখছি। সেই কলস থেকে পানি পড়ছিল। কীভাবে ওকে বাঁচাবো আমি।” বলেই অপূর্ব কান্নায় ভেঙে পড়ে। পুনরায় আরুর জন্য নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার প্রয়াস করলে তিস্তা বাধা দেয়। টর্চ দিয়ে নদী পর্যবেক্ষণ করে বলে, “নদীতে যা স্রোত, না-জানি ওদের ভাসিয়ে কতদূর নিয়ে গেছে।”

‘তার পদ্মবতীর উচিত পদ্মের মতো ভেসে থাকা এই জলে?’ অপূর্বকে চিন্তা মুক্ত করতে সেখানে এসে উপস্থিত হলো একদল জেলে। নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরা তাদের পেশা!

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
খাইরুল সুন্দরীর মতো আরুকে আমি যেহুতু উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলাম, তাই দৃশ্যতে আমি তাকেই অনুসরণ করলাম।💚

ভালোবাসা, ভালোবাসাই হয়। নব্বই দশকের ভালোবাসা নিঃস্বার্থ হয়।
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here