প্রিয়_রাগান্বিতা🩷 #লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷 পর্ব-২৪

0
127

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৪
________________
রৌদ্রময় সকাল! ফজরের নামাজ সেরে পুনরায় আরেকবার ঘুমিয়ে ছিল রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ ফজরের সময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আর এসেছিল কি না জানে না রাগান্বিতা। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে নড়েচড়ে উঠলো রাগান্বিতা। আশেপাশের কোথাও ইমতিয়াজকে না দেখে খানিকটা চিন্তিত হয়েই পালঙ্ক ছেড়ে নামলো সে। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখা মিললো দাদিমার সাথে। তাকে দেখেই দাদিমা মিষ্টি হেঁসে বললেন,
“তুমি উডছো রাগান্বিতা।”
“হুম বাবা কোথায় দাদিমা?”
“তোর আব্বা তো হকাল হকালই হাডে গেছে বাজার করনের লাইগ্যা।”
“ওহ আচ্ছা আর দাদাভাই?”
“ওয় তো চাষাবাদে গেছে জমির ফসল দেহার লাইগ্যা।”

দাদিমার কথা শুনে রাগান্বিতা অবাক স্বরে এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,
“দাদাভাই চাষাবাদ করে কবে থেকে?”
“মেলাদিন(বেশিদিন) হয় নাই হুনছি এহন থেইকা গ্রামেই থাকবো তোর আব্বায় আর শহরে যাইতে দিতে চায় না।”
“ওহ।”
“হয় তুমি এখন যাও চোহে মুহে পানি দিয়াও আমি খাওন বাড়তাছি।”
“ঠিক আছে।”

দাদিমা রন্ধনশালার দিকে এগিয়ে গেলেন আর রাগান্বিতা আশেপাশে তাকিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠানের কলপাড়ের দিকে আসলো। এই ইমতিয়াজটা সকাল সকাল গেল কই! রাগান্বিতার মনটা বড় অস্থির লাগছে। রাগান্বিতা দিনে দিনে হারে হারে টের পাচ্ছে প্রেম বড্ড ভয়ংকর জিনিস। মানুষটাকে এক পলক না দেখলেই কেমন অস্থির অস্থির লাগে। রাগান্বিতা কলের গোঁড়ায় এসে দাঁড়াতেই আচমকাই এক বাঁশির সুর কানে ভেসে আসলো। রাগান্বিতা ধড়ফড়িয়ে উঠলো এ তো সেই মানুষটারই বাঁশির সুর। রাগান্বিতা যেন ঠাহর করতে পারলো ইমতিয়াজ কোথায় আছে রাগান্বিতা আর দেরি করলো না কলগোড়া ছেড়েই ছুট লাগালো বাহিরে।

ইমতিয়াজের সঙ্গে রাগান্বিতার প্রথম দেখা হওয়া প্রথম দিনের সেই জায়গা আর সেই বিশাল গাছটার নিচে বসে আজও বাঁশি বাজাচ্ছে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা দূর থেকেই নিজের পায়ের গতি কমিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে ছিল ইমতিয়াজের দিকে। সেদিনকার সেই দিনটা আর আজকের দিনটার মধ্যে কত তফাৎ! রাগান্বিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে আনমনা বসলো ইমতিয়াজের পাশ দিয়ে। ইমতিয়াজ তখনও নিজ মনে বাঁশি বাজাতে ছিল। কি মুগ্ধনীয় শব্দ তার রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগলো তা। হঠাৎই বাঁশি বাজানো থামিয়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই বললো ইমতিয়াজ,
“কারো অনুমতি ছাড়া তার পাশে বসে বাঁশির সুর শোনা কিন্তু ঘোর অন্যায় জমিদার কন্যা।”

রাগান্বিতা যেন ধড়ফড়িয়ে উঠলো এক মুহূর্তের জন্য হলেও চরমভাবে অবাক হয়েছে সে। রাগান্বিতা নিজেকে দমালো। বললো,
“বাঁশির সুর কানে আসাটা অন্যায় নয়।”
“ঘরে বসে শুনলে অন্যায় নেই ছুটে এসে শুনলে ঘোর অন্যায়।”

রাগান্বিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। পরমুহুর্তে কি ভেবে জবাব দিলো,
“যে বাঁশি বাজাচ্ছিল তার ওপর আমার অধিকার আছে।”

ঝটপট প্রশ্ন ইমতিয়াজের,
“কিসের অধিকার?”
“সে আমার একজন নিজস্ব মানুষ। আর নিজস্ব মানুষের ওপর কিসের অধিকার থাকতে পারে তা নিশ্চয়ই আপনায় বুঝিয়ে বলতে হবে না।”

ইমতিয়াজ হেঁসে ফেলে মেয়েটা কিভাবে বলে দিল “সে তার নিজস্ব মানুষ’’! ইমতিয়াজ শীতল সুরে বললো,
“তুমি এত সুন্দর করে কথা বলো না রাগান্বিতা, আমি যদি প্রেমে পড়ে যাই আমার তো ভয় লাগে।”

রাগান্বিতা শব্দ করে হাসে আয়েশ করে ইমতিয়াজের পাশে বসে বলে,
“বউকে ভালোবাসতে ভয় কিসের?”
“তুমি বুঝবে না।”
“বুঝিয়ে বললে কে বুঝবে না শুনি!”

অভিমানী স্বরে শুধালো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার নাকের ডগায় হাল্কা স্পর্শ করে বললো,
“সবাই বুঝবে কিন্তু তুমি বুঝবে না।”

রাগান্বিতার রাগ হলো সে রাগ নিয়ে মুখ ভাড় করে বসে রইলো। আর ইমতিয়াজ তার কান্ডে হাসলো। শীতল সুরে বিড়বিড়িয়ে বললো,
“তুমি কি বিশ্বাস করবে বউ, খুন না করেও আজ আমি খুনি হয়েছি।
ভালোবাসবো না ভেবেও ভালোবাসতে শুরু করেছি!”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে কেমন এক চাহনী নিয়ে তাকালো। ভ্রু-জোড়া কুঁচকে বললো,
“কিছু কি বললেন আপনি?”

ইমতিয়াজ উদাসীন সুরে আবার শুধালো,
“আমি তোমায় অনেক কিছু বলি বউ, কিন্তু তুমি শুনো না। আমি আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ বউ, তুমি আমার প্রতি এত অনুরাগী হও না।”
“ভালোবাসতে বারণ করছেন আমায়?”
“এত বড় সাধ্য আমার কই!”
“তবে নিজে ভালোবাসতে চাইছেন না কেন?”
“আমি ভালোবাসতে শুরু করলে তুমি সইতে পারবে না।”
“কেন পারবো না?”

ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। উল্টো বলে,
“তুমি কি জানো বউ, আমি তোমার চোখে আমার মরণ দেখি!’

স্তব্ধ হয়ে গেলো রাগান্বিতা। চোখদুটো আচমকাই কেমন একটা করে উঠলো বুকটা থমকে উঠলো মুহূর্তেই। রাগান্বিতা তার ভেজা ভেজা আঁখি নিয়ে বলে,
“আপনি এভাবে কথা কেন বলেন, আমার যে খারাপ লাগে।”

ইমতিয়াজ বুকে জড়িয়ে ধরে রাগান্বিতাকে। মিষ্টি হেঁসে বলে,
“তুমি এভাবে কেঁদো না, আমি ব্যাথা পাই!”

রাগান্বিতা আর কিছু বলতে পারলো না চুপ হয়ে গেল ওখানেই। এই মানুষটা এমন কেন। অভিমানের ক্রোধে ভাসলো রাগান্বিতা! আর ইমতিয়াজ ভিতরে ভিতরে কি যে ভাবলো বোঝা গেল না।’
____________________________

“রামু! দ্রুত দরজা খোলো, তুমি এভাবে কাহিনির অর্ধেক বলে বাথরুমে যেতে পারো না। আমি কাল শেষ রাতে কখন ঘুমিয়ে গেলাম, তুমি ডাকবে না আমায়! রামু কি হলো! বের হও বলছি!”

লাগাতার রামুর বাথরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে আর কথাগুলো বলছে ইলিয়াস। তার মাথা ভন ভন করছে এই গল্পের শেষটা জানার জন্য মনটা অস্থিরতায় ধেয়ে আসছে তার। কালরাতে কাহিনি শুনতে শুনতে কখন যে চোখ দুটো বুজিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিল ইলিয়াস সেটা বুঝতে পারে নি। সকালে ঘুম ভাঙতেই রামুর বউকে ডেকে জানতে পারে রামু বাথরুমে গেছে। তাই তো ছুটে আসলো এখানে। ইলিয়াস আবারও দরজা ধাক্কালো। জোরে আওয়াজ করে বললো,
“তুমি কি বাহিরে আসবে রামু নাকি আমি দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকবো।”

এবার রামু পারুক কেঁদে ভাসিয়ে দিক। এই কোন পাগলকে সে রাগান্বিতার কাহিনি বলতে বসেছিল। তাকে শান্তি মতো বাথরুমও করতে দিবে না নাকি। রামু আরো দশমিনিটের মতো সময় নিয়ে বের হলো। একরাশ আক্রোশ নিয়ে বললো,
“আমারে কি আমনে শান্তি মতো একটু ইয়ে করবাও সময় দিবেন না ডাক্তার বাবু!’
“তোমার ইয়ে টিয়ে বাদ দেও আগে কাহিনি বলো। তোমার কাহিনির চক্করে আমার রাতে ঘুম হয়নি জানো তুমি। সকালেও তো ধড়ফড়িয়ে উঠলাম পুরো।”
“আমার কি দোষ আমনেই তো ঘুমাইয়া গেছিলেন।”

ইলিয়াস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“ঠিক আছে ওসব বাদ দেও। এবার যদি পুরো কাহিনি না বলে কোথাও গিয়েছো তো ইনজেকশন দিয়ে আমিও তোমায় রাগান্বিতার মতো পাগল বানিয়ে দিবো।”

রামু অবাক হয়ে গেল ডাক্তার ইলিয়াসের কথা শুনে এগুলান কোনো ডাক্তারে কয়! রামু শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“এমনে কেউ কয়?”
“তুমি বড্ড বকছো দ্রুত বলো, ইমতিয়াজ গেল কই! রাগান্বিতা কিভাবে পাগল হয়ে গেল! ওর বাবাও বা মারা গেলেন কি করে! তার থেকেও বড় কথা রাগান্বিতাকে চিঠিগুলো দিতো কে, ইমতিয়াজ নাকি অন্যকেউ! আর দাদিমার রাগান্বিতা শাপলার অলংকারের সাজ দেখে ভয় পাবার কারণটাও এখনও বলো নি তুমি! তার থেকেও বড় প্রশ্ন ইমতিয়াজ যদি কুহুকেই ভালোবাসতো তাহলে রাগান্বিতাকে বিয়ে করলো কেন?”

রামু বেশি না ভেবেই জবাব দিলো,
“কেন আবার মাহাদকে খুঁইজ্জা পাওন যাচ্ছিল না বইলা।”

চমকে আবার প্রশ্ন করলো ইলিয়াস,
“আরো একটা প্রশ্ন মাহাদকে মারলো কে? ইমতিয়াজ! যাতে রাগান্বিতাকে বিয়ে করতে পারে।”
“না। একখান কথা কি জানেন ডাক্তার বাবু এই মাহাদরে যে মারছিল হেও বাইচ্চা নাই আর!”

ইলিয়াসের মাথা ঘুরে উঠলো কথা শুনে। এত রহস্য কেন। ইলিয়াস তাড়া দিল। চেঁচিয়ে বললো,
“কাহিনি কও রামু!”

রামু ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে তার ঘরের সামনের জায়গাটা দেখিয়ে বললো,
“আমনে ওইখানে যাইয়া বহেন আমি এক্ষুণি আইতাছি পুরা কাহিনি শেষ কইরাই এবার দম ফালামু আমি।”

ইলিয়াস নিজেকে শান্ত করলো। আর দেরি না করে চলে গেল রামুদের ঘরের দুয়ারের সামনে। বসলো পিড়িতে।’

রামুদের ঘর থেকে রাগান্বিতাদের সেই তালুকদার ভিলাটা দেখা যায় বছর পাচেক আগেই রামু এখানে ঘর বানিয়েছিল চাইলে জমিদার বাড়িতে থাকতে পারতো কিন্তু অজানা কোন ভয়ের কারণে থাকতে পারলো না। পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে তালুকদার ভিলাটি। তালুকদার ভিলার সামনেই ছোট্ট কুঁড়েঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে রাগান্বিতাকে। এটাও পাঁচবছর আগেরই তৈরি। রাগান্বিতাকে সবাই ছেড়ে ছুঁড়ে গেলেও রামু পারে নি যেতে। রাগান্বিতার জন্যই রামু তার নিজ গ্রাম ত্যাগ করে এখানেই বউ নিয়ে থাকছে। তবে একেবারে কাছে নয় একটু দূরে। ধুলোতে জর্জরিত নিজ বাড়িটাকে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলো রাগান্বিতা। চোখের নিচে কালো দাগ, এলেমেলো চুল, ময়লাযুক্ত ছিঁড়ে যাওয়া পোশাক আর পায়ে শিকল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। দৃষ্টি তার ওই বাড়িটার দিকে। রাগান্বিতা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে বাড়িটার পানে। রাগান্বিতার কাজই ওই বাড়িটার দিকে কোনো কারণ ছাড়াই ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। রাগান্বিতা বিড় বিড় করে বললো,
“তুমি কবে ফিরবে ইমতিয়াজ! আমি যে আজও তোমার অপেক্ষায় বসে। কতদিন হয়ে গেল তোমার মুখের সেই বউ বউ ডাকখানা আমি শুনি না।”

চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রাগান্বিতার! তবে উত্তর আর মিললো না।
____________________________
১৯৮১ সালে! বড় সেই বিশাল গাছটায় এখনো পাশাপাশি বসে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা এখনো মন খারাপ করে ইমতিয়াজের বুকে মাথা দিয়ে বসে আছে। ইমতিয়াজ নড়েচড়ে উঠলো। বললো,
“আর কত মন খারাপ করবে বউ, আমি তো তোমার পাশেই বসে!’

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের বুক থেকে মাথাটা ওঠালো। বললো,
“আপনি একটা বদমাশ লোক!”

ইমতিয়াজ হেঁসে জবাব দেয়,
“জানি তো!”

আক্রোশে ফেটে বলে রাগান্বিতা,
“না জানেন না।”

আবারও হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“ঠিক আছে। এবার ওঠো জলদি সকাল থেকে কিছু খেয়েছো দেখে তো মনে হচ্ছে না। চলো দ্রুত কিছু খেয়ে নিবে,

উঠে দাঁড়ালো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। দুজনই চললো তালুকদার ভিলার উদ্দেশ্যে। ইমতিয়াজ যেতে যেতে বললো আবার,
“কথায় কথায় শুধু এভাবে রাগ দেখালে কিন্তু হবে না বউ। মাঝে মাঝে ভালোও বাসতে হবে।”
“মাঝে মাঝে কেন, আমি তো আপনায় রোজই ভালোবাসি।”

ইমতিয়াজ মিষ্টি একটা হাসি দিলো, রাগান্বিতার গাল টিপে বললো,
“তুমি একটা পাগল বউ,

কপাল কুঁচকে জবাব দিলো রাগান্বিতা,
“আপনি করেছেন, আমার কোনো দোষ নেই।”

ইমতিয়াজ চুপ হয়ে গেল। সে বুঝেছে আজ রাগান্বিতা বেশ ক্ষেপেছে তার একটা কথাও মাটিতে ফেলতে দিবে না। তার আগেই উত্তর হাজির!’

#চলবে…..

[ভুল-ক্রটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আর গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে। সবাইকেই ধৈর্য্য ধরতে হবে না হলে উপায় নেই। পুরোটা গুছিয়ে আনতে আমার সময় লাগবে।]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here