রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৭| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
246

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

“আম্মা তুমি আমাকে ডেকেছিলে? হঠাৎ এখানে কেন ডাকলে আম্মা?”

মেয়ের শান্ত মোলায়েম কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই হাত থেমে গেলেন মহুয়ার৷ সোনালি রোদ আছড়ে পড়ছে৷ বাগানে ভেজা কাপড়চোপড় মেলছিলেন তিনি। রান্নাবান্না কাজ শেষ হতেই সাবান পানিতে ভিজিয়ে রাখা ময়লা কাপড়চোপড় গুলো ধুয়ে নিলেন তিনি। ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে তাকাতে চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। অনেকটা সময় রোদের দিকে তাকিয়ে থেকেই হয়তো এমনটা হচ্ছে। কিছুটা সময় নিলেন মহুয়া। এরপর বললেন‚

“এখানে যেহেতু ডেকেছি তার মানে কোনো একটা দরকার তো নিশ্চয়ই রয়েছে।”

“কিন্তু এ বাড়িতে আমাকে কীসের দরকার আম্মা?”

“হাতের কাজটা শেষ করতে দে— বলছি সব।”

ভূমিও মায়ের হাতে হাতে সাহায্য করতে শুরু করল। যাতে করে এই খাঁখাঁ রোদ্দুরে তার আম্মাকে বাহিরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। মহুয়া বারণ করলেন তবে এ মেয়ে শুনলে তো? কাজ শেষ হতেই মহুয়া মেয়েকে নিয়ে বিশাল বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন। উনার হাতে একটা বালতি৷ আরেকটা বালতি ভূমির হাতে। খাবার টেবিলের চেয়ার টেনে বসে ছিল ইরা৷ ভূমির আসার অপেক্ষাতেই প্রহর গুনছিল সে৷ অপেক্ষা প্রহর যে কতটা কঠিন আজ হারে হারে টের পেয়েছে৷ হঠাৎ করেই ইচ্ছে হলো মহুয়া আন্টির মেয়ে দেখবে৷ দেখবে মানে দেখবেই!

মহুয়ার সঙ্গে একটা মেয়েকে আসতে দেখে ইরা উঠে দাঁড়াল। সে ধরেই নিয়েছে এটাই মহুয়া আন্টির মেয়ে৷ কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে এগিয়ে গেল সে৷ ভূমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“তোমার নাম কী?”

ভূমি একবার তার মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পেতেই অপ্রতিভ কম্পিত কণ্ঠে বলল‚

“ও…ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি।”

ভূমির কাঁধে হাত রেখে ইরা বলল‚ “বাহ্! নামের মতই তুমি খুব সুন্দর।”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ভূমি। প্রত্যুত্তরে কী বলা উচিত জানা নেই তার৷ ইরা মহুয়ার কাছে অনুমতি চাইল‚

“আন্টি ভূমিকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাই?”

মহুয়া একবার মেয়ের দিকে তাকালেন। উনার বোকাচণ্ডী যে কিছুই বুঝতে পারছে না৷ মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে মহুয়া বললেন‚

“ও কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের। এখানে আমাকে ছাড়া আর কাউকেই তো ও চেনে না তাই কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছে।”

“তুমি চিন্তা কোরো না আন্টি। আমি তো ওর বন্ধু।”

মহুয়া নিঃশব্দে অনুমতি দিলেন। ইরা এগিয়ে এসে ভূমির হাত ধরল। যারপরনাই বিস্ময়াভিভূত অঙ্গনা সেখানেই বরফের ন্যায় থমকে দাঁড়াল। সে যাচ্ছে না দেখে ইরাও থেমে গেল। সে জিজ্ঞেস করল‚

“কি হলো থেমে গেলে কেন?”

কম্পিত কণ্ঠস্বরে ভূমি বলল‚ “আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে৷ যদি বলতেন আমাকে এখানে কীসের জন্য আনা হয়েছে? আমাকে কী কোনো কাজ করতে হবে।”

অনুদ্ধত স্বীকারোক্তি ভূমির৷ ইরা বুঝিয়ে বলল‚

“তেমন কিছুই না। আমি তো তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই৷ তাই তো তোমাকে এত তাড়াহুড়োর মাঝে নিয়ে আসা হলো৷ আমাকে কী তোমার পছন্দ হয়নি?”

“তেমন কিছুই না আপু।”

“আপনি বা আপু কোনো সম্বোধন নয়। তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকবে। আজ থেকে আমরা বন্ধু। আর হ্যাঁ বন্ধকে কেউ আপনি বলে ডাকে না৷ তুমি আমাকে তুই করেও বলতে পার!”

ধনী পরিবারের মেয়েকে কী আর তুই করে বলা যায়? কস্মিনকালেও না৷ ভূমি বলল‚

“তুমি করেই বলব।”

“আচ্ছা। এবার চল‚ তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে যাই।”

ইরাকে অনুসরণ করল ভূমি। চকচকে শ্বেত টাইলসের সিঁড়ি ভেঙে উপরের দিকে উঠছে ইরা। নিচ তলা থাকে উপরের তলা আরও বেশি সুন্দর আর পরিপাটি। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ভূমি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে৷ বেখেয়ালিতে কখন যে মাথায় পেঁচিয়ে রাখা ওড়না পড়ে গিয়েছে টেরই পেল না৷ লম্বা বিনুনি হেঁটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠছে। ইরা সামনে থাকায় ভূমিকে তেমন খেয়াল করেনি।

সকালে নাস্তা করেই বের হয়েছিলেন শাহাদাৎ মোড়ল। কালকের কথানুযায়ী আজ হসপিটালে যাওয়া হয়েছিল৷ প্রলয়‚ অর্পণ আর আরশও গিয়েছিল৷ কাল রাতেই উপরের মহলে ঔষধ আর ব্রিজের কাজের কথাটা জানিয়েছিল প্রলয়৷ তার এক কথাতেই কাজ হয়ে গিয়েছে৷ এই সপ্তাহেই সব কাজ শুরু হয়ে যাবে। গ্রামে বেশ কয়েকটা জায়গায় চাপকলের ব্যবস্থা করা হবে৷ অর্পণকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে প্রলয়। ওর নাকি শরীর টা খারাপ লাগছিল। বাহির থেকে স্যালাইন আর পানি কিনে গুলিয়ে খেয়েছিল৷ এরপর প্রলয়ের কথাতেই হাসপাতাল থেকে প্রস্থান নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে৷ অর্পণকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে প্রলয় আবারও কোথাও একটা যাচ্ছিল। তখনই দেখতে পেল কালকের সেই মেয়েটাকে৷ পুষ্করিণী পাড়ে এই মেয়েটাকেই সাহায্য করেছিল৷ মেয়েটাকে মোড়ল বাড়িতে বেশ অবাকই হলো সে।

প্রলয়কে দেখা মাত্রই ক্ষিপ্রবেগে ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে নিল৷ লোকটাকে চিনতে তার এক মুহূর্ত সময় ব্যয় হয়নি। এই লোকটাই তো কাল তাকে বাঁচিয়েছিল৷ আঁটসাঁট হয়ে ইরার পাশে দাঁড়িয়ে রইল ভূমি৷ ওদের দুজনকে যাওয়ার জন্য পথ করে দিল। অর্থাৎ প্রলয় সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। বাহিরে রোদ থেকে আসার কারণে মাথা ধরেছে৷ চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে৷ ফোন একবার সময় দেখে নিল প্রলয়। এরপর উল্টো ঘুরে যেতে লাগল। হঠাৎই ভূমিকে পরিপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করল ইরা৷ বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল‚

“মাশাআল্লাহ! তোমার চুল এত ঘন আর লম্বা? আমি এর আগে কখনো এত সুন্দর চুল দেখিনি। আমি তো তোমার চুলের প্রেমে পড়ে গেলাম।”

আগে কখন নিজেকে নিয়ে প্রশংসিত হয়নি ভূমি। ইরার মুখে এমন কথা শুনে অতীব লজ্জাপীড়িত হলো সে। সলজ্জে ক্ষীণ হাসল সে।

চলে যাওয়ার আগে ইরার কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই থমকে দাঁড়াল প্রলয়। সমস্ত লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে একটিবার পেছন ফিরে তাকাল। কোমর ছড়ানো ঘন দিঘল বিনুনি। হঠাৎই অনুভূত হলো বুকের মাঝে প্রলয়ঙ্কারী তরঙ্গ বাজছে। দৃষ্টি স্থির হলো কিছু সময়ের জন্য। হৃৎস্পন্দন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এ কী দোটানায় পড়ল সে৷ চুলের ভারে মেয়েটা পড়ে না যায়! আচ্ছা খোপা করলে কী— মাথার চাইতেও খোপাটা বেশি বড়ো হয়? আরও অনেক কিছুই ভাবল প্রলয়৷ মাথাটা ঝেড়ে সমস্ত আজগুবি ভাবনাকে দূর করল। বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেল নিজের বরাদ্দকৃত কামরায়৷ অর্পণ হয়তো ফ্রেশ হতে গিয়েছে৷ বাহিরে রোদের ছটা অত্যন্ত উত্তাপ ছিল৷ এখন নিজেরই গরম লাগছে। গোসল করতে পারলে ভালো লাগছে। গরম সহ্য হয় না তার।

নাজমা এসে আরেকদফা গুণকীর্তন করে গেলেন ভূমির৷ মেয়েটার প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই সুন্দর নয় কি-না। এমন সুন্দরী মেয়েকে যেকেউ-ই পুত্রবধূ করতে চাইবে। উনার মনেও এমন ভাবনা বার কয়েক উঁকি দিয়েছে ইতিমধ্যেই।

মেঘমালা রং পাল্টেছে। মধ্যাহ্ন পেরিয়ে অপরাহ্ণে এসে ঠেকেছে। আজ হাতের কাজ তাড়াতাড়ি মিটিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন মহুয়া। খালি বাড়ি রেখে মেয়েটা মোড়ল বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল। অজানা আশঙ্কা মনে গাঁথিয়েই বেরিয়েছিল মেয়েটা। ভূমিকে দেখা মাত্রই মুরগী গুলো ছুটে এলো। হয়তো ক্ষিধে পেয়েছে ওদের৷ সেই যে সকালে খাবার দিয়েছিল তারপর আর খাবার দেওয়া হয়নি। বাচ্চা গুলোও ক্ষিধের তাড়নায় চিঁচিঁ করছে৷ ভূমি দ্রুত ঘর থেকে খুদের কৌটা নিয়ে এলো। খাবার দেখে সবগুলো এসে হাজির হলো তার পায়ের কাছে। কয়েক মুঠো খুদ উঠোনে ছিটিয়ে দিল ভূমি। আছরের নামায আদায় করা হয়নি এখনো। গোসলঘর থেকে ওযু করে এলো সে। মহুয়া এতক্ষণে ওযু করে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

ঘরের কোণায় কুপি জ্বলছে৷ যামিনী নামতেই গাছের পাতাগুলো মূর্ছা গেল। তাদেরও বিশ্রামের প্রহর নেমেছে৷ ঘন তমসাচ্ছন্ন ঘুটঘুটে সর্বত্র। হরিদ্রাভ টিমটিমে আলোতে মাদুর আর তার উপর মোটা কাঁথা বিছিয়ে নিল ভূমি। রাত হয়েছে৷ ঘুমোনোর সময়ও হচ্ছে। বিছানা করে বসতেই মহুয়া মশারী টানিয়ে নিলেন। বিছানার কিনারায় মশারী গুজে দিল ভূমি৷ কুপি নিভিয়ে মেয়ের পাশে এসে শুয়ে পড়লেন মহুয়া। শুয়ে থেকেই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। চোখ বন্ধ রেখে ভূমি বলল‚

“মোড়ল বাড়ির মানুষগুলো খুব ভালো।”

“হ্যাঁ।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here