রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪১| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
622

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

সাঁঝক প্রহর নেমেছে অনেক আগেই৷ অদূরেই আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়। পাখিরা যেমন নীড়ে ফিরে যায় ঠিক তেমনই তারও ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। আসার সময় ভূমিকে বলে এসেছিল‚ আজ বাড়িতে তাড়াতাড়িই ফিরবে। অনেকটা সময়ই তো হলো এভাবে চেয়ারের উপর পায়ে পা তুলে বসে রয়েছে। লোকটার মৃ’ত্যু ঘটার আগ অবধি‚ কামরা বিশিষ্ট খাঁচার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। লোকটার মৃ’ত্যু একদিক থেকে তাকে তৃপ্তি দিচ্ছে অন্যদিকে রাগ হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে করছে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে সবকিছু তছনছ করে দিতে। এরই মাঝে রবিন এলো।

রবিন এসে সামনে দাঁড়াতেই প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚ “কাজ হয়েছে? এর সঙ্গে কে জড়িত— জানা গেছে কিছু?”

“হ্যাঁ ভাই আপনি যা ভেবেছিলেন সেটাই সত্যি হয়েছে।”

কথাটা বলেই খাঁচার দিকে তাকাল৷ পুরো ঘরটা এখন আলোকিত। সেই আলোয় খাঁচার ভেতরে র’ক্ত আর কিছু হাড়গোড় পড়ে রয়েছে। কুমির গুলো তৃপ্তি নিয়ে ঘুমচ্ছে। বেশ কিছুদিনের ক্ষুধার্ত ছিল এরা৷ খাবার পেয়ে আর অপেক্ষা করেনি৷ একদম ছিড়েখুঁড়ে খেয়েছে৷ তাচ্ছিল্য করে হেসে রবিন বলল‚

“দুনিয়া থেকে একটা ঝঞ্ঝাট কমেছে।”

রবিনের কথায় বাঁকা হাসল প্রলয়। মনে মনে অনেক হিসেব কষছে। বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে বলল‚

“হাড় গুলো সঠিক লোকের কাছে পার্সেল করে দিবি৷ আর কাগজে একটা লেখা কম্পিউটারে টাইপ করে দিবি৷”

“কী লিখতে হবে ভাই? আপনি বলেন আমি টাইপ করি।”

দাঁড়িয়ে পড়ল প্রলয়৷ গম্ভীর স্বরে বলল‚ “এটা জাস্ট ট্রায়াল— বাকিটা তোর উপর দিয়ে যাবে শু’য়োরের বাচ্চা।”

“আচ্ছা ভাই কাজ হয়ে যাবে৷ আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।”

“এদিকটা সামলে নিস৷ আমি যাচ্ছি।”

অন্যদিকে…

রান্নাঘরে চুলোয় ঘুগনি গরম বসিয়েছে ভূমি৷ নিজের জন্য এক কাপ আদা দিয়ে রং চা করেছিল। চা পান করে মাথা ব্যথা এখন একটু কমেছে। দুপুরে ঘুম না হওয়ার দরুন মাথা ধরেছিল কিন্তু পুষ্পিতার বায়না ফেলতে পারল না সে। ঝটপট তেঁতুলের কাথ বের করে ফেলল। খুব বেশি পরিশ্রম করতে হলো না তাকে। শসা‚ পেঁয়াজ‚ কাঁচা মরিচ‚ ধনিয়া পাতা কুচি করে কে’টে দিয়েছে। পাঁচফোড়ন আর চিলি ফ্লেক্স আগে থেকেই ছিল। কুচি করে রাখা সবগুলো উপকরণ ঘুগনির সঙ্গে মিশিয়ে নিল। সাবিনা টিভি দেখছে। ভূমি তাকে রান্নাঘরে থাকতে দেয়নি‚ বলেছিল সে একাই সবটা পারবে। সাবিনা তাকে সাহায্য করার জন্য অনেকক্ষণ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। ভূমির জোরাজুরিতে বৈঠকখানায় চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল ঘুগনিতে এই শসা‚ পেঁয়াজ‚ কাঁচা মরিচ‚ ধনিয়া পাতা মিশিয়ে নিতে। এগুলো কীভাবে বানাতে হয় ভুমির জানাই ছিল না! জানবে কী করে সে তো আর কোনদিন ফুচকা বানায়নি!

ফুচকা গুলো বেশ ফুলকো হয়েছে। একটা ট্রেতে তিনটে বাটি নিল। একটা বাটিতে টক‚ আরেকটা বাটিতে ঘুগনি আর আরেকটা বাটিতে ফুচকা গুলো ভেজে তুলে রাখল। দুটো চামচ আর মসলার ছোট বাটি রাখল এক কোণায়৷ এরপর ট্রে হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে দোতালায় পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে চলল। মেয়ে দুটো পড়াশোনায় ব্যস্ত। ফুচকা ট্রেটা নিয়ে গিয়ে বিছানার উপর রাখল। পড়াশোনা কিছু সময়ের জন্য স্থগিত। পুষ্পিতা খুশি হয়ে ভূমিকে জড়িয়ে ধরল। আদুরে সরে বলল‚

“তুমি কত সুইট ভাবিমণি। লাভ ইউ।”

পূর্ণতা জিজ্ঞেস করল‚ “অ্যাই পুষ্প! তুই কী ভাবিমণিকে ফুচকা বানাতে বলেছিলি?”

“তুই তো বানিয়ে দিবি না। মাও পারমিশন দেবে না আমাকে বানানোর জন্য। তাই আমি ভাবিমণিকে বলেছিলাম ফুচকার কথা।”

পূর্ণতা কিছুটা ধমকের স্বরে বলল‚ “তোর আক্কেল জ্ঞান কবে হবে? সেই বিকেল থেকে ভাবিমণির মাথা ব্যথা। আর তুই তাকে দিয়ে কাজ করালি?”

ব্যাপারটা একদমই বুঝতে পারিনি পুষ্পিতা। মাথা নিচু করে অপরাধীর ন্যায় বলল‚

“স্যরি ভাবিমণি! আমি বুঝতে পারিনি তোমার মাথা ব্যথা করছিল। শুধু শুধু তোমাকে খাটালাম।”

পুষ্পিতার গালে হাত রেখে ভূমি ক্ষীণ হেসে বলল‚

“তাতে কী? আমার মাথা ব্যথা এখন আর নেই। সেই কখন পালিয়েছে! তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। তোমাদের যা খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবে‚ আমি চেষ্টা করব বানিয়ে দিতে।”

“তুমি কত ভালো ভাবিমণি!”

“তোমরা দুজনও অনেক ভালো রায়বাঘিনী ননদিনী। তোমরা খেয়ে পড়তে বোসো। আমি একটু ঘরে যাচ্ছি।”

ভূমি চলে যেতে নিলে পুষ্পিতা তার হাত ধরে ফেলল। তাকে বিছানায় বসিয়ে বলল‚

“তোমাকে এখন যেতে দেওয়া যাবেনা। তুমিও আমাদের সঙ্গে খাবে।”

এই বলেই পুষ্পিতা একটা ফুচকা ভূমির মুখে পুরে দিল। ঝাল ঝাল ফুচকা গুলো খেতেও ভালোই হয়েছে। তৃপ্তির সঙ্গে খেল পূর্ণতা পুষ্পিতা। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ভূমি নিজেদের ঘরে চলে এলো। আসার সময় সাবিনাকে ডেকে বলল‚ পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘর থেকে ট্রেটা যেন নিয়ে যায়।

ইরা অর্পণের সঙ্গে এসেছে। তার আসার কথা ছিল সকালে। কিন্তু সকালে কলেজ থাকায় আর অর্পনের হসপিটালে ডিউটি থাকায় ইরাকে নিয়ে সবেই এসেছে। ইরাকে দেখে খুশি হয়ে গেলেন ফিরোজা। মেয়েটাকে ভীষণই পছন্দ হয়েছে উনার। মাধুরীরও বেশ পছন্দ হয়েছে ইরাকে। মনে মনে ভাবলেন‚ এমন একটা পরিবারের মেয়েকেই তো প্রলয়ের বউ হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন। আফসোস হলেও কিছু করার নেই। বৈঠকখানায় এখন শুধু ফিরোজা‚ মাধুরী আর ইরা রয়েছে৷ সাবিনা রান্নাঘরে নাস্তা বানানোর বন্দোবস্ত করছে। অর্পণ তার ঘরে চলে গিয়েছে। সারাদিন ডিউটি করে সেও ভীষণ ক্লান্ত। ইরা জিজ্ঞেস করল‚

“আন্টি ভূমির ঘরটা কোথায়? আমি একটু ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

মাধুরী জিজ্ঞেস করলেন‚ “তুমি ভূমিকে চেন কী করে?“

নিচু স্বরে ইরা বলল‚ “আমরা তো একই গ্রামের। মহুয়া আন্টি আমাদের বাড়িতে…”

ইরাকে আর কিছু বলতে দিলেন না ফিরোজা। কথার মাঝেই আটকে দিলেন তিনি। মহুয়া যে ইরাদের বাড়িতে কাজ করেন সেটা যদি মাধুরী জানতে পান তাহলে আবারও আরেকটা অশান্তি শুরু হবে। সবে ভূমিকে মেনে নিতে শুরু করেছেন মাধুরী। ভূমির ঘরটা ইরাকে দেখিয়ে দিলেন ফিরোজা।

মাগরিবের নামায আদায় করে‚ বিছানায় একা বসে রয়েছে ভূমি। প্রলয় হয়তো চলে আসবে। বারবার ঘড়ির সময় দেখছে। লোকটা দুপুরে কিছু খেয়েছে কিনা জানা নেই! তখন ভেবেছিল‚ কাপড়চোপড় গুলো গুছিয়ে প্রলয়ের নাম্বারে একবার কল লাগাবে। কিন্তু তখন পুষ্পিতা ফুচকা খাওয়ার বায়না করায়‚ প্রলয়ের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। এরই মাঝে দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো।

“আসতে পারি?”

ঘরের দরজা চাপানো বিধায় কে এসেছে বুঝতে পারল না ভূমি। ঠিকঠাক হয়ে বসে অনুমতি দিল। অনুমতি পেয়ে ইরা ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। ইরাকে দেখে খুশি এবং অবাক দুটোই হলো। খুশির মাত্রাটা একটু একটু করে বাড়তে শুরু করল। ভূমি মনে মনে ভাবল‚ ইরা বুঝি গ্রাম থেকেই এসেছে। হয়তো সঙ্গে করে তার আম্মাও এসেছে। কতদিন পর আম্মাকে চোখের সামনে দেখতে পাবে! ভাবতেই চিত্ত উচ্ছ্বসিত হলো। ইরাকে জিজ্ঞেস করল‚

“ইরা আপু কেমন আছ তুমি?

“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমাকে কতবার না বললাম— আমাকে আপু বলে ডাকবে না?”

হেসে উঠল ভূমি৷ ইরাকে বলল‚ “ভুলে যাই। কখন এলে তোমরা? আম্মা কোথায়? বড়োদের সঙ্গে কথা বলছি বুঝি?”

“তুমি ভুল বুঝছ! আমি ঢাকায় এসেছি আজ চারদিন হলো। হোস্টেলে থাকছি।”

ভূমির মনঃক্ষুণ্ণ হলো ভেবেছিল আম্মাও সঙ্গে এসেছেন। এতক্ষণের উচ্ছ্বসিত মনটা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। ইরা এসে ভূমির পাশে বসে বলল‚

“শুনলাম তোমাকে প্রলয় ভাইয়া ফোন কিনে দিয়েছে। কই আমাকে তো একবারও কল দিলে না! এখন তো যখন ইচ্ছে তখনই কল করে কথা বলতে পারো। ভুলেই গেছ আমাদেরকে!”

“সকালেও তো জেঠি মায়ের (ইরার মা) সঙ্গে কথা হলো। উনি তো কিছু জানালেন না!”

“মা হয়তো বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। আচ্ছা ওসব কথা বাদ‚ তুমি কেমন আছ? এখানে সব ঠিকঠাক তো? সবাই তোমাকে মেনে নিয়েছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ আপু। আমি খুব ভালো আছি। এ বাড়ির সবাই খুব ভালো।”

“কথাটা শুনে বেশ খুব ভালো লাগল।” একটু থেমে এরা আবার বলল‚ “ওয়েট— ওয়েট! তুমি আমাকে আবার আপু বলে ডাকছ?”

বোকা হেসে ভূমি বলল‚ “ভুলে গিয়েছিলাম।”

এরই মাঝে প্রলয় ঘরে এলো। তাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়াল ইরা। এভাবে দাঁড়িয়ে পড়ায় প্রলয় ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল‚

“উঠে পড়লে কেন? বোসো— কথা বল! খুব ক্লান্ত লাগছে আমার। ফ্রেশ হয়ে এসে কথা বলব।”

পকেট থেকে ওয়ালেট মোবাইল ফোন রেখে দিয়ে‚ হাত থেকে ঘড়ি খুলতে খুলতে ভূমিকে বলল‚ “আমার জামাকাপড় গুলো বের করে দাও।”

ভূমি বিছানা ছাড়ল। ব্যস্ত হয়ে ওয়ারড্রব থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করে প্রলয়ের হাতে দিল। সঙ্গে তোয়ালে এগিয়ে দিল। প্রলয় আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। খুব ক্লান্ত লাগছে তার। লম্বা সময় নিয়ে গোসল করবে। ঘরে এসি চালিয়ে রাখা অথচ ভ্যাপসা গরম লাগছে৷ যাওয়ার আগে ভূমিকে বলল তার জন্য এক প্লাস ঠান্ডা পানি এনে রাখতে।

ভূমির সঙ্গে সঙ্গে ইরাও বেরিয়ে পড়ল৷ ইরাকে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে নিয়ে গেল। একা একা বোর হওয়ার থেকে‚ ওদের সঙ্গেই না হয় সময় কাটুক। ভূমি রান্না ঘরে চলে গেল। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করল। জগে পানি মিশিয়ে নিল। খুব বেশি ঠান্ডা রাখল না। গোসল করে আবার অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি খেলে প্রলয়ের সর্দি লেগে যেতে পারে। সঙ্গে করে জগ আর গ্লাস নিয়ে ঘরে ফিরে গেল। প্রলয় এখনো ওয়াশরুমে। ভূমি ডাকল না। বিছানা গুছিয়ে রাখল। লোকটাকে দেখে বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here