#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বিদ্যুৎ এসেছে কিছুক্ষণ আগে৷ বৈঠকখানায় বসে আছেন শাহাদাৎ মোড়ল। উনার সামনেই মুখোমুখি বসেছে প্রলয় আর অর্পণ। উনার বাম পাশে বসেছে আরশ। হাসপাতাল নিয়েই মূলত উনাদের কথাবার্তা চলছিল৷ হাসপাতাল হরদমে চালু করতে চাইছেন শাহাদাৎ মোড়ল। বৈঠকখানায় বসে এই প্রস্তাবটা রেখেছেন তিনি৷ উনার কথানুযায়ী সবাই রাজি। আরশও নিজের মতামত প্রকাশ করল।
“মেডিকেল ক্যাম্প করলে কেমন হয়? ঢাকা অথবা অন্য জায়গা থেকে ভালো ভালো ডাক্তার আনা হবে রোগী দেখার জন্য। এভাবে আমাদের হাসপাতালও চালু হবে আর গরীব অসহায় মানুষরা সেবাও পাবে৷ আমার তো এখনো মাস ছয়েক ঢাকা থাকতে হবে বাবা। তার আগে তো পুরোপুরি ভাবে আমি গ্রামে আসতে পারছি না৷”
আরশের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনল। তার কথা শেষ হবার পরপরই অর্পণ বলল‚ “আরশের সঙ্গে আমিও এক মত আঙ্কেল৷ এখানে হসপিটালে ক্যাম্প হলে মন্দ হবে না।”
এতক্ষণ চুপ থেকে সবার কথা শুনছিল প্রলয়৷ মনে মনে একটা সিদ্ধান্তই নিয়েছে সে। মানা না মানা বাকিদের ব্যাপার। প্রলয় এবার নিজে থেকেই বলল‚
“আমি কী একটা প্রস্তাব রাখতে পারি?”
“হ্যাঁ বাবা বল।”
“হসপিটালের পাশেই একটা ফার্মেসির ব্যবস্থা করে দিতে চাই৷ ঢাকা থেকে সব ধরনের ঔষধ এখানে আনা হবে৷ গরীবদের জন্য ডক্টর প্যাসক্রাইভ করা ঔষধ স্বল্প মূল্যে দেওয়া হবে৷”
“প্রস্তাবটা কিন্তু খারাপ না৷ এ কথা আগে মাথায় আসেনি৷ হাসপাতালের প্রাঙ্গণে একটা বড়ো ঘরের মতো রয়েছে ওখানে ফার্মেসি তৈরি করলে মন্দ হবে না।”
“তাহলে কালই সব বন্দবস্ত করে ফেলা হবে ইনশাআল্লাহ।”
একটু থেকে প্রলয় আবারও বলল‚
“গ্রামের কিছু কিছু জায়গায় কলের ব্যবস্থা করা উচিত৷ নদীর ধারে ব্রিজটাও পুরোপুরি ভাবে হয়নি৷ শুনেছি কলেজটাও নাকি ওপাড়ে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জটিলতা বাড়ছে৷ তাদের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই কথা বলব৷”
অতি উচ্ছ্বাস সহিত অর্পণ বলে উঠল‚ “আমার ভাই সবসময় জনগনের সেবায় নিয়োজিত।”
চোখ রাঙিয়ে তাকাল প্রলয়৷ নিজের প্রশংসাগীতি শুনতে তার মোটেও ভালো লাগে না। প্রলয় আবারও বলল‚
“তবে আঙ্কেল একটা জিনিস খেয়াল রাখবেন— এসব কাজে আমার নামটা জড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমার কাজ জনগনের সেবা করা‚ নিজের পাবলিসিটি নয়।”
শাহাদাৎ মোড়ল ভীষণ খুশি হলেন প্রলয়ের কথায়৷ গত সংসদ নির্বাচনের সময় কত কত ওয়াদা করেছিলেন এমপি পদের প্রার্থীরা। অথচ কোনো কাজই সুষ্ঠু ভাবে সম্পূর্ণ হয়নি। সরকার থেকে তো অনুদান কম আসছে না। গত কাউন্সিলর ভোটে কত কত প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন প্রার্থীরা। বয়স্ক ভাতা‚ প্রতিব’ন্ধী ভাতা‚ বিধবা ভাতা আরও কত ভাতা‚ অনুদান— সবই নাকি আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। অথচ সেগুলো পায় হাতে গোনা কয়েকজন। বাকি ভাতা গুলো কোথায় যায়?
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে মেয়েদের রাখতে পছন্দ করেন না শাহাদাৎ মোড়ল। তার একটা কারণ হলো‚ বাড়ির মেয়েরা যেহেতু এসব ক্ষেত্রে জড়িত নয় তাই তাদের এসব ক্ষেত্রে না টানাই ভালো। মেয়েকে শিক্ষিকা হতে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। অথচ উনার মেয়ে হবে কি-না জার্নালিস্ট। তবুও তিনি মেয়ের স্বপ্নকে সম্মান করেন শাহাদাৎ মোড়ল৷ নাজমা সব কথাই শুনলেন। প্রলয়ের কথায় তিনি খুবই প্রসন্ন। উনার মতে এমন এমপি প্রতেকটা জেলায় জনকল্যাণের জন্য থাকা উচিত।
নাজমা গিয়ে বসলেন স্বামীর পাশে। সঙ্গে সঙ্গে ইরাও গিয়ে বসল তার মায়ের পাশে। অনেকক্ষণ ধরেই একটা কথা বলার জন্য হাঁসফাঁস করছে সে৷ সবাই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিল বিধায় কিছু বলার সাহস হচ্ছিল না৷ এই তো এখনই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ ধরা দিয়েছে৷ মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ইরা বলল‚
“মা তুমি কী মহুয়া আন্টির মেয়েকে কখনো দেখেছ?”
“হঠাৎ তুই মহুয়ার মেয়েকে নিয়ে পড়লি কেন?”
“উফ তুমি বলোই না।”
“আমি দেখিনি তবে মিন্টুর বোনের থেকে শুনেছিলাম— মেয়েটা নাকি অনেক সুন্দরী। বাড়ি থেকে বেরই হয় না৷ সারাটাদিন একা বাড়িতে পড়ে থাকে। মণির সঙ্গেই তো মহুয়ার মেয়ে পড়ত।”
ভূমির প্রতি আগ্রহ বাড়তে লাগল ইরার৷ এত বছর ধরে মহুয়া তাদের বাড়িতে কাজ করছে কিন্তু কখনও এইসমস্ত কথা জানতে চাওয়া হয়নি৷ কিন্তু আজ ভীষণ করে জানতে চাইছে সে। ইরা তার মাকে জিজ্ঞেস করল‚ “এখন পড়ে না?”
“না রে। মেয়েটা মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা করেনি৷ পড়াশোনায় নাকি খুব ভালো ছিল৷ আর খুব ভালো নাচ করে৷”
“মেয়েটাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে৷ আচ্ছা মেয়েটার নাম কী?”
“ভূমি।”
❑
আঁধারিয়া মেদিনী ধূসর রঙে সাজিয়েছে নিজেকে৷ সময় অতিবাহিত হবার সঙ্গে সঙ্গে নিজের রূপ পালটে হয়তো আলোয় আলোকিত হবে সমগ্র। ভূমির ঘুম ভেঙেছে সেই কাক ডাকা ভোরে৷ উঠেই হাতের কাজ সব সেরেছে। রাতের কিছু এঁটো বাসন ছিল সেগুলোও ধুয়ে দিয়েছে৷ এরপর আম্মাকে ডেকেছে। মা মেয়েতে মিলে ফজরের নামায আদায় করবে বলে৷
‘চিল কাকের সঙ্গে উড়ে যা।’ কথাটা বলেই মুরগীটাকে টিনের চালে উড়িয়ে দিল ভূমি। একাকী খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সে৷ এমন করাটা তাকে মণি শিখিয়েছে। এটা বেশ কাজেও দিয়েছে। আজ অবধি তার একটা মুরগীর বাচ্চাও চিল বা কাক নেয়নি। খাঁচায় নাদুসনুদুস বাচ্চাগুলো তাদের মাকে খুঁজে না পেয়ে চিঁচিঁ করছে। সেই আওয়াজ অনুসরণ করে মুরগী টিনের চাল থেকে নেমে পড়ল৷ মাটি ঠুকরে বাচ্চাগুলোকে কাছে ডাকছে। ডিম থেকে গুনে গুনে চৌদ্দটা বাচ্চা ফুটেছে। আম্মা পানি নিয়ে এলেই বাচ্চাগুলো দেখাবে৷
মোড়ল বাড়িতে….
রান্নাঘরে সবজি কাটছিলেন মহুয়া। টাটকা মাছ সবজি সকালে মিন্টুকে দিয়ে কিনিয়ে আনেন শাহাদাৎ মোড়ল। প্রতিদিনকার কাঁচাবাজার প্রতিদিনই আনা হয় মোড়ল বাড়িতে। মাছ আগে থেকেই কা’টিয়ে আনা৷ সবজি আর শাকও বেছে নিয়েছিলেন মহুয়া৷ এবার শুধু রান্না করাটাই বাকি। তখনই উপস্থিত হলো ইরা। রান্নাঘরে তার দেখা সচরাচর মেলে না। আজ এসেছে হয়তো কোনো কাজ আছে৷ মহুয়া হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন‚
“তোমার কী কিছু লাগবে? তাহলে আমাকে বল আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
“আমার কিছু লাগবে না আন্টি।”
একটু থেকে ইরা আবারও বলল‚
“মহুয়া আন্টি আমার একটা আবদার আছে তোমার কাছে।”
সবজি কা’টা থামালেন মহুয়া৷ ইরার দিকে তাকিয়ে বললেন‚ “কী আবদার মা? তুমি বল— আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব পূরণ করার।”
“ভূমিকে একবার আমাদের বাড়িতে আসতে বলবে? ওকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে৷”
হকচকিয়ে গেলেন মহুয়া৷ ছোটো বেলা থেকেই মেয়েটা বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যায়নি। স্কুলেও খুব ভয়ে ভয়ে যেত। ওর উপস্থিতি কারো পছন্দ ছিল না৷ মেয়েরা ঠাট্টা তামাশাই করেছে বেশি৷ হাতে গোনা দুজন বন্ধু ছিল ভূমির। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মেয়েটাকে আর পড়াশোনাও করতে পারলেন না তিনি৷ গ্রামে একটাই বেসরকারি কলেজ। কলেজের খরচও আকাশচুম্বী। একা হাতে সংসার আর মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারলেন না মহুয়া৷ সমাপ্তি টানতে হলো পড়াশোনার অধ্যায়কে৷
“আমার মেয়েটা খুবই অন্তর্মুখী আর ভীতু স্বভাবের৷ বেশি মানুষের মাঝে গেলে হতভম্ব হয়ে পড়ে। আমি মণিকে বলছি ওকে ডেকে নিয়ে আসতে।”
প্রসন্ন মনে ঘাড় কাত করে সায় জানাল ইরা৷ বাড়ির পুরুষরা এখন বাড়িতে নেই। সবাই হাসপাতালে গিয়েছেন। আসতে হয়তো দেরি হতে অয়ারে। ইরা মিন্টুকে ডাকল‚
“মিন্টু ভাই একটু এদিকে আসেন তো।”
ইরার ডাকে বাগান থেকে ছুটে এলো মিন্টু৷ এসেই জিজ্ঞেস করল‚
“কী হইছে আফামণি— কোনো দরকার?”
“তুমি একটু বাড়িতে গিয়ে মণিকে ডেকে আন। বল আমি ডাকছি।”
“আইচ্ছা।”
কথাটা বলেই যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবে ছুটে চলে গেল মিন্টু৷ মিনিট পাঁচেকের মাথায় তার ছোটো বোন মণিকে নিয়ে এলো। এবার আর ইরা কিছু বলল না। মহুয়া নিজে থেকেই বললেন‚
“ভূমিকে একটু নিয়ে আয় তো মা৷ আর শোন— বলবি ভালো জামাকাপড় পড়ে আসতে।”
শেষোক্তটি কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললেন মহুয়া৷ উনার কথার প্রত্যুত্তরে মণি বলল‚ “আইচ্ছা খালা।”
ইরা খাবার টেবিলের চেয়ার টেনে সেখানেই বসল। মহুয়া টেবিল পরিষ্কার করতে লাগলেন। এঁটো বাসন গুলো রান্না ঘরে রেখে এসেছেন৷ এবার শুধু দুপুরের রান্নার শেষ করার পালা। তাহলে বড়ো কাজটা থেকে নিস্তার পাবে।
সবে যহরের নামায আদায়ের জন্য জায়নামায বিছিয়েছে ভূমি। এরই মাঝে উঠোনের কাছে কারো গলার আওয়াজ ভেসে আসছে৷ প্রথমে বুঝতে পারল না— কে এভাবে ডাকছে! পরবর্তীতে মণির কথা মাথায় এলো। হ্যাঁ! এ তো মণির কণ্ঠস্বর। জায়নামাযটা একটু ত্যারচা ভাজ করে ঘর থেকে বের হলো ভূমি। তার ভাবনাই ঠিক। টিনের বেড়া সরিয়ে দেখতে পেল‚ মণি কোমরে হাত গুজে হাঁপাচ্ছে। মেয়েটা কী ছুটে এসেছে? কিন্তু কেন? ভূমিকে দেখতে পেয়েই মণি লম্বা নিশ্বাস নিল। এরপর বাড়ির ভেতরে ঢুকল। প্রবেশদ্বার আটকে ভূমি গেল মণির পেছন পেছন। মণি এবার বলল‚
“তোরে খালা আমার লগে যাইতে কইছে।”
“কোথায় যাব আমি?”
“মোড়ল বাড়িত।”
অবাক হলো ভূমি। হঠাৎ ও বাড়ি থেকে তার ডাক এলো কেন? আম্মার কিছু হয়নি তো? কথাটা ভাবতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ভূমির। ত্রস্ত ভারী কণ্ঠে শুধাল‚
“আ…আম্মার কিছু হয়েছে?”
ব্যকুল অষ্টাদশী কন্যা মুহূর্তেই অধৈর্য হয়ে পড়ল৷ কণ্ঠনালি দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না। সে মণিকে প্রত্যুত্তরের সুযোগ পর্যন্ত দিল না। আবারও জিজ্ঞেস করল‚
“কী হলো কিছু বলছিস না কেন? আম্মা ঠিক আছে তো?”
“কইতে তো দিবি। খালা ঠিক আছে। খালা আমারে পাঠাইছে তোরে নিয়া যাইতে৷ কারণ জানতে চাইস না। আমারেও কিছু কয় নাই খালা।”
“নামাযটা পড়ে নিই৷”
মণি ঘাড় কাত করে সায় জানাল‚ “আইচ্ছা।”
চলবে?…..