রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪০| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
289

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

অনেকক্ষণ হয়ে গেল প্রলয় এখনো ঘরে আসছে না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। অপেক্ষারত রমণী হতাশ হচ্ছে প্রলয় আসার অপেক্ষায়। লোকটা কী বুঝতে পারছে না— তার জন্য কেউ একজন অপেক্ষা করছে? না! আর অপেক্ষা যাচ্ছে না। পেছন ফেরার জন্য উদ্যত হওয়ার আগেই দরজা আটকানোর শব্দ কর্ণগোচর হলো। আয়নাতেই প্রলয়ের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। ভূমি একটু নড়েচড়ে দাঁড়াতেই দোল খেল লম্বা বিনুনি। বারান্দা থেকে ফিরে ভূমিকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তারমানে মেয়েটা এখনো ঘুমাইনি। প্রলয় একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বারোটা বাজতে চলল। মেয়েটা এখনো ঘুমাচ্ছে না। কিছু না বলেই বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল প্রলয়। ভূমির মনে হলো লোকটা তার উপর রেগে আছে। রাগার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি। বিকেলের কথাটা মনে পড়ে গেল। ভূমি কাচুমাচু হয়ে চলে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইল প্রলয়। এমনিতে তো কথার ঝুলি নিয়ে বসে। প্রলয় আজ নিজে থেকে কথা বলছে না৷ লোকটা কী তার উপর মা’রাত্মক রেগে রয়েছে? প্রলয়ের চুপ থাকা সহ্য হচ্ছে না তার। ভূমি বোকা বোকা কণ্ঠে শুধাল‚

“আপনি কী আমার উপর এখনো রেগে আছেন?”

ফোনের দিক থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে প্রলয় বলল‚ “তোমার কী তাই মনে হচ্ছে?”

প্রলয়ের মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করল‚ “কই বাড়ি ফেরার পর তো একটা কথাও বললেন না!”

একটু সোজা হয়ে বসে প্রলয় আবারও বলল‚ “একটু ব্যস্ত ছিলাম আমি। এখন তো কথা বলছি।”

পরক্ষণেই প্রলয়ের মনে পড়ল এত কিছুর মাঝে ভূমি কোথাও ব্যথা পেয়েছে কিনা জানা হলো না। ত্রস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল‚ “তখন রাস্তায় ছিটকে পড়েছিলে— কোথাও কী ব্যথা লেগে লেগেছিল?”

ভূমি দুই দিকে মাথা ঝাকিয়ে বলল‚ “উঁহু!”

মিথ্যে বলল ভূমি। কোমরে কিছুটা ব্যথা পেয়েছে কিন্তু প্রলয়কে জানাতে চাইছে না। পাছেই না লোকটা আবারও তার উপর রেগে যায়। বুকে দুহাত গুজে বসল প্রলয়৷ ভূমিকে বলল‚

“তখন তো আমি দেখলাম তুমি ঠিক মতো হাঁটতে পারছিলে না৷”

প্রলয় কখন দেখল জানা নেই তার৷ ধরা খেয়ে গেল যেন৷ আমতা আমতা করতে শুরু করল৷ প্রলয় আবারও বলল‚

“লাইট অফ করে এসো।”

প্রলয়ের কথা মতো ধীর গতিতে বিছানার অপর পাশে চলল। এরপর লাইট বন্ধ করে প্রলয়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল৷ কোমরের চিনচিনে ব্যথায় হাঁটতে একটু কষ্ট হয়েছে বটে। কামরায় নীলচে ঘুম বাতি জ্বলছে৷ ভূমিকে নিজের দিকে ফিরাল প্রলয়৷ আবছা আলোতেই ভূমির চোখে চোখ রাখল। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল‚

“কোথায় ব্যথা লেগেছে?”

আড়াল করতে ভূমি বলল‚ “ব্যথা নেই।”

কিন্তু প্রলয় যে নাছোড়বান্দা। সত্যিটা সে ভূমির মুখেই শুনতে চায়৷ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল‚ “সত্যিটা শুনতে চাইছি আমি।”

এবার সত্যিটা বলতেই হলো‚ “কোমরে লেগেছিল।”

“তখন জিজ্ঞেস করলাম— বললে না কেন?”

ভূমি আমতা আমতা করে বলল‚ “যদি আপনি রেগে যান।”

“আমি কী তোমার উপর রাগ করি?”

“সেদিন রাতেও তো রেগে আমার উপর চেঁচিয়েছিলেন। আজ বিকেলেও তো চেঁচিয়েছেন।”

“তুমি বড্ড কেয়ারলেস ভূমি কন্যা।”

“কী করেছি আমি?”

“এখনো জিজ্ঞেস করছ— কী করেছ?”

“হুম!”

“তোমার যদি কিছু হয়ে যেত?”

অকপটে ভূমির জবাব এলো‚ “কী আর হত— ম’রে যেতাম!”

ভূমির গাল চেপে ধরল প্রলয়৷ কথাটা তার মোটেও পছন্দ হয়নি৷ প্রলয়ের স্পর্শ রুক্ষ৷ ব্যথাকে অবজ্ঞা করল ভূমি৷ তাকে ছেড়ে দিয়ে মলম বের করল। কোমল স্পর্শে ভূমির কোমরে মলম লাগিয়ে দিতে শুরু করল৷ প্রলয়ের স্পর্শে হৃদয় ব্যাকুল হতে শুরু করেছে৷ কিছু বেহায়া অনুভূতি আটঘাট বেঁধে নেমেছে হৃদয় প্রাঙ্গণে। ভেতরটা কেঁপে উঠছে ক্রমশ। ভূমি ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে রেখেছে৷ আবছা আলোয় প্রলয় দেখল বিছানার চাদর খামচে ধরেছে মেয়েটা৷ মুখে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি৷ অনুমতি ব্যতীত গ্রীবায় উষ্ণ অধর ছোঁয়াল প্রলয়। কেঁপে উঠল ভূমি৷ অবাক চোখে তাকাল৷ হুটহাট এই স্পর্শ গুলো হৃদয়ে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় তুলছে৷ তীব্র জোয়ারে শরীর শিরশির করে উঠছে৷ ভূমির কানে ফিসফিসিয়ে বলল‚

“এভাবে তাকিয়ো না— প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা দায় হয়ে পড়ছে।”

সকালে…

ঘুম থেকে উঠে ভূমিকে পাশে পেল না প্রলয়৷ মেয়েটা তার আগেই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে৷ তাকে একবারও ডাকল না পর্যন্ত। মুখ ফুলিয়ে আবারও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমনোর চেষ্টা করল৷ এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না।

আজ সকাল সকাল চিকেন বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। পূর্ণতা পুষ্পিতা খুবই পছন্দ করে৷ নাস্তা হিসেবে আজ বিরিয়ানিই পরিবেশন করা হবে৷ ফিরোজার রান্নার হাত ভালো। বাড়িতে উনার রান্না সকলেই পছন্দ করেন৷ এইজন্যই রান্নার দায়িত্বটা উনার উপরই বর্তায়। ফিরোজাও খুব আনন্দের সঙ্গে রান্নার সকল কাজ করেন। শুরু থেকে উনারা দুই জা মিলে সংসারটাকে জুড়ে রেখেছেন৷ উনাদের দুজনের মাঝে খুবই মিল। বিষয়টা খুবই ভালো লাগে ভূমি। অর্পণের বউ এলে তারাও এভাবে বোনের মতো মিলেমিশে থাকবে। ফিরোজার সাথে দাঁড়িয়ে ওকালতি করছে ভূমি। সে মূলত রান্না শিখছে উনার থেকে। ঘর থেকে ফোন বাজার শব্দ আসছে। মোর্শেদ শিকদার আর মেহরাব শিকদারের ঘর নিচ তলাতেই। পাশাপাশি দুই ভাইয়ের ঘর। তাই ফোনের আওয়াজ রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে৷ ফিরোজা ভূমিকে বললেন‚

“তুমি এইদিকটা একটু সামলে নাও। তোমার চাচ্চু হয়তো কল দিচ্ছেন৷ আমি গিয়ে একটু দেখে আসছি।”

“আচ্ছা চাচি মা।”

ফিরোজা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভূমি চুলোর আঁচ কমিয়ে দিল। পুড়ে গেলে হবে আরেক সমস্যা। বিরিয়ানির ঘ্রাণে রান্নাঘর ম-ম করছে৷ রান্না হয়ে এসেছে। সাবিনাকে সালাদ বানানোর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন ফিরোজা৷ একফাঁকে প্লেট আর গ্লাসগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে এলো ভূমি৷ মোর্শেদ শিকদার তৈরি হয়েই এসেছেন৷ নাস্তা করেই বের হবেন তিনি৷ উনার পেছন পেছন মাধুরীও চলে এসেছেন৷ প্রলয় উঠেছে কিনা জানা নেই ভূমির৷ চুলো নিভিয়ে ঘরে চলে গেল ভূমি৷ যা ভেবেছিল সেটাই। লোকটা এখনো ওঠেনি। মুখের উপর থেকে চাদর সরাল৷ কিন্তু একি? লোকটা কোথায়। এ তো কোলবালিশ। ভূমির ভাবনার মাঝেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো প্রলয়। এসেই ভূমিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল৷ মুখ ধোয়ার দরুন চুলও খানিকটা ভিজেছে৷ টপটপ পানি ঝড়ে পড়ছে ভূমির গ্রীবায়৷ প্রলয় ফিসফিসিয়ে বলল‚

“সকালে ডাকলে না কেন?”

“আপনি তো ঘুমচ্ছিলেন।”

“তাই বলে আমাকে ডাকবে না? একটু রোমান্টিক ভাবে আজ ঘুমটা ভাঙত।”

মুখ ভেংচি কাটল ভূমি৷ প্রলয় তা দেখল না। তাকে তাড়া দিতে শুরু করল ভূমি। খাবার টেবিলে হয়তো সবাই তাদের দুজনের জন্যই অপেক্ষা করছে। প্রলয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল৷ ওয়ারড্রব থেকে প্রলয়ের জন্য টিশার্ট বের করে দিল ভূমি।

গোধূলি লগ্নে…

ধোয়া কাপড়চোপড় গুলো গুছিয়ে রাখছে। ভূমি দুপুরে ধুয়ে দিয়েছিল। বেশির ভাগই প্রলয়ের। ছেলেদের যে এত জামাকাপড় পাল্টাতে হয়‚ জানা ছিলনা ভূমির। প্রতিদিন চার পাঁচটা জামাকাপড় অনায়াসেই পাল্টে ফেলে। ভাজ করা কাপড়চোপড় গুলো ওয়ারড্রবের ড্রয়ার গুছিয়ে রাখল। এরই মাঝে পুষ্পিতা এসে বসলো তার সামনে। এই সময় ওদের তো পড়াশোনা করার কথা। হুট করে তাদের ঘরে কেন এসেছে জানার জন্য ভূমি শুধাল‚

“তুমি না পড়তে বসেছিলে?”

“ভাবিমণি আমার একটা আবদার ছিল। তুমি প্লিজ না করো না।”

“রায়বাঘিনী ননদিনীর আবার কী আবদার করতে ইচ্ছে হলো? অবশ্যই আমি তা পূরণ করার চেষ্টা করব।”

পুষ্পিতা ভুমির গাল টেনে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল‚ “ইউ আর সো সুইট! লাভ ইউ ভাবিমণি।”

সশব্দে হেসে ভূমি শুধাল‚ “এবার বলবে তো কী আবদার?”

“আমার না খুব ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মা কিছুতেই রান্নাঘরে যেতে দেবে না। আর না এগুলো খেতে দেবে। তুমি প্লিজ একটু বানিয়ে দেবে?”

পুষ্পিতার কথা শুনে হতাশ হলো ভুমি। সে যে ফুচকা বানাতে পারে না। এগুলো বানানো তো আম্মা শেখায়নি। শুষ্কবিমর্ষমুখে ভূমি বলল‚

“আমি তো ফুচকা বানাতে পারি না আপু। আর না কখনো বানিয়েছি তবে একবার দেখিয়ে দিলে চেষ্টা করব।”

“ভেলপুরি কিনে আনা হয়েছিল‚ তুমি শুধু একটু ভেজে দেবে। আর ফ্রিজে হয়তো ঘুগনি বানানো রয়েছে। সেদিন মাকে দেখলাম বানাতে। আর হ্যাঁ তেঁতুলের টকটা একটু বানিয়ে দেবে। ঝাল ঝাল করে বানাবে!”

ঘাড় কাত করে সায় জানাল ভূমি। পুষ্পিতা বলল‚ “তাহলে চলো আমি তোমার সাথে রান্নাঘরে যাচ্ছি।”

পুষ্পিতাকে থামিয়ে দিয়ে ভূমি বলল‚ “মা রাগ করবেন৷ তুমি গিয়ে পড়তে বস৷ আমি বানিয়ে এনে দিচ্ছি।”

জড়িয়ে ধরে পুষ্পিতা বলল‚ “থ্যাংক ইউ ভাবিমণি।”

অন্ধকার কামরায় একটা লোককে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। লোকটার কপাল ঠোঁট কে’টে র’ক্ত ঝরছে। দেখে মনে হচ্ছে তাকে বেধড়ক মারা হয়েছে। এরই মাঝে প্রবেশ করল এক চিলতে আলো। লোকটার চোখমুখ কুঁচকে এলো। সুঠাম আঁটসাঁট দীর্ঘ দেহাবয়ব দৃষ্টিগোচর হলো। তবে লোকটা চোখে কিছুটা ঝাপসা দেখল। প্রলয় সামনের চেয়ারে এসে বসল। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল‚

“তোকে কে বলেছিল‚ এভাবে গাড়ি চালাতে?”

লোকটা হাসতে হাসতে বলল‚ “কিছুতেই বলব না৷ আমার অপারগতা এটাই যে‚ তোর ধ্বংস আমি দেখতে পেলাম না৷ গাড়িটা আরও স্পিডে চালানোর উচিত ছিল৷ তোর বউকে মে’রে আমি ম’রেও শান্তি পেতাম।”

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো৷ ঠোঁট উঁচিয়ে ‘চ’ উচ্চারিত হলো। প্রলয় সিংহের ন্যায় গর্জে উঠল। পুরো ঘরময় কেঁপে উঠল। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল লোকটার। কম্পিত কন্ঠে ক্ষমা চাইতে শুরু করল। প্রলয় তোয়াক্কা করল না। বরঞ্চ সিংহের ন্যায় আবারও গর্জে উঠল।

“আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করলেও বেঁচে যেতে পারতি কিন্তু তুইতো আমার জানের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিস। তোকে কে পাঠিয়েছে তা আমার জানার প্রয়োজন নেই! তোকে তো আমি তড়পাতে তড়পাতে মারব। কারণ তোকে বাঁচিয়ে রাখলে অন্যায় করা হবে। মৃ’ত্যু মোবারক।”

লোকটাকে ধাক্কা মে’রে ছোটো কামরা বিশিষ্ট খাচায় ঢুকিয়ে দিল৷ খাবারের লোভে কুমিরগুলো লোকটার কাছে ছুটে এলো। মুহূর্তেই লোকটাকে ছিড়েখুঁড়ে খেতে শুরু করল৷ লোকটার তুমুল আর্তনাদ পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে প্রলয়কে। তৃপ্তির হাসি হাসছে সে।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here