এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️ #লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️ — পর্বঃ৩৬

0
844

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৬

বেশ নিরাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সবাই আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার সেদিকে হুস নেই। সে নিজের মতো করে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে। মৃদুল এতক্ষণ মুরগীর রোস্ট নিয়ে এতকিছু বললো তাতেও তার ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন শুনতে পায় নি। হঠাৎই মুনমুন বললো,“আদু,

আদ্রিতা জবাব দিলো না। আদ্রিতার কান্ডে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো সবাই। আশরাফ সবাইকে চুপ হতে বলে এগিয়ে গেল আদ্রিতার কাছে। সামনে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। তাও আদ্রিতার কোনো হেলদোল দেখা গেল। বেশ চিন্তিত হলো সবাই। আশরাফ আলতো করে আদ্রিতার কাঁধে হাত রাখলো। নিচু স্বরেই ডাকলো,“আদু,”

আদ্রিতা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো এবার। কোনোরকম বললো,“জি,

পরমুহূর্তেই চোখের সামনে তার বন্ধুমহলের সবাইকে দেখে হতভম্ব স্বরে বললো,“তোরা এখানে? কখন এলি?”

বিষম খেলো সবাই। তারা সেই কখন এখানে এসেছে হইচই করছে অথচ আদ্রিতা তাদের দেখতে পায় নি। সবাই বেশ বিস্মিত।’

বিকেলের ফুড়ফুড়ে আলোতে শীতল বাতাসময় পরিবেশ। হসপিটাল থেকে খানিকদূরেই অবস্থানরত এক নদীর পাড়। তার সামনের এক বেঞ্চিতে বসে আছে আদ্রিতা। আর তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী। মূলত দু’ঘন্টার একটা ছুটি নিয়ে তারা এখানে এসেছে। প্রকৃতির মিষ্টি বাতাস তাদের ছুইলো হঠাৎ। আশরাফই শুরু করলো আগে। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে তোর?”

আদ্রিতার ছলছল দৃষ্টি ভঙ্গি। বুকে তীব্র ব্যাথা। তবুও প্রশ্ন এড়াতে বললো,“কি হবে?”

“আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছিস তুই”–চিন্তিত স্বর মৃদুলের।

আদ্রিতা আশেপাশে চায়। বিস্মিত কণ্ঠে বলে,“না।কি লুকাবো?”

সন্দিহান দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতা শুঁকনো হাসলো। বললো,“কিছু হয় নি রে আসলে কাল রাতে ঠিক মতো ঘুম হয় নি। তাই আর কি নিজেকে মরা মরা লাগছে। প্রচুর ঘুমও পাচ্ছে।”

কথাটা বলে হাই তুললো আদ্রিতা। শুরুতে কেউই বিশ্বাস করতে চাইলো না আদ্রিতার কথা। কিন্তু আদ্রিতার চোখ বোধহয় সত্যি বলছে। সে ক্লান্ত। তার চোখ খানিক লাল। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সবাই। মৃদুল পরিবেশ ঠিক করতে বললো,“তাইলে কিছু খাওয়া যাক। ঝালমুড়ি ফুচকা খাবি তোরা?”

সবাই চেঁচিয়ে উঠলো। যার মানে ‘তারা খাবে’।
মেয়ে তিনজন ফুচকা আর ছেলে তিনজন ঝালমুড়ি খাবে বলে ঠিক করলো। আশরাফ ওরা গেলো আনতে, এরপর খেতে খেতে মৃদুলের বিয়ের কথাবার্তা চলবে। ঘুম পেয়েছে বললেই তো আর আদ্রিতাকে ঘুমোতে দেয়া যাবে না এখন।’
—-
খুলনার ফ্যাক্টরিতে পা রেখেছে ফারিশ। আজ অনেকদিন পরই পা রেখেছে এখানে। বেলা তখন বিকেল ছাড়িয়ে। ফারিশকে দেখেই সেখানকার ম্যানেজার মহিন উদ্দিন দৌড়ে আসলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে আওড়ালেন,“কেমন আছেন স্যার?”

ফারিশ সামনে হাটলো। তার পিছনে আদিব। আর তাদের সঙ্গে মহিন উদ্দিন। ফারিশ গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল,
“ভালো। কাজ কেমন চলছে?”
“জে ভালোই স্যার।”
“আজ রাতে কি মাল ডেলিভারি দেয়া হবে?”
“জে স্যার।”
“কোন কোন দেশে যাবে?”
“একটা জাপানে, আরেকটা নেদারল্যান্ড।”

ফারিশ ছোট করে উত্তর দিলো,“ওহ।”
একটু থেমে আবার বলে,
“ঔষধের কি খবর?”
“স্যার দেশেই অনেকগুলো অর্ডার আছে। ঢাকার বেশিরভাগ সরকারি, বেসরকারি হসপিটালগুলো আমাদের ঔষধ ব্যবহার করছেন। বাচ্চাদের জন্য নতুন তৈরিকৃত কাশির ঔষধটাও ব্যাপক ভালো হয়েছে। ঢাকা সরকারি হসপিটালের ড. ওয়াজিহা আদ্রিতা নামের একজন ডক্টর ঔষধটার ভালো রিভিউ দিয়েছে স্যার। এছাড়া খুলনাতেও বেশ সাড়া ফেলেছে।”

ফারিশ কিছু বললো না। ওয়াজিহা আদ্রিতা নামটা শুনতেই বুক কাঁপলো ফারিশের। যন্ত্রণাও হলো বুঝি। আদিব বুঝলো। এগিয়ে এসে বললো,“আপনি ভাই ওখানের একটা চেয়ারে বসুন আমি বাকিটা দেখে নিচ্ছি।’

ফারিশ শুনলো না। জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো,“আমি ঠিক আছি আদিব।”

কথাটা বলে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সবটা। মেয়েটার সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়ছে ফারিশের। অস্থির লাগছে আচমকা। মুখ থেকে অস্পষ্টনীয় বার্তা বের হলো একটু,“এভাবে না ঠকালেও বোধহয় হতো ডাক্তার ম্যাডাম।”
—-
নিঝুম রাত! চুপচাপ হাঁটছে আদ্রিতা। সেদিনের পর চারদিন কাটলো আজ। ফারিশের সাথে চারদিন যাবৎ কথা নেই। ফোন নাম্বার থাকতেও কল দেয়া মানা। আদ্রিতা চাইলেও কল করতে পারছে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ফোন করে কি বলবে তাও জানে না! ক্ষমা চাইবে কি না তাও বুঝচ্ছে না। আর ক্ষমা চাইলেই কি ফারিশ তাকে ক্ষমা করে দিবে! অবশ্যই দিবে না। আদ্রিতা চাইছে ক্ষমা না করলেও ফারিশ কম করে হলেও তার সাথে রাগারাগি করুক। চেঁচামেচি করুক। ছেলেটার এভাবে গুম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আদ্রিতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তার কষ্ট হচ্ছে। একটা ভুল তার পুরো জীবন ওলোট পালোট করে দিলো। কোথাও গিয়ে তার মনে হচ্ছে তার কক্সবাজার যাওয়াই ভুল হয়েছে। না যেত কক্সবাজার, না দেখা হতো ফারিশের সাথে, আর না ওই পুলিশ অফিসারের সাথে। আনমনা রাস্তার কর্ণার থেকে ফুটপাতের রাস্তা থেকে নামলো আদ্রিতা। এরপর পিচঢালা রাস্তা দিয়ে হাঁটলো। তার কিছু ভালো লাগছে না। মাঝরাতে এভাবে হেঁটে বেড়ানোটাও সেইফ না। কিন্তু তবুও আদ্রিতা হাঁটছে। রজনীর রাতে, আলোকিত ল্যামপোস্টের নিচে বিষণ্ণ মন নিয়ে হাঁটছে আদ্রিতা। হঠাৎই উল্টো পথ দিয়ে একটা গাড়ি ছুটে আসলো আদ্রিতার দিকে। সে বিমূঢ় চেয়ে। গাড়িটা সরাসরি আদ্রিতার মুখোমুখি এসে থামলো। গাড়ির লাইটের আলোতে চোখ ধাদিয়ে উঠলো তার। খানিকটা ঘাবড়ানো, আর ভয়ার্ত মুখ নিয়েই সে চেয়ে রইলো গাড়িটির দিকে। চুপ হয়ে গেল গাড়ির স্থির দৃষ্টিতে বসে মানুষটাকে দেখে। ফারিশ বসে। তার গাড়ি ব্রেকফেল করেছিল। ভাগ্যিস এখানে এসে থেমেছে। সে বুঝতে পারে নি এই মুহূর্তে রাস্তার দিকে তার মুখোমুখি আদ্রিতা দাঁড়িয়ে থাকবে। ফারিশের স্থির দৃষ্টি। ফারিশ তার পকেট থেকে ফোন বের করলো। আদিবকে বললো,“আমার গাড়ি ব্রেকফেল করেছিল আদিব। নতুন গাড়ি পাঠাও আমি হসপিটাল রোডে আছি।”

ফোন কাটলো ফারিশ। সে গাড়ি থেকে বের হলো। আদ্রিতা তখনও তার দিকে তাকিয়ে। ফারিশ পুরো গাড়িটা চেক করে বুঝলো সে আসার সময় ভুল করে নষ্ট গাড়ি নিয়ে এসেছে। এই গাড়ির ব্রেকফেল আরো আগেই হয়েছিল। ফারিশ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো ইদানীং কি তার ভুলের পাল্লা ভাড়ি হচ্ছে নাকি।’

ফারিশ একটু একটু করে এগিয়ে আসলো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার বুক ধড়ফড় করছে। ফারিশ বললো,“আমি খুব দুঃখিত হঠাৎ এমন সামনে চলে আসায়। আসলে আমার গাড়ি ব্রেকফেল করেছিল।”

কথাটা বলেই ফারিশ সরে আসলো। আদ্রিতার গলা বুঝি আটকে গেছে। মুখ দিয়ে কথাই বের হতে চাইলো না। সে কি করবে বুঝচ্ছে না বাড়ি চলে যাবে। নাকি দাঁড়িয়ে থাকবে। দাঁড়িয়ে কেন থাকবে? ফারিশের আচরণটাও ঠিক লাগলো না। মনে হলো তাকে চেনেই না। আদ্রিতার বুক ভাড়ি হয়ে আসছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। সে বহুকষ্টে ডাকলো,“মিস্টার বখাটে।”

ফারিশ দাঁড়ালো না মোটেও। গাড়ির চাবি বের করে গাড়িটা লক করে সে হাঁটা ধরলো উল্টোদিকে। আদ্রিতার চোখ বেয়ে পানি পড়লো আচমকা। সে কান্নামাখা মুখশ্রী নিয়েই বলে উঠল,“ফারিশ।”

না চাইতেও ফারিশের পা থেমে গেল। এই অনাকাঙ্খিত মোলাকাত ফারিশ চায় নি। ফারিশকে দাঁড়াতে দেখে আদ্রিতা চোখের পানি মুছতে মুছতে দৌড়ে গেল ফারিশের কাছে। দাঁড়ালো মুখোমুখি। বললো,“আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে ফারিশ?”

ফারিশের স্বাভাবিক মুখভঙ্গি। শান্ত গলা,
“আমার মনে হয় না আপনার আমার সাথে কোনো কথা থাকতে পারে।”
“অবশ্যই আছে।”
“আমি শুনতে চাইবো কেন?”
“সত্যিই কি শোনা যায় না?”

আদ্রিতার বিষণ্ণ মুখ। মলিন কণ্ঠস্বর। ফারিশ চাইলো এবার আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। এতক্ষণ তাকায়নি কিন্তু এবার না তাকিয়ে পারলোই না। ফারিশ ঝুকে গেল আদ্রিতার দিকে। নিশ্বাস ছাড়লো হঠাৎ। সেই নিশ্বাস গিয়ে লাগলো আদ্রিতার মুখপানে। সে চোখ বন্ধ করে আবার খুললো। তবুও নড়লো না। স্থির দাঁড়িয়ে। ফারিশ শীতল স্বরে আওড়ায়,
“যারা মন ভাঙে, দুঃখ দেয়,হৃদয়ে জ্বালাপোড়া ঘটায় তাদের কথা শোনা কি আধও শোভা পায় ডাক্তার ম্যাডাম!”

আদ্রিতা থমকে যায়। মাথা নুইয়ে ফেলে তক্ষৎনাৎ। এ কথার পিঠে কি উত্তর দেয়া যায় সে ভাবে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। উত্তর নেই এ কথার। ফারিশ মলিন হাসে। করুন দেখায় সেই হাসি। ফারিশ নীরব স্বরে আবার শুধায়,
“তোমায় ভালোবেসেছিলাম বলেই দুঃখ দিতে পারলে, নয়তো এই আমিকে দুঃখ দেয়ার সাহস এই ধরণীর কারো নেই।”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। দেরি হয় বলে রাগ করো সবাই আমি জানি। কিন্তু কি করবো চেয়েও লিখতে পারি নি এই দুইদিন🙂]

#TanjiL_Mim♥️.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here