রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৮| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
273

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

ঊষাকাল উঁকি দিতে শুরু করেছে৷ আলোকচ্ছটায় পরিপূর্ণ মেদিনী। পাখিরা কিচিরমিচির কলরব তুলছে৷ পূর্বাকাশে দিবসপতি একটু একটু করে গাঢ় রং ধারণ করেছে। নীলাম্বরের মাঝে একটুকরো রক্তিম আভা। সবে ভাত বসিয়েছে ভূমি। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে রয়েছে। রাতে ঘুম হয়নি। তারউপর লাকড়িতে কিছুতেই আগুন জ্বলতে চাইছে না। পুরো ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ওদের আলাদা করে রান্নাঘর নেই৷ ছোট্টো ঘরের এক কোণায় চুলো পেতেছেন মহুয়া৷ চুলোর সংলগ্নে থাকা ছোটো জানালাটা খুলে দিল ভূমি। আজকের দিনটাই কদাকার— ভীষণ পাংশুটে। মহুয়া গিয়েছেন পানি আনতে।

“ভাবি এ মাসের পানির টাকাটা।”

রমিজা হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে নিলেন। প্রত্যেক মাসে দেড়শো টাকা করে নেন শুধুমাত্র পানির জন্য৷ টাকাটা হাতে পেয়ে হেসে দিলেন রমিজা৷ পান খেয়ে লাল হয়ে যাও দাঁতগুলো দৃশ্যমান। মহিলা ভীষণ পান চিবোন৷ গ্রামের মহিলাগন তো উনাকে ‘পানখোর’ ডাকেই চিনে ফেলেন৷ কলসি কাখে আর হাতে একটা বালতি নিয়ে বাড়ির দিকে চললেন মহুয়া৷ জামালদের বাড়ি থেকে বের হতেই পথরোধ করে দাঁড়াল মকবুল। মুখে তার বিকৃত হাসি৷ তর্জনী ও মধ্যমাঙ্গুলি ফাঁকে আটকে রাখা বিড়িতে টান দিল৷ নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে উড়িয়ে দিল নিমিষেই। কাজের দেরি হচ্ছে মহুয়ার৷ তিনি শুধালেন‚

“কিছু বলবেন ভাই?”

“কইতে তো অনেক কিছুই আছে।”

“জি বলুন।”

“আমি আবার সোজাসাপ্টা কথা কইতেই পছন্দ করি।”

প্রত্যুত্তরে মহুয়া কিছু বললেন না। পরবর্তী কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন হয়তো। মকবুল বলল‚

“মাইয়া তো বড়ো হইছে— বিয়া শাদি দিবা না?”

“মেয়ের বিয়ে নিয়ে এখনো কিছু ভাবিনি ভাই৷”

“তোমার মাইয়া কিন্তু দেখতে হুনতে ভালাই৷ হেতিরে আমি বিয়া করবার চাই। যৌতুক দিতে হইব না। উল্টা আমি টেকা পয়সা দিমু। সারাজীবন বইয়া খাইতে পারবা। আর মাইনসের বাড়ি কাজ কইরা খাইতে হইব না।”

“ছিহ্! এইসব কী ধরনের কথাবার্তা? ভূমি আপনার সন্তান সমতুল্য।”

“আমি তো সেইটা ভাবি না।”

এই লোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলতে রুচিতে বাঁধছে৷ ইচ্ছে তো করছে এখানেই খু’ন করে ফেলতে। মহুয়া আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালেন না৷ বড়ো বড়ো পা ফেলে বাড়ি ফিরে এলেন। টিনের বেড়াটা খুব ভালো করে আটকে দিয়ে এলেন। লোকটা চোখমুখের ভাষা খুব একটা ভালো লাগেনি মহুয়ার। বালতিটা বারান্দায় রেখে কলসি নিয়ে ঘরে এলেন তিনি। রাগে শরীর কাঁপছে উনার। ভূমি তখন ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল৷ কাজের ফাঁকে একবার তার আম্মার দিকে তাকাল। কেমন অস্বাভাবিক লাগছে তার আম্মাকে৷ কাজ ফেলে মহুয়ার কাছে এলো ভূমি। শশব্যস্ত ভঙ্গিতে তার আম্মার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল‚

“কী হয়েছে আম্মা তোমার?”

মেয়েকে এভাবে বিচলিত হতে দেখে নিজেকে সামলে নিলেন মহুয়া৷ ভূমিকে আশ্বস্ত করে তিনি বললেন‚ “ক..কিছু হয়নি। একটু গরম লাগছিল।”

“ভাত রান্না হয়েছে?”

“হ্যাঁ! তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ঝাড় দেওয়া ময়লা গুলো ফেলে দিয়ে আসি।”

“হুম যা।”

আজকের সকালের নাস্তা বানিয়েছেন নাজমা। মহুয়া এখনো আসেননি। এদিকে বাড়িতে মেহমান। বাড়িতে বিস্কুট‚ ড্রাই কেক আগে থেকেই কিনে আনা ছিল। নাজমা ঝটপট চা আর ডিম দিয়ে পাউরুটি ভেজে নিলেন। ছেলে মেয়েগুলো এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি৷ সকালে উঠে হাঁটার অভ্যেস আছে শাহাদাৎ মোড়লের। বাগানে হাঁটাহাঁটি করে অনেকটা সময়। নাস্তার ব্যবস্থা হতেই নাজমা ডাক দিলেন মিন্টুকে৷

“আমারে ডাকছিলেন খালা?”

“তোর খালু হয়তো বাগানে রয়েছেন। একটু ডেকে নিয়ে আয়৷ গিয়ে বলবি নাস্তা তৈরি৷”

“আইচ্ছা।”

ছুটে গেল মিন্টু। এদিকে নাজমা প্রথমে ইরাকে ডাকলেন৷ এরপর আরশের ঘরে ডাকতে গিয়ে বুঝলেন উনার ছেলের অনেক আগেই ঘুম ভেঙেছে। ওয়াশরুমে গিয়েছে ফ্রেশ হতে৷ তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন‚

“নাস্তা তৈরি। অর্পণ আর প্রলয়কে নিয়ে নিচে আয়।”

ওয়াশরুমে থেকেই “হ্যাঁ!” বলে সায় জানাল আরশ৷ নাজমা চলে গেলেন।

নীলাম্বর ছুটি নিয়েছে ধূসর মেঘমালার আড়ালে। ঊষাকালে উঁকি দেওয়া দিবসপতি ম্লান হয়েছে৷ ছাই রঙা মেঘ গুটলি পাকিয়েছে অন্তরিক্ষে। কাজে এসেও মন টিকছে না মহুয়ার। বারবার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটবে৷ সকাল থেকেই বাঁ চোখটা ক্ষণে ক্ষণে লাফাচ্ছে৷ মহুয়া একটা জিনিস খেয়াল করেছেন‚ যখনই উনার বাঁ চোখ লাফায় তখনই খারাপ কিছু ঘটারই হয়৷ এই নিয়ে খুব চিন্তায় রয়েছেন তিনি। হঠাৎ করে কেন এমন হচ্ছে? ভাবাচ্ছে ভীষণ। আজ কাজে না এলেই পারতে৷

“ভাবি আজ আমি একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাব।”

“কোনো সমস্যা হয়েছে মহুয়া?”

“মেয়েটার জন্য হুট করেই ভীষণ চিন্তা হচ্ছে৷ এমনটা তো কখনো হয় না।”

“তাহলে তুমি দুপুরের রান্নাটা করেই চলে যেও। বাকি কাজ আমি সামলে নিতে পারব।”

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাবি।”

বিরস দিবসের সূচনা ঘটেছে মধ্যাহ্নলগ্নে। বিশাল অম্বর জুড়ে কৃষ্ণ মেঘের আবির্ভাব। নিটোল জলে মেঘের প্রতিবিম্ব ভাসছে। শীতল বাতাবরণে পুষ্করিণীর জলও নিশ্চয়ই শীতলই হবে৷ আজ হয়তো বৃষ্টি হবে অথবা তুমুল ঝড়! শানবাঁধানো ঘাটে বসে রয়েছে প্রলয়। এখানে কেন এসেছে জানা নেই কিন্তু সকাল থেকেই ইচ্ছে করছিল এখানটায় আসতে৷ সঙ্গে থাকা নুড়িপাথর গুলো একটা একটা করে ছুড়ে ফেলছে নিটোল সেই জলে। মিন্টু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল‚

“ভাইজান বাড়িত যাইবেন না? মেলা দেরি হইছে আমরা এনে আইছি।”

“তুমি বাড়ি ফিরে যাও মিন্টু৷ আমার ফিরতে দেরি হবে।”

“আপনে একলা যাইতে পারবেন?”

“এ আর কঠিন কী?”

“তাইলে আমি বাড়িত যাই। মেলা কাম পইড়া রইছে।”

“আচ্ছা যাও৷”

সোফায় বসে আছেন শাহাদাৎ মোড়ল। আরশ আর অর্পণও রয়েছে এখানে। দুপুরের খাবার খেয়ে মিন্টুকে নিয়ে বের হয়েছিল প্রলয়। তারপর আর ফেরেনি। অর্পণ নিজে থেকে বলল‚

“আঙ্কেল কাল আমরা ঢাকা ফিরে যাব।”

“সে কী বাবা— এই প্রথম অনিন্দ্যনগরে এলে। এক সপ্তাহ অন্তত থেকে যাও৷”

“আসলে আঙ্কেল‚ ভাইয়ের কাঁধে তো অনেক দায়িত্ব। লাগাম তো আর অন্যের হাতে দিয়ে দেওয়া যায় না৷”

“কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। তবে এর পরের বার এলে অনেকদিন থেকে যেতে হবে৷ তোমার পুরো পরিবারের আমন্ত্রণ রইল।”

প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ হাসল অর্পণ। একবার ইরার দিকে তাকাল। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হতেই ভেংচি কাটল ইরা৷ অর্পণের হাসি পেলেও ভদ্রতার খাতিরে হাসতে পারল না৷ প্রলয় বাড়িতে নেই। একটু বের হয়েছে মিন্টুকে নিয়ে৷ বের হবার আগে শাহাদাৎ মোড়লকে জানিয়ে গিয়েছিল। তাকে নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয় অর্পণের। রাজনীতির সুক্ষ্ম পথে প্রত্যেকটা কদম অতি সাবধানে ফেলতে হয়৷ কখন কোথায় কোন ঘাতক ওত পেতে বসে থাকে‚ কে জানে! ফোন বের করে ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করল। দু বার রিং হতেই রিসিভ করল প্রলয়। স্বস্তির নিশ্বাস নিল অর্পণ। শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“একা কোথায় গিয়েছ ভাই?”

“প্রেমিকাদের মত আচরণ করবি না একদম। আমি জবাব দিতে বাধ্য নই।”

“আমার চিন্তা হচ্ছে। কোথায় আছ?”

“আছি কাছে পাশেই।”

সঙ্গে সঙ্গে কল কে’টে দিল প্রলয়। এই ছেলের ধৈর্য হবে কবে? সবকিছুতেই তাড়াহুড়ো। নাজমা গরম গরম নাস্তা বানিয়ে নিয়ে এলেন। সঙ্গে চাও বানিয়ে এনেছেন। শাহাদাৎ মোড়লের সারাদিনে দু’বেলা চা চাই-ই চাই৷ সকালে একবার তো আরেকবার সন্ধ্যায়৷ এমন সময় হুড়মুড় করে মোড়ল বাড়িতে এলেন মহুয়া। অসময়ে উনাকে দেখে সকলেই অবাক হলেন। বিশেষ করে নাজমা। দুপুরেই তো মহুয়া বলছিলেন‚ মেয়েটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এখন আবার কী হলো? কোনো বিপদ হলো না তো? হাতে রাখা ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখেই তিনি এগিয়ে গেলেন মহুয়ার কাছে। জানতে চাইলেন কী হয়েছে? মহুয়ার চোখমুখ ঠিক লাগছে না৷ ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন তিনি। উনার কান্না দেখে উপস্থিত সকলে ঘাবড়ে গেলেন সবাই৷ শাহাদাৎ মোড়লের সামনে হাত জোড় করে ক্রন্দনরত কণ্ঠে মহুয়া বললেন‚

“ভাইজান— আমার মেয়েটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ আমি সবার বাড়িতে খুঁজেছি৷ গ্রামে তো আপনাকে সবাই খুব মান্য করে। আমাকে দয়া করে সাহায্য করুন।”

আরশ এগিয়ে এসে বলল‚ “ভূমি কখন থেকে নিখোঁজ— আই মিন‚ ওকে কখন থেকে খুঁজে পাচ্ছ না আন্টি?”

“আজ তো আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। দুপুরের রান্নার পরপরই আমি বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।”

অর্পণ বলল‚ “তখন থেকেই উনি বাড়িতে নেই?”

“না বাবা! বাড়ি ফিরে দেখি ঘরের দরজা বাহির দিয়ে আটকানো। উঠোন পেরিয়ে টিন দিয়ে ঘেরা প্রবেশদ্বারও চাপিয়ে রাখা ছিল৷ আমার মেয়েটা তো বাড়ি থেকে কোথাও যায় না।”

কথাটা বলে আবারও কেঁদে দিলেন মহুয়া। মেয়ে ছাড়া যে এই পৃথিবীতে উনার আর কেউ নেই৷ আর কোথায় কোথায় খুঁজবেন মেয়েটাকে? অজানা আশঙ্কায় চিত্তব্যাকুল হয়ে উঠল৷ ভয় হচ্ছে ভীষণ। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে উনার৷ ক্রন্দনরত মানবীকে দেখে ভীষণ মায়া হলো অর্পণের৷ সে এগিয়ে এসে মহুয়ার হাতটা ধরে আশ্বাস দিয়ে বলল‚

“আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি৷ আমরা যথা সম্ভব চেষ্টা করব আপনার মেয়েকে খুঁজে আনার।”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here