রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৯| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
247

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

সময় গড়াচ্ছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেয়ের জন্য চিন্তা৷ ভূমিকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। মেয়েটা সেই বিকেল থেকে নিখোঁজ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে পেরিয়েছে৷ গ্রামে সন্ধ্যে নামার সঙ্গেই রজনি নামে। ব্যাকুল আঁধারিয়ায় ছেয়ে যায় সর্বত্র। জায়নামাযে বসে মেয়ের জন্য দোয়া করছেন মহুয়া। এতটা সময় হলো এখনো মেয়েটার কোনো খোঁজ খবর নেই।

“ও আল্লাহ‚ আমার যে এই মেয়ে ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই। আমাকে মেয়েটাকে সহিসালামতে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ।”

অনুমতি ছাড়াই বাড়িতে প্রবেশ করল অর্পণ আর আরশ। কারো অস্তিত্ব অনুভূত হলো মহুয়ার৷ আমিন ধরে পিছু ফিরে তাকালেন তিনি। অর্পণ আর আরশকে দেখে কান্নার বেগ বাড়ল উনার৷ মেয়েটার কোনো খোঁজ পেয়েছে কি-না জিজ্ঞেস করলেন তিনি‚

“কোনো খোঁজ পেলে বাবা?”

আরশ বলল‚ “পুলিশ নিজের কাজ করছে আন্টি৷”

“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আন্টি। আমার ভাই নিজে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছে। সবাই নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। ভূমিকে আমরা অবশ্যই খুঁজে পাব। আপনি প্লিজ কান্না করবেন না৷”

অর্পণের কথার মাঝেই হুহু করে কান্না করে দিলেন তিনি। শত স্বান্তনা পেলেও মায়ের মন তো আর মানে না। মা কী তার সন্তানের জন্য চিন্তা করা ছেড়ে দিতে পারে? কক্ষনো না!

রুমাল দিয়ে বেঁধে রাখা ভূমির মুখটা খুলে দিল মকবুল। মুখে তার পৈশাচিক হাসি। ভূমিকে এই অবস্থায় দেখে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তার। হাত‚ পা‚ মুখ বেঁধে রাখা হয়ছে। মেয়েটার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ অশ্রুকণা। মেয়েটার কান্নাই যেন আনন্দ দিচ্ছে মকবুলকে৷ সেই কোন বিকেলে মেয়েটাকে এখানে এনে রেখেছে। তার একটাই কারণ হচ্ছে‚ রাত হলে ভূমিকে নিয়ে এই গ্রাম থেকে পালাবে সে। ঘেমেঘেটে একাকার অবস্থা ভূমির। অতিরিক্ত কান্নার ফলে গলা শুকিয়ে কাট হয়ে রয়েছে। ক্রমাগত কাশছে মেয়েটা৷ মকবুল গিয়ে মুখটা খুলে দিল ভূমির। মেয়েটা হাঁপাতে শুরু করল। ক্রন্দনরত হতবিহ্বল অবস্থায় ভূমি বলল‚

“দয়া করে আমাকে যেতে দিন কাকা।”

“বারে বারে আমারে কাকা কইবা না৷ আমি তোমার কোন জনমের কাকা লাগি? আমার খালি বয়সটাই ইট্টূ বাড়ছে। দাঁড়ি ফালাইয়া দিলে চ্যাংড়া পোলাগুলার লাহান লাগব।”

শক্ত হাতে ধরল ভূমির হাত দু’খানা। মেয়েটা ছাড়া পাবার আশায় মোচড়ামুচড়ি করছে। যতই হোক পুরুষালি শক্তির সাথে কী আর পারা যায়? তারউপর হাত দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা। পা দুটোও একই দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে মকবুল।

“আমাকে ছেড়ে দিন। আম্মা জানলে কিন্তু আপনার রক্ষে নেই।”

“তোমার আম্মা আমার কিছুই করতে পারব না। হুদাই আমারে ভয় দেখাইয়া লাভ নাই। আমি তোমার ছাড়মু না। আর না কোনো খানে যাইতে দিমু৷ আমার বয়স কী বইয়া থাকব? আমি আইজকাই তোমারে শহরে রওনা দিমু। এইতো সকালে তোমার আম্মারে কইলাম‚ মাইয়া বিয়া দিবা নাকি! হেতি এমন কইরা চাইয়া রইল‚ মনে হইল আমারে কাঁচা চিবাইয়া খাইব। মা’গীর বহুত তেজ।”

“মুখ সামলে কথা বলুন কাকা৷ আমার আম্মাকে গালমন্দ করে কথা বলবেন না।”

মাতাল মকবুল মেঝে থেকে মদের বোতল খানা তুলে ভূমির কপালে ছুড়ে দিল। ‘ঠাস’ শব্দটা হলরুমে প্রতিধ্বনি তুলছে। সঙ্গে সঙ্গে কপাল কে’টে র’ক্ত ঝড়তে শুরু করল। মেঝেতে কাঁচের টুকরো বিছিয়ে পড়েছে৷ আঁধারে ব্যথায় নড়েচড়ে উঠতে দুপায়ে কাঁচ ফুটে উঠল। ব্যথার মাঝেও আফসোস করতে শুরু করল ভূমি৷ কোন কুক্ষণে যে জিনিয়ার কথা শুনে বাহির হয়েছিল আল্লাহ মালুম।

বিকেলে…

রাতের জন্য ভাত তাড়াতাড়ি রান্না করে ফেলেছে ভূমি। কুপির টিমটিমে আলোতে রান্না বসাতে ইচ্ছে করে না। রাতের জন্য তরকারি রান্না করতে হয় না। আম্মা সঙ্গে করে তরকারি নিয়ে আসেন। ভাত রান্না হতেই ভূমি গিয়ে মুরগী গুলোকে খাবার দেওয়ার প্রস্তুতি নিল৷ আছরের আযান অনেক আগেই পড়েছে। নামাযও আদায় করে নিয়েছে সে৷ সন্ধ্যে হবার ঘণ্টা খানেক আগেই আর মুরগী গুলো খুপরিতে উঠে যায়। এদের অভ্যেস আবার ভালো আছে। কারো গলার আওয়াজ ভেসে আসছে আবছা৷ হ্যাঁ! ভূমিকেই তো ডাকছে।

“ভূমি বু! ও ভূমি বু!”

হাতের মুঠোয় রাখা খুদ গুলো উঠোনে ছিটিয়ে দিয়ে‚ ভূমি গেল প্রবেশদ্বারের কাছে৷ জামাল কাকা মেয়ে জিনিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ এ সময় জিনিয়াকে দেখে বেশ অবাক হলো ভূমি। রমিজা কাকি তো তার মেয়েকে কস্মিনকালেও এ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেন না। তবে আজ হঠাৎ? টিনের বেড়া সরিয়ে দিতেই জিনিয়া বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল৷ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার আগে বাহিরের এদিকসেদিক তাকিয়ে দেখল কেউ দেখেনি তো? যাক কেউ নেই আশেপাশে। হাফ ছেড়ে বাঁচল জিনিয়া। ভেতরে প্রবেশ করেই ভূমিকে বলল‚

“তোমারে খালা যাইতে কইছে৷”

“আজ আবার কেন যেতে বলেছে? আম্মার কোনো দরকার পড়লে তো মণিকেই পাঠান।”

“আমি অত কিছু জানি না। তুমি যাইবা নাকি না?”

“যাচ্ছি। তুই একটু অপেক্ষা কর। আমি মুরগী গুলোকে খুপরিতে তুলে নিই।”

“আইচ্ছা।”

স্কুলের দিক থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ক্রমাগত। থানা থেকে বেরিয়ে এদিকটা দিয়ে যাচ্ছিল প্রলয়৷ অর্পণের থেকে যখন শুনেছে ভূমি নামের মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না‚ তখনই সে মোড়ল বাড়ি থেকে আবারও বেরিয়েছিল। বিকেলে পুষ্করিণী পাড়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে মোড়ল বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে অর্পণকে পেল না সে। ফোনে কল দিতেই অর্পণ সব খুলে বলল তাকে। এরপর হুড়মুড় করে বেরিয়েছে সে। সোজা গিয়েছে অনিন্দ্যনগর থানায়। তাকে দেখা মাত্রই কনস্টেবল তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ বেচারা বসে বসে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল৷ প্রলয়কে দেখেই চিনতে পেরে গিয়েছিল। একটা মিসিং ডায়েরি আর শাসিয়ে এসেছিল— যে করেই হোক মেয়েটাকে একঘণ্টার মাঝেই খুঁজে বের করতে হবে৷ তার এক কথাতেই কাজ হয়ে গিয়েছে৷

সন্দেহকে গুরুত্ব দিয়ে প্রলয় স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করল। এরপর যা দেখল তাতে তার শিরা উপশিরা রক্ত টগবগ করতে শুরু করল। সেদিনে সেই লোকটাই ভূমিকে আটকে রেখেছে৷ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট চালু করতেই মকবুল চেঁচিয়ে উঠল‚

“অ্যাই কে রে? কে ওখানে?”

“তোর মৃত্যুদূত।”

প্রলয় দৌঁড়ে গিয়ে ভূমির পাশে দাঁড়াল৷ একটু ঝুকে বলল‚

“আপনি ভয় পাবেন না৷ আমি আছি তো। আমি আপনার কোনো ক্ষতি হতে দেব না।”

প্রলয়কে খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিল ভূমি। এই লোকটাই যে পরশুদিন তাকে মকবুলের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল৷ আধবোজা চোখে প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে শুষ্কবিমর্ষ কণ্ঠে ভূমি বলল‚

“দয়া করে আমাকে বাঁচান। আমাকে আমার আম্মার কাছে পৌঁছে দিন।”

দুজনের কথার মাঝেই ভারী মাতাল কণ্ঠে মকবুল বলে উঠল‚

“তোর আম্মা যেমনে বেশ্যার খাতায় নাম লেখাইছিল তোরেও ওই খাতাতেই নাম লেখাইতে হইব৷ তুই হইবি আমার রক্ষিতা।”

নিভন্ত ছাই এবার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পরিনত হলো৷ চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তৎক্ষণাৎ। শুকনো ঢোক গিলল মকবুল। তবে নিজের ভীতিকে প্রকাশ করল না প্রলয়ের সামনে। মনে সাহস সঞ্চার করে বলল‚

“ওই মিয়া তুমি এইখান থাইকা চইলা যাও। আমারে আমার কাম করতে দেও।”

প্রলয়ের গম্ভীর সেই কণ্ঠস্বর‚ “যদি না যাই?”

“তোমারে মাইরা হইলেও আমি এই মাইয়ারে নিয়া যামু।”

বাঁকা হেসে প্রলয় বলল‚ “আমাকে মারবেন? সেহরিশ আরশান প্রলয়কে মারবেন?”

হকচকিয়ে গেল মকবুল। তবুও নিজের ধারাকে অটল রেখে বললেন‚ “হ কইলামই তো— তোমারে মাইরা হেরপর এই মাইরারে ভোগ করমু আমি।”

“তাই বুঝি?”

তীব্র রাগে চেঁচিয়ে উঠল প্রলয়। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল মকবুলের। এ জন্মে এমন রাগের সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। আজই প্রথম৷ প্রচণ্ড রাগ ধরে রাখতে না পেরে মকবুলের বুকের মধ্যিখানে লাথি মে’রে বসল প্রলয়৷ ছিটকে পড়ে গেল মকবুল। ধুলোবালি জমা মেঝেতে পড়তেই আর্তনাদ করে উঠল সে৷ ভয়ে দুচোখ বন্ধ করে নিল ভূমি। কপাল বেয়ে র’ক্ত ঝড়ছে। এতকিছুর মাঝে পায়ের ব্যথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে সে৷ চোখের সামনে প্রলয়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখছে। এমনিতে গম্ভীর মনে হয়েছে তাই বলে এত রাগ? চোখমুখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে৷ থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ভূমি। হঠাৎ করে অচৈতন্য হয়ে মেঝেতে ঢলে পড়ে মেয়েটা। দেখেও দেখে না প্রলয়। তার পূর্ণ অগ্নিদৃষ্টি মকবুলের দিকে নিক্ষেপ করেছে৷ মকবুল হাত জোর করে ভীতু গলায় বলল‚

“আ..আমারে ছাইড়া দেও৷ এই ভূল আমি আর করতাম না।”

“আমার বিচারালয়ের একটাই শাস্তি। আর তা হচ্ছে মৃত্যু।”

তিনটে গুলির আওয়াজে অনিন্দ্যনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হলগুলো কেঁপে উঠল। অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকা অঙ্গনাকে একপলক দেখে নিল প্রলয়। কা’টা মুরগীর মতো ছটফট করছে মকবুল। একটা সময় তার নিথর দেহটা সেখানেই পড়ে রইল৷ মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট চালু করে এদিক-সেদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগল। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেতেই কোলে তুলে নিল ভূমিকে। মেয়েটার কপাল র’ক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠছে। কাঁচের টুকরো দিয়ে পা কে’টে ক্ষ’তবিক্ষ’ত হয়েছে। আদতে কী সেই ব্যথা অনুভূত হচ্ছে অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকা অঙ্গনার? তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে আছে কোমলময়ীর সুশ্রী।

বড়ো বড়ো পা ফেলে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল প্রলয়। এখানে থাকাটা একটুও নিরাপদ নয় দুজনের জন্য। নিজের আর ভূমির বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ রাখেনি সে৷ আর যদি এতেও কোনো সমস্যা হয়ে থাকে— সেটা ব্যক্তিগত ভাবে বুঝে নিবে। রাতের নিস্তব্ধতা বাড়ছে৷ একটু আধটু হাঁটার শব্দ হচ্ছে৷ রাতের শিশিরে ভিজে আছে মাটিতে জন্মানো দূর্বাঘাস গুলো। ভেজা কাঁদা মাটি লেগে রয়েছে প্রলয়ের জুতো জোড়ায়। অন্ধকার নিশ্চয়ই সেটা দৃষ্টিগোচর হবে না। শানবাঁধানো ঘাটে নিয়ে এসে শুইয়ে দিল ভূমিকে। হাঁটু গেড়ে বসে পায়ের বাঁধন খুলে দিল প্রলয়। ডান পায়ের গোড়ালিতে একটা বড়ো কাঁচের টুকরো গেঁথে রয়েছে। প্রলয় সন্তপর্ণে টুকরোটা বের করল। অচৈতন্য অবস্থাতেও কেঁপে উঠল ভূমি।

পুষ্করিণী পাড়ে আবছা আলোর দেখা পেয়েই কয়েকজন ছুটে এলো৷ গুলির আওয়াজ শুনেই মূলত উনারা বের হয়েছেন। ব্যাটারি লাইটের আবছা আলোতে প্রলয় আর একটা অচৈতন্য মেয়েকে একসঙ্গে দেখে একজন বলে উঠলেন‚

“পুষ্করিণী পাড়ে ন’ষ্টা’মি করবার আইছেন? এই না আপনে মান্যগণ্য লোক। সমাজের সেবা করেন? একা একটা মাইয়ারে পাইয়া ইজ্জত লুটবার আইছেন!”

মুখ তুলে লোকগুলোর দিকে তাকাল প্রলয়। আপাতত নিজের জন্য চিন্তা হচ্ছে না তার৷ মেয়েটার জ্ঞান ফেরানো অধিক জরুরি। লোকগুলোর কথা কানে তুলল না৷ হাতে মুঠোয় কিছুটা পানি তুলে ছিটিয়ে দিল ভূমির মুখে। ভূমির মুখের দিকে একজন লাইট ধরল৷ অসাড় হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটার মুখ ভেসে উঠল নিমিষেই। লোকগুলোর মাঝেই একজন বলে উঠল‚

“কারেই বা কী কইতাছি আমরা? মা যেমন আকাম করছিল‚ মাইয়াও তো সেই পথেই হাঁটব।”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here