অপ্রিয়_জনাব #Mehek_Enayya(লেখিকা) #পর্ব_০৩

0
110

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৩

জমিদার গৃহে নিস্তব্ধ পরিবেশ বিরাজমান। গৃহের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে গুমোট ভাব স্পষ্ট। সময় ঘড়ির কাটায় চারটা পঞ্চাশ মিনিট। আঁতকে সকলের মনেই এক ভয় কাজ করছে। সোহরাব দেহরক্ষীদের নিয়ে বের হয়েছে আক্রমণকারির খোঁজ লাগাতে। ছায়া আর সাইয়েরা উপমার কক্ষে। তুলসীর মাথা ঘোরাচ্ছিলো তাই সে নিজ কামরায় চলে যায়। বাকিরাও যে যার স্থানে চলে যায়। ইয়ামিন আম্মার পাশে বসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ঘুমন্ত উপমাকে দেখছে। ছায়া উপমার হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবছে সেই সময়ের কথা। সোহরাবের প্রশ্ন শুনে সকলে ভুত দেখার মতো করে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। ছায়াও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তুলসীর রাগ হয় পুত্রের কথা কর্ণপাত হতেই। বিবাহ করে দুইদিন হলো নতুন বউ এনেছে গৃহে। অথচ যার বউ সেই জিগ্যেস করছে মেয়েটা কে! তাহেরা ফোড়ন কেটে বলে,
-কী বলেন ভাইজান! তিনি আমাদের ছোট ভাবিজান গতকাল আপনি যাকে বিবাহ করেছেন।

সোহরাব নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। আম্মার দিকে ক্রোধে জর্জরিত করুণ নেত্রপল্লব নিক্ষেপ করেন। অতঃপর কিছু না বলেই চলে যায়। তুলসীর আত্মা কেঁপে উঠে সেই চাহনিতে। ভিতর ভিতর এক অজানা ভয় বাসা বাঁধে। জোর করে, ম’রার দোঁহাই দিয়ে বিবাহ তো করিয়েছেন কিন্ত এখন মেয়েটির কী হবে! বিবাহের দিনও কবুল বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। একবার নতুন বউয়ের মুখটাও দেখেনি। এতো জেদ তার! তবে তার জন্য কী মেয়েটির উজ্জল ভবিষ্যত ধ্বংস হয়ে যাবে! আরেকদিকে রয়েছে ছায়া! বছর তিনেক আগে বেশ ধুমধাম করে একমাত্র ভাইজিকে নিজ পুত্রের স্ত্রী রূপে গৃহে নিয়ে আসেন। তখনও সোহরাব বিবাহ করতে রাজি ছিলেন না। নিজ জেদে বসে পুত্রকে বিয়ের পিঁড়িতে বসান।
সেই জিদ থেকে সোহরাব আজ পর্যন্তও ছায়াকে ভালোবাসতে পারেননি। অথচ ছায়া মেয়েটি কতই না ভালোবাসে ঐ এক’রোগা পুরুষকে! বিবাহের পর থেকে অনেক কম সময়ই গৃহে আসেন। বেশিরভাগ সময়ই শহরে নিজ চেম্বারে থাকেন। গ্রামে আসলেও ছায়াকে উপেক্ষা করে চলতেন যেটা সবার নজরেই পরতো।

কয়েকমাস যাবৎ অসুস্থ ছিল ছায়া। ডাক্তারের কাছে নিলে তারা বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা করতে দেন। সোহরাব সেই সময়টা ছায়ার সাথেই ছিল। পরীক্ষা করে ধরা পরে ছায়ার জ’রা’য়ু ক্যা’ন্সার হয়েছে। ডাক্তার বলেন অপারেশন করলে ছায়া আর মাতৃতের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন না। সবটা শুনেই সোহরাব তৎক্ষণাৎ অপারেশনের ব্যবস্থা করেন। তুলসী এটা শুনার পর থেকেই অন্যরকম হয়ে যায়। মমতাময়ী শাশুড়িকে পরিবর্তন হতে দেখে ছায়া।

-বড় বউমা তুমি নাহয় এখন নিজ কক্ষে যেয়ে একটু বিশ্রাম নেও আমি এখানে থাকি।
সাইয়েরার কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ছায়া। ইয়ামিনকে দেখে নরম কণ্ঠে বলল,
-না ছোট আম্মা আপনি ইয়ামিনকে নিয়ে জান। ওর ঘুম পাচ্ছে।
-তুমি থাকবা?
-থাকি। আপনি যান।
সাইয়েরা চলে যায়। উপমার পাশেই শুয়ে পরে ছায়া।

মোরগের ডাকে জানান দিচ্ছে সকাল হয়ে গিয়েছে। জমিদার গৃহের সকলের ঘুম ছুটে গিয়েছে অনেক আগেই। সোহরাব, আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন ও তাঁদের বিশ্বস্ত ভৃত্য জসিম একসাথে বৈঠকখানায় বসে গতরাতের ঘটনার বিষয় কথা বলছেন। সোহরাব যতটুকু জানতে পেরেছেন গতকালের আক্রমণকারি তাঁদের শত্রুর গুপ্তচর ছিল। তাকে মনে করে আক্রমণ করেছিল উপমার ওপর। তাঁদের উদ্দেশ্যে ছিল সোহরাবকে আঘাত করা।
চায়ে চুমুক দিয়ে আলাউদ্দিন বলল,
-এটা মুহিব চৌধুরী ছাড়া অন্য কারো কাজ হতেই পারে না।
-ঠিক কইছেন বড় ভাই। ঐ বদমাইশেরই নজর আমাগো জায়গা-জমিনের ওপর।
-চাইলে এখনই ওকে ওর বাড়ির সামনেই পুঁতে রাখতে পারি কিন্তু শত্রুদের এতো সহজে পরাজিত করলে কী আর কোনো মজা আছে নাকি!
ভাইয়ের কথায় তাল মিলিয়ে প্রসন্ন হেসে সালাউদ্দিন বলল,
-কথা ঠিক। ওর পোলারে আমাগো মাইয়ার পিছনে লাগায়! টু’করা টু’করা কইরা কা’ইট্টা ওগো পোলারে ওগো কাছেই দিয়া আমু নে তখন মজা বুঝব।
শব্দ করে হেসে উঠে আলাউদ্দিন। সোহরাবকে অন্য ধেনে মগ্ন থাকতে দেখে আড়চোখে তার দিকে তাকায়। বক্ষস্থলে এক অজানা পীড়া অনুভব করছে সোহরাব। এই পীড়ার আরম্ভ কোথায়, অন্তর কোথায় কিছুই জানা নেই তার। এলোমেলো মস্তিকে এক শুভ্র রমণীর চিত্র এঁকে যাচ্ছে বার বার। ছায়ার প্রতি তার অন্যরকম অনুভূতি তৈরি না হওয়ার আরেকটা কারণ ছায়াকে সোহরাব বিবাহের পূর্বে বোনের নজরেই দেখতো। সেই অভ্যাস পরিবর্তন করতেই না কত হিমশিম খেতে হয়েছে তার!

-কোন ভাবনায় ঢুকে পরলে পুত্র?
আলাউদ্দিনের উচ্চারিত বাক্য কর্ণ পযন্ত পৌঁছাতেই নড়েচড়ে বসে সোহরাব। নিজ ওপর বিরক্ত হয়ে বলল,
-তেমন কিছুই নয় আব্বাজান। কে জ্বালাচ্ছে আমার বোনদের?
-ঐটা আমরাই দেখে নিবো নে।
-ঠিক আছে কিন্তু বোনদের বেলায় খামখেয়ালি করলে চলবে না আব্বাজান।
-তাহসিয়ার কী খবর? ভালো আছে তো সেখানে?
-ভালো থাকবে না কেন?
-না। এমনেই বললাম।
আলাউদ্দিন এদিকসেদিক পরোক্ষ করে ধীর কণ্ঠে সোহরাবকে বলল,
-পুত্র তোমার কী কোনো অসুবিধা হচ্ছে? তোমার আম্মা বলল তুমি বলে এখন পর্যন্ত ছোট বউর সাথে সাক্ষাৎ করোনি?
সোহরাবের রাগ হলো আম্মার ওপর। সব বিষয় কেনো সবাইকে জানাতে হবে! মুখে কাঠিন্য ভাব এনে বলে,
-বিবাহ করিয়েছে আম্মায় তো এখন সংসারও নাহয় সেই করুক।
আলাউদ্দিন জানতো সোহরাব তেড়া উত্তর দিবে। দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে পুনরায় বলল,
-তোমার কী নিজের কোনো পছন্দ আছে আব্বা? থাকলে বলো আমাকে?
-যদি বলি আছে তাহলে আরেকটা বিবাহ করাবেন?
বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে নিলিপ্ত ভঙ্গিতে বলল সোহরাব। জসিম চোখের ইশারায় আলাউদ্দিনকে কিছু বলতে বারণ করলেন কিন্তু আলাউদ্দিন সম্মতি স্বরে বলল,
-অবশ্যই করাবো। জানো তো পুত্র মুসলিম পুরুষদের জন্য চারটা বিবাহ জায়েজ আছে।

আব্বার কথা শেষ হতেই গা কাঁপিয়ে হেসে উঠে সোহরাব। সালাউদ্দিন, আলাউদ্দিন একজন আরেকজনের পানে তাকায়। সোহরাবের নাটকীয় হাসি দীর্ঘক্ষণ রইলো না। হাসি হাসি মুখ রূপ নিলো অগ্নিমূর্তি। প্রচন্ড ক্ষোপের সাথে বলল,
-জায়েজ আছে বলে একটার পর একটা বিবাহ করতেই থাকবো? জানেন আব্বাজান আমি পূর্ণ বয়সে পা দেওয়ার পর শপথ করেছিলাম আর যাই হোক নারীর দিক দিয়ে আপনার মতো হবো না। কিন্তু দেখেন মাশাআল্লাহ! আমিও আপনার মতো দুইটা বিবাহ করে ফেললাম। এটাই বুঝি রক্ত! জমিদার বাড়ির পুরুষ শুধুই নারীর ব্যবসা করে কিছুদিন পর লোকজন এটাই বলবে আব্বাজান।
আলাউদ্দিন কিছু বলতে পারলো না। বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। জীবনে সর্বপ্রথম আজ তার পুত্র, তার সোহরাব তার সাথে এভাবে কথা বলল! বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় সোহরাব। গায়ে জড়ানো শার্ট ঠিক করে স্মিত হেসে বলল,
-আসি আব্বাজান এবং ছোট আব্বা।

সোহরাব সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায়। আলাউদ্দিন থম মেরে বসে রইলো। জসিম অসহায় কণ্ঠে বলল,
-ভাইজান কাইল রাইত থেকাই রাইগ্গা আছিলো। কিছু মনে কইরেন না খালুজান।
-দেখলি তোরা আমার পুত্র এই প্রথম আমার সাথে এভাবে উঁচু গলায় কথা বলল!
-ভাইজান আমার তো মনে হয় সোহরাব আব্বার দুইনম্বর বউডাই সব নষ্টের মূল! বাড়িতে আইতে না আইতেই আপনেগো জগড়া বাঝাইয়া দিলো। অশুভ মাইয়া!
আলাউদ্দিন কিছু বলল না। তবে সালাউদ্দিনের কথায় কোনো এক যুক্তি খুঁজে পেলো সে।

____________________
প্রচন্ড পানির তৃস্নায় ঘুম ভেঙে যায় উপমার। আদৌ আদৌ আঁখিজোড়া খুলতেই শরীরের রনরনে ব্যাথার অনুভূতি হয়। মাথা থেকে শুরু করে কোমর পর্যন্ত শিরশির করছে তার। রাতের কথা মাথা থেকে সরে যায়। উল্টো হয়ে শুয়েছিল উঠে বসতে উদ্যত হতেই পিঠের আঘাতের অসহনীয় ব্যাথায় চোখ, মুখ খিঁচে আর্তনাদ করে উঠলো,
-ওওও মা গো!

মাত্রই কক্ষে প্রবেশ করেছিলো ছায়া। উপমার আর্তনাদ শুনতে পেয়ে চটজলদি করে এসে তাকে ধরে। সহ্য করতে না পেরে কেঁদে দিয়েছে উপমা। উপমার পরনে ছিল সাদা রঙের ব্লাউজ দিয়ে কালো রঙের শাড়ী। ব্লাউজের বোতমের অংশ পিছনে দিয়েছিলো ছায়া যাতে ঘাঁ উন্মুক্ত রাখতে পারে। উপমাকে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় বসিয়ে দেয়। পিঠের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সাদা ব্যান্ডেজ র’ক্তে লাল হয়ে আছে। তাহেরা, তুলসী কক্ষে আসতেই ছায়া তাঁদের উদ্দেশ্যে বলল,
-তাহেরা তোমার ভাইজানকে ডেকে নিয়ে এসো ওর ঘাঁ এর অবস্থা করুণ।
-এখনই ডাকছি।

তুলসী উপমার চোখের পানি মুছে দেয়। এতটুকু আঘাতেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সামনে কী হবে ভেবেই বিরক্ত উপমার ওপর। শাড়ীর আঁচল দিয়ে সুন্দর করে বক্ষবিভার্জন ঢেকে দেয়। উপমা কম্পিত ওষ্ঠজোড়া দিয়ে নিম্নস্বরে জিগ্যেস করে,
-রাতে আমার ওপর কে আঘাত করেছিলো? আর কেনো আঘাত করেছিলো?
-তুমি এখন চুপ থাকো ছোট বউমা। একটু শান্তভাবে বসো।

তাহেরার পিছু পিছু কক্ষে প্রবেশ করে সোহরাব। ছায়া নিজের ঘোমটা ঠিক করে সরে দাঁড়ায়। কী মনে করে যেনো ছায়া তুলসীকে বলে,
-আম্মাজান আপনে থাকুন আমার আবার রসইকক্ষে কাজ আছে।
-যাও।
সোহরাবের পাশ কাটিয়ে চলে যায় ছায়া। আড়ষ্ট কাটিয়ে উপমার দিকে দু পা এগিয়ে যায়। উপমা এতক্ষন খেয়াল করেনি সোহরাবকে অকস্মাৎ পুরুষালি সুগন্ধির সুবাস নাকে আসতেই মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। সেইদিনের অজ্ঞাত পুরুষকে চিনতে বেশ সময় লাগলো উপমার। এটা যে তার স্বামী সেটাও উপলব্ধি করতে পারলো উপমা।
স্বাভাবিক ভাবেই রোগীর চিকিৎসা করতে এগিয়ে এসেছিলো সোহরাব। তৎক্ষণাৎ উপমার বাঘিনীনেয় আঁখিজোড়া দেখে মস্তিককে হট্টগোল বেঁধে যায়। ঘনঘন কয়েকবার ভারী নিঃশাস ত্যাগ করে নিজেকে শান্ত করলো সোহরাব। সে একজন ডাক্তার। শত পুরুষ নারীর চিকিৎসা সে নিজ হস্ত ধারা করেছেন তবে আজ কেনো এমন অনুভূতি হচ্ছে!
উপমা চোখ খিঁচে বসে রইলো। সোহরাব নগ্ন পিঠে হাত লাগাতেই নিজ হাত মুঠিবোধ করে ফেলে উপমা। ত্বরিত গতিতে কাজ সম্পূর্ণ করে পুনরায় ব্যান্ডেজ করে দেয়। এরই মধ্যে কেউ একটা বাক্যও ব্যয় করলো না। শেষ বারের মতো চোরা দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যায় সোহরাব।

_______________________
এরই মধ্যে কেটে যায় বেশ অনেক দিন। গৃহের সকলের সাথে তেমন ভাব না হলেও তাহেরা, সাইয়েরা ও বাচ্চাদের সাথে বেশ ভাব হয়েছে উপমা। আঘাতে সুস্থ হতেই এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছে। সেই সময়টা ছায়া তার ভীষণ যত্নয়াদী করেছেন। তবে কোনো একটা অজানা কারণে উপমার কেনো জানি মনে হয় ছায়া যতটা ভালো বাহ্যিক রূপে ভিতরে তার ব্যতিক্রম! সকলের সামনে ভালো মানুষীর মুখোশ পরে ঘুরে এটাই আন্দাজ করছে সে। উপমা যেদিন প্রথম সোহরাবকে দেখলো তার ঠিক দুদিন পরেই শহরে চলে যায় সে। এতে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই উপমার।

-ছোট ভাবিজান আসেন না কুতকুত খেলি।
উঠানে মোড়া পেতে বসেছিলো উপমা, তাহেরা। তাঁদের সামনেই সাইফা,রোমানা তাঁদের বান্ধবীদের নিয়ে কুতকুত খেলছিলো। উপমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে উক্ত কথাটা বলল। উপমা স্মিত হেসে বলল,
-তোমরা খেলো আমি বসে বসে দেখি।
-আসেন না ভাবিজান। আমরা দুইজন মিলে খেলবো অনেক মজা হবে।
বাচ্চাদের সাথে তাহেরাও আবদার করে বসলো। শেষে কী মনে করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় উপমা। বিকালবেলা সাধারণত তেমন কোনো পুরুষ বাসায় থাকে না। শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে খেলতে রাজি হয় উপমা। সকলে খুশিতে চিৎকার করে উঠে। বারিবারি সকলে খেলতে থাকে।
আঠাড়শী কন্যা, গায়ে জড়ানো লাল রঙের সুতির শাড়ী। সুতির শাড়ীর পরায় দরুণ বকে তুলসী তাকে। জমিদারের গিন্নিরা পরিধান করবে ভারী কাজ করা কাতান, বেনারসি ও মসলিন শাড়ী! সেখানে উপমার এই সুতির শাড়ী পরিধান করা একদম অপছন্দ তার। কোমর সমান কালো খয়েরি সংমিশ্রনে কোঁকড়ানো কেশ বেনুনি করায় খেলার ফাঁকে ফাঁকে দুলছে। হলদে সাদা গায়ের বরণে লাল, কালো, খয়েরি রঙটা যেনো একটু বেশিই মানায়। অনেকটা চাকমাদের মতো ছোট ছোট আঁখিজোড়া, লম্বা খাড়া নাক তার সাথে পাতলা ঠোঁট সব মিলিয়ে উপমার সামনে নিজেকে অত্যাধিক অসুন্দর বলে মনে হলো ছায়ার। খানিক সময় ধরে জানালার ধাঁরে দাঁড়িয়ে উপমাকে নিলিপ্ত ভঙ্গিতে পরোক্ষ করছিলো সে। কী হাসিখুশি প্রাণজ্জল মেয়েটি! বিবাহের চারদিনের মাথায়ই যে তার নববিবাহিত স্বামী তাকে রেখে চলে গিয়েছে তাতে তার একটুও আফসোস নেই।

সন্ধ্যার আজান কর্ণকুহর হতেই খেলা শেষ করে দ্রুত পায়ে গৃহের ভিতরে ঢুকে যায়। বৈঠকখানা পেরিয়ে ভিতরে সিঁড়িতে উঠে যাবে এমন সময় তাঁদের সামনে উপস্থিত হয় তুলসী। তাহেরাকে আদেশ স্বরে চলে যেতে বলে। উপমা মাথার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে পরে। তুলসী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উপমার পানে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
-ভুলে যেয়েও না এ’বাড়ির বউ হয়ে তুমি গৃহে প্রবেশ করেছো। বাড়ির মেয়ে বাচ্চাদের সাথে মিলে খেলা তোমাকে সাজে? নিজের ব্যক্তিত্ব কেনো ছোট করছো?

উপমা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। বিবাহের পর পর উপমার মনে হতো মায়ের মতন একজন শাশুড়ি পেয়েছেন তিনি। তবে আজ তার কথা বলার ধরণ দেখে উপমার চিন্তা পরিবর্তন হয়ে গেলো। শাশুড়ি কখনোই মা হতে পারে না। তুলসী দম নিয়ে ফের বলল,
-আমার ছেলের সাথে তোমাকে বিবাহ করানোর একমাত্রই কারণ সেটা হলো তুমি তোমার সৌন্দর্য দিয়ে ওকে গৃহে আঁকড়ে রাখবা এবং আমাদের বংশধর দিবা। কিন্তু তুমি পারলে? সেই আগের মতোই শহরে চলে গেলো আমার ছেলে। আর তুমি বাড়ির মেয়েদের সাথে ড্যাংড্যাং করে খেলছো? মেয়ে মানুষ যদি তার রূপ, যৌবন দিয়ে সোয়ামীকে আকর্ষিত করতে না পারে, প্রেমে মশগুল করতে না পারে তাহলে তার সৌন্দর্যই বৃধা! আশা করি সবটা তুমি বুঝতে পেরেছো?

নীরবে হ্যাঁ বোধক মাথা নারায় উপমা। চোখের কোণে অশ্রু এসে ভীড় জমিয়েছে। তুলসী অনুমতি দিতেই উপমা নিজ কক্ষে এসে পরলো। দ্বার লাগিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরে। অশ্রুরা বাঁধ ভাঙে। বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে। মনে যত বিষাদ জমেছিলো সব একসাথে উপচে পরছে যেনো!
__________________
রাতের খাবার শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে নিজ কক্ষে আসে উপমা। সহসা তার মনে ইচ্ছে জাগলো ছাদে যাওয়ার। এই বাসায় আসার পর থেকে যে কয়বার উপমার মন খারাপ ছিল তখন ছাদে গেলে খোলা হাওয়ায় নিঃশাস নিলে শান্তি অনুভব হয় তার। শাড়ীর কুচি ধরে সাবধানে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। ছাদে আসা মাত্রই মাথার আঁচল সরিয়ে ফেলে। আষার মাস চলে। এই গুমোট পরিবেশ, তো এই প্রকৃতির ভয়ংকর তান্ডব। আকাশ আলোকৃত করে কিছুক্ষন পর পর বীজলি চমকাচ্ছে। জমিদার গৃহের চারপাশে বড় বড় দানব আকৃতির গাছপালা বাতাসে মৃদু নড়ছে।
উপমা উৎফুল্ল হয়ে দুইহাত মেলে ঘুরতে থাকে। অধীর অপেক্ষা করতে থাকে কখন বর্ষণ হবে কখন তার এলোমেলো মনকে শীতল করে দিবে।

উপমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গগন কাঁপিয়ে বর্ষণরা উপমার রাতের সঙ্গী হতে এসে পরে। উল্লাসে হাত, পা নাচিয়ে এদিকসেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এক সময় হয়রান হয়ে ছাদের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে পরে। বড় বড় নিঃশাস নিতে থাকে চোখ বন্ধ করে। পিছনে ফিরে আঁখিজোড়া খুলতেই জমিদার বাড়ির সদর দ্বার দিয়ে অজ্ঞাত একজনকে ভিতরে আসতে দেখতে পায় উপমা। যত এগিয়ে আসছে ততো স্পষ্ট হচ্ছে অগন্ত। সহসা উপমা নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারলো না। চট করে নেত্রপল্লব বন্ধ করে ফেলে। বড় বড় নিঃশাস নিয়ে পুনরায় তাকায়। অস্পষ্ট স্বরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-ইয়াশার!

কাঁধে কলেজ ব্যাগ জড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চুবচুব হয়ে এগিয়ে আসছে একজন অজ্ঞাত যুবক। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি থেকে টপটপ পানি পরছে। সেটা ভীষণ বিরক্তের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যুবকের। দুইহাত দিয়ে ললাটে থেকে মাথার পিছনে নিয়ে চুলের পানি ঝরিয়ে নেয়। অতঃপর দৌড়ে গৃহের ভিতরে চলে যায়।
উপমার সবটা কল্পনার মতো মনে হলো। সেই পুরুষ, সেই চলাফেরা, সেই মুখমন্ডল, সেই হাসি, সেই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, সেই সিগা’রে’টের পোড়া ওষ্ঠজোড়া! আর ভাবতে পারলো না উপমা। পিছনে ফিরে রেলিং এ পিঠ ঠেকিয়ে জমিনে বসে পরে। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-এমনটা করো না সৃষ্টিকর্তা, এমনটা করো না। আমি এখন অন্য একজনের স্ত্রী। সে সহ্য করতে পারবে না খোদা। আমাকে এতো বড় পরীক্ষায় ফেলো না। একটু দোয়েয়া করো আমার ওপর।

>>>চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here