#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৩
________________
বাবাকে দেখেই মহিষের গাড়ি থেকে নেমে ছুট্টে এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতা। রাগান্বিতার বাবা মৃদু হাসলেন। চোখের পানি আসলেও মুছে নিলেন নিমিষেই। মিষ্টি সুরে সুধালেন,
“কেমন আছো মা? কতদিন পর তোমারে দেখলাম।”
রাগান্বিতা চোখে পানি রেখেই বললো,
“ভালো বাবা। তুমি কেমন আছো?”
“আমিও ভালো আছি।”
রাগান্বিতা তার বাবাকে ছাড়লেন। ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে মোতালেব তালুকদারের পা ছুঁতে নিলেই হাত দুটো ধরে উঠিয়ে নিলেন। ইমতিয়াজকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“পায়ের হাত দেয়ার দরকার নেই ইমতিয়াজ, তুমি তো শুধু আমার মেয়ের জামাই নও আমার ছেলেও।”
রাগান্বিতার বাবার কথা শুনে তেমন কোনো রিয়েকশন দিলো না ইমতিয়াজ। শুঁকনো হেঁসে বললো,
“ভালো আছেন তো আগের চেয়ে শুঁকনো দেখাচ্ছে।”
রাগান্বিতার বাবা মুখে হাসি রেখেই উত্তর দিলেন। বললেন,
“ওসব কিছু না। বয়স বাড়ছে আর কত তরতাজা থাকবো। চলো ভিতরে চলো,
এই বলে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজকে ভিতরে নিয়ে গেলেন রাগান্বিতার বাবা। সর্বপ্রথমই দেখা মিললো রেজওয়ানের সাথে রাগান্বিতা তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কেমন আছো দাদাভাই কতদিন পর তোমায় দেখলাম?”
রেজওয়ান হাসলো,খুশি মনে রাগান্বিতাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“ভালোই আছি। তুই কেমন আছিস?”
“ভালো দাদাভাই।”
রাগান্বিতার উত্তর শুনে রেজওয়ান তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। বললো,
“কেমন আছো আমার বোনটা তোমায় জ্বালাচ্ছে না তো?”
ইমতিয়াজ হেঁসে জবাব দিলো,
“না আপনার বোন খুবই ভালো। আমার বড্ড খেয়াল রাখে।”
ইমতিয়াজের কথা শুনে শুধু হাসে রেজওয়ান আর কিছু বলে না। ওরা ভিতরে চলে যায়।
——
রাগান্বিতার কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ। পুরো কক্ষটায় চোখ বুলাচ্ছে সে। রাগান্বিতা নিচে আছে, দাদিমার কাছে গেছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার কক্ষের আয়নার দিকে তাকালো বার কয়েক নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলে বিড় বিড় করে বললো শুধু,
“কুহু কি এই আয়নাতেই নিজের মুখশ্রী দেখতো! হবে হয়তো!”
ইমতিয়াজ আয়না থেকে সরলো চলে গেল সামনের জানালাটার দিকে। পর্দাটা সরালো আগে সঙ্গে সঙ্গে শেষ বিকেলের শীতল বাতাস এসে ছুয়ে দিলো তাকে। বাতাসের ছোঁয়ায় চোখ বন্ধ করলো ইমতিয়াজ। হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার,
“একটা নিথর দেহ, তার পানে ছলছল চোখ নিয়ে অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজ স্তব্ধ হয়ে ছুট্টে এসে লুটিয়ে পড়লো নিথর দেহটার সামনে। চারপাশটা যেন এক নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেল। ভিতর থেকে ধ্বংস হলো ইমতিয়াজ। তখনই কে যেন যেন কানের পাশে ঝনঝন শব্দে বললো,
“প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ চাই ইমতিয়াজ। এক ধ্বংসে সবটার ধ্বংস চাই।”
—
“এই যে শুনছেন?”
আচমকাই রাগান্বিতার ভয়েসটা কানে বাজতেই হকচকিয়ে উঠলো ইমতিয়াজ। তার চোখ দুটো তখন ধারণ করেছিল লাল বর্ণ, প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠছিল শরীর। দু’হাতের মুঠো করছিল শক্ত। নিজেকে সামলাতে সে হচ্ছিল ব্যর্থ।
রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো ইমতিয়াজের। রাগান্বিতার হাতের স্পর্শ পেতেই পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিলো ইমতিয়াজ। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো মুহূর্তেই। রাগান্বিতা কি যেন ভাবলো হুট করেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজকে। শীতল সুরে বললো,
“আর কতক্ষণ পিছন ঘুরে থাকবেন, এবার তো আমার পানে তাকান আমি যে অধিক আগ্রহে আপনার অপেক্ষায় বসে।”
জবাব আসলো না। ধীরে ধীরে ইমতিয়াজ শান্ত হলো। মুঠো করে থাকা হাতটা ঢিলে হয়ে গেল। সে চাইলো, মুচকি হেঁসে পিছন ঘুরলো। জড়িয়ে বুকে আনলো রাগান্বিতাকে। অভিমানী সুরে বললো,
“তুমি আমার অভিমান বুঝো না বউ?”
রাগান্বিতার অবাক স্বরে বললো,
“মানে।”
“ইমতিয়াজ কি কোনোদিন তোমার মানের জবাব দিয়েছে যে আজ দিবে।”
“কিন্তু না বললে বুঝবো কেমন করে?”
রাগান্বিতার থুতনী ধরে মাথাটা উঁচু করলো ইমতিয়াজ। চোখে রাখলো চোখ, ঠোঁটের অতি নিকটে এসে শীতল সুরে সুধালো,
“আমার চোখের ভাষা না বুঝলে তুমি আমায় কি করে বুঝবে বউ?”
দ্রুততার সঙ্গেই রাগান্বিতার জবাব,
“আমি আপনায় বুঝি! এই যে মাত্র আপনি জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন কোনো কথা ভেবে দুঃখ পাচ্ছিলেন, আপনার রাগ হচ্ছিল,হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রাগ দমালেন এগুলোর সবটাই আমি বুঝি ইমতিয়াজ।”
মুহূর্তের মধ্যে ইমতিয়াজ থমকে গেল ছিটকে পিছন সরে আসলো দু’কদম। বললো,
“তুমি মিথ্যে বলছো!”
রাগান্বিতা উচ্চস্বরে হেঁসে ফেলে। নিরদ্বিধায় বলে,
“জানি তো। ওটা তো আপনায় চমকানোর জন্য বলেছিলাম।”
ইমতিয়াজের বিশ্বাস হলো না সে আবার প্রশ্ন করলো। বললো,
“তুমি সত্যি বলছো?”
“তা নয় তো কি! আর তাছাড়া আচমকাই আপনার রাগ আসবে কেন?”
“রাগ তো আমার আসছিল।”
“কেন?”
ইমতিয়াজের শীতল চাহনী!
“তুমি কক্ষে আসতে এত দেরি কেন করছিলে বউ?”
রাগান্বিতা লাজুক হাসলো। এতক্ষণে বুঝলো ইমতিয়াজ কেন তার ওপর অভিমান আর রাগ করছিল। রাগান্বিতা মিষ্টি হেঁসে বললো,
“আমাকে খুব ভালোবাসেন ইমতিয়াজ সাহেব?”
বুকের কোথাও এসে যেন কথাটা বারি খেল ইমতিয়াজের। সে উত্তর দিতে পারলো না। আবার চুপও থাকলো না। রাগ নিয়ে বললো,
“তোমায় বলবো না।”
আবার হাসে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
“একদম হাসবে না বউ,তুমি হাসলে আমার অসুখ অসুখ লাগে।”
রাগান্বিতা হাসি থামিয়ে দেয়। বলে,
“অনেক হয়েছে এবার চলুন আমি শরবত আর কিছু শুঁকনো খাবার নিয়ে এসেছি।”
বলেই ইমতিয়াজের হাত ধরে পালঙ্কের কাছে নিয়ে গেল রাগান্বিতা। খাবার দেখিয়ে বললো,
“দাদিমা পাঠালেন খেয়ে নিন।”
ইমতিয়াজ একবার রাগান্বিতার মুখশ্রী আর আরেকবার খাবারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি খেয়েছো?”
“না আপনি আগে খান তারপর আমি খাবো।”
ইমতিয়াজ শুনলো না রাগান্বিতার হাত ধরে পালঙ্কে বসিয়ে বললো,
“চলো একসাথে খাই।”
রাগান্বিতা মিষ্টি হাসলো। যেন সে জানতো বিষয়টা। রাগান্বিতা আশ্বাস দিয়ে বললো,
“আপনি খান আমার তেমন খিদে নেই নৌকায় বসে তখন খেয়েছিলাম না।”
“সে তো সেই কখন খেয়েছো এখন আবার খাও।”
ইমতিয়াজ শরবতের গ্লাসটা হাতে নিলো রাগান্বিতার মুখের কাছে ধরে বললো,
“খাও,
রাগান্বিতা আর বারণ করতে পারলো না একটুখানি খেয়ে নিলো। বললো,
“এবার আপনি খান।”
ইমতিয়াজ অনেকক্ষণ গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে রইলো তার মোটেও খেতে ইচ্ছে করছে না। কেমন গলাটা আঁটকে আঁটকে আসছে। ইমতিয়াজকে খেতে না দেখে আবারও বললো রাগান্বিতা,
“কি হলো আপনি খাচ্ছেন না কেন?”
এবার খেল ইমতিয়াজ। একটুখানি খেয়ে বললো,
“তোমায় একটা প্রশ্ন করবো বউ?”
রাগান্বিতা নিরদ্বিধায় বললো,
“জি বলুন!’
“আমি শুনেছিলাম তোমার নাকি আর একটা বড় বোন ছিল কিন্তু তাকে তো দেখি নি এখনো। কোথায় সে?”
নিমিষেই রাগান্বিতার হাসি মাখা মুখটা চুপসে যায় স্তব্ধ স্বরে বলে,
“নেই সে।”
অবাক স্বরে বলে ইমতিয়াজ,
“নেই মানে কোথায় গেছে?”
ইমতিয়াজের প্রশ্নে হুট করেই উঠে দাঁড়ালো রাগান্বিতা, আচমকাই ইমতিয়াজের হাত ধরে বললো,
“চলুন আমার সাথে দেখাচ্ছি।”
ইমতিয়াজও উঠে দাঁড়ালো। বিনা বাক্যে এগিয়ে চললো সে রাগান্বিতার পিছন পিছন। যেন সে ভেবেছিল রাগান্বিতা এমন কিছুই করবে।”
—–
গাছের পাতাতে ভরপুর পরিবেশ। কেমন যেন নিস্তব্ধ সব। গত দিনগুলোতে বৃষ্টি না হওয়ায় মাটিগুলো পুরোই শুকনো আর ফেটে ফেটে গেছে এমন। রাগান্বিতাদের বাড়ির রন্ধনশালা পেরিয়ে হাতের ডান দিকটা ছুট্টে যাচ্ছিল রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। শেষ বিকেলের জন্য সব কেমন যেন ছমছমে লাগছে। রাগান্বিতা অনেকটা পথ হেঁটে এসে বাঁশ দিয়ে বেড়া দেয়া একটা কবরস্থানের সামনে দাঁড়ালো। ইমতিয়াজের পা ওখানেই থেমে গেল। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের হাতটা ছেড়ে পায়ের চটি খুলে কবরের দোয়া পাঠ করে ভিতরে ঢুকলো। নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“এই যে মাটির নিচটা দেখছেন, এখানেই আমার বোন কুহু শুয়ে আছে। আমাদের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে দূরে যেখান থেকে আর কখনো ফিরে আসবে না আপা। কখনোই আসবে না।”
বলেই কবরের পাশে লুটিয়ে পড়লো রাগান্বিতা। বোনের মৃত্যুর পর আজ প্রথম তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়লো। তার বুকটা কেঁদে উঠলো আচমকা। বোনের সাথে কাটানো কিছু খুনশুঁটির মুহূর্ত ভেসে আসলো চোখের সামনে।”
রাগান্বিতার কান্না দেখে আরো দু’পা পিছিয়ে গেল ইমতিয়াজ। বুকে ব্যাথা অনুভব করছে সে। রাগান্বিতার চোখের অশ্রু সে কেন সহ্য করতে পারছে না! কেন!’
ইমতিয়াজ কুহুর কবরের পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“তুমি কি দেখছো কুহেলিকা আমি এসেছি! তোমার অসমাপ্ত সেই প্রেমের গল্পের বিষাক্ত প্রেমিক ফিরে এসেছে তুমি কি দেখতে পাচ্ছো তাকে! আচ্ছা তোমার কি রাগ হচ্ছে না আমার উপর! মনে হচ্ছে না এই পাষাণ মানুষটাকে ভালোবেসে তুমি ভুল করেছিলে! এক ভয়ংকর চরম ভুল! আচ্ছা তোমার বোনকে বললে কি সে বিশ্বাস করবে,
“আমি তোমার দূরে থেকেও কাছের কেউ ছিলাম!”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পানে তাকালো মেয়েটা এখনো কাঁদছে। হঠাৎই সেদিকে এগিয়ে আসলো রেজওয়ান বোনকে কাঁদতে দেখে ছুটে আসলো সে। দৌড়ে গিয়ে ধরলো বোনকে। চোখে পানি তারও জমলো। ইমতিয়াজ শুধু দেখে গেল দুই ভাইবোনকে মুখ ফুটে কিছু বললো না আর।’
#চলবে……
[ভুল-ক্রটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আর গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে।]
#TanjiL_Mim♥️