#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৮
নিজের হাইস্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। আজ বহুদিন পর এখানে এসেছে সে। ইচ্ছাকৃত নয়। বিকেলের দিকটায় খুঁটিনাটি বাজার করতে বেরিয়েছিল আদ্রিতা। কাল মৃদুলের বিয়েতে বেশ আনন্দ হইচই করেছে তারা। নয়নতারা আর আশরাফের সাথে বেশ ভাব জমেছে। আসার সময় ফোন নাম্বারও আদান-প্রদান হয়ে গেছে। আদ্রিতা খুশি যাক তাদের ফ্রেন্ড গ্রুপের শেষ সিঙ্গেল ছেলেটাও মিঙ্গেল হওয়ার লাইন ঢুকেছে। চাঁদনীর জন্য খারাপ লাগছে আদ্রিতার। সে শুনেছে আদিব তার সাথে কথা বলছে না। কারণ কি তাও বলছে না। তবে আদ্রিতা জানে এর কারণ কি! কি করবে ভেবে পায় না। আদ্রিতার যে ফারিশের সাথে সম্পর্ক ছিল বা তাদের ভিতরকার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার কিছুই আদ্রিতার বন্ধুমহল জানে না। আদ্রিতা বলে নি। আর বলতেও চাইছে না। কি বলবে তাও একটা প্রশ্ন! নিজের ওপর অত্যাধিক ঘৃণা ধরেছে আদ্রিতার। বিতৃষ্ণায় সবকিছুই শূন্য শূন্য লাগে। আদ্রিতা চেয়েও কিছু করতে পারছে না। ফারিশ তাকে শুনতেই চাইছে না। ফারিশের ওপর আদ্রিতার এসব নিয়ে কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই যা আছে সেটা হলো খারাপ লাগা,ইমোশন। ফারিশের জায়গায় আদ্রিতা থাকলেও সেইম কাজ করতো। কিন্তু আদ্রিতা ফারিশকে কি করে বোঝাবে যে আদ্রিতা এতদিন যা করেছিল তা অভিনয় ভেবে করলেও কোনোটাই অভিনয় ছিল না। সত্যিকারের ভালোবাসা ছিল। সেই গভীর রাতের কনকনে শীতের মাঝে আগুন নিয়ে বসে থাকার সুন্দর মুহূর্তগুলো যেন এখনো আদ্রিতার চোখে ভাসে। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো আদ্রিতার।
আদ্রিতা বন্ধ থাকা স্কুলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার শৈশবের কতকত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই স্কুল নিয়ে। কত হাসি, তামাশা, হুল্লোড়। ইস! আনমনা হেঁসে উঠলো আদ্রিতা। যাকে বলে দুঃখের মধ্যেও হাসি।’
কাল মৃদুলের বৌ-ভাত। আদ্রিতাদের সকাল সকালই যেতে বলেছে সেখানে। আপাতত হসপিটাল থেকে তিনদিনের ছুটি নেয়া। আদ্রিতা আর দাঁড়ালো না। বিকেল হয়েছে বাড়ি ফেরা দরকার। আদ্রিতা উল্টোদিকে হাঁটা ধরলো। আদ্রিতার বাড়ি এদিকে নয়। অথচ আজ আনমনা হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে আসলো। এলাকাটা খুব নিরিবিলি। বিশেষ করে চারটার পর। পুরো স্কুল ফাঁকা থাকে আর আশপাশটাও। আদ্রিতার যেতে যেতে মনে পড়লো এই পথ দিয়েই একসময় কাঁধে স্কুল ব্যাগ, গায়ে ইউনিফর্ম জড়িয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। তখন আদ্রিতারা এই কাছেই একটা দোতলা বাড়িতে ভাড়া থাকতো। এখন নিজেদের বাড়ি হয়েছে বাবা করেছেন সেখানেই থাকে। স্কুল থেকে বেশ দূরে তার অবস্থান। আদ্রিতা পুরনো স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে আস্তে আস্তে হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে চললো। চারপাশ চুপচাপ। হঠাৎ আদ্রিতার মনে হলো কেউ বুঝি তার পিছন পিছন আসছে। আদ্রিতা পিছন ঘুরে চাইলো কিন্তু না কিছুই নেই সব ফাঁকা। খুব একটা ভাবলো না সে হাঁটা ধরলো। আবারও শোনা গেল কারো পায়ের পদধ্বনি তাও একজন না দুজনের। আদ্রিতা আবারও ঘুরলো কিন্তু কাউকে দেখে হাঁটলো। হয়তো মনের ভুল।’
আদ্রিতা হাঁটতেই একটা গলির ভিতর থেকে দুটো ছেলে বের হলো। কাউকে ফোন করে বললো,“গলির মুখে গাড়ি নিয়ে আয় বলির পাঠা পাইয়া গেছি।”
কথাটা বলেই আদ্রিতার থেকে দূরত্ব নিয়ে ওর পিছু পিছু হাঁটলো।’
আচমকাই গা ঘেঁষে একটা গাড়ি থামতেই আদ্রিতা চমকে উঠলো। ঘাবড়ে গেলো খানিকটা। হাত ফসকে পড়ে গেল হাতের ব্যাগটা। ব্যাগ থেকে পড়ে গেল কিছু আলু পেঁয়াজ। আদ্রিতা বিচলিত হয়ে নিচে বসে সেগুলো ওঠাতে ব্যস্ত হলো। গাড়ি চালিত মানুষটি দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো। হতভম্ব স্বরে নিচে বসে বললো,“আপনি ঠিক আছেন তো আসলে আমি..
পুরো কথা শেষ করার আগেই আদ্রিতাকে দেখে চোখমুখ খিঁচে ফেললো আদিব। কারণ গাড়ি চালক আর কেউ নয় আদিব ছিল। আদ্রিতাও তার দিকে তাকিয়ে বললো,“আদিব,
আদিব উঠে বিনা বাক্যে হাঁটা ধরলো। আদ্রিতা দ্রুত উঠে দাড়িয়ে বললো,“আদিব ভাইয়া যাবেন না প্লিজ।”
আদিব একটু দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা ধরলো। আদ্রিতা অসহায় ন্যায় বললো,“প্লিজ ভাইয়া যাবেন না।”
খুবই করুণ কণ্ঠস্বর আদ্রিতার। আদিবের মায়া হলো সে দাঁড়ালো। আদ্রিতা দৌড়ে গিয়ে আদিবের মুখোমুখি দাঁড়ালো। বললো,“আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। তবুও আমার সাথে কি একটু কথা বলা যায় না।”
আদিব আর ফারিশের মতো করে বলতে পারলো না,“না যায় না। সে করুণ দৃষ্টি ফেললো আদ্রিতার দিকে। মেয়েটার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আদ্রিতা দারুণ অনুতপ্ত। আদিব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,“এত কিছু তো করলেন আর কি করতে চান?”
আদ্রিতা কেঁদে উঠলো হঠাৎ। আদিব ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল তাতে। উত্তেজিত হয়ে বললো,“আরে আরে কাঁদছেন কেন?”
আদ্রিতা কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিলো,“আমি আপনাদের কি করে বোঝাবো যে আমি ফারিশের সাথে অভিনয় করি নি।”
আদিব অবাক হলো খুব। কথার অর্থ না বুঝে বললো,“মানে।”
আদ্রিতা উত্তর দিতে পারলো না। তার চোখ বেয়ে অজস্র হারে পানি পড়ছে। আদিব কি করবে বুঝতে না পেরে দ্রুত গাড়ির কাছে ছুটে গেল। গাড়ির ভিতর থাকা পানির বোতলটা এনে আবার এগিয়ে আসলো আদ্রিতার দিকে। পানিটা এগিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললো,“খান।”
আদ্রিতা পানির বোতলটা নিলো ঢকঢক করে পানিটা গিলে বললো,“ধন্যবাদ।”
আদিব আর আদ্রিতা গিয়ে বসলো সামনের ফুটপাতের রাস্তার উপর। আদিবের গাড়ি পাশেই। আদিব শান্ত ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,“বলুন কি হয়েছে?”
আদ্রিতা ছলছল নয়নে আদিবের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমায় কি একবার ক্ষমা করা যায় না?
আদিব জবাব দেয় না। আদ্রিতা আবার বলতে থাকে,
“আমি মানছি আমি ভুল করেছি। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় বলুন। ওই পুলিশ অফিসার আমায় ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করে কাজটা করতে বলেছিল। আমি হাজারবার বারণ করেছি কিন্তু শুনতে চায় নি। আমার ফারিশকে প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল। সেই যে এক পশলা ঝুম বর্ষায় সে আহত অবস্থায় আমার হসপিটাল এসেছিল সেদিন থেকেই। লোকটার কথা বলার স্টাইল, এটিটিউড সব আমার ভালো লেগেছিল প্রথম দিনই। কিন্তু ওইদিন আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই। উনি আমার পিঠে ছুরি বসিয়ে কিছু মানুষকে মিথ্যে বলতে বলে সে এখানে আসেনি। আমিও আতঙ্কিত হয়ে মিথ্যে বলি। পরেরদিন সকালে খবরে দেখানো হয় এক মাফিয়া হসপিটালে ঢুকে। আপনি বলুন আমার কি খটকা লাগবে না। এরজন্য বন্ধুদের ওনার কথা বলতেই তারা আমায় পুলিশ স্টেশন নিয়ে যায়। জানি উনি কোনো মাফিয়া টাফিয়া কিছু না একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক। ওইদিন প্রথম অনুতপ্ত হই। তারপর উনি আমায় ধরে নিয়ে যায়। আমাদের কক্সবাজারে সাক্ষাৎ হয়। ওনার সাথে আমার যতবার দেখা হতো আমি ততবারই মুগ্ধ হতাম। দারুণ ভালো লাগতো ওনাকে, ওনার রাগটাকে। আলাদা অনুভূতিও তৈরি হয় ওনার প্রতি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি। আমি ওনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। যেই মুহূর্তে আমি বিষয়টা বুঝবো সেই মুহূর্তেই কিশোরের আগমন। ওনার কথা শুনে আমি ফারিশের সাথে একটু ঘনিষ্ঠ হই। আমি নিজের দিক থেকে তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোকে অভিনয় করছি ভাবতাম। কিন্তু ওগুলো আসলে অভিনয় ছিল না। প্রতিটি মুহূর্ত আমার ভিতর থেকে আসা চরিত্র ছিল। আমি অভিনয় করছি ভাবলেও আমি অভিনয় করি নি। ফারিশের সাথে কাটানো সময়টুকুতে আমার কোথাও মনে হয় নি সে খারাপ। বা মাফিয়া। তার সাথে মেশার আগেও আমি জানতাম না সে আধোতেও মাফিয়া কি না। এখনও তো জানি না। তবে আমি বিশ্বাস করি ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়। আমাদের বিচ্ছেদ ঘটার দু’দিন আগে থেকে ফারিশ আমায় কিছু বলবে বলবে বলেও বলছিল না। আমি ভেবেছিলাম সেই কথাগুলো যদি মাফিয়া রিলেটেড কোনো কথা না হয়। কিশোরকে তার রেকর্ড শুনিয়ে মুখের উপর বলবো,“বিশ্বাস হলো আপনার। আমার ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়।” – এরপর আমি আর ফারিশ বিয়ে করে সুখে থাকতাম। কিন্তু তার আগে আমি এগুলো সব বলতাম। কিন্তু দেখেন কি করে সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমি শুরুটা অভিনয় দিয়ে করলেও কোনোটাই অভিনয় ছিল না। আমি কি করে বুঝাই ফারিশকে। আমার খুব কষ্ট হয় আদিব। আমি সত্যিই ফারিশকে ভালোবাসি। তার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই। বাঁচতে চাই নতুন করে।”
বলতে বলতে আবার কেঁদে উঠলো আদ্রিতা। আদিব কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার কি সান্ত্বনা দেয়া উচিত নাকি রাগ দেখানো উচিত বুঝতে পারছে না।’
আদিব স্নেহময় হাতে আদ্রিতার মাথায় হাত বুলালো। বললো,“কি বলবো সত্যি বুঝচ্ছি না।”
আদ্রিতা ছলছল নয়নে তার পানে তাকিয়ে বলে,“আমায় কি একবার ক্ষমা করা যায় না?”
আদিব উত্তর দিতে পারে না। তার ফোন বাজে। একটা ইমারজেন্সি কাজের জন্যই এদিকে এসেছিল আদিব। ফারিশের আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে হঠাৎ মত বদলায়। আদিবও জোর করে নি। আদিব বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বলে,“আমায় যেতে হবে।”
আদ্রিতাও বারণ করে না। চোখ মুছে বলে,
“লাস্ট একটা কথা বলবো ভাইয়া?”
আদিব মাথা নাড়িয়ে বলে,“বলুন?”
আদ্রিতাও উঠে দাঁড়ায়। মায়াভরা কণ্ঠে বলে,“আমার জন্য চাঁদনীকে ছাড়বেন না ভাইয়া ও এসব বিষয়ে কিছু জানে না। কিছু না। শুধু ও না আমার বন্ধুবান্ধব কেউই এসবের কিছু জানে না। আমার জন্য ওকে শাস্তি দিবেন না।”
আদিব এবার এ কথার উত্তর দেয় না। ছোট করে বলে,“ভালো থাকবেন।”
বিনিময়ে মৃদু হাসে আদ্রিতা। আদিব গাড়িতে উঠে বসে। তার ওদিকে যেতে হবে। না হলে আদ্রিতাকে সে বাড়ি পৌঁছে দিত। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল আদিব।
আদ্রিতাও আর বসে রইলো না। সন্ধ্যা নামবে তাকে দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। আদ্রিতা তার ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা ধরলো।’
এতক্ষণ পর সামনের মেয়েটাকে একা পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো পিছনের ছেলেদুটো। এতক্ষণ তারা গলির মুখে লুকিয়ে ছিল। আদিবের গাড়িটা গলির মুখটা ছাড়াতেই। আচমকা আরেকটা বড়গাড়ি এসে থামলো আদ্রিতার মুখোমুখি। আদ্রিতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির দরজা খুলে তাকে জোর জবরদস্তি উঠিয়ে নিলো গাড়িতে। হাত থেকে বাজারের ব্যাগ পড়ে গেল নিচে। আদ্রিতা চেঁচানোর আগেই মুখে রুমাল চেপে ধরলো আগন্তুকরা। সঙ্গে সঙ্গে সে লুটিয়ে পড়ে গাড়ির ভিড়ে। ধীরে ধীরে চারপাশটা হয়ে গেল অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার।”
—-
বেশ কয়েকদিন পর আজ নিজের ঔষধের কোম্পানিতে পা রেখেছে ফারিশ। এতদিনের সব ঝামেলার জন্য এদিকটায় খুব একটা নজর পড়ে নি তার। ফারিশ জোরে নিশ্বাস ফেললো। এরপর আস্তে আস্তে ঢুকে গেল ভিতরে।”
#চলবে…..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️.