নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৫৫

0
242

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৫

বাড়ি ভরতি মানুষ। অয়নকে চাদরে মুড়িয়ে হোগলার ওপর রাখা হয়েছে। শিউরে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে তার জননী। আরু তার ভারি পেট নিয়ে বসা মাটিতে। জামা দেহেই শুকিয়েছে। পাথর হয়েছে মন। পেটের ব্যথাটা আরও বেড়েছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলার ধ্যান নেই। ইমদাদুল হোসেন থলে রাস্তায় ফেলেই ছুটতে ছুটতে এলেন বাড়িতে। শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা শুনে রাস্তায় ফেলে রেখে এসেছে থলে। উল্কার বেগে ভেতরে এসে মৃত ছেলের মুখটা দেখে বললেন, “পারুল, কীভাবে হলো এসব? কখন হলো?”

বাঁধ ভাঙল, জলপ্রপাত সংঘঠিত হলো। সব ছেড়েছুড়ে স্বামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, “ওগো, আমার কী সর্বনাশ হলো! আমার কোল খালি হয়ে গেল। আমার অয়ন মা বলে ডাকছে না কেন? ওর আগে আমাকে কেন নিয়ে গেল না?”

ইমদাদুল হোসেন নিজেকে ধাতস্থ করলেন। দাঁত চেপে পুরুষ মানুষ বলে নিজেকে কঠোর করলেন। তদানীং শাড়ি উঁচু করে ছুটতে ছুটতে এলেন নয়না। আরুর কাঁধে হাত রেখে উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কীভাবে হয়েছে আরু?”

আরু আপন কাউকে পেল। জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে পুনরাবৃত্তি করল, “চাচি, আমার জন্য সব হয়েছে। কেন অয়নকে একা রেখে আমি ঘরে গেলাম? তুই তো বলেছিলিস, পা ধুয়ে ঘরে আসবি। কেন এলি না? জানো অয়ন আমাকে বলেছিল, যাতে আমি আবার এই বাড়িতে থাকি। আসবি?
অয়ন ভাই আমার, একবার তুই ফিরে আয়। আমি আর কখনো তোকে ছেড়ে ওই বাড়িতে ফিরে যাব না।”
কাঁদছে আরু। নয়না লক্ষ করল আরুর দেহ ক্ষতবিক্ষত। ভেজা শাড়ি শুকিয়ে গেলেও ভাজ তেমনই রয়েছে। আরুকে ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “এই অবস্থায় কে ভেজা থাকে মা? ঘরে আয়! জামা পালটে নে।”

পারুলের হুঁশ ফিরল নয়নার কথায়। উশকোখুশকো চুল, রুগ্‌ণ মুখমণ্ডল, চোখ উত্তাপ, জ্বলছে আগুন। হিংস্র পশুর মতো এগিয়ে এসে বাধা দিয়ে বলল, “ওরে নিবা না ভাবি। ওর জন্য আমার ছেলের এই অবস্থা। আমার ছেলেটাকে একটুও সহ্য করতে পারেনা। শুধু এক সন্তান কেন? ওরে দিঘির পানিতে চুবিয়ে মে/রে একসাথে আমি নিঃসন্তান হব।”

“পা/গ/ল হয়েছিস তুই? ও কী চুবিয়ে মা/র/ছে? ওর হায়াত এই পর্যন্ত ছিল। ওভাবে মেয়েটাকে দোষী করছিস কেন?” আরুকে আগলে নিয়ে কথাটা বলে নয়না। ব্যথায় ঠিকমতো দাড়াতেও পারছেনা আরু। অথচ তাকে নিয়ে চলছে টানাহেঁচড়া। আরুর দাদি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বললেন, “তুমি চুপ করো বড়ো বউ। এই মেয়ে অপয়া, অলক্ষ্মী। আমার নাতিটাকে খেয়ে ফেলল। এজন্য এই অপয়াকে আমি সহ্য করতে পারতাম না। ওকে পুলিশে দিয়ে যদি আমি কোমরে দড়ি পরিয়ে জেলে পাঠাতে না পারি, তবে আমি শিকদার বাড়ির মেয়ে না।”

নয়না তাচ্ছিল্য করল শাশুড়িকে। আরুর বিয়ের পর থেকে অয়নকে সহ্য করতে পারত না, অথচ এখন ভালোবাসা উপচে পড়ছে। আরুকে ঘরে নিয়ে জামাকাপড় পালটে বললেন, “ওখানে যাবিনা তুই, গেলেও কারও কথা মাথায় নিবিনা। অয়নের শোকে মাথা ঠিক নেই, কী বলতে কি বলে ফেলছে।”

“মিথ্যা বলছে না।”

“মুখে মুখে কথা। চুপ করে বসে থাক।” রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে নয়না। আরু মাথা নিচু করে বলে, “চাচি, আমার পেটে ব্যথা করছে। উনি যাওয়ার সময় থেকে ব্যথা করছে। একটু একটু করে কেবল বাড়ছে।”

“টেনশনে বাড়ছে। চুপ করে একটু শুয়ে থাক।” বলেই বিছানা ঠিক করে নিজের হাতেই আরুকে শোয়ালেন নয়না। আরু শুয়ে জানালা দিকে লেবু গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। নয়ন ভরা জল। অপূর্ব কখন আসবে? কখন? এই দম বন্ধ পরিবেশ থেকে অপূর্ব ছাড়া কেউ আরুকে বের করে আনতে পারবেনা।
.
হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করতে করতে নয়না আরুর কাছে এলেন। হাত ধরে হেঁচকা টেনে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলেন। আরু টু শব্দটি করল না। উঠানের একপাশে তার পরিচিত মুখগুলো দাঁড়িয়ে আছে। কেউ সাহস করে আরুকে বাঁচাতে পারছে না। অবশেষে মোতাহার আহসান পারুলকে ধরে বললেন, “শান্ত হ। ওর দোষ কী এখানে?”

“ওরই সব দোষ। পুলিশ এসেছে, ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিব।” পারুল বলে‌। অনিতা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই জাহানারা বলল, “ভাবি, পারুলকে সামলাতে হবে আগে।”

অনিতা বলল, “আরুর উপর দিয়ে কী যাচ্ছে, সেটা তুই দেখছিস না?”

জাহানারা বলল, “তাই বলে আরুর দোষ অস্বীকার কেন করছ ভাবী? ওর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যই অয়নের এই অবস্থা। আমরাও ওর সময়টা পার করে এসেছি। ওর মতো এত ন্যাকামি করিনি। ও তোমার পুত্রবধূ, পেটে বংশধর। তাই তুমি অন্ধ। কিন্তু আমি অন্ধ নই। আমার সুমি যদি এমন কাজ করত, তাহলে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।”

“হয়েছে তোর জ্ঞান দেওয়া? এতই যখন জ্ঞানী তাহলে শেফালীর সময় জ্ঞান কোথায় ছিল তোর? তখনবাড়ির মেয়ের জন্য যেমন নিজের পুত্রবধূকে বের করে দিসনি। তেমন আমিও ভাগনের জন্য পুত্রবধূকে বের করে দিতে পারব না।
বড়ো বড়ো জ্ঞান আমাকে না দিয়ে, পারুলকে জ্ঞান দে যা। উসকানি দিস না।” বিদ্রুপ করে কথাটা বলে মোতাহার আহসানের কাছে গেল অনিতা। স্বামীর হাত ধরে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, “পারুল কী বলছে! আরুকে পুলিশে দিবে মানে? এই অবস্থায় এত প্রেসার কীভাবে নেবে মেয়েটা?”

“এছাড়া কোনো উপায় নেই। পুলিশের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওখানে আরুর অযত্ন হবেনা। এখানে থাকলে মেয়েটাকে শান্তি দিবেনা পারুল আর পারুলও শান্ত হবেনা। তাই এটা করতেই হবে। কালকে আরুকে বের করে অপূর্বর সাথে তোমার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিব। ওখানে আরুর অযত্ন হবেনা।” মোতাহার আহসান মনে মনে ছক করেছে। স্বামীর কথাটা সন্তুষ্ট সে। অনিতা স্বামীকে ছেড়ে পারুলের কাছে এলো। আরুর হাত ধরে পারুলের থেকে ছাড়িয়ে নিল। কড়া গলায় বলল, “কেন এমন করলি তুই? তোর জন্য অয়ন আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ, আরুকে নিয়ে চলে যান। ওকে আমি আর এখানে সহ্য করতে পারছি না।”

“মামি…

“চুপ। একদম আমাকে মামি বলে ডাকবি না। স্যার, আপনাকে আমি কী বললাম শুনতে পাননি?” অনিতার কথায় আরু হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল। জীবনের প্রতি আর কোনো অভিযোগ নেই তার। যারা এই অসময়ে পাশে থাকবে, তারাই দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মহিলা পুলিশ এসে আরুর কোমরে দড়ি পরিয়ে দিলো। অতঃপর টানতে টানতে ভ্যানগাড়ির দিকে নিয়ে গেল। আরু কাতর দৃষ্টি ও ঝাপসা চোখ নিয়ে এগিয়ে গেল। ভ্যানগাড়িতে তুলে চলল তার গন্তব্যে। ভ্যানগাড়ি যখন তার গন্তব্যের কাছাকাছি তখন আরুর পেটের ব্যথা ক্রমশ বাড়তে লাগল। শুয়ে পড়ল ভ্যানের উপর। হাত দিয়ে চুলগুলো টেনে গলা কা/টা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে। আরুর অবস্থা দেখে মহিলা কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে বলল, “কী হয়েছে,এমন করছিস কেন?”

“পেটে ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে ম/রে যাচ্ছি।”

“কখন থেকে?”

“সকাল থেকে। ধীরে ধীরে বাড়ছে। এখন আর সহ্য করতে পারছি না। আপনারা কিছু করুন।” কাতরাতে কাতরাতে কথাটা বলে আরু। দুজন কর্মীরা উভয়ের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে বলে, “পেট তো বড়ো। মনে হয়, লেভার পেইন উঠেছে। ওকে দ্রুত ভেলিভারি করাতে হবে।”

“স্যার, চেয়ারম্যান সাহেবকে জানাবেন?” মহিলার কর্মীর জবাবে দারোগা বলে, “না, চেয়ারম্যান ব্যস্ত আছেন। আপনাদেরই কিছু একটা কথা হবে। আপনাদের পরিচিত কোনো ধাত্রী থাকলে খবর দিন।”

“আপা, তাহলে আপনি পোয়াতির সাথেই থাকুন। আমি ধাত্রী, প্রয়োজনীয় কাপড়, যা যা লাগবে সব নিয়ে আসি।”
বলেই কর্মী নেমে গেল ভ্যানগাড়ি থেকে। আরু যাতনা সহ্য করে চলেছে। সম্পূর্ণ সময় জুড়ে আপনজনেরা থাকলেও, গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে তারা নেই। কেউ নেই। অপূর্বও নেই।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ
আপনাদের কথা রাখতে পারলাম না। দুঃখিত আমি।
গল্পটা আর বেশি নেই। মূলত এই অংশের জন্যই গল্পটা এত বড়ো হলো। মানুষের জীবনে সুখের পর দুঃখ। দুঃখের পর আবার সুখ। যারা এই অংশ পড়তে পারবেন না, তারা স্কিপ করুন। শেষ পর্ব পড়ে নিয়েন।😐

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here