কাব্যের_বিহঙ্গিনী #পর্ব_৫৭ (বোনাস পার্ট) #লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

0
275

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫৭ (বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন শান্ত হয়ে বসে আছে শাহরিয়ার পরিবারের সামনে। কাল হুট করেই মাহফুজ শাহরিয়ার এসেছিলেন তার কলেজে এই বলতে কালকে তার বাড়িতে যেতে হবে। মেহবিন মানা করেছিল তবে সে অনেক অনুরোধ করার পর মেহবিন রাজি হয়েছে। তবে সে এটাও বলেছে কাউকে পাঠাতে হবে না সে নিজেই চলে যাবে শাহরিয়ার ভিলায়। মাহফুজ শাহরিয়ার আর কিছু বলেন নি। অতঃপর মেহবিন আজ এসেছে শাহরিয়ার ভিলায়। সে আসতেই সবাই খুশিতে গদগদ হয়ে পরেছে। আছিয়া খাতুন আর মিসেস মাহফুজ পারলে তো মেহবিন কে কোলে বসিয়ে রাখে। তাদের এই অতিরিক্ত জিনিস দেখে মেহবিন মনে মনে ভাবলো কিছু তো একটা আছে। তবে প্রকাশ করলো না। আসার পর থেকে একবার ও মুখরের সাথে দেখা হয়নি। এই নিয়ে মেহবিন অবশ্য মনে মনে হাফ ছেড়েছে। দুপুর বেলা হতেই সবাই খেতে বসেছে তখন আগমন ঘটে মুখরের। মুখর আজ মেহবিনের দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খেতে বসলো। আছিয়া খাতুন খুব যত্ন সহকারে মেহবিনকে খাবার খাওয়ালেন। খাওয়া শেষে সকলে সোফায় বসলো। মুখর ও বসলো। আছিয়া খাতুন মেহবিনের পাশে বসলো। আর বলল,,

“মেহু! মেহুই কইতাছি তুমি আবার কিছু মনে কইরো না।তুমিও তো আমার নাতনির মতোই।”

‘সমস্যা নেই দাদি আপনি বলুন।”

‘আসলে তুমি বুদ্ধিমতী বিচক্ষণ মাইয়া। তাই সরাসরিই কই। আমরা সবাই মিলা সিদ্ধান্ত নিছি মুখরের সাথে তোমার বিয়ার।”

আছিয়া খাতুনের কথা শুনে মেহবিন মনে হয় থমকে গেল। ও আগে মুখরের দিকে তাকালো মুখর নিজের মনে কি যেন দেখছে। তা দেখে ও চোখ সরিয়ে আছিয়া খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“এসব এখন আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।

‘আরে সমস্যা নাই আমরা তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি তুমি হয়তো পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চাইছিলে। তোমার কথা ভাইবা আমরা সিদ্ধান্ত নিছি এখন আকদ করে রাখমু তোমার পড়াশোনা শেষ হলে না হয় একেবারে ধুমধাম করে ঘরে তুলবো।”

“আসলে দাদি আমি,,

‘আরে আমার নাতির বয়স হইছে তো বিয়ার। পড়াশোনা শেষ কইরা এহন পুলিশ হইছে। আমার নাতি পুলা খারাপ না। তোমারে সুখেই রাখবো তাছাড়া আমরাও তো আছি। তুমি তোমার মা বাবারে খবর দেও তাগো সাথে আমরা কথা কমু।

মেহবিন এবার শান্ত স্বরেই বলল,,

‘আমার কেউ নেই আমি এতিম। ”

মেহবিনের এই শান্ত স্বরে বলা কথাটা কেউ সহজ ভাবে নিতে পারলো না। আছিয়া খাতুন অদ্ভুত ভাবে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখরও এবার তাকিয়েছে। সবাই কিছুক্ষণ মৌন রইলো। তখন মেহবিন আবার বলল,,

“আমি জানতাম না এবং বুঝতেও পারিনি। এ বিষয়ে কথা বলতে আপনারা আমাকে এখানে ডেকেছেন।”

তখন মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

‘মেহবিন! তোমার পরিবার নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমরা তোমার জন্য আমার ছেলের সাথে প্রস্তাব রেখেছি। তোমার পরিবার দেখে নয় তাই না। এখন বলো তোমার গার্ডিয়ান কি কেউ আছে তার সাথে কথা বলে আমরা তোমাদের বিয়ের কথা পাকা করতে পারি।

তখন মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আমার কেউ নেই আংকেল। আমার আমিই সব! এবং আমার নিজের দায়িত্ব আমার সবকিছু আমি নিজেই বহন করি।”

“তাহলে তুমিই বলো তুমি রাজি কি না?”

মেহবিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,,

“আমার কিছুদিন সময় লাগবে আমি কয়েকদিন পরে আপনাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি। আসছি আংকেল।”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে গেল। এদিকে ড্রয়িংরুমে সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তখন মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

“মা তুমি কোন কথা বললে না যে?”

আছিয়া খাতুন বললেন,,

‘শেষমেষ আমার নাতির বউ একজন এতিম মাইয়া।”

‘মানে কি বলতে চাইছো তুমি?”

‘আরে তেমন কিছুই না আমি ভাবছিলাম আমার নাতি শ্বশুরবাড়িতে মেলা আনন্দ করবো খাইবো দাইবো। কিন্তু কপালে নাই‌। যাই হোক যা হয় ভালোর জন্য হয় আমার কোন আপত্তি নাই।”

বলেই তিনি চলে গেলেন। তিনি ভেতরে ভেতরে খুব একটা রাজি নন। তিনি মেহবিনকে এ কয়েকদিনে বেশ অনেকটাই আপন করে নিয়েছে। কিন্তু তার কেউ নেই শুনে তাকে মুখরের বউ হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার ধারনা একটা পরিবার হীন মেয়ে কখনো পরিবারের সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝবে না। তারওপর একা একা থাকে সে তো আরো বুঝবে না। যদি ওর কারনে পরিবারে ভাঙন সৃষ্টি হয়। উনি ভেতরে ভেতরে মেহবিনকে বউ করা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। এখন তো পেছাতেও পারবে না। কারন সবার আগে উনিই বলেছেন মেহবিনকে নাতবউ করবে। কিন্তু এখন তিনি মনে মনে বলছে মেহবিন যাতে রাজি না হয়।

এদিকে মুখর ভাবছে অন্যকিছু যদি মেহবিন রাজি না হয়। ওর মুখ দেখে কিছু বোঝাও গেল না। ও মেহবিনের সাথে দেখা করতে চাইলো। তার আগে ওর ফোনে একটা মেসেজ এলো। মেহবিন একটা লেকের ধারে ওকে ডেকেছে। মুখর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো। পড়ন্ত বিকেল মুখর লেকের ধারে গিয়ে দেখলো মেহবিন বেঞ্চে বসে আছে। ও গিয়ে ওপর পাশে দাঁড়ালো মেহবিন মুখরের অস্তিত্ব টের পেয়ে বলল,,

“বসুন!”

মুখর বসলো তখন মেহবিন বলল,,

‘আমাকে বিয়ের করার জন্য পরিবারকেও জানিয়েছেন। আপনি কি ভেবেছেন আপনার পরিবার প্রস্তাব দিলে আমি নাকচ করতে পারবো না।”

মুখর মনে মনে হাসলো ও কিছুটা সেরকমই ভেবেছে। তবে বিয়ের বিষয়টা তো জানায় নি। মুখর বলল,,

“না আমি পরিবারকে জানাই নি বরং তারাই আমাকে জানিয়েছে যে তারা আমার বউ হিসেবে আপনাকে পছন্দ করেছে।”

“আর এই বিষয়ে আপনি কিছুই বলেন নি? যে আপনি আমায় প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমি নাকচ করে দিয়েছি।”

‘না আসলে?”

‘আপনাকে কেউ নাকচ করেছে এটা বলতে আপনি নিজেকে ছোট ভেবেছেন। যে আপনার মতো মানুষ কে কেউ রিজেক্ট করে পারে। এটা আপনার জন্য অসম্মানের।”

“ব্যাপারটা পুরোপুরি তেমন না তবে কিছুটা আছে। আমি আপনাকে আমার প্রাপ্তির খাতায় রাখতে চাই বিহঙ্গিনী।”

“অপ্রাপ্তিকে আপনি এতো ভয় পান কেন? আপনাদের কিসের এতো তাড়া প্রাপ্তির? কই আমি তো কখনো প্রাপ্তি নিয়ে তাড়াহুড়া করিনি। সারাজীবন তো অপ্রাপ্তি নিয়েই কাটিয়ে দিলাম। অপ্রাপ্তি তো কঠিন কিছু না। দিব্যি হেঁসে খেলে নিঃসঙ্গতায় জীবন কেটে যায়।”

মেহবিনের এরকম কথায় মুখর একটু থমকালো। ও কস্মিনকালেও ভাবে নি মেহবিন ওকে এরকম কিছু বলবে। ও বলল,,

“আপনার কিসে ভয় ? আপনি কেন কোন সম্পর্কে জড়াতে চান না। কেন অন্যের দায় নিতে চান না?”

মেহবিন কিছু বললো না এ বিষয়ে তবে এইটুকু বলল,,

“আমাকে প্রাপ্তির খাতায় না রাখলে কি খুব ক্ষতি হবে আপনার?”

“এটা তো আমিও বলতে পারি আমাকে প্রাপ্তির খাতায় রাখলে কি খুব ক্ষতি হবে আপনার?”

মেহবিন মুখরের দিকে তাকালো।মুখর মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহবান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই মানুষটা ওকে যে খুব ভালোবাসে এটা ও মুখরের চোখ দেখেই উপলব্ধি করতে পারছে। মুখরের মুখে হাঁসি থাকলেও চোখ দু’টো ছলছল করছে। মেহবিন কিছু বলবে তার আগে মুখর বলল,,

“আমাকে আপনার প্রাপ্তির খাতায় নাম লেখাতে চান, না অপ্রাপ্তির খাতায় এটা সম্পূর্ণ আপনার ওপর নির্ভর করে। যদি চান প্রাপ্তির খাতায় নাম লেখাতে তবে আমি আমার সর্বোচ্চটা দেব আপনার হতে। কিন্তু যদি অপ্রাপ্তির খাতায় নাম লেখাতে চান তাহলে আমি নিজ থেকেই চলে যাব।

বলেই মুখর চলে গেল। মেহবিন কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারলো না। মেহবিন নিজের সম্পর্কে আর তার জীবন নিয়ে কি ভাবে সেটা একমাত্র ও নিজেই বলতে পারবে। ওর আজ ভিশন অসহায় লাগছে মুখর ওকে ভালোবাসে এটা ও প্রথমদিনই বুঝতে পেরেছিল কিন্তু এই ছন্নছাড়া বিহঙ্গিনীর সাথে ও মুখরের জীবনটা জড়াতে চায় না। ওর নিজের জীবনের কোন ভরসা নেই। তাছাড়া ও বিচ্ছেদ এ ভিশন ভয় পায়। ওর মাকে হারানোর পর থেকে ও তেমনভাবে কাউকেই আপন করতে পারে নি রাইকে করেছিল ও ছেড়ে চলে গেছে।সাবিনা আহমেদ কে করেছিল তিনি চেয়েও মেহবিনের সাথে থাকতে পারে নি। এরপর আলম আহমেদ ও এতো বছর পর ওকে ছুড়ে ফেলেছে এটাও ও ভুলেনি। ওর প্রিয় মানুষ গুলোই ওকে ছেড়ে চলে যায়। এই জন্যই প্রিয় মানুষ বানাতে চায় না। তখনি ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। মেহবিন উঠলো না। সেখানেই বসে বসে ভিজতে লাগলো। বেশ ঘন্টাখানেক ভিজলো তখন হুট করেই বুঝতে পারলো বৃষ্টি ওর মাথার ওপর পরছে না। ও পাশে তাকাতেই দেখলো শেখ শাহনাওয়াজ ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেহবিন সেদিকে তাকিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“কি মেহবিন মুসকান ভয় পেয়ে গেল নাকি?”

মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর কথায় তার ভ্রু কুঁচকে তাকালো আর বলল,,

“মানে?”

“মানে এটাই মেহবিন মুসকান সম্পর্কে জড়াতে ভয় পাচ্ছে। কারন সে তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। সে সম্পর্ক মানেই বুঝে না।”

“একদম ভুলভাল কথা বলবেন না।”

“তাহলে সম্পর্কে জড়াতে এতো ভয় কিসের? সত্যি তো এটাই আপনি ছন্নছাড়া পাখি। আপনি পরিবার সম্পর্ক এগুলো বোঝেন না।’

মেহবিন কিছুই বললো না। চুপ করে রইলো। শেখ শাহনাওয়াজ অনেক কিছু বললেন। মেহবিন তবুও রিয়াক্ট করলো না। সে শান্ত মস্তিষ্কে কথাগুলো শুনলো। মেহবিনকে অপমান ও করলো মেহবিন তবুও কিছু বললো না। সবশেষে মেহবিন মুচকি হেঁসে শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তা এই মেয়েটাকে পরিবারহীন ছন্নছাড়া কে করেছে শেখ শাহনাওয়াজ? আরে বাপরে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম কেউ ভুলে আমাকে রাস্তায় মরার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। আচ্ছা এক্সিডেন্ট এ যদি আমি শুধু আহত না হয়ে একেবারে মরে যেতাম তাহলে কি হতো বলুন তো? বলুন না কি হতো তাহলে আর এই মেয়েটাকে ছন্নছাড়া পাখির মতো বাঁচতে হতো না ঠিক বললাম তো? ইশশ মেয়েটা সম্পর্কের মানে বোঝে না। সে কি করে একটা সম্পর্ক গড়তে পারে বলুন তো?”

লাস্টের কথাগুলো মেহবিন ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে বলল। শেখ শাহনাওয়াজ হতভম্ব হয়ে দেখলো শুধু। মেহবিন উঠে দাঁড়ালো আর লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগলো। ওকে দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ বছরের কোন বাচ্চা বৃষ্টির মজা নিচ্ছে। মেহবিনের ঠান্ডা মাথায় করা অপমানে শেখ শাহনাওয়াজ এর মাথা নিচু হয়ে গেল। সে অস্ফুট স্বরে বলল,,

“ঠান্ডা মাথায় মুচকি হেসে অপমান করা আর ঠান্ডা মাথায় খুন করা একই ব্যাপার। আর আপনি ঠান্ডা মাথায় খুন করতে বেশ ভালোই পারেন আম্মা।

আমি তো এসেছিলাম আপনাকে রাগিয়ে দিতে যেন।আপনি রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নেন মুখর কে বিয়ে করার। মুখর খুব ভালো ছেলে আর এই মুহূর্তে আপনার একটা ছাদ দরকার আর তাছাড়া মুখর আপনাকে অনেক সুখে রাখবে। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম আপনি তো সবার মতো নন। যে রাগের মাথায় কথা বলবে বা সিদ্ধান্ত নেবে।তবে আমি তো বুঝতেই পারলাম না আপনি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনি এমন কেন আম্মা আপনার কি আমার ওপর একটুও ভরসা নেই।”

রুমে ফিরেই মেহবিন বুঝতে পারলো ওর জ্বর আসছে। ও দু’টো নাপা খেয়ে শুয়ে পড়লো। বাকিটা না হয় কাল দেখা যাবে। মেহবিন দুদিন সময় নিল অনেক ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল যে ও মুখরের প্রাপ্তির খাতায় নাম লেখাবে। ও চোখ বন্ধ করলেই মুখরের ছলছল চোখটা দেখতে পায় যা ওকে অসহ্যকর পীড়া দেয়। মেহবিন মাহফুজ শাহরিয়ার কে ফোন করে বলল সে রাজি। তবে সে অনুষ্ঠান করতে রাজি নয় এখন। মুখর তো খুশিতে প্রায় কেঁদেই ফেললো। তবে আছিয়া খাতুন বললেন ওদের বিয়ের কথা শুনে বলল কাউকে কিছু আগেই না জানাতে আর আকদের ডেটটা দুই মাস পর করার কথা বললেন। আর একদম কাছের আত্মীয়দের পনেরো দিন আগে না হয় বলা যাবে। আছিয়া খাতুনের এরকম কথায় সবাই অবাক হলো কিন্তু কেউ কিছু বললো না। যেহেতু অনুষ্ঠান মেহবিনের পড়াশোনা শেষ হলে করা হবে তাই। এদিকে এসব বিষয়ে মেহবিন কে কিছু বলা হলো না। মেহবিন রাজি হয়েছে দেখে মুখর ওকে একটা রেস্টুরেন্টে ডাকলো। মেহবিন আর না করলো না। সে চলে গেল। মুখর একটা কেবিন বুক করেছে মেহবিনের জন্য। মেহবিন কেবিনের ভেতরে ঢুকে যেতেই মুখর মেহবিনের হাত ধরে নাচতে লাগলো আর গানের সুরে বলতে লাগলো,,

‘পাঞ্জাবি ওয়ালা,, পাঞ্জাবিওয়ালা তোমার বিয়া লাগছে।”

মুখরের এরকম আচরনে মেহবিন হতভম্ব হয়ে গেল। মেহবিন বলল,,

‘এসব কি?”

মুখর বলল,,

‘ওহ তোমার ভালো লাগছে না নাচতে।”

বলেই মেহবিন কে ছেড়ে দিল আর নিজে একা একাই নাচতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর পর বলছে,,

“পাঞ্জাবিওয়ালা, পাঞ্জাবিওয়ালা !”

মুখরের এমন পাগলামো দেখে না চাইতেই মেহবিনের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। অতঃপর মুখরের নাচ শেষ হলে মুখর বলল,,

“বুঝলে বিহঙ্গিনী এটা হলো মুখর শাহরিয়ার এর খুশির বহিঃপ্রকাশ।”

মেহবিন মুখরের মুখে তুমি শুনে তেমন একটা ভাবান্তর হলো না। তবে সে হেঁসে বলল,,

“আপনি পাগল হয়ে গেছেন মুখর শাহরিয়ার!”

“তা তো একটু হয়েছিই। শুনো বিহঙ্গিনী এই মুখরের মাঝে ছোট্ট একটা অবুঝ বালক আছে। যা সবার কাছে অপরিচিত । কিন্তু তোমার কাছে পরিচিতি পাবে। একে কিন্তু তোমাকেই সামলাতে হবে।”

মেহবিন মুচকি হাসলো। মুখর ওকে নিয়ে বসিয়ে দিল আর বলল,,

“আমার আলুওয়ালা কাচ্চি ভিশন পছন্দের আর আমি এটা শুধু পছন্দের মানুষদের সাথে খাই। তোমার আমার প্রথম খাবারটা না হয় আলুওয়ালা কাচ্চি দিয়েই হোক।”

“আপনি কাচ্চি খাওয়ার জন্য এখানে ডেকেছেন?”

‘না আমার আনন্দ দেখাতে আজকে আসতে বলেছি। যতোটুকু তোমায় চিনি তুমি ট্রিপিক্যাল প্রেমিক প্রেমিকা ওগুলো পছন্দ করো না।”

‘হুম!”

‘যাই হোক ঐ যে চলে এসেছে খাবার খাওয়া শুরু করো।”

মেহবিন আর মুখর খাওয়া শেষ করলো। মুখর অনেক কিছু বললো আর মেহবিন মনোযোগ দিয়ে শুনে গেল। শেষে বলল,,

‘বিহঙ্গিনী আমি তোমার কাব্য হতে চাই এবারও কি বাঁধ সাধবে?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“না এবার আর বাধ সাধবো না। বিহঙ্গিনীর জীবনে না হয় একজন রুপকথার কাব্যের আগমন ঘটুক।”

মুখর হাসলো প্রাপ্তির হাঁসি। মুখর মেহবিনকে বলল সবসময় কাব্য বলেই ডাকতে নয়তো পাঞ্জাবি ওয়ালা। মেহবিন বলল ঠিক আছে। এরপর যে যার গন্তব্যে চলে গেল।

তার দু’দিন পর নাফিয়া ওর কিছু কেনার জন্য মার্কেটে গেলে মেহবিনের সাথে দেখা হয়। নাফিয়া মেহবিনের ডাকে মেহবিন ও ওর কাছে যায়। মেহবিন একাই এসেছিল আর নাফিয়াও। দুজনে একসাথে শপিং করতে লাগলো। মেহবিন আর নাফিয়া নিচে আসতেই মেহবিন আর নাফিয়া কে উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মেহবিন বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে। মেহবিন আশে পাশে খুঁজতে গিয়ে দু’টো লাঠি দেখতে পায়। মেহবিন একটা দিয়ে যে নাফিয়াকে উঠানোর চেষ্টা করে তাকে আঘাত করে। সে একটু সরে গেলেই মেহবিন হাতের লাঠিটা নাফিয়াকে দেয়। আর নিজে আরেকটা লাঠি দিয়ে মারতে থাকে এমন সময় কেউ পেছন থেকে মেহবিনের হাতে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। ও হাত চেপে ধরে। তখন সামনে তাকাতেই ও দেখতে পায় নাফিয়াকে নিচে ফেলে একজন পেটে বারবার লাথি মারছে। নাফিয়া চিৎকার করছে জোরে জোরে কিন্তু কেউ আগাচ্ছে না। মেহবিন নিজের সব ভুলে সেই লোকটাকে গিয়ে মারতে থাকে। ও মারামারিতে এক্সপার্ট তাই সেই তিনজন ওর সাথে পেরে উঠে না। ওরা তিনজন পালিয়ে যায়। মেহবিন সবার দিকে তাকিয়ে নাফিয়ার দিকে তাকালো ও ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। মেহবিন দেরি না করে নাফিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ও মুখরকে ফোন করে সব জানালো। নাফিয়ার কথা শুনে পুরো শাহরিয়ার পরিবার হাসপাতালে চলে গেল। মেহবিন যে হাতে আঘাত পেয়েছে এটা ও কাউকে দেখালো না ওরনা নিয়ে ঢেকে রইলো। মুখর মেহবিনের কাছে জানতে চাইলো কারা ছিল মেহবিন বলল সে চেনে না। মুখর মেহবিনকে কাউকে কিছু জানাতে বারন করলো। ও ওর পরিবার কে বলেছে নাফিয়ার ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। ডাক্তার বেরিয়ে বলল,,

“নাফিয়া পেটে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে আর এমন জায়গায় আঘাত পেয়েছে যার জন্য ওর মা হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। মাত্র দুই পার্সেন্ট।”

সব শুনে শাহরিয়ার পরিবারের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। সবাই খুব ভেঙে পড়ে। মেহবিন শান্ত ভাবে সবাইকে শান্তনা দেয়। নাফিয়ার জ্ঞান ফিরলে নাফিয়া সবকিছু বলে দেয়। মেহবিনকে সবাই ধন্যবাদ জানায় ওকে বাঁচানোর জন্য। আছিয়া খাতুন মেহবিনকে অনেক আপন করে নেয়। তবে নাফিয়াকে আগেই জানানো হয় না ও মা হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। সে কয়েকদিনে মেহবিনের ও বাড়িতে যাওয়া আসা হয়।তবে হুট করে একদিন আছিয়া খাতুনের কাছে একজন ছবি পাঠায় যেখানে মেহবিন লাঠি দিয়ে নাফিয়ার পেটে আঘাত করছে। এটা মুলত লাঠি দেওয়ার ছবি সেদিনকার এডিট করে এমনভাবে করা হয়েছে যেন মেহবিনই মারছে। আর ফোন করে জানায় লোকগুলো মেহবিনকেই ধরতে এসেছিল আর নাফিয়া কে দেখে ওকেও তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। আছিয়া খাতুন ধরে নেয় মেহবিনের কারনেই এসব হয়েছে। কারন মেহবিন কে ধরতে না এলে নাফিয়ার সাথে এসব হতো না। তিনি সবকিছুর জন্য মেবিনকেই দায়ী করে। নাফিয়া শুধু বলেছিল গুন্ডারা এটাক করেছিল কিন্তু এটা বলেনি ওর পেটে আঘাত করেছিল। উনার সবকিছু মাথায় তালগোল পাকায়। মেহবিনের জন্য নাফিয়ার এই অবস্থা উনি মানতে পারছেন না। উনি কেঁদে ফেলেন কাকে কি বলবে ও। তাই তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু মেহবিনের জন্য হয়েছে সেহেতু মেহবিনকেই চুকাতে হবে। নাফিয়া মা হতে পারবে না শুনে কোন ছেলেই ওকে বিয়ে করতে চাইবে না। তাই ওর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ও নিজেও স্বামী নিয়ে সংসার করতে পারবে না। এটাই মেহবিনের শাস্তি রাখেন। কিন্তু তিনি কাউকেই বলেন না বিষয়টা এমন কি মেহবিনকেও না। পরেরদিন তিনি সবাইকে ডাকেন এমনকি মেহবিন কেও। উনি মুখর আর মেহবিন কে শর্ত দেন ওদের আকদ হওয়ার পর কেউ যেন না জানতে পারে ওরা বিবাহিত। আর নাফিয়ার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত মেহবিনের এই বাড়িতে বউ হিসেবে আসা চলবে না। তবে এ বাড়িতে তার আসা যাওয়া চলবে। মানে টোটালি বউ হিসেবে শাহরিয়ার পরিবারের সাথে ওর কোন সম্পর্ক থাকবে না। আর বিয়েটা একদম সিমপল নরমাল ভাবে হবে। শুধু শাহরিয়ার পরিবার জানবে আর কেউ না। শর্তটা যদি না মানে তাইলে বিয়া হবে না। আর যদি বিয়া করতেই হয় তাহলে শর্ত মেনেই বিয়ে করতে হবে।

এরকম শর্ত শুনে সবাই অবাক হয়। সবাই এটার মতবিরোধ করে কিন্তু মেহবিন চুপচাপ মেনে নেয়। তবে ও বলে ওর দিক থেকে দুজন মানুষ ওর পক্ষ থেকে থাকবে। মেহবিনের কথা শুনে আছিয়া খাতুন রাজি হয়ে যায়। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে মেহবিন আর মুখরের বিয়ে হয়ে যায়। আর বিয়েতে মেহবিনের পক্ষ থেকে দুজন আর কেউ না তারা হলো আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ। তারা দুজন মাস্ক পরে এসছিলেন। সাক্ষী হিসেবে সাইন করে আবার চলে যান। কেউ তাদের সম্পর্কে জানতে পারে না। সেদিনের জন্য আছিয়া খাতুন ওদেরকে শাহরিয়ার বাড়িতে নিয়ে যান। মেহবিন আর মুখরের রাত গল্প করেই কাটে। মেহবিন পরের দিন হলে ফিরে যায়। মুখরের ইচ্ছে হলেই সে মাস্ক ক্যাপ পরে মেডিকেলের বাইরে তার বউয়ের জন্য অপেক্ষা করে। আর মেহবিন বের হলেই তাকে নিয়ে ঘুরতে যায়। এভাবে কতোদিন কতবার ঘুরেছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে এর মাঝে আরবাজ মিশু কে জানায় ওদের বিয়ের ব্যাপারটা তবে শর্তের কথা জানায় না। যদি জানাতো তাহলে আরবাজ হয়তো বোনের জন্য আরো আগে নাফিয়াকে বিয়ে করতো। মেহবিন ও মাঝে মাঝে সবার সাথে ফোনে কথা বলে এর মধ্যে মেহবিনের ওর মামার সাথে পরিচয় হয়। মেহবিন সে বিষয়ে মুখরকে জানায় এও জানায় তার মামা তাকে বাইরের দেশ থেকে পড়াশোনা করতে বলছে। যাতে সে উন্নত ভাবে সবকিছু শিখতে পারে। আর এটাও বলে আরবাজ ওর ভাই আর শেখ শাহনাওয়াজ ওর বাবা। তবে ও কেন ওনাদের সাথে থাকেন না এটা জানায় না। মেহবিনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা কয়েকদিন পর। এখন ফর্মফিলাপ চলছে। মুখরের মা ওকে যেতে বলেন। মেহবিন ও খুশিমনে যায়। মুখরের মা তাকে আদর যত্ন করে খাওয়ান । মুখরও বাড়িতে ছিল। হুট করে মুখর বলে,,

“তোমার পরীক্ষার ফর্মফিলাপ কবে করবে? ডেট তো পুরশুদিন শেষ।

মেহবিন বলল,,

“এই তো করবো কাল?”

তখন আছিয়া খাতুন বললেন,,

“তা এই জন্য মনে হয় আজ এখানে টাকা নিতে আইছো? সেই জন্যই তো কই এতো দিন দেখলাম না এহন এনে আইছো?

হুট করে আছিয়া খাতুনের কথায় সকলে চমকে উঠে। তিনি জানেন না মুখরের মা ওকে ডেকেছে। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“না দাদি জান এর জন্য আসি নি। মা ডেকেছিলেন তাই এসেছি।”

“হ সবই বুঝি তোমার মতো এতিম মাইয়া বিয়া করছেই তো তার খরচ চালানোর লাইগা। প্রথমে তো খুব দাম দেহাইলা দুইদিন সময় নিলা। তারপর রাজি হইলা। সব বুঝি আমি চুলগুলা এমনিই পাক ধরে নাই। নিজে তো হলে থাকো টিউশনি করো শুনলাম পার্ট টাইম জব ও করো। পড়াশোনার লাইগা এইসব যাতে না করতে হয় এই জন্য রাজি হইছাও আমার নাতিরে বিয়া করার লাইগা। এতো বড় লোক বাড়ি টাকা পয়সার কোন অভাব নাই‌। এই জন্য শর্ত দিলাম তোমারে তাও তুমি রাজি হইলা। লোভে পইরা আমার নাতিরে বিয়া করলা।”

অপমানে মেহবিনের হাত শক্ত হয়ে আসে। সে এক মিনিট মৌন থেকে বলল,

“আচ্ছা মেনে নিলাম লোভে পড়ে বিয়ে করেছি। তাহলে আপনার নাতিকেই জিজ্ঞেস করুন আপনার নাতি আমার পেছনে আমার ভরন পোষনের জন্য কতটাকা খরচ করেছে। আর হ্যা আপনি বোধহয় জানেন না আমি এখনো টিউশনি আর জব দুটোই করি। আমার নিজের খরচ আমি নিজে চালাই। কয়েক মাস তো হলো জিজ্ঞেস করুন আপনার নাতি কে? কতটাকা আমি তার কাছে থেকে নিয়েছি?”

মেহবিনের কথায় আছিয়া খাতুন একটু দমলেন। নাফিয়ার ব্যাপারটা জানার পর থেকে কেন যেন মেহবিনকে উনার সহ্য হয় না। তাই তিনি বলল,,

‘নাও নাই সামনে নিবা এহন ভালোগিড়ি দেহাইতেছো। বছর ঘুরলেই নিজের আসল রুপ দেহায় দিবা। তোমাগো মতো পরিবারহীন মাইয়া গো ভালো কইরা চেনা আছে আমার। তোমরা সবার সাথে ভালো ব্যবহার কইরা তাগোর কাছে ভালো সাজো। যেমনে আমার আর মাহফুজের কাছে সাজছিলা। তোমাগো কাছে সম্পর্কের কোন দাম নাই তোমাগো কাছে টাকায় সব। একজন এতিম মাইয়া সম্পর্কের গুরুত্ব কিভাবে বুঝবো। কোনদিন পরিবার আছিল নাকি বুঝবো।

মেহবিন শান্ত ভাবে আছিয়া খাতুনের দিকে তাকালো আর মুচকি হেসে বলল,,

“আজ বুঝলাম সব! নিজের খেয়াল রাখবেন আসছি।

বলেই মেহবিন চলে গেল। মুখর ওর পেছনে গেল আর পুরো শাহরিয়ার পরিবার শুধু দেখে গেল। মুখর মেহবিনের হাত ধরে বলল,,

“বিহঙ্গিনী?”

~চলবে,,

বিঃদ্রঃ অতীত শেষ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু হলো না। যাই হোক আজ এইটুকুই। কেমন লাগছে অতীত জানাবেন কিন্তু। তাড়াহুড়োর জন্য অগোছালো হতে পারে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here