প্রিয়_রাগান্বিতা🩷 #লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷 পর্ব-২৫

0
226

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৫
________________
কড়া রোদ্দুরে আচ্ছন্ন চারপাশ। ইমতিয়াজ বাড়ি নেই মোকলেসের সাথে দেখা করতে গেছে। রন্ধনশালায় রান্না করছে রাগান্বিতা আর দাদিমা। রাগান্বিতার মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরছে সে চাইছে দাদিমাকে বলতে। সে কুহুর বিষয় নিয়েই কিছু বলবে কিন্তু দাদিমা আধও কিছু বলবে কি না জানে না রাগান্বিতা৷ দাদিমার সেদিনকার তার সাজ দেখে তার ওপর রেগে যাওয়া আর ভয় পাওয়ার বিষয়টা এখনো প্রায়সই মাথায় ঘোরে। রাগান্বিতার মনে হচ্ছে আজ দাদিমাকে জিজ্ঞেস করলে সে নিশ্চয়ই কিছু বলবে। অনেক ভেবে রাগান্বিতা সিদ্ধান্ত নিলো প্রশ্নটি সে করবেই। রাগান্বিতা প্রশ্নটি করবে এরই মাঝে দাদিমা বলে উঠলেন,
“জানো রাগান্বিতা তুমি যাওনের পর একখান ঘটনা ঘটছে।”

রাগান্বিতা নিজের প্রশ্নটি ধামাচাপা দিল। নরম কণ্ঠে বললো,
“কি ঘটনা?”
“মাহাদরে কেডা জানি মাইরা ফেলছে। তুমি যাওনের দিনই রাত্তির বেলা মুজিবর গো বাড়ির পিছনের ডোবায় মাহাদের লাশখানা ভাইসয়া উঠছিল। কি যে মায়া লাগজিল রাগান্বিতা তুমারে বুঝবার পারমু না। কে যে করলো! কে জানে!

রাগান্বিতা স্তব্ধ স্বরে বললো,
“পুলিশ আসে নি।”
“আইছিল মাহাদ নাকি হাতার(সাঁতার) জানতো না হের লাইগ্যা বেশি আগায় নায়।”
“কিন্তু মুজিবর চাচাদের ডোবায় তো পানি কম থাকে পড়লে মরে যাওয়ার কথা তো নয়।”
“ওইদিন নাকি বেশি আছিল।”

রাগান্বিতা চুপ রইলো তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে! মাহাদ নিখোঁজ হওয়ার পর তার সাথে ইমতিয়াজের বিয়ে হওয়াতে তার খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু মাহাদের মৃত্যু সে ভাবে নি। রাগান্বিতা নিশ্চুপে ‘আমি একটু আসছি’ বলে বাড়ি থেকে বের হলো। একটু হাঁটতেই দেখা মিললো ইমতিয়াজের তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার সামনে দাঁড়াতেই রাগান্বিতা থমথমে গলায় বললো,
“জানেন মাহাদ আর নেই কে যেন মেরে ফেলেছে।”

ইমতিয়াজ থতমত খেয়ে গেল। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“কে মারলো?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না তার মনে হচ্ছে তার জন্যই মাহাদকে কেউ মেরে দিয়েছে। রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার জন্যই মারা গেছে মাহাদ।”

ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো। না কেউ নেই। সে রাগান্বিতার হাত ধরলো। নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“এসব তুমি কি বলছো?”

হঠাৎই কেঁদে উঠলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ চমকে উঠলো রাগান্বিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার সাথে চলো।”
“আমি মাহাদের খুনি।”

রাগান্বিতার মুখ চেপে ধরলো ইমতিয়াজ। বললো,
“হুস,চুপ! একটাও কথা না।’

রাগান্বিতা চুপ হয়ে গেল তার মাথা ভনভন করছে বার বার নিজেকেই মাহাদের খুনি মনে হচ্ছে। তাকে যদি মাহাদ বিয়ে করতে না আসতো তাহলে হয়তো মাহাদ আজ বেঁচে থাকতো। তার জন্য মাহাদের জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল। ভাবলেই বুক চিঁড়ে কান্না আসছে রাগান্বিতার।’

নদীর ঘাটে ঢেউ চলছে প্রবল। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে নিয়ে নদীর ঘাটে এসেছে। আশপাশে জনশূন্যহীন কেউ নেই। দূরদূরান্তে শুধু ট্রলার আর নৌকা যাওয়া দেখা যায়। নদীর ঘাটের ডানদিকটায় মাটির একটা সরু রাস্তা যায়। দুই পাশে সারি সারি তালগাছ। যার একপাশে নদী আর অন্যপাশে মাঠ। মাঠের ওপার মুন্না মিয়াদের বাড়ি। নদীর দিকের তালগাছের সারির আগে রয়েছে এক বিশাল বড় রেন্টিগাছ। সেই রেন্টি গাছের নিচে পাশাপাশি বসে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা এখনো ফোঁপাচ্ছে। ইমতিয়াজ এবার বিরক্ত নিয়ে ধমক দিলো। বললো,
“এভাবে কাঁদতে থাকলে মানুষ তো ভাববে আমি তোমায় মেরেছি। তারপর লোকে নারী নির্যাতনে আমাকে জেলে দিক।”

রাগান্বিতা তাও নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। আরও কতক্ষণ ফোপালো। ধীরে ধীরে পরিবেশ হলো শান্ত। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ইমতিয়াজ এবার পরিস্থিতি বুঝে নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,“এবার বলো কি হয়েছে?”

রাগান্বিতা নির্জীব। চুপচাপ। মুখে কোনো কথা নেই। ইমতিয়াজ আবার প্রশ্ন করলো,“তুমি কি কিছু বলবে?”

রাগান্বিতা এবার মুখ খুললো। বললো,“আমার কাছে প্রায়সই কারো লেখা চিঠি আসে সে নিজেকে নিষ্ঠুর বলে দাবি। বিয়ের আগে আমি অনেকগুলো চিঠি পেয়েছি। চিঠির জন্যই সেদিন গ্রামের সব শিক্ষিত ছেলেদের ডাকি তাদের হাতের লেখা দেখি আপনাকেও তো ডাকা হয়েছিল।”

ইমতিয়াজ শুনলো,কিছু ভাবলো। বললো,
“তারপর।”
“কিন্তু কারো সাথে ওই চিঠির হাতের লেখা মিলে নি।”

ইমতিয়াজের মাঝে তেমন কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সে স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
“এতে মাহাদের খুনের কি সম্পর্ক?”
“আপনি বুঝতে পারছেন না আমার মনে হচ্ছে ওই চিঠি দাতাই মাহাদকে মেরেছে।”
“নাও হতে পারে।”

রাগান্বিতা নিজেকে ধাতস্থ করলো। চোখের পানিটুকু মুছে বললো,
“মানে?”
“মানেটা খুব সোজা হতেই পারে অন্যকেউ মেরেছে।”
“আপনি বুঝছেন না চিঠির লেখাগুলো খুব ধারালো ছিল।”
“আমার মনে হয় না চিঠিদাতা এমন কিছু করবে।”
“আপনি এতটা নিশ্চিত কি করে হচ্ছেন?”
“আমি নিশ্চিত নই মনে হলো তাই বললাম।”

রাগান্বিতা কিছু বলে না সে ভেবেছিল চিঠির কথাগুলো ইমতিয়াজকে বললে ইমতিয়াজ তাকে কটু কথা শোনাবে কিন্তু ইমতিয়াজ এমন কিছুই করলো না। কিন্তু কেন? রাগান্বিতার ভাবনাটা বুঝি ইমতিয়াজ বুঝলো। সে বললো,
“আমি সেদিনই আঁচ করতে পেরেছিলাম কেউ তোমার নামে প্রেমপত্র দিচ্ছে। আর তুমি তাকে খুজচ্ছো। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তুমি সুন্দরী, তোমাকে হাজার ছেলে চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তুমি বিবাহিত। আমার মনে হয় না তোমার নামে আর কোনো চিঠি আসবে আর যদি আসে আমায় বলবে আমি এর ব্যবস্থা নিবো।”

রাগান্বিতা নিখুঁত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। বিয়ের পর আর একটাই চিঠি এসেছিল রাগান্বিতার কাছে রাগান্বিতা কথাটি চেপে গেল কিন্তু ভাবলো পরে আর কোনো চিঠি আসলে সে চেপে যাবে না চিঠি সমেত দেখাবে। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো। না কেউ নেই, সে আচমকাই ইমতিয়াজের গালে চুমু খেল। মিষ্টি হেঁসে বললো, “আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স্বামী।”

ইমতিয়াজ আকস্মিক কান্ডে কিছুটা চমকে উঠলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো, তবে কিছু বললো না। মেয়েটাকে যত দেখে তত অবাক হয় ইমতিয়াজ,“মেয়েটা তাকে এত ভালোবাসে কেন?”

কিছু সময় যেতেই মোকলেসের হাক শোনা গেল নদীর পাড়ে রঙিন নৌকা নিয়ে ঘুরছে। মোকলেস এগিয়ে আসলো ইমতিয়াজকে দেখে বললো,
“ভাই আমনে এহানে কি করেন?” রাগান্বিতা আপাও দি আছে।”

ইমতিয়াজ, রাগান্বিতা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো মোকলেসকে কি বলবে উত্তর খুঁজে পায় না। ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“তোর জন্যই বসে ছিলাম।”

মোকলেস অবাক হলো। বললো,
“আমার জন্যে,
“হ তোর নৌকায় চড়বো।”

মোকলেস কথা বাড়ালো না নৌকাটাকে ইমতিয়াজদের অনেকটা কাছে নিয়ে এসে বললো,
“হাচা(সত্যি) উডবেন ভাই। এহন তো ঠাডা পড়া রোদ্দুর।”
“তাতে কি নদীতে হাওয়া নেই।”
“তা একটু আছে,
“তাইলে আবার কি চল। রাগান্বিতা উঠো!’

রাগান্বিতা বিনা বাক্যে উঠে দাঁড়ালো। ইমতিয়াজের হাত ধরেই সে নৌকায় চড়ে বসলো। দুজন একসাথে অনেকটা সময় পার করলো। মোকলেস নৌকা চালাতে চালাতে শাপলার বিলে চলে আসলো। তবে আজ শাপলা নেই। কিছু লতা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। ইমতিয়াজ বললো,
“আজ শাপলা থাকলে তোমায় আবার সাজাতাম বউ?”

রাগান্বিতার মুখটা খানিকটা কালো হয়ে গেল। সে খুশি হতে চেয়েও খুশি হতে পারলো না। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো,“কি হলো?”

রাগান্বিতা মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
“দাদিমা শাপলাফুল দিয়ে সাজতে বারণ করেছেন।”

ইমতিয়াজ খানিকটা ভড়কালো। প্রশ্ন ছুড়লো আবার,
“কেন?”
“জানি না। আপনি সেদিন যখন শাপলা দিয়ে সাজিয়েছিলেন দাদিমা তা দেখেন। খুব অদ্ভুত আচরণ করেন! কি নিয়ে যেন ভয় পেয়েছিলেন খুব। সাথে আমায় বারণ করেছেন আমি যেন আর শাপলা দিয়ে না সাজি।”

ইমতিয়াজ কিছু বললো কি যেন ভাবলো রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,“কি ভাবছেন।”

ইমতিয়াজ তাকালো নদীর দিকে শুঁকনো মুখে জবাব দিলো,
“ফুলের সাথে কিসের ভয়?”
“পোকামাকড়ের কথা বলেছিলেন।”

ইমতিয়াজ আর ভাবলো না এতটুকু বললো শুধু,“ওহ আচ্ছা।”
—-
রাতের খাবার সেরে দাদিমার কক্ষে ঢুকলো রাগান্বিতা। দাদিমা তখন পালঙ্কের চাদর ঠিক করছিলেন। রাগান্বিতার উপস্থিতি টের পেতেই দাদিমা প্রশ্ন করলেন,
“কিছু কইবা রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জোরালো কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,“আমি সব জানতে চাই দাদিমা।”

দাদিমা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন,
“কি জানবার চাও?”
“এই যে তুমি সেদিন আমার শাপলার সাজ দেখে কেন ঘাবড়ে গিয়েছিলে?”

দাদিমা থমকে হাসলেন। বললেন,
“হেদিনই(সেদিনই) তো কই ছিলাম শাপলা ফুলে পোকামাকড় থাহে।”
“তুমি মিথ্যে বলো না। আমি কিন্তু সবটা জেনেই ছাড়বো। আমার মন বলছে তুমি কুহু আপার বিষয়েও কিছু জানো।”

এবার যেন আরো ঘাবড়ে গেলেন দাদিমা। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। রাগান্বিতা ক্ষিপ্ত মেজাজ। সে আজ জেনেই ছাড়বে। রাগান্বিতা দাদিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমায় সব বলো।”

দাদিমা শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদলেন। রাগান্বিতার বুকটা হঠাৎই কেঁপে উঠলো। সে দাদিমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তুমি কাঁদছো কেন দাদিমা?”

দাদিমা চুপ রইলেন। রাগান্বিতা দাদিমাকে নিয়ে জানালার পাশে বসলো। জানালার কপাট খুলতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার পরিবেশটা নজরে আসলো প্রথম। তারপর আকাশের চাঁদখানা দেখা গেল। রাগান্বিতা কিছু বললো না দাদিমা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“কুহুরে কেউ মারে নাই রাগান্বিতা। কুহু তোর আব্বার মুখে চুনকালি মাখাইয়া মইরা গেছে। নিজেই নিজের পাপ ধুইতে বিষ খাইছে।”

রাগান্বিতার চোখ থমথমে, গলায় কণ্ঠস্বর গেল থেমে। আপা বাবার মুখে চুনকালি দিয়েছে। রাগান্বিতা থমথমে গলাতেই বললো,
“আপা কি করছিল?”

মুখে আঁচল চেপে বললো দাদিমা,
“কুহু পোয়াতি আছিল।”

থমকে গেল রাগান্বিতা। পায়ের মাটিটা বুঝি সরে যাচ্ছিল এক মুহূর্তের জন্য। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হলো। সে স্তব্ধ! তার আপা বিয়ের আগে, না না! রাগান্বিতার বিশ্বাস হলো না তার আপা কলঙ্কিত নয়! কিছুতেই এটা হতে পারে না। দাদিমা মিথ্যে বলছে। তার আপা পবিত্র ছিল। মৃত বলে কি যা খুশি তাই শুনে নিয়ে বিশ্বাস করে নিবে রাগান্বিতা!

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ!]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here